কয়েকজন বিদেশি বাংলাদেশের ইমিগ্রেশনের চেকপোস্টে দাঁড়িয়ে আছেন। বেশিরভাগই সাংবাদিক। ইমিগ্রেশন অফিসারের দায়িত্ব পালনকারী পাসপোর্টে সিল মেরে Welcome to Bangladesh বলেছিলেন কিনা কে জানে? Welcome বললেও সেটা ছিল শুধুই সৌজন্যতা। কারণ বাংলাদেশ তখন যেন এক মৃত্যুকূপ! বলছি ১৯৭১ সালের কথা। সারা দেশ তখন পাক হানাদারদের দখলে। তবে সারা দেশ দখলে থাকলেও একটা এলাকা ছিল যেখানে পাকবাহিনী পা ফেলতে পারেনি।
বলছি বেনাপোল স্থলবন্দরের কথা। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মধ্যে গোটা খুলনা অঞ্চল দখল করে নিলেও বেনাপোলের ২ বর্গকিলোমিটার জায়গা পাকিস্তানি বাহিনী দখল করতে পারেনি। বেনাপোল ছিল মুক্তিবাহিনীর এক স্ট্রংহোল্ড/Stronghold। সামরিক ভাষায় স্ট্রংহোল্ড বলতে বোঝায় এমন এলাকা যেটা শত্রুদের তীব্র হামলা সহ্য করেও টিকে থাকে। তবে এই স্ট্রংহোল্ড টিকিয়ে রাখা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। কীভাবে আদিম যুগের অস্ত্র নিয়ে অত্যাধুনিক পাক বাহিনীর মোকাবেলা করলো মুক্তিবাহিনী?
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করার পর সারা দেশেই নিজেদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তানি বাহিনী। প্রাথমিকভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাঙালিদের প্রতিরোধ নিস্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়।
১৯৭১ সালে খুলনা অঞ্চলে পাকিস্তানি ৯ পদাতিক ডিভিশনকে মোতায়েন করা হয়। ১০৭ ও ৫৭ হেভি ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড এই ডিভিশনের অন্তর্গত ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েনকৃত সবচেয়ে শক্তিশালী ডিভিশন বলা হতো ৯ পদাতিক ডিভিশনকে। এছাড়াও যশোর আর কুষ্টিয়ায় সীমান্ত ঘেঁষে বাড়তি দুটি ট্যাংক স্কোয়াড্রন মোতায়েন করা হয়।
৩১ মার্চ মুক্তিবাহিনী ঝটিকা অভিযান চালিয়ে যশোর শহর মুক্ত করেছিল। তবে ৬ দিন পরেই পাক বাহিনীর তীব্র হামলায় পিছু হটতে হয় মুক্তিবাহিনীকে। যশোর সেনানিবাস পুরোপুরি দখল করার পর পাকিস্তানি বাহিনী ১৬ এপ্রিল ঝিনাইদহ নিয়ন্ত্রণে আনে। অপারেশন ফার্স্ট লেগের মাধ্যমে কুষ্টিয়া সাময়িকের জন্য মুক্ত হলেও সেটাও পরে দখলে নেয় পাকবাহিনী। পরবর্তীতে মাগুরায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে এবং ধীরে ধীরে তারা মুক্তিবাহিনীকে বেনাপোলের দিকে হটিয়ে দেয়। কিছু মুক্তিসেনা চলে যায় বয়রা সীমান্তের দিকে। সেখান থেকে গেরিলা হামলা চলতে থাকে পাকবাহিনীর ওপর। যদিও মে মাসে বয়রার সীমান্ত ঘেঁষে থাকা মুক্তিবাহিনীর ১টি কোম্পানিও তীব্র হামলার মুখে ভারতের অভ্যন্তরে চলে যায়।
পাক বাহিনী তীব্র গতিতে বেনাপোলের উপকণ্ঠ নাভারন পর্যন্ত দখলে নিয়ে নেয়। অস্ত্র, সংখ্যা এবং প্রশিক্ষণ সব দিক থেকেই মুক্তিবাহিনী তখনো অনেক পিছিয়ে। তাই বেনাপোলের দিকে Retreat (কৌশলগত পিছু হটা) করে তারা। নাভারন থেকে কিছুটা সামনে কাগজপুকুর এলাকায় ডিফেন্স লাইন বানায় মুক্তিবাহিনী (ইপিআর, আধা সামরিক মুজাহিদ বাহিনী ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট)। ১টি ইপিআর কোম্পানি, ১টি আনসার কোম্পানি, ১টি মুজাহিদ কোম্পানির সেনাদের নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করা হয় এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গলের ১টি রিজার্ভ বাহিনী বেনাপোলের কাস্টমস কলোনির দক্ষিণ পাশে পজিশন নেয়।
বেনাপোল দখল করতে পারলে খুলনা ফ্রন্টের বর্ডার প্রায় বন্ধ করে ফেলা যেত। শরণার্থীদের ভারত যাওয়া আটকানো যেত, বিদেশিদের খবর সংগ্রহের রাস্তা আঁটকে দেওয়া যেত। সর্বপরি বাংলাদেশকে বাইরের দুনিয়া থেকে বিছিন্ন করা সহজ হতো।
কয়েক দফা হামলার পর বেনাপোল দখল করতে আর্টিলারি হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় পাক বাহিনী। ভারতের দিকে আশ্রয় নিতে যাওয়া শরণার্থীদের কাছ থেকে যশোর রোডের পাশে বসানো এই আর্টিলারিগুলোর খবর জানতে পারে মুক্তিবাহিনী।
এদিকে রাতের আঁধারে নাভারনে থাকা পাক আর্টিলারির উপর কম্যান্ডো রেইড অপারেশন চালায় ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট)। মাটি কামড়ে পাক পজিশনের কাছে পৌঁছে রকেট ফায়ার করেন তারা। ট্রেসার রাউন্ড মেরেও মুক্তিদের হদিস পায় না পাক বাহিনী। হতাহত হয় ২৫ শত্রু সেনা। পরদিন ইন্ডিয়ান সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স পাকবাহিনীর ওয়্যারলেস ইন্টারসেপ্ট করে জানতে পারে বেশ কিছু আর্টিলারি গান হারিয়েছে পাক বাহিনী।
এপ্রিলের ৩য় সপ্তাহ থেকে কাগজপুকুর ডিফেন্স লাইনে তিন দিক থেকে নতুন করে আক্রমণ শুরু করে পাক বাহিনী। তাদের ১টি ব্যাটালিয়ন শার্শা থেকে পোতাপাড়া হয়ে লাউতলা দিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। তারা লাউতলার আমবাগানে তাদের Assembly area (আক্রমণ করার আগে যেখানে বিভিন্ন দল এসে এক হয়, তারপর শত্রুর দিকে এগিয়ে যায়) করে। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এদিকে মূল লাইন থেকে সামনে কয়েকটি Patrol party (মূল প্রতিরক্ষার একটু সামনে বা শত্রুর নিয়ন্ত্রিত এলাকার কাছে গিয়ে টহল দেওয়া, যাতে শত্রু অগ্রসর হলে মূল বাহিনীকে জানাতে পারে) পাঠিয়েছিল মুক্তিবাহিনী।
গয়রা খাল এলাকায় মুক্তিবাহিনীর একটি টহল দল পাকবাহিনীকে দেখতে পেয়ে গুলি করে। পাকবাহিনী পাল্টা হামলা চালায়। পিছু হটে টহল দলটি। তবে শত্রুর ধাওয়ায় কয়েকজন নিহত হয়েছিল। এতে পাকবাহিনীর আক্রমণ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়।
ফ্রন্টলাইনে থাকা অনেক সেনার রাইফেল পর্যন্ত ছিল না। তারপরও তারা ফ্রন্টলাইনে ছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন কোনো পাক সেনা কাছে মারা গেলে তার রাইফেল এনে যুদ্ধ করবেন।
২৩-২৪ এপ্রিল ভোর ৪টা থেকে কাগজপুকুরে মুক্তিবাহিনীর ওপর তীব্র আর্টিলারি ফায়ার শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এ হামলায় মেইন রোড ব্যবহার না করে যশোর-বেনাপোল সড়কের উত্তর দিকে খাজুরা বাজার-পান্থপাড়া, ভুজতলা এবং দক্ষিণ দিকে অবস্থিত গয়রা, কাগমারা এলাকাগুলো দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে।
উত্তরের প্রতিরক্ষা অবস্থান প্রায় কোনোরকম প্রতিরোধ না করেই পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু দক্ষিণের প্রতিরক্ষা অবস্থান প্রাকৃতিক সুবিধা এবং আড়াল থাকার কারণে মোটামুটি সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে। লাইনের মাঝ বরাবরও প্রায় ফাটল ধরিয়ে ফেলেছিল পাকবাহিনী। হঠাৎ নায়েব সুবেদার মুজিবুল সেখানে হাজির হয়ে মেশিনগান ফায়ার করে কয়েকটা পাক স্কোয়াড সাফ করে দেন।
মেজর ওসমান একটি ১ টন ডজ গাড়িতে করে ৩ ইঞ্চি মর্টার পাঠিয়ে দেন ফ্রন্টলাইনে ফায়ার সাপোর্ট দিতে। সুবেদার মোমিনুল হকের নেতৃত্বে তারা কিছুটা অগ্রসর হয়ে সুবিধাজনক স্থানে পজিশন নিয়ে শত্রুর ওপর গোলাবর্ষণ করতে থাকেন।
পাকবাহিনী নতুন কৌশলের আশ্রয় নেয়। নিজেদের ইউনিফর্ম খুলে ইপিআরের ইউনিফর্ম পরে তারা দক্ষিণ দিক দিয়ে এগোতে থাকে। আরেকটি দল নায়েব সুবেদার মুজিবুল হকের পজিশনের দিকে যেতে শুরু করে। এদিকে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা দক্ষিণে ইপিআরের পোশাক পরা পাক সেনাদের দলটির চাল একটু দেরিতে হলেও ধরে ফেলে। সাথে সাথে ফায়ার শুরু করে। ফলে সেই অবস্থানে ফাটল ধরাতে পারে না পাকবাহিনী। এদিকে যুদ্ধের ময়দানে কোনো ফিল্ড টেলিফোন বা ওয়্যারলেস ছিল না। দক্ষিণের এ ঘটনা অন্য পজিশনকে জানানো সম্ভব হয়নি।
নায়েব সুবেদার মুজিবুল হকের অনেক কাছে চলে আসে ইপিআরের পোশাক পরা পাক বাহিনী। মুজিবুল তাদের নিজস্ব বাহিনী মনে করে তাদের ওপর ফায়ার করা থেকে বিরত থাকেন। একটু পরেই ভুল বুঝতে পেরে মেশিনগান ফায়ার শুরু করেন। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। কয়েকটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় তার শরীরে। শহীদ হন তিনি।
নায়েব সুবেদার মুজিবুল হকের একটু পেছনেই ছিল মর্টার বাহিনী। সুবেদার মোমিনুল হকের মর্টারের গোলাগুলো গাড়িতে ছিল। তারাও পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। গাড়ির ড্রাইভার পাকসেনাদের দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে ক্রল করে চলে যান। অন্যরাও গাড়ি রেখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। মর্টার ও গোলা হাতছাড়া হয়।
তীব্র হামলায় কাগজপুকুর থেকে Retreat করে কাস্টমস কলোনির পেছনে নতুন লাইন গড়ে তুলে মুক্তিবাহিনী। এপ্রিলের শেষ ১০ দিন এবং মে মাসের প্রথমদিকে অনেকবার হামলা করেও পাক বাহিনীর বেনাপোলের ডিফেন্স লাইন ভাঙতে পারে না।
ক্যাপ্টেন হাফিজের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, পাকিস্তানিরা প্রতিবার এক নাগাড়ে ৩০/৪০ রাউন্ড আর্টিলারি ফায়ার করে মুক্তিবাহিনীর লাইনের দিকে আগ্রসর হতো। কিছু পাকিস্তানি গোলা ভারতের বনগাঁওতে গিয়েও আছড়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্স লাইনের সামনে খোলা জায়গা বেশি থাকায় শত্রু আগ্রসর হলে তাদের আগেই দেখা যেত এবং মুক্তিবাহিনী ফায়ার করতো। কখনো কখনো পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর পজিশনের ১০০ মিটারর মধ্যে চলে আসত। গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোডে থাকা বড় কিছু গাছের আড়াল থেকে তারা গুলি চালাত, এমনকি বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে গালাগালি করতো। জবাবে বাঙালি সেনারাও তাদের গালি দিত।
খুলনা অঞ্চলের অন্যান্য স্থানে গেরিলা হামলা বাড়তে থাকায় বেনাপোলে আর পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না পাকিস্তানি সেনারা। পাকবাহিনী ইতিমধ্যে সারা দেশের প্রায় সব বড় শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিলেও বেনাপোল দখল করতে পারে না। বেনাপোল হয়ে ওঠে মুক্তিবাহিনীর একটা Stronghold। ২ বর্গকিলোমিটার জায়গা থেকে যায় মুক্তাঞ্চল। অস্থায়ী সরকার থেকে শুরু করে অনেক বিদেশী কূটনৈতিক বা সাংবাদিকরা বেনাপোল দিয়েই দখলকৃত বাংলাদেশ পরিদর্শনে আসতেন।
১৮ মে বাংলাদেশ সরকারের সেনাপতি কর্নেল (জনোরলে) ওসমানী বেনাপোল পরিদর্শনে আসেন। ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ৭০০ সৈনিকের পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়নরূপে গড়ে তোলার নির্দেশ দেন তিনি। পরে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বেনাপোল থেকে ময়মনসিংহে ‘জেড’ ফোর্সের সাথে যোগদান করে। মেজর ওসমান ইপিআর, মুজাহিদ, আনসার, পুলিশ ও কিছু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক দিয়ে তার বাহিনী পুনর্বিন্যাস করে ৭টি কোম্পানিতে বিভক্ত করেন এবং ৭ জন অধিনায়কের নেতৃত্বে সীমান্তবর্তী ৭টি এলাকায় ঘাঁটি তৈরি করেন এবং সম্মুখযুদ্ধ পরিহার করে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ শুরু করেন। ছোট ছোট হামলায় শত্রুর মনোবল নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে।