আমরা অনেকেই যুদ্ধ দেখিনি। যুদ্ধের নির্মমতা, ভয়াবহতা ও নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা আমাদের অনেকেরই নেই। তবু হাজার হাজার মাইল দূরে কোনো একটি দেশ, সেটি সিরিয়া, আফগানিস্তান বা ফিলিস্তিন যে দেশই হোক না কেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ’ তকমা পেলে মনের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। কিন্তু বাবা মায়ের কাছে যখন নিজের দেশের যুদ্ধ জয়ের গল্প শুনি; যখন শুনি পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর ভয়ে কী করে কেটেছে তাদের এক একটা দিন, কী করে ঘর থেকে পালিয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছে অপরিচিত কোনো এক গ্রামে। তখন সত্যি বলতে বিশ্বাস হতে চায় না; ভাবি, বানিয়ে বলছে। ছোটবেলায় যেমন দাদা দাদীরা দৈত্য দানবের গল্প শোনাতো, তেমনই।
একসময় বলেই ফেলি, “ধুর! তুমি এসব বানিয়ে বলছ ভয় দেখানোর জন্যে।” মা খানিকটা হাসে। সে হাসি বিদ্রূপ মেশানো। বাবা বলে, “তুই কী বুঝবি?” আমি মুখ বাঁকিয়ে প্রশ্ন করি, “তুমি যুদ্ধে যাও নি কেন?” উত্তরে বাবা বলে, “অস্ত্র ধরতে সবাই পারে না, সবাইকে দিয়ে হয় না।” তখন বলি, “তুমি তাহলে ভীতু।” উত্তরে বাবা কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে পরিবারের সকলকে বাঁচিয়ে রাখার যে লড়াই, তা-ও তেমন কম কিছু নয়।” বুঝতে পারি, এই অভিজ্ঞতা শুধু শুনে বোঝার বিষয় নয়। এ হলো বাস্তব পরীক্ষা, ক্রান্তিকাল। এটা অর্জন করতে হয়, উপলব্ধিতে এর দায় মেটানো যায় না।
তবুও শোনার চাইতে দেখার মধ্যে যুদ্ধের বিভীষিকা অনেক বেশি ধরা পড়ে। তাই তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়েছে কত শত চলচ্চিত্র। এসব ছবি সেই সময়ের কথা বলে, সেই সময়কে আমাদের কাছে তুলে ধরতে চায়। সত্যি বলতে কী, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাছে আজও রূপকথা হয়ে আছে। স্বাধীনতার মর্ম যতটা না আমাদের অস্তিত্বে, তার চাইতে বেশি আছে ‘কী চেয়েছিলাম আর কী পেলাম’- এই সংঘর্ষে। অনেকেই আবার মুক্তিযুদ্ধকে লুকিয়ে রাখতে চায় পাঠ্যপুস্তকের বেড়াজালে। এখনও সত্য মিথ্যের বেড়াজাল ছিঁড়ে আমরা বেড়িয়ে আসতে পারছি না। তবুও সেলুলয়েডের ছোঁয়ায় ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের কাছে আবার ফিরে যাওয়া, আবার নতুন করে জানতে চাওয়া, তেমন কিছু অন্যায় তো নয়। তাই আজ তেমন কিছু সিনেমার কথা বলছি, যা তৈরি হয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই। এই অল্প পরিসরে সব সিনেমা একসাথে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো নিয়েই আলোচনা করছি।
ওরা ১১ জন
বাংলাদেশ যুদ্ধ জয়ের কিছুদিন পরেই ১৯৭২ সালে এই সিনেমার মুক্তি হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শহীদের রক্তের দাগ তখনও শুকায়নি। স্বাধীনতার উপলব্ধি তখনও অনেকের মনে উঁকি দিচ্ছে দিন-রাত। ঠিক সেই সময় পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম আর প্রযোজক মুরাদ পারভেজ দায় অনুভব করলেন এই সময়ের সাক্ষী হওয়ার।
চিন্তা হলো, এমন একটি সিনেমা বানানো হবে, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমাদের স্বাধীনতার মর্মকথা শোনাবে। সাথে নেয়া হল খসরু, মুরাদ ও নান্টুর মতো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের। এই সিনেমায় অনেক গোলাগুলি এবং গেরিলা যুদ্ধের দৃশ্য রয়েছে, যা সত্যিকারের রাইফেল, এলএমজি ও গ্রেনেড দিয়ে করা। সদ্য মুক্তি পাওয়া দেশে কলাকুশলীদের নিরন্তর ভালোবাসা ও কঠোর পরিশ্রমের ফসল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ছবি ‘ওরা ১১ জন’।
অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী
সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ১৯৭২ সালে নির্মিত আরেকটি চলচ্চিত্রের নাম ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর কলুষিত হাত পড়ে আমাদের দেশের লাখো নারীদের প্রতি। সেই সকল নারী, যারা বীরাঙ্গনা, তাদের জন্য স্লোগান ওঠে,
লাঞ্চিত নারীত্বের মর্যাদা দাও,
নিষ্পাপ সন্তানদের বরণ কর…
মূলত বীরাঙ্গনা নারীদের আকুতির প্রেক্ষাপট নিয়েই আবর্তিত হয় ছবিটির মূল কাহিনী। ছবিটির তিনটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ববিতা, উজ্জ্বল ও আনোয়ার হোসেন। অন্যরকম কাহিনীচিত্র এবং অসম্ভব দক্ষ অভিনয়ের জন্য বেশ প্রশংসিত হয়েছিল সিনেমাটি।
আলোর মিছিল
মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার দূরত্ব বেড়ে চলছিল। কিছু অর্থলোভী স্বার্থপর মানুষ নীতি-নৈতিকতা ভুলে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দাবিকে পেছনে রেখে নিজেদের স্বার্থকেই বড় করে দেখতে থাকে তারা। নিজেদের স্বজনদের এমন কাজে লজ্জিত মুক্তিযুদ্ধ ফেরত তরুণ সমাজ কী করে এর প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তারই এক অনন্য রূপ দিয়েছিলেন পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা। রাজ্জাক, সুজাতা, ফারুক, খলিলের মতো অনেক দক্ষ শিল্পীরা এ ছবিতে অভিনয় করেন।
একাত্তরের যীশু
নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে খুব পরিচিত নাম। শাহরিয়ার কবিরের ‘একাত্তরের যীশু’ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে ১৯৯৩ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রটি।
যুদ্ধের একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার পথ বেছে নেয় একদল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তাই ক্রুশবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের যীশুর সঙ্গে তুলনা করে ছবিটির নামকরণ করা হয় ‘একাত্তরের যীশু’। ছবির প্রধান প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ূন ফরীদি, জহির উদ্দিন পিয়াল, আবুল খায়ের ও শহীদুজ্জামান সেলিম।
আগুনের পরশমণি
নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ আমাদের উপহার দিয়েছিলেন অনন্য এক মুক্তিযুদ্ধের ছবি। অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায়, প্রাণবন্ত অভিনয় আর কুশলী উপস্থাপনায় তিনি তৈরি করেছিলেন ‘আগুনের পরশমণি’, যা এখনও আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়।
এই চলচ্চিত্রে আসাদুজ্জামান নূরের অভিনয়ে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, আবুল হায়াতের অসহায়ত্ব, ডলি জহুরের মাতৃমনের পরিচয়, বিপাশা হায়াতের একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি ভালোবাসা- এসবই দর্শকদের এক কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। শেষ দৃশ্যে আসাদুজ্জামান নূরের হাতে যখন রাতের সব অন্ধকার পেছনে ফেলে নতুন দিনের সূর্যের আলো এসে পড়ে, তখন যেন স্বাধীনতা এসে ধরা দেয় এক নতুন আলোকে সাক্ষী রেখে।
হাঙর নদী গ্রেনেড
বাংলা সাহিত্যের খুব পরিচিত মুখ সেলিনা হোসেন। তার হাত ধরে আমরা পেয়েছি ‘হাঙর নদীর গ্রেনেড’-এর মতো অসাধারণ এক উপন্যাস। সেই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রকে কল্পনা থেকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম।
সরকারি অনুদানে নির্মিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। দেশের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে এক মা তার প্রতিবন্ধী ছেলেকে তুলে দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। মায়ের চোখের সামনে সে সন্তানকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। সুচরিতার অনবদ্য অভিনয় সিনেমাটিতে যোগ করেছে অন্য মাত্রা।
ধীরে বহে মেঘনা
বাংলাদেশের যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের আরেকজন শক্তিমান পরিচালক আলমগীর কবিরের হাত ধরে আমরা পাই মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি ‘ধীরে বহে মেঘনা’। চলচ্চিত্রটির মূল পরিকল্পনা ছিল জহির রায়হানের।
২০০২ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ১০টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘ধীরে বহে মেঘনা’ সিনেমাটিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। সিনেমায় মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখায় এবং সমর দাসের সুরে ‘কতো যে ধীরে বহে মেঘনা’ গানটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এক অপূর্ব আবহের সৃষ্টি করে। ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে অভিনয় করেন বুলবুল আহমেদ, ববিতা, গোলাম মুস্তাফা, আনোয়ার হোসেন, খলিল উল্লাহ খান সহ আরও অনেকে।
আবার তোরা মানুষ হ
১৯৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধের উপর বেশ কয়েকটি ছবি মুক্তি পায়, যার মধ্যে খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ বেশ জনপ্রিয়। আমজাদ হোসেনের রচিত কাহিনী নিয়ে নির্মিত এ চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য, সংলাপ ও সঙ্গীত রচয়িতা খান আতা নিজেই। এই ছবিতে অভিনয় করেন ফারুক, আসাদ, খান আতাউর রহমান, ববিতা ও রওশন জামিল।
যুদ্ধ পরবর্তী প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধাদের যে কষ্টের মধ্যে যেতে হয়েছে তার একটি অনন্য চিত্রায়ন এই ছবি। কিন্তু গল্পের বিষয়বস্তু এবং নামকরণ নিয়ে অনেক মহলে অনেক ধরনের সমালোচনার ঝড় ওঠে। এমনকি সেন্সর বোর্ড থেকেও ছবি মুক্তির প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। অবশেষে খান আতাউর রহমানের প্রচেষ্টায় মুক্তি পায় এবং ব্যাপক প্রশংসিত হয় সিনেমাটি।
নদীর নাম মধুমতি
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের এক পরিচিত নাম তানভীর মোকাম্মেল। ১৯৯৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘নদীর নাম মধুমতি’ চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি রাজাকারদের দুরাচারের সাক্ষী। মধুমতি নদীর পাড় ধরে গড়ে ওঠা একটি গ্রামের মোতালেব মোল্লা নামে এক রাজাকারকে কেন্দ্র করে ছবিটির পুরো কাহিনীচিত্র আবর্তিত হয়।
সেই ঘরেরই এক ছেলে বাচ্চু স্বাধীনতার জাগরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মোতালেব মোল্লাকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। মোতালেবের চরিত্রে অভিনয় করেন আলী যাকের আর বাচ্চুর চরিত্রটি করেন তৌকির আহমেদ। কাহিনী ও সংলাপ রচনার জন্য তানভীর মোকাম্মেল শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
গেরিলা
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’। এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালে নাসির উদ্দীন ইউসুফ নির্মাণ করেন ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটি। একজন বলিষ্ঠ নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যায় গল্পের চিত্রপট।
বিলকিস নামের মেয়েটির স্বামী সাংবাদিক হাসান ২৫ মার্চ রাতে নিখোঁজ হয়। সেই রাতেই শুরু হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ। যুদ্ধের একপর্যায়ে নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যায় বিলকিস। ছবিটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, শতাব্দী ওয়াদুদ। ‘গেরিলা’ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং ২০১১ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ বেশ কয়েকটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। আর সেই অহংকারের উপর আমাদের সিনেমার সংখ্যা যে অসংখ্য, তা কিন্তু বলা যাবে না। এতো স্বল্প পরিসরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সিনেমার নামই নেয়া গেল কেবল। এছাড়াও তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’, মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’, আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামলছায়া’, হারুন অর রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমাদের এই নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠার পথে এই সকল চলচ্চিত্রের আবেদন যুগ যুগান্তরের।
মুক্তিযুদ্ধের বইগুলো পড়তে ক্লিক করুন রকমারি ডট কমে।
ফিচার ইমেজ- bmdb.co