ছোটবেলায় স্কুলে থাকতে আমাদের কম-বেশি সকলের সিলেবাসে রচনা থাকতো “My Favorite Hobby” বা “আমার প্রিয় শখ”। কখনো সেই শখের সাথে আমাদের বাস্তবিক পরিচয় হয়েছে কিনা বা রচনায় লেখা সে শখকে নিজেদের হৃদয়ঙ্গম করাতে পেরেছি কিনা তা পুরোপুরি আলোচনা সাপেক্ষ। কিন্তু পৃথিবীর বড় বড় বিশেষজ্ঞদের মতে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে একটি পছন্দসই শখ থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কর্মচঞ্চল এই জীবনে, সারাদিনের ব্যস্ততা, জ্যামে বসে থাকা, বসের বকুনি, সংসারের চাপ এবং পরিচিত মুখ হতে দূরে সরে যাওয়া এই কর্মমুখর জীবনে হালকা শ্রান্তির অনুভূতি এনে দিতে পারে নিজেকে নতুন করে বাঁচার উদ্দীপনা।
সারাদিনের হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পর নিজেকে সবকিছু থেকে কিছুটা আড়াল করে রাখার আনন্দ কার কাছে লোভনীয় নয়? শুধু কর্মজীবনই বা কেন? স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কথাই ধরা যাক না। সারাদিন বাবা মায়ের মুখে ‘পড়া পড়া’ শুনতে শুনতে এবং তাদের কথায় কিছুটা সায় দিয়েও নিজের মতো কিছু করতে পারার সুখ, সে যার নেই তাকে বলে বোঝানো যাবে না। শুধু সাধারণ মানুষই নন, অনেক কর্মব্যস্ত মানুষের জীবনে রয়েছে তাদের পছন্দসই কিছু করার আকুতি যা তাদের জীবনকে কর্মময় জীবন থেকে কিছুটা আলাদা করে রাখে। আর তেমনি কিছু কর্মব্যস্ত মানুষ হলেন হলিউডের খ্যাতনামা তারকারা। তাদের জীবনের বাহারি শখের কথা হয়তো আগ্রহ জোগাবে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবনার।
টম হ্যাঙ্কস
আমরা যারা সিনেমা দেখতে ভালবাসি, তাদের কাছে এই নামটি খুবই পরিচিত। তার দক্ষ অভিনয় এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আমাদের অনেককেই তার ভক্ত হতে বাধ্য করেছে। অভিনেতার পাশাপাশি টম হ্যাঙ্কস একজন সুন্দর মনের মানুষও। এই অসাধারণ ব্যক্তি কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে আছে একটু ভিন্ন কিছু করার শখ। কিছুটা অবাক হতে হয় বৈকি। কারণ এহেন শখ আমি আর কারও আছে বলে শুনিনি। জানতে চান সেটা কি? পুরনো টাইপ রাইটার সংগ্রহ করা।
১৯৭৮ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন ধরনের টাইপ রাইটার সংগ্রহ করে আসছেন। টাইপ রাইটারের ‘শুক’ ‘শুক’ আওয়াজ তাকে অন্য এক চিন্তা জগতে দাঁড় করায়। যেখানে টাইপ রাইটারের আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। সময় পেলেই টাইপ রাইটারে টাইপ করতে বসে যান তিনি। নিউইয়র্ক টাইমসে তিনি লিখেছেন, “প্রতিটি শব্দের সাথে সাথে ছাপার অক্ষরে এক একটি শব্দের বিন্যাস যেকোনো লেখায় একটি অন্য মাত্রা জুড়ে দেয়। সাধারণ একটি ধন্যবাদের চিঠিও যেন একটা শৈল্পিক সৃষ্টি হিসেবে ধরা দেয়।” তিনি আরও ঠাট্টা করে বলেছেন, “এর আরেকটি ভাল দিক হলো এটি কেউ হ্যাকও করতে পারবে না।”
মেরিল স্ট্রিপ্স
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত অভিনেত্রী ও গায়িকা তিনি, পুরো নাম মেরি লুইস মেরিল স্ট্রিপ। সিনেমার সেটে সবসময় এই মহিলাকে দেখা যাবে আপন মনে উলের সোয়েটার বুনে চলেছেন। যখনি শুটিংয়ে ডাক পড়ছে, তখনই উঠে গিয়ে অভিনয় করে আসছেন। আমেরিকার এক সাংবাদিক এই দক্ষ অভিনেত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি কিভাবে ক্যামেরার সামনে এতো ফোকাস্ড থাকেন?” উত্তরে খানিক মুচকি হেসে মেরিল বলেছিলেন, “নিটিংই হলো একমাত্র রহস্য যা সবকিছু থেকে পৃথক করে দেয়।”
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি
কিছুটা ব্যতিক্রমী শখের কথা শোনা যায় হলিউড সুন্দরী অ্যাঞ্জেলিনা জোলির কাছে। বিভিন্ন ধরনের ছুরি সংগ্রহ করা তার একমাত্র শখ। শখটি তার চরিত্রের সাথে যে একেবারে বেমানান তা কিন্তু মনে হয় না। “সল্ট” বা “মিস্টার অ্যান্ড মিসেস স্মিথ” এর মতো অ্যাকশনধর্মী মুভি দেখলে ধারণাটা আরও পাকাপোক্ত হয়।
এর চাইতেও মজার ব্যাপার হলো জোলি এক ম্যাগাজিনে বলেছেন যে, ছেলে ম্যাডক্সের মাঝেও তার এই শখ ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। আর এজন্য তিনি এখন থেকেই ছুরি হাতে তুলে দিচ্ছেন ছেলের, যদিও ধারালো অংশটা ভোঁতা করে দিয়ে।
কিয়ানু রিভস
ব্যান্ডের নাম ছিল “ডগস্টার”, আর সেখানে বেজ গিটার বাজাতেন কে ধারণা করতে পারছেন? “ম্যাট্রিক্স” মুভির স্টাইলিশ বয় স্বয়ং কিয়ানু রিভস। ১৯৯০ থেকে শুরু হয়ে ব্যান্ডটি ২০০০ সাল পর্যন্ত চলে। কিয়ানু রিভসের অভিনয় খ্যাতির কারণে মিডিয়ার বেশ নজর কাড়ে সেই সময়। পেশাগত ব্যস্ততার কারণে শেষ পর্যন্ত আর চালিয়ে যেতে পারেননি রিভস। কিন্তু ব্যান্ডে না বাজালে কি হবে? এখনও সময় পেলেই হাতে তুলে নেন গিটার আর প্লাগ-ইন করেন সুরের মূর্ছনা।
হ্যারিসন ফোর্ড
ইন্ডিয়ানা জোন্স খ্যাত হ্যারিসন ফোর্ড সিনেমাতে যে অনেক ধরনের বিধ্বংসী কাজ কারবার করে ফেলেন, তা আমাদের তো আর অজানা নয়। বাস্তব জীবনেও তার চিন্তা-ভাবনা তার চাইতে কম কিছু নয়। সুযোগ পেলেই তাই ছুটে যান ককপিটে হেলিকপ্টার উড়ানোর জন্য। এমনকি সিনেমার শুটিংও করেন নিজেই পাইলট হয়ে।
লিয়াম নিসন
Taken চলচ্চিত্র খ্যাত ৬৫ বছর বয়সী অ্যাকশান হিরো লিয়াম নিসন অবসর সময় কাটাতে চান একটু অন্যভাবে। শহরের ক্লান্তি আর কোলাহল ছেড়ে চলে যান দূরে কোথাও, কোনো লেকে, পরিবারের সাথে মাছ ধরতে। “কন্টাক্ট মিউজিক” এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে লিয়াম বলেছিলেন, “আমি যখন কাজে থাকিনা তখন আমার গুরুত্বপূর্ণ সময় শুধু পরিবারের সাথে আর মাছ ধরে কাটাতে চাই“। আমেরিকায় আয়োজিত “ফ্লাই ফিশিং এরাউন্ড দা ওয়ার্ল্ড” এ মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় অনেকবার নাম লিখিয়েছেন এই গুনী অভিনেতা।
আধুনিক এই যুগে ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, টিভি আরও কত কিছুর মাঝে নিজের শখ বা হবি বলে যে কিছু থাকতে পারে তা যেন আমরা একেবারে ভুলতেই বসেছি। ছোট ছোট বাচ্চা থেকে বুড়ো অনেকেরই আজকাল সময় অতিবাহিত করার জন্য পছন্দের তালিকায় রয়েছে অ্যান্ড্রয়েড গেমস, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব আরও কত কি! কিন্তু কিছু বছর আগেও মানুষের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা ছিল খানিকটা অন্যরকম।
একটুখানি সময় পেলেই দেখা যেত কারও হাতে গল্পের বই, কেউ শিখছে গান, কেউ করছে আবৃত্তি, কেউ করছে গাছের পরিচর্যা আবার কেউ বা করছে খেলাধুলো। শখের বৈচিত্র্য আনার মধ্যেও ছিল একেকজনের প্রানবন্ত চেষ্টা। কারও পছন্দ ডাকটিকিট সংগ্রহ, কারও বা কলম।
হরেক রকমের মানুষ হরেক রকমের শখ। তেমনি পৃথিবীর সফল মানুষদের জীবনী পড়লেও দেখা যাবে তারা শুধু কাজের পেছনে ছুটে নিজেকে বিলিয়ে দেননি। তাদেরও ছিল নিজের পছন্দ করা কাজের বাহার। হলিউড অভিনেতাদের শখের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় পৃথিবীতে আমরা সকলেই ব্যস্ত। কিন্তু এই ব্যস্ততার ফাঁকে কিছুটা সময় যদি নিজের করে নিতে পারি পছন্দসই কাজের সাথে, তাহলে তা হবে অন্যরকম প্রাপ্তি।