Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নারী ও পুরুষের মধ্যে কি ‘শুধুই বন্ধুত্ব’ সম্ভব?

নিপা স্বাধীনচেতা মেয়ে। সে আঁকতে ভালোবাসে। ভালোবাসে গাইতে। সে ঠিক করেছে কখনো কাউকে ভালোবাসবে না। তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ইকবাল। ইকবালের সাথে সে সব কিছু শেয়ার করে। যখন তার কোনো কিছু ভালো লাগে না তখন সে ইকবালকে ফোন দেয়। তার মনের সব দুঃখের কথা খুলে বলে। ইকবালও তেমনই নিজের ভেতরকার কথা অবলীলায় বলতে থাকে নিপাকে। তারা দুজনই সময়ে সময়ে একে অপরকে ফোন দেয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হয়। মেসেঞ্জারে চ্যাট হয়। হয়তো প্রেমের কথা নয় কিন্তু নিজেদের কথা।

নিপার প্রতি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে ইকবাল। এই তো কয়েক দিন আগে নিপার মোবাইল নষ্ট হয়ে গেলে প্রায় তিনদিন ফোনে কথা হয়নি তাদের। ইকবালের মনে হতে থাকে এই তিনদিন বুঝি তিন যুগ। যেন কাটতেই চায় না। তারা দুজনই দুজনকে বন্ধু ভাবে। কয়েকদিন আগে নিপার একটি ছেলেকে ভালো লেগে যায়। ইকবালের সে সময় কেমন যে লেগেছিল তা বলে বোঝানোর নয়। নিপার বাড়িতে বিয়ের কথা হলেও ইকবাল অস্বাভাবিক হয়ে যায়। মনের অজান্তে নানা চিন্তা ঘুরপাক খায় ইকবালের মাথায়। কিছুটা হয়তো নিপার ক্ষেত্রেও এমন ঘটে। নিপা ও ইকবাল কি শুধুই বন্ধু? না কি বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু?

“বন্ধু বোঝে আমাকে, বন্ধু আছে আর কী লাগে?” গানের মতোই আমাদের বন্ধুরা আমাদের জীবনের সাথে জড়িত। জীবনে চলার ক্ষেত্রে আমাদের বন্ধুর দরকার হয়। তবে সব বন্ধু এক নয়। আমরা একেকজনের সাথে একেকভাবে মিশি। একটা সময় ছিল যখন ছেলে মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হতো না। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন নারীবাদের উত্থান ঘটে তখন থেকেই নারী ও পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্বের বিষয়টি সবার সামনে আসে।

এর আগে নারী ও পুরুষের মধ্যে হতো বিয়ে অথবা প্রেম। কিন্তু নারীরা এখন পুরুষের সাথে চাকরি করছেন, একইসাথে পড়াশোনা করছেন। আর সাথে আছে ফেসবুক সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তাই নারী ও পুরুষের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। নারী ও পুরুষের এই বন্ধুকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি টার্ম আছে ‘প্লেটোনিক ভালোবাসা’। অর্থাৎ যে ভালোবাসার সাথে যৌনতার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় নারী ও পুরুষের মধ্যে কি ‘কেবলই বন্ধুত্ব’ সম্ভব? দুই পক্ষের বন্ধুত্বের মধ্যে কি যৌনতা চলে আসে না?

নারী ও পুরুষের মধ্যে কি কেবল বন্ধুত্ব সম্ভব? Source: pexel.com

আমাদের কিছু বন্ধু থাকে সামাজিক জীবন কাটানোর জন্য। যখন আমরা দলবদ্ধভাবে নারী-পুরুষ কোনো বন্ধুত্বে আবদ্ধ হই তখন হয়তো এধরনের ব্যাপার কম ঘটে। আমাদের অল্প কিছু বন্ধুর সাথে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবন শেয়ার করি।  প্রতিটি মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবনে একাকীত্ব অনুভব করে। সেই একাকীত্ব মেটাতে আমরা বন্ধুর শরণাপন্ন হই। কিন্তু সেই বন্ধু যদি বিপরীত লিঙ্গের হয় তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়। যদি তারা পরস্পরের প্রতি খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তখনই সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাহলে বিপরীত লিঙ্গের মানুষেরা যদি বন্ধু থাকতে চায় তাহলে কি কোনো সীমারেখা আছে? যদি থাকে তাহলে সেটা কতটুকু?

এখানে একটি বিষয় আছে, নারী ও পুরুষের বন্ধুত্বের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। নারীরা খুব সহজেই তাদের ঘনিষ্ঠ নারী বন্ধুর সাথে তাদের মনের দুঃখ, গোপন কথা ও দুর্বলতা সহজেই প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষকে তার দুর্বলতার কথা সহজে প্রকাশ করে না। আরেকটি বিষয় হলো, যেকোনো সম্পর্কে নারীরা খুব অনুভূতিপ্রবণ হয়। কাজেই একজন নারীর দুঃখ অন্য একজন নারী যত সহজে অনুভব করেন একজন পুরুষ ততটুকু অনুভব করতে পারেন না। পুরুষরা একসাথে আড্ডা দেবে, খাওয়া দাওয়া করবে, ঘুরে বেড়াবে, মজা করবে কিন্তু তার ভেতরকার মনের কথা অন্য পুরুষকে বলবে না। ফলে একজন নারী ও পুরুষ যখন বন্ধু হয় তখন পুরুষটি আবেগপ্রবণ হওয়ার সুযোগ পায়। সে তার দুর্বলতার কথা বলতে পারে, যা অন্য পুরুষদের বললে হয়তো বা তারা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিতো। অন্য দিকে নারীরাও পুরুষ বন্ধুদের সাথে তার পাগলামির অংশীদার হতে পারে।

Source: tallypress.com

একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রেম ও বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আলাদা করার উপায় কী? এর সহজ উত্তর হতে পারে বন্ধুত্বে তারা পরস্পরের মধ্যে রোমান্টিক কথাবার্তা বলছে না, তারা একে অন্যকে প্রেমের কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না এবং তারা যৌন সম্পর্কেও জড়াচ্ছে না। কিন্তু নারী ও পুরুষের বন্ধুত্বকে কাগজে কলমে এবং তত্ত্বে যত সহজে বলা যায়, বাস্তবে তত সহজ নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এই সম্পর্কে সূক্ষ্ম কিছু জটিলতার জন্ম হয়। পরবর্তীতে বোঝা যায় এ সমস্যা মোটেও সূক্ষ্ম নয়।

অনেক সময় দেখা যায় তাদের দুজনের একজন নতুন প্রেমে জড়িয়ে যায়। তখন একে অন্যকে আগের মতো সময় দেয়া সম্ভব হয় না। আগে যখন বন্ধুর সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলা হতো সেই সময়ে এখন সঙ্গীর সাথে কথা বলা হয়। এখন আর আগের মতো ফেসবুক, হোয়াটস এপে ইত্যাদিতে কথা হয় না। তখন অন্য বন্ধু সেই শূন্যতাটি অনুভব করে। নারী-পুরুষ দুজন যদি শুধু বন্ধু থাকতেন তাহলে এই সমস্যা হতো না। তারা হয়তো বা বন্ধুত্বের চেয়ে একটু এগিয়ে যান।

অনেকে মনে করতে পারেন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্কীর্ণতার কারণে হয়তো কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশেই কেবল নারী-পুরুষ বন্ধুত্বে সমস্যা হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে আমেরিকাতে চালানো এক জরিপে দেখা যায় অর্ধেকের বেশি নারী পুরুষ মনে করেন একজন পুরুষ ও একজন নারী যদি স্বামী-স্ত্রী না হন তবে একসাথে বসে এলকোহল পান করা, ডিনার করা কিংবা লাঞ্চ করা অথবা গাড়িতে যাওয়া ঠিক নয়।

Source: nytimes.com

এমনকি অফিসের কাজের বিষয়েও নারী ও পুরুষ আলাদাভাবে বসাও তারা অনুচিত মনে করেন।

Source: nytimes.com

একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী ৬,৫০০ নারী-পুরুষকে নিয়ে করা একটি জরিপে দেখা যায় অর্ধেকের বেশি তাদের বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুকে নিয়ে যৌন চিন্তা করেছেন। শতকরা ৪০ জন তাদের বন্ধুদের সাথে যৌন সম্পর্ক তৈরি করেছেন। আর দুই তৃতীয়াংশ বলেছেন যদি সুযোগ আসে তারাও যৌন সম্পর্ক তৈরি করতে চান।

প্রশ্ন আসতে পারে আমরা নারী-পুরুষ একসাথে কাজ করছি, পড়াশোনা করছি, তাহলে কেন সাধারণভাবে বড় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে বাহ্যিকভাবে আমরা এই জিনিসকে উপেক্ষা করলেও ভেতরে ভেতরে এ নিয়ে আমরা একধরনের দ্বন্দ্বে ভুগি। এ বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য ৮৮ জোড়া আন্ডারগ্র্যাড নারী-পুরুষ শিক্ষার্থীকে নিয়ে গবেষণা করা হয়। তাদের পরস্পর সম্মন্ধে জিজ্ঞেস করা হয় তারা পরস্পরের প্রতি রোমান্টিক তথা যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন কিনা।

এ গবেষণায় চমৎকার কিছু তথ্য উঠে এসেছে। দেখা গেছে নারী ও পুরুষ তাদের বন্ধুত্ব সম্বন্ধে দুই ধরনের মন্তব্য করছে। নারীদের থেকে পুরুষেরা তাদের বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুর প্রতি বেশি আকর্ষণ অনুভব করে। পুরুষেরা মনে করে তার নারী বন্ধুটি তার প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে। এই ভ্রমে থেকে সে পুরো বাস্তবতাটিকেই গুলিয়ে ফেলে। অন্যদিকে নারীরা মনে করে পুরুষটি শুধু তার বন্ধুই, অন্য কিছু নয়। এখান থেকে বলা যায় নারী-পুরুষ বন্ধুত্বকে গুলিয়ে ফেলার জন্য পুরুষরাই বেশী দায়ী। এই গবেষণার প্রেক্ষিতে যদি প্রশ্ন করা হয় নারী-পুরুষ বন্ধুত্ব সম্ভব কিনা, তাহলে এর উত্তরে বলতে হবে, আপনি যদি নারীর দৃষ্টিতে দেখেন তাহলে হয়তো সম্ভব কিন্তু পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নারী-পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। এজন্যই হয়তো একজন পুরুষ কবি অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন,

“নারী ও পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। ওখানে আবেগ থাকে, বিরোধীতা থাকে, ভক্তি থাকে, ভালোবাসা থাকে, কিন্তু বন্ধুত্ব থাকে না।”

Source: azqoutes.com

এতক্ষণ পর্যন্ত যা বলা হলো তা বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য। তবে এ সম্পর্কে একদম নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কঠিন। কারণ ভালোবাসার মতো বন্ধুত্বও একটি রহস্যময় বিষয়। একে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। তবে নারী ও পুরুষের মধ্যে নিশ্চিতভাবে একটি সীমারেখা প্রয়োজন আছে। না হলে আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ বিশেষ ধরনের অনুভূতি শুধু বিশেষ মানুষের জন্যই কেবল থাকা উচিত।

আবার অনেকে বলেন, নারী ও পুরুষের সম্পর্ক অবশ্যই সম্ভব। সব সম্পর্কের প্রথমে আকর্ষণ অবশ্যই থাকে। আমরা যখন আরেকজনকে পছন্দ করি তখনই তার সাথে বন্ধু হতে চাই। আর নারী-পুরুষ বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো জৈবিক আকর্ষণ থাকতে পারবে না এমনটিও নয়। হরমোনের পীড়া থেকে তো সহজে বাঁচা যায় না। তবে এই আকর্ষণকে স্বীকার করেই নিজেদের মধ্যকার সীমারেখার মধ্যে থাকলে একটি সুন্দর বন্ধুত্ব সম্ভব। ইরা ভারটানেন টেড টকে দেয়া তার বক্তব্যে এটাই তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নারী ও পুরুষ বন্ধু হওয়া সম্ভব এবং উচিত। তা না হলে জনসংখ্যার অর্ধেককে আপনি বাদ দিয়ে দিচ্ছেন।

আসলে এটা এমন এক বিষয় যা নিয়ে যুক্তি তর্ক থাকবেই। তাই আমাদের মাঝে মাঝে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ উল্টিয়ে দেখা দরকার। সূক্ষ্ম মনো-জটিলতাগুলোকে পেরিয়ে আমাদের সম্পর্কগুলো সুন্দর হোক। আমাদের সেক্ষেত্রে সেটাই করা উচিত যা আমাদের জীবনকে অশান্তি থেকে শান্তির দিকে নিয়ে যাবে।

ফিচার ইমেজ: popsugar.com

Related Articles