কাকতাড়ুয়া নাম শুনে মনে হতে পারে, কাক তাড়ানোর সঙ্গে এদের একটা সম্পর্ক আছে। তবে শুধু কাক তাড়ানোই নয়, যেসব পশুপাখি ফসলের ক্ষতি করে, তাদের ভয় দেখানোর জন্যই কাকতাড়ুয়ার প্রচলন।
কাকতাড়ুয়ার প্রচলন শুরু হলো যেভাবে
গ্রামীন জীবনধারার সাথে কাকতাড়ুয়া যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইতিহাস হতে জানা যায়, মিশরে প্রথম কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার শুরু হয়। মিশরের নীল নদের অববাহিকায় পলি জড়ানো ভূমির সৃষ্টি হয়েছিল, সে ভূমিতে মিশরীয়রা চাষাবাদ করতো। গম থেকে শুরু করে নানারকমের শস্য ফলাতো তারা। কিন্তু পাখির উৎপাতে সেসব ফসল রক্ষা করায় দায় হয়ে পড়েছিল মিশরীয়দের। চাষীরা তাদের ক্ষেতের ফসল রক্ষা করার জন্য ফসলের ওপর জাল বিছিয়ে দিত। খাওয়ার জন্য পাখিরা পাকা ফসলের ওপর বসতেই জালে আটকে পড়তো। আর জালে আটকানো পাখিদের মাংস পরম উপাদেয় খাবার হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে মিশরীয়দের কাছে।
২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক কৃষকরা তাদের ফসল রক্ষার জন্য কাঠের তৈরি কাকতাড়ুয়া ফসলের মাঠে স্থাপন করতে শুরু করে। এই কাকতাড়ুয়া অনেকটা দেবতা ডায়ানিসাসের পুত্র প্রিয়েপাস এবং জিউসের কন্যা দেবী আফ্রোদিতির আদলে তৈরী। গ্রিকদের বিশ্বাস ছিল, ফসলের ক্ষেতে এসব দেবতার প্রতিমূর্তি স্থাপন করলে পশুপাখি ফসলের কোনো ক্ষতি করতে পারে না এবং সেসব দেবতার কল্যাণে প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপাদিত হবে। গ্রিকরা এই কাঠের কাকতাড়ুয়াকে রক্তিম বর্ণে রাঙাতো এবং কাকতাড়ুয়ার একটি হাতে থাকতো লাঠি বা মুগুর জাতীয় কিছু, যা দেখে পাখিরা খুব একটা সাহস করতো না খেতের ফসল মাড়াতে।
রোমানরা গ্রিকদের অনুকরণে কাকতাড়ুয়াদের সাজাতো। রোমান সৈন্যরা যখন ইউরোপ অভিযানে বের হয়, তখন তারা প্রিয়েপাসের আদলে তৈরী কাকতাড়ুয়াকে বিভিন্ন ফসলের মাঠে দেখতে পায়। পরবর্তীতে রোমান সৈন্যরা রোমের কৃষকদেরকে ফসলের মাঠে এ ধরনের কাকতাড়ুয়া স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করে।
মধ্যযুগে, ব্রিটেন ও ইউরোপে বাচ্চদেরকে কাকতাড়ুয়া হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তাদের কাজ ছিল লাঠি দিয়ে টিনের বাক্স বাজিয়ে ফসলের মাঠে ছুটে বেড়ানো, যাতে এই শব্দ শুনে পাখিরা পাকা ফসল খেতে আসতে না পারে। কিন্তু কিছুকাল পর সারা ইউরোপ জুড়ে প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এর ফলে ইউরোপে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যায়। ফসলের মাঠে পাখি তাড়ানোর জন্য যথেষ্ট বাচ্চা পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন কৃষকরা পুরনো কাপড় ও খড় দিয়ে বাচ্চা ছেলের আদলে কাকতাড়ুয়া তৈরি করতে শুরু করে। সেই মানুষ সদৃশ খড়ের প্রতিকৃতিকে ক্ষেতের মাঝে বেশ উঁচু লাঠির সাহায্যে স্থাপন করে পাখি তাড়ানোর এক বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর কিছুদিনের মধ্যেই আশাতীত সাফল্য পাওয়ায় এই ব্যবস্থা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
এশিয়ার মধ্যে জাপানে প্রথম কাকতাড়ুয়ার প্রচলন শুরু হয় বলে জানা যায়। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে জাপানী ভাষায় সংকলিত এক বইতে এই কাকতাড়ুয়ার সম্পর্কে জানা যায়। জাপানের সামন্তবাদী রাজত্ব শুরু হওয়ার আগে থেকেই ক্ষেতের পাকা ধান রক্ষা করার জন্য ফসলের মাঠে নানা রকম কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করতে থাকে। তবে সে সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ‘কাকাসি’ নামের কাকতাড়ুয়া। কাকাসি কাকতাড়ুয়াকে জাপানি মানুষের আদলে তৈরি করা হতো। সেই কাকতাড়ুয়ার গায়ে থাকতো বর্ষাতি, মাথায় থাকতো টুপি আর হাতে থাকতো তীর-ধনুক।
নেটিভ আমেরিকান সংস্কৃতিতে কাকতাড়ুয়ার প্রচলন বেশ লক্ষণীয়। শেতাঙ্গদের আগমনের পূর্বে বর্তমান ভার্জিনিয়া এবং ক্যারোলিনার বেশ কিছু অঞ্চলে শস্যক্ষেতের আশেপাশে কোনো পশুপাখি দেখলে নেটিভ আমেরিকানরা জোরে জোরে আওয়াজ করে তাদের তাড়াতো। কিছু নেটিভ নৃগোষ্ঠী পাখিদের তাড়ানোর জন্য শস্যবীজের সাথে একধরনের ওষধি গাছের রস মিশিয়ে দিতো এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া হতো ফসলের মাঠের আশেপাশে। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের কিছু নেটিভ আমেরিকান শিশুর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো কে কত ভয়ঙ্কর কাকতাড়ুয়ার রূপ নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দার সময় কৃষকের ফসলের মাঠে ব্যাপক পরিমাণে কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন কৃষি এবং কৃষিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক যুগের শুরু হয়, তখন মার্কিন কৃষকেরা কীটনাশকের প্রচুর ব্যবহার শুরু করে। এর ফলে ফসলের পোকামাকড়ের উপদ্রব কমে যায় এবং পাখিরাও কীটনাশক থেকে দূরে থাকে। তখন কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকে। কিন্তু ১৯৬০ এর পর মার্কিন কৃষকেরা বুঝতে পারলো যে, কীটনাশক পাখি, পোকামাকড়দের যেমন ক্ষতি করে, তেমনি মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তখন তারা ফসলের মাঠে ধীরে ধীরে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে থাকে। ফসলের মাঠে পুনরায় কাকতাড়ুয়ার প্রচলন শুরু হয়। শুধু কাকতাড়ুয়াই নয়, উইন্ডমিল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পাখি তাড়ানোর কাজ দুটোই একসাথে চলতে থাকে।
বাংলার কাকতাড়ুয়া
আমাদের গ্রামবাংলায় যেসব কাকতাড়ুয়া চোখে পড়ে, সেগুলোর আদল প্রায় একরকম। কালো মাটির হাঁড়ির ওপর সাদা চুন দিয়ে মুখ চোখ এবং বড়-বড় দাঁত এঁকে লম্বা লাঠির ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়। কখনো কখনো ছেঁড়া জামা, ছেঁড়া গেঞ্জি আর খাটো লুঙ্গিও পরিয়ে দেওয়া হয়, যাতে দূর থেকে কিম্ভূতকিমাকার একজন রাক্ষস পাহারাদার বলে মনে হয়।
শুধু আমাদের দেশে নয়, বিদেশেও কাকতাড়ুয়ার চল রয়েছে। সে সব কাকতাড়ুয়া যত না ভয়ের, তার চেয়ে বেশি মজার। বিভিন্ন দেশের কাকতাড়ুয়া অবশ্য দেখতে একরকম নয়, তাদের আদল অনেকটা সেই দেশের মানুষ আর পরিবেশ অনুযায়ী তৈরি হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কাকতাড়ুয়ার প্রচলন আছে।
ব্রিটিশ কাকতাড়ুয়া
ইংল্যান্ডের এক বিশেষ অঞ্চলে নৃত্যরত কাকতাড়ুয়া চোখে পড়ে। এদের পোশাক-আশাক এবং দাঁড়াবার ভঙ্গি এমনই, যাতে দূর থেকে মনে হয়, যেন একটি মেয়ে নাচছে। কখনো কখনো এই নাচুনে কাকতাড়ুয়ার হাতে ছেঁড়া ছাতাও ধরিয়ে দেওয়া হয়।
পর্তুগিজ কাকতাড়ুয়া
অ্যাপ্রন পড়া পর্তুগিজ কাকতাড়ুয়া দেখতে অনেকটা মেয়েদের মতো হলেও, এদের মাথায় থাকে ঝলমলে বড় টুপি।
স্প্যানিশ কাকতাড়ুয়া
রাক্ষুসে ইগলের হাত থেকে ফসল রক্ষা করবার জন্য স্পেনের কাকতাড়ুয়াকে কোনো ভয়ঙ্কর মূর্তির মতো তৈরি করা হয়। ছেঁড়া প্যান্ট, শার্ট, টুপি, ছেঁড়া জুতো ইত্যাদি পরিয়ে দিয়ে এমনভাবে মাঠের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় যে, শুধু ইগল নয় যে-কেউই ভয় পেয়ে দূরে পালিয়ে যাবে। ওদেশে অবশ্য অনেকেই কাকতাড়ুয়াকে ‘ভূত’ বলে মনে করে। এই কাকতাড়ুয়াকে ‘ইগলতাড়ুয়া’ বললেও ভুল হবে না!
ফরাসি কাকতাড়ুয়া
ফ্রান্সে আবার ঠিক উল্টোটা, এদেশে কেউ কাকতাড়ুয়াকে ভূত বলে মনে তো করেই না, বরং এরা কাকতাড়ুয়াকে সাজিয়ে তোলে একেবারে নিজেদের আদলে। যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে কোর্ট, প্যান্ট, টাই পরিয়ে দেওয়া হয়। কখনো কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দিয়ে ভাঙা সাইকেলের ওপর এমনভাবে ক্ষেতের বেড়ার পাশে বসানো হয়, যাতে পশুপাখি তো বটেই, মানুষও পাহারাদার বলে ভুল করে।
পোলিশ কাকতাড়ু
পোল্যান্ডের চাষীরা অবশ্য খড়, শুকনো পাতা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি ‘মোটা কাকতাড়ুয়া’ পছন্দ করে। কখনো-সখনো এদের চোখে চশমাও পরিয়ে দেওয়া হয়।
আমেরিকার কাকতাড়ুয়া
সব দেশের কাকতাড়ুয়ারই দুটো হাত থাকে, কিন্তু আমেরিকার কোনো কোনো অঞ্চলের কাকতাড়ুয়ার থাকে চার-পাঁচটা হাত। দেখায়ও বেশ।
কাকতাড়ুয়া তৈরির নানা উপককরণ
সব সময় যে শুধু খড়, শুকনো পাতা, ছেঁড়া জামাকাপড় ইত্যাদি দিয়ে কাকতাড়ুয়া তৈরি করা হয়, তা নয়। বিদেশের কোনো কোনো জায়গায়, কাকতাড়ুয়া তৈরি হয় স্রেফ ফেলে দেওয়া টিনের কৌটো দিয়ে, যার ওপর সূর্যের আলো পড়লেই ঝকমক করে জ্বলতে থাকে। কাকতাড়ুয়াকে আবার নিরস্ত্র ভাবার কোনো কারণ নেই। অনেক দেশেই এদের হাতে ধরানো থাকে লাঠি, কাটারি, বল্লম, খেলনা-বন্দুক ইত্যাদি। কখনো আবার বাটি, গেলাস, থালা, এমনকি ফুলের তোড়াও হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়।
আজকাল অবশ্য কাক তো বটেই, দুষ্টু চড়ুই পাখিরাও কাকতাড়ুয়াকে ভয় পায় না। বরং তাদের মাথার ওপর বসে থেকে দিব্যি কিচিরমিচির জুড়ে দেয়। এইসব দেখে শুনে জাপানিরা রোবটকে কাকতাড়ুয়ার কাজে লাগিয়েছে। জ্যন্ত কাকতাড়ুয়া দিনরাত লাঠি হাতে সমস্ত মাঠ ঘুরে-ঘুরে ফসল পাহারা দেয়। তাই, শুধু পশুপাখি নয়, দুষ্টু ছেলেমেয়েরাও এই জ্যান্ত কাকতাড়ুয়াকে ভীষণ ভয় পায়। বর্তমানে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় প্রাচীন কাকতাড়ুয়ার সেই বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
কাকতাড়ুয়া উৎসব
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাকতাড়ুয়াদের নিয়ে আয়োজিত হয় কাকতাড়ুয়া উৎসব। ইংল্যান্ডে প্রতি বছর মে ডে-তে আরচফন্ট স্কেয়ারক্রো ফেস্টিভ্যাল আয়োজিত হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন অঞ্চলে বছরের বিভিন্ন সময়ে কাকতাড়ুয়া উৎসব পালন করা হয়। এর মধ্যে ল্যাঞ্চেশায়ারের ওয়েরি ফেস্টিভ্যাল উল্লেখযোগ্য।
কাকতাড়ুয়া উৎসব উপলক্ষে পৃথিবীর বৃহত্তম জমায়েত হয় ইংল্যান্ডের স্টেফোর্ডশায়ারে। স্কটল্যান্ডে প্রথম কাকতাড়ুয়া উৎসব পালিত হয় ২০০৪ সালে পশ্চিম কিলব্রাইডে। ফিলিপাইনের ইসাবেলা প্রদেশে যে কাকাতাড়ুয়া উৎসব পালিত হয়, স্থানীয় ভাষায় সেই উৎসবের নাম ‘বামবান্তি ফেস্টিভ্যাল’। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জাঁকজমকভাবে কাকতাড়ুয়া উৎসব পালিত হয়ে থাকে।
ফিচার ইমেজ- Mental Floss