Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বর্তমান জীবনে বিজ্ঞাপন বিভ্রান্তি: শিল্প না টাকার খেলা?

শিল্প বলতে এমন সবকিছুকেই বোঝায়, যা আমরা করি। একজন মানুষ শিল্পের সহায়তায় তার চিন্তা,  ইচ্ছার সবটুকুই যেন তুলে ধরেন তার ক্যানভাসে। এই ক্যানভাসের মাধ্যমেই একজন শিল্পী এমন মনোভাব তুলে ধরেন, যা শুধুমাত্র শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু এই শিল্পই যখন বিজ্ঞাপনের বিভ্রান্তিতে পড়ে, বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে আমজনতা। আমাদের আজকের মূল আলোচনা তাই চিত্রশিল্প নিয়েই। তবে আলোচনা শুরু করার আগে চলুন কিছু আধুনিক চিত্রশিল্প দেখে আসা যাক।

 

১৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রয় করা একটি চিত্রশিল্প; source: tate.org

উপরের ছবিটি প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলারে (প্রায় ১২৪ কোটি টাকা) বিক্রয় করা হয়। ওহ আচ্ছা, আপনি দেখতে পারছেন না। ছবিটি পেছনের রঙের সাথে মিলে যাওয়াতে হয়তো দেখতে একটু কষ্ট হচ্ছে। তাহলে ছবিটি আরেকটু দূর থেকে দেখালে মনে হয় ভালো হয়।

একটু দূর থেকে দেখা সেই ১৫ মিলিয়ন ডলারের ছবিটি; source: youtube.com

একটি ছবির মাধ্যমে একজন শিল্পী তার কোন উপলব্ধি বা ভাব তুলে ধরেন। এই ছবির বিবরণে উল্লেখ করা আছে যে এই ছবির মাধ্যমে খুব উগ্র পর্যায়ের স্বাজাত্যবাদের (Racism) মনোভাব প্রকাশ করেছেন, যেখানে কালোকে একেবারেই দেখাই যাবে না। শিল্পী আমাদের এরকম এক ভয়ানক বাস্তবতার ধারণা চিন্তা করতে আমন্ত্রণ জানান তার এই পটের মাধ্যমে। এখন অনেকের মনে হতে পারে, হয়ত লেখক শিল্প বোঝেন না দেখে এমনটা বলছেন। তাহলে চলুন আরো কিছু চিত্রপট দেখে আসা যাক।

জোয়ান মিরোর আঁকা Peinture; source: christies.com

দেখতে বাচ্চাদের ড্রয়িং বলে মনে হলেও এই চিত্রশিল্পটির দাম বর্তমানে হাঁকা হয়েছে ২.২ মিলিয়ন ডলার। নিচের ছবিটি দেখে কি মনে হয় আপনার? আপনার কাছে রাখতে বললে কি রাখবেন?

সাই টাওম্বলির আঁকা ছবি; source: moma.org

এই ছবিটি আপনার কাছে বাচ্চাদের হিজিবিজি অংকন বলে মনে হলেও এই ছবিটির বর্তমান মূলে প্রায় ৭০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। শুধুমাত্র চিত্রশিল্পই নয়, স্থাপত্যের বেলায়ও কিছু অদ্ভুত শিল্পকর্মের দাম হয়ে দাঁড়ায় কয়েক মিলিয়ন ডলারের মধ্যে। তার মধ্যে একটি হলো ড্যামিয়ান হার্স্টের হাঙরের উপস্থাপন, যা তিনি প্রায় ১৫.৩ মিলিয়ন ডলারে বিক্রয় করেছেন।

ড্যামিয়ান হার্স্টের হাঙরের উপস্থাপন; Source- damienhirst.com

তাহলে এখন আসা যাক কেন এই শিল্পগুলোর এভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, এ বিষয়ে। প্রথমত, আপনি যখন কোনো শিল্পকর্ম ক্রয় করতে চাইবেন, তখন আপনার কাছে দুটি সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গা থাকে, হয় কোনো গ্যালারি বা আর্ট কালেক্টরের কাছ থেকে কেনা, নতুবা নিলাম থেকে কেনা। তবে মজার ব্যাপার হলো এই দুই জায়গাতেই বিক্রেতা তার ইচ্ছেমতো দাম দিয়ে কোনো শিল্পকর্ম বিক্রয় করতে পারেন, এমনকি তারা এটাও সিদ্ধান্ত নেন যে কাকে তাদের প্রদর্শনীতে রাখা শিল্পকর্ম বিক্রয় করবেন। এরই এক উদাহারণ হয়ে রয়েছেন হ্যারি পটারখ্যাত অভিনেতা ড্যানিয়েল র‍্যাডক্লিফ। ফ্রিযা আর্ট ফেয়ার থেকে তিনি জিম হজেসের একটি শিল্পকর্ম ক্রয় করতে চাইলে তাকে তা বিক্রয় করা হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়, কারণ তারা আরো মর্যাদাপূর্ণ কারো অপেক্ষায় রয়েছেন।

ড্যানিয়েল র‍্যাডক্লিফ; Source- observer.com

এখন আপনার মনে নিশ্চয় প্রশ্ন আসছে যে এই মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব কারা। বর্তমানে কিছু মুষ্টিমেয় আর্ট গ্যালারি এবং সংগ্রহণকারীদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে শিল্পের বাণিজ্য। তারাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে কোন শিল্প ভালো বা দাম বেশি হওয়া দরকার। এভাবে বর্তমানে শিল্পকে বাণিজ্যের পর্যায়ে নিয়ে ২০১৬ সালে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলারের হাতবদল হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা কিছু অভিজাত ব্যক্তিদের কাছে তাদের সংগ্রহে থাকা শিল্পকর্ম বিক্রয় করতে ইচ্ছা পোষণ করেন, যাতে তারা উচ্চ দামে শিল্পের মূল্য নির্ধারণ করতে পারেন। এই একই কারণে কোনো গ্যালারিতে শিল্পকর্মের নিচে তার মূল্য লেখা থাকে না সাধারণত। এতে করে একজন ব্যবসায়ী তার ক্রেতা হিসেবে তার ইচ্ছানুযায়ী একটি দাম বলে দিতে পারেন। আবার ক্রেতারা যতটুকু না চিন্তা করেন একটি জিনিসের শৈল্পিক মূল্যায়ন নিয়ে, তার চেয়ে বেশি চিন্তা করেন তার ব্র্যান্ড নিয়ে। এরই প্রমাণ দেখা যায় দুজন কিশোরের করা একটি দুষ্টুমির মধ্য দিয়ে।  কেভিন এবং খায়াতান নামে দুজন কিশোর স্যান ফ্র্যান্সিস্কোতে অবস্থিত মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের এক জায়গায় খায়াতানের চশমা রেখে দেয়। তারা ধারণা করেছিলেন, হয়তো এর কারণে অল্প কিছু মানুষের নজরে আসা হবে। তবে অনেককেই দেখা যায় ছবি তুলতে, তার চশমা নিয়ে শৈল্পিক আলোচনায় মত্ত হতে!

মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে চশমা নিয়ে দুষ্টুমির একাংশ; Source: twitter.com

এরকম আরেকটি ঘটনা ঘটে স্কটল্যান্ডের রবার্ট গর্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুজন শিক্ষার্থী এক আর্ট প্রদর্শনীর সময় একটি আনারস এনে রেখে দেন, এই আশায় যে কেউ এটিকে শিল্পকর্ম ভেবে মেনে নেবে। তাদের নিজেদের কাছে অবাক করা মনে হলেও, আসলেই তা-ই হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে এসে তারা দেখতে পান যে তাদের আনারসকে একটি কাচের আবরণে আবদ্ধ করা হয়েছে। তাদের এই শিল্পকর্ম প্রায় এক সপ্তাহ যাবত প্রদর্শনীতে ছিল।

আনারস শিল্প; source- nytimes.com

এসবের মাধ্যমে এটিই বোঝা যাচ্ছে যে বর্তমানে শিল্পের বাণিজ্যে আপনার সামনে যা-ই তুলে ধরা হোক না কেন আপনি সেটি আধুনিক শিল্প বলে মেনে নিচ্ছেন। এমনটাই বললেন রবার্ট গর্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আর্ট প্রফেসর। এত দাম সত্ত্বেও এই বাজার নিয়ে নেই কারো কোনো অভিযোগ। কারণ যে সকল সংগ্রহকারীরা এসব উচ্চ দামে শিল্প ক্রয় করছেন তাদের কেউ চিন্তা করছেন ব্র্যান্ড নিয়ে আবার কেউ উচ্চ মূল্যের শিল্প ক্রয় করেছেন তা বলার জন্য। এক্ষেত্রে সমাজবিদ ডাংকেন ওয়াটস বলেন, সবাই ‘সঙ্গত সুবিধা’র কথা চিন্তা করেন। কোনো কিছু একবার জনপ্রিয় হলে সেটি দিনদিন আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। এর উদাহরণ ধরা যায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ থেকে। ষোড়শ শতাব্দীর এই শিল্পকর্ম বর্তমানে এত জনপ্রিয়তা পেলেও উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তা খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না। এমনকি সেসময়ের অন্যান্য শিল্পী টিটিয়ান এবং রাফায়েলের হিসেবে ভিঞ্চিকে খুব একটা জনপ্রিয় বিবেচনা করা হত না। এরই প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, চুরির প্রায় একদিন হয়ে গেলেও ‘মোনালিসা’ চুরির ঘটনা কেউ উপলব্ধি করেননি। চুরির পরেই নাকি জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করে এই চিত্রশিল্প। তবে এই কাহিনী নাহয় অন্য একদিনের জন্য তোলা থাকুক।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’; source: cnn.com

এসবের ব্যাখ্যা হিসেবে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ শামাস খান বলেন, আমাদের সমাজে কোনো জিনিস ‘ভালো’ তা যতটা না নির্ভর করে শৈল্পিক মূল্যের উপরে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে আমাদের সামাজিক স্ট্যাটাসের উপরে। উনবিংশ শতাব্দীতে উচ্চ মানসিকতা ধরা হতো অপেরা দেখতে যাওয়াকে, বিংশ শতাব্দীতে যা এসে দাঁড়িয়েছে ‘উচ্চ মানসিকতার শিল্প’ খরিদ করা নিয়ে।

সাধারণ এবং অসাধারণ শিল্পের মাঝে মানুষ তার শৈল্পিক মনোভাবই দিন দিন হারিয়ে ফেলছে। সাধারণ জনগণের এর জন্য দেখতে হবে তার আশেপাশে, পড়তে হবে। কে বলতে পারে তার দেখে যাওয়া স্থানের পাশেই হয়ত কোনো অসাধারণ কাজের অস্তিত্ব থাকতেই পারে। এর জন্যই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “শিল্পের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বিকশিত করে, তার বস্তুকে নয়।

ফিচার ইমেজ: Widewalls.ch

Related Articles