বলা হয়ে থাকে ভালোবাসা নিজেই নাকি একটি ভাষা। দেশ, জাতি, গোত্রের যত বিভাজনই থাকুক না কেন, ভালোবাসার ভাষা এমনই সার্বজনীন যে, সকলেই তা বুঝতে পারে। আসলেই কি তা-ই?
আমেরিকান লেখক ডক্টর গ্যারি চ্যাপম্যান কিন্তু তার The Five Love Languages: The Secret to Love that Lasts বইতে বলছেন, ভালোবাসা প্রকাশ এবং অনুভব করার পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা রয়েছে। প্রত্যেক মানুষের এই পাঁচটির মধ্যে একটিই প্রধান ভাষা থাকে, যার মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করলে মানুষটি সবচেয়ে গভীরভাবে সেটি অনুভব করতে পারেন।
চ্যাপম্যান এগুলোকে Love Language বা ভালোবাসার ভাষা বলে অভিহিত করেছেন। সেই ভাষা বা মাধ্যমগুলো হলো- ১. মৌখিক অভিব্যক্তি (words of affirmation), ২. কাজের মাধ্যমে (act of service), ৩. স্পর্শ (physical touch), ৪. গুণগত সময় (quality time), এবং ৫. উপহার পাওয়া (receiving gifts)।
এই পাঁচটির মধ্যে এক বা একাধিক মাধ্যমে একজন মানুষ ভালোবাসা অনুভব করে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ভাষাগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা থাকে না। ফলে ঠিক যেভাবে আমরা সঙ্গীর কাছ থেকে ভালোবাসা পেতে চাই, সেই প্রত্যাশামাফিক সঙ্গীর প্রতি নিজের ভাষাতেই ভালোবাসা প্রকাশ করি।
কিন্তু সঙ্গীর ভাষা ভিন্ন হলে আমাদের এই ভালোবাসা সঙ্গীকে সেভাবে আপ্লুত করতে পারে না। ব্যাপারটি অনেকটা ভিনদেশী কারও সাথে বাংলায় কথা বলার মতো। যেন আমি আমার ভাষায় কথা বলেই যাচ্ছি, কিন্তু তিনি তার একটি অক্ষরও বুঝতে পারছেন না। ফলে সম্পর্কে সৃষ্টি হয় টানাপোড়েন, ভুল বোঝাবুঝি। তাই সম্পর্কে ভাবের সার্থক আদান প্রদানের জন্যে সঙ্গীর এবং নিজের ভালোবাসার ভাষা সম্বন্ধে জানা থাকা ভীষণ দরকার।
মৌখিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে ভালোবাসার প্রকাশ
অনেকের কাছে ভালোবাসার মৌখিক প্রকাশই সর্বাধিক পছন্দের। সঙ্গীর কাছ থেকে পাওয়া প্রেমময় সম্ভাষণ, আন্তরিক প্রশংসা, সমর্থন, সম্মান, সমাদর ও অনুপ্রেরণামূলক কিছু কথা তাদেরকে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ অনুভব করায়। সামনাসামনি বলা, ফোনালাপ, ক্ষুদেবার্তা, চিঠি, কার্ড, ছোট একটি চিরকুট কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে উৎসর্গ করে পোস্ট- এ সবই হতে পারে তার প্রতি আপনার ভালোবাসার বার্তাবাহক।
তবে এসব ক্ষেত্রে মুখস্থ বুলির ব্যবহার পারতপক্ষে করবেন না; ভাষার স্বকীয় ব্যবহারে সচেষ্ট হোন। সেটি খুব কঠিন কিছু নয়, দরকার শুধু চর্চা। যেমন- প্রতিবারই “তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে” না বলে কখনও তার সাজ, কখনও ব্যক্তিত্ব, কখনও পোশাকের রুচিতে মুগ্ধতা প্রকাশ করুন।
আবার সবসময় “আমি তোমাকে ভালোবাসি” বলার চেয়ে খুঁজে বের করুন আপনার জীবনে তার কী কী ইতিবাচক অবদান রয়েছে? একেক সময় একেকটির জন্যে তার প্রতি মন থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। তাকে জানতে দিন জীবনসঙ্গী, মা-বাবা, সন্তান, ভাই-বোন হিসেবে তিনি সফলভাবে যে ভূমিকা পালন করছেন, তা নিয়ে আপনি গর্বিত।
সঙ্গীর প্রতি নিজে কোনো ভুল করে ফেললে ভুল স্বীকার করতেও দেরি করবেন না। কর্মক্ষেত্রে তার বিশেষ কোনো অর্জনের আনন্দে নিজেও শামিল হোন।
আবার সঙ্গী যখন নিজের দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপের কথা আপনাকে জানাচ্ছেন, তখন ধৈর্য্য ধরে তার কথা শুনুন। তাকে মন হালকা করতে দিন। “শান্ত হও, এত দুশ্চিন্তা করার মত কিছুই হয়নি”, “এত চাপ নিয়ে কী হবে, অযথাই অস্থির হচ্ছ”– এমন মন্তব্য করে তাকে থামিয়ে দেওয়া একেবারেই উচিত হবে না।
আবার যেহেতু তারা কথার প্রতি অনেক বেশি গুরুত্ব দেন, সেহেতু তাদের সমালোচনা করার ব্যাপারেও বিশেষভাবে সতর্ক থাকা দরকার। অসচেতনভাবে করে ফেলা একটি আপাত নির্দোষ নেতিবাচক মন্তব্যও তাদের মনে গভীরভাবে দাগ কাটতে পারে। অতএব, সাধু সাবধান।
কাজের মাধ্যমে প্রকাশ
এরা কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। অর্থাৎ এই ধরনের মানুষকে মুখে “ভালোবাসি ভালোবাসি” বলার চেয়ে ব্যালকনিতে তার শখের বাগানের গাছগুলোর যত্ন নিতে তাকে সাহায্য করলে বরং তারা বেশি সমাদৃত অনুভব করবেন।
আপনার সঙ্গীও এই দলের হলে, ঘরের কলিংবেলটি নষ্ট হয়ে গেলে সঙ্গীর অপেক্ষায় না থেকে নিজেই তা সারানোর ব্যবস্থা করুন। ছুটির দিনে অতিথি আপ্যায়নের গুরুদায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে সঙ্গীর ওপর না চাপিয়ে নিজেও কাজে হাত লাগান।
সঙ্গী যখন জরুরি দাপ্তরিক কাজ বা পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, কিংবা যখন তার টানা বিশ্রাম প্রয়োজন, তখন তা যেন নির্বিঘ্ন হয়, সেটি নিশ্চিত করুন। বাজারের কেনাকাটা, রান্না করা, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা, বিল পরিশোধ, সন্তানকে স্কুলে আনা-নেওয়া করা- এমন যেসব কাজের দায়িত্ব সঙ্গীর ঘাড়ে থাকে, মাঝে মাঝে স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেই তা সেরে ফেলুন।
মোদ্দা কথা হলো, তাদের ভাগের দায়িত্বটা মাঝেমধ্যে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে তাকে বিশ্রাম দেওয়া, দৈনন্দিন কাজে তিনি সাহায্য চাওয়ার আগেই তাকে সাহায্য করা, তার খেয়াল রাখা– এগুলোই তার কাছে আপনার দায়িত্ববোধ, যত্নশীলতা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরা দেবে। তবে হ্যাঁ, কাজগুলো করতে হবে আপনার সঙ্গী আপনাকে কাজটি করতে বলার আগেই!
শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে ভালোবাসার প্রকাশ
একে লঘু, অগভীর বা নিছক শরীরকেন্দ্রিক আকর্ষণ ভাবলে ভুল হবে। মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্পর্শ সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে থেকেছে। আবেগের চিরাচরিত বহিঃপ্রকাশ, যেমন- হাত ধরা, চুম্বন ইত্যাদি তো বটেই, হাঁটার সময় সঙ্গীকে ধরে থাকা, প্রতিদিন সঙ্গীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বা ঘরে ফিরে তাকে আলিঙ্গন করা, দুঃসময়ে তার কাঁধে হাত রেখে সহমর্মিতা প্রকাশ করা, সবই শারীরিক সংস্পর্শের অন্তর্ভুক্ত।
ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, সঙ্গীর হৃদ্যতাপূর্ণ স্পর্শ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তা, সন্তুষ্টি ও বিশ্বস্ততার বোধ তৈরি করে, ‘ভালোবাসার হরমোন’ অক্সিটোসিনের নিঃসরণ ঘটায়। ফলে পারস্পরিক বন্ধন আরও জোরালো হয়, ব্যথা ও মানসিক চাপ কমে যায়, এমনকি রক্তচাপ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপরেও তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বোঝাই যাচ্ছে, সম্পর্ক অটুট রাখতে নিয়মিত স্পর্শের ভূমিকা একেবারেই ফেলনা নয়
কাছের মানুষের সান্নিধ্য ও স্পর্শের এত সব উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের স্পর্শের চর্চা আমাদের পরিবারগুলোতে তেমন থাকে না বললেই চলে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা এবং দম্পতির বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তা যেন আরও কমে যায়। ফলে স্পর্শই যাদের ভালোবাসা অনুভবের প্রধান ভাষা, তারা এক্ষেত্রে উপেক্ষিত বা বঞ্চিত অনুভব করতে পারেন। সঙ্গীর এই ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখা দরকার।
গুণগত সময়ের মাধ্যমে ভালোবাসার প্রকাশ
ঘড়ি ধরে লম্বা সময় একসঙ্গে কাটানো এখানে প্রধান বিবেচ্য নয়। বরং বাকি সবকিছু থেকে সাময়িক বিরতি নিয়ে পরস্পরকে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ ও আন্তরিকতাপূর্ণ কিছু সময় উপহার দেওয়াই এখানে মূল লক্ষ্য। ব্যস্ত জীবনের দৌড়ঝাঁপের ফাঁকে ফাঁকে সঙ্গীর সাথে সময় কাটানোর ছোটখাট সুযোগগুলোও হাতছাড়া করা উচিত নয়।
দুজনে মিলে ভোরে জগিংয়ে বেরিয়ে পড়ুন, ঘরে ফিরে একসাথে নাশতা করুন, দিন শেষে কিছু সময় আলাপচারিতায় কাটান, ছুটির দিনে মিলেমিশে ঘর গোছান, বই পড়ুন, গেমস্ খেলুন, পছন্দের সিরিজ দেখুন, পছন্দের কোনো খাবার তৈরি করুন, লম্বা ছুটিতে যান ভ্রমণে; প্যারেন্টিং, আত্মোন্নয়ন, ভাষা শিক্ষা বা এমন যে কোনো প্রশিক্ষণে ভর্তি হয়ে যান। এসবই গুণগত সময় বলে গণ্য হতে পারে।
গুণগত সময় কাটানো যাদের ভালোবাসা অনুভবের প্রধান মাধ্যম, তারা সঙ্গীর কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ না পেলে নিজেকে অবহেলিত বা উপেক্ষিত বোধ করতে পারেন। যৌক্তিক কারণে সঙ্গী বেশি সময় দিতে অপারগ হলে, সেটা যেমন বোঝা প্রয়োজন, তেমনি একজন অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকায় অপরজন যেন বিচ্ছিন্ন বোধ না করেন, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। অতএব, এসব ক্ষেত্রে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে না থেকে পরস্পরের সাথে আলাপ ও বোঝাপড়া করে নেওয়াই উচিত।
উপহারের মাধ্যমে ভালোবাসার প্রকাশ
ভালোবাসা অনুধাবনের এই ধরনটি কারো কারো কাছে স্থূল বা অতিমাত্রায় বৈষয়িক মনে হতে পারে। কিন্তু উপহার যাদের ভালোবাসার ভাষা, তাদের ক্ষেত্রে মূলত উপহারের অর্থমূল্য নয়, উপহারের পেছনের ভাবনাটাই বেশি গুরুত্ববহ। তার সঙ্গী তার মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানোর জন্যে তার পছন্দসই একটি উপহার এনেছেন- এই বোধটুকুই তাকে অভিভূত করবার জন্যে যথেষ্ট।
এরা মূলত এমন কিছু নিদর্শনের প্রত্যাশা করেন, যা তাদের আত্মিক ভালোবাসাকে তুলে ধরে। যত্নে গড়া সম্পর্কটিকে চোখে দেখতে পারলে, ছুঁতে পারলেই যেন তাদের স্বস্তি!
আপনার সঙ্গী যদি উপহারের মাধ্যমে ভালোবাসার প্রকাশ পছন্দ করেন, তাহলে তার কথোপকথন খেয়াল করুন। তিনি কি নতুন কোনো বই কেনার কথা ভাবছেন? তিনি কিনে ফেলার আগে আপনিই বইটি কিনে তার টেবিলে রেখে দিন। সম্পর্কের বর্ষপূর্তিতে আপনাদের প্রথম দেখার দিনের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাটিতে বেড়িয়ে আসুন দু’জনে।
সঙ্গীর প্রিয় ফুল, প্রিয় স্ন্যাকস, পছন্দের শিল্পীর অনুষ্ঠান বা পছন্দের দলের ক্রিকেট ম্যাচ দেখার টিকেট এনে দেওয়া- এমন যেকোনো কিছুই এখানে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ ধরনের মানুষদের কাছে জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, ভালোবাসা দিবস- এ ধরনের উপলক্ষগুলো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাই এই তারিখগুলো মনে রেখে এই দিনগুলোতে সাধ্যমত বিশেষ কিছু আয়োজন করলে সঙ্গীর মনে আপনার স্থান আরও বেশি পাকাপোক্ত হবে।
ডক্টর গ্যারি চ্যাপম্যানের মতে, প্রতিটি মানুষের কাছে একটি কাল্পনিক ভালবাসার পাত্র বা love tank থাকে। সঙ্গীর কাছ থেকে প্রতিনিয়ত ভালোবাসা অনুভব করলে সেই পাত্র ক্রমান্বয়ে পূর্ণ হতে থাকে, দুজনে সদ্ভাব বজায় থাকে। সুতরাং সম্পর্কে সুখময় পরিপূর্ণতা আনতে হলে জানতে হবে ভালবাসার ভাষা, শিখতে হবে সম্পর্কের ব্যাকরণ।