বছর ঘুরে আবার চলে এলো আত্নসংযম এবং আত্নশুদ্ধির পবিত্র মাস মাহে রমজান। প্রতি বছর আরবী নবম মাসে বিশ্বের সমগ্র ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ অত্যন্ত ভক্তি এবং বিশ্বাসের সাথে রোজা পালন করেন। চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল বলে রোজা প্রতি বছর ১১ দিন এগিয়ে আসে এবং ৩৩ বছরে ঋতু একই সময়ে ঘুরে আসে। বছরের ১১ মাস থেকে ভিন্ন এই এক মাস।
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সূর্যোদয়ের আগে থেকে (সেহরি) সূর্যাস্ত পর্যন্ত (ইফতার) সময় খাদ্য ও ইন্দ্রিয়তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার নামই হলো রোজা।
এ মাসে অনেকেই চেষ্টা করেন সবগুলো রোজা রাখতে। আবার অনেক অসুস্থ ব্যক্তিও রোজা রাখার ব্যাপারে আগ্রহ দেখান, কিন্তু বুঝে উঠতে পারেন না যে রোজা রাখা ঠিক হবে কিনা। অনেকে অ্যাসিডিটি বা পেপটিক আলসারের অজুহাত দেখান রোজা রাখতে গিয়ে। আবার অনেকে ঔষুধ খাওয়ার বিড়ম্বনাও প্রকাশ করেন। রোজা নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য-ভাবনার শেষ নেই। কিন্তু সুস্থভাবে রোজা পালনের জন্য দরকার দৃঢ় সংকল্প এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা।
রোজাদারদের খাদ্যভাস এবং জীবনযাত্রায় হঠাৎ করে বেশ পরিবর্তন আসে দীর্ঘ ১১ মাস পরে। পরিবারে যারা নিয়মিত রোজা রাখেন, প্রাপ্তবয়স্ক ও বয়স্ক সকলেরই খাদ্য গ্রহণে এবং স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে এই মাসে।
রমজান মাসে খাবার গ্রহণের দুটি বিশেষ সময় হলো সেহরি এবং ইফতার। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে রমজানে যে খাদ্যাভ্যাস লক্ষ্য করা যায়, তা পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত নয়। সেহরি ও ইফতারের খাবার নির্বাচনে রোজাদারের বয়স ও শারীরিক অবস্থাকে বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রথমেই সেহরি প্রসঙ্গে আসা যাক।
সেহরিতে খাদ্যাভ্যাস
স্বাভাবিকভাবে যেকোনো ধরনের খাবারই সেহরিতে খাওয়া যায়, তবে খেয়াল রাখতে হবে খাবারটা যেন সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত হয়। রোজায় দীর্ঘ সময় উপবাস থাকতে হয় বলে সেহরিতে কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট বা জটিল শর্করা গ্রহণ করা উচিত। এই জটিল শর্করা ধীরগতিতে হজম হয় এবং হজম হতে প্রায় ৮ ঘণ্টা সময় লাগে। ফলে দিনের বেলায় ক্ষুধা কম অনুভূত হয়।
জটিল শর্করাজাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে শস্যদানা বা বীজজাতীয় খাবার, অপরিশোধিত বা ননরিফাইনড আটা, ময়দা এবং ঢেঁকিছাঁটা চাল। ভাত বাঙালির মুখ্য খাবার। তাই সেহরিতে অবশ্যই সাদা ভাত রাখবেন। তবে ভাতের সাথে রাখতে হবে উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার, যেমন- মাছ, মাংস ও ডিম। খরচ কমাতে চাইলে ভাতের সাথে শুধু ডিম ও ডাল। ডাল উদ্ভিজ প্রোটিন বলে এতে ক্ষতিকর চর্বি নেই। সেহরির খাবার তালিকায় যেকোনো একটি সবজি থাকা বাঞ্ছনীয়। পাকস্থলীতে উত্তেজনা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করে- এমন কোনো খাবার খাওয়া উচিত নয় সেহরিতে।
ইফতারে খাদ্যাভ্যাস
লেবুর শরবত শরীরের জন্য খুবই উপকারী। তবে শরবতে কৃত্রিম রঙ মেশাবেন না। এ রঙে থাকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান। বাজারে অনেক কৃত্রিম রঙ মেশানো শরবত পাওয়া যায়, সেসব অবশ্যই পরিহার করবেন।
ইফতারে ফলের রস বেশ উপকারী। এ সময় যেকোনো একটি ফল খাবেন, ফলে থাকে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ, যা আপনাকে স্বাস্থ্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে।
বুট, ছোলা ও মুড়ি খেতে পারেন এ সময়। দই, চিঁড়া ও কলা খেলে ভালো। তবে প্রচলিত বেগুনি ও পেঁয়াজু সর্বদা পরিহার করবেন।
পরিশোধিত শর্করা দ্রুত হজম হয়ে যায় এবং রক্তে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে শরীরকে চাঙ্গা করে তোলে। তাই এ ধরনের খাবার ইফতারে গ্রহণ করা উচিত। এ ধরনের খাবার হজমে সময় নেয় তিন-চার ঘণ্টা। দ্রুত হজম হয় এ ধরনের শর্করাজাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে রিফাইনড ময়দা ও চিনিজাতীয় খাবার।
খেজুর হতে পারে ইফতারের একটি অন্যতম খাবার। খেজুর হচ্ছে চিনি, তন্তু বা ফাইবার, শর্করা, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়ামের উৎস। ইফতারে দু-তিনটা খেজুরই শরীরকে দ্রুত চাঙ্গা করে দিতে পারে, তবে সাথে পানি পান করতে হবে প্রচুর পরিমাণে।
রোজায় ভাজাপোড়া খাবার প্রায় সবারই প্রিয়, কিন্তু এই ভাজাপোড়া জাতীয় ইফতারি গ্রহণের ফলেই অনেক রোজাদার শারীরিক অস্বস্তিতে ভোগেন।
মিষ্টি খাবারের তালিকায় রাখতে পারেন জিলাপী। সারাদিন রোজা শেষে জিলাপী সুগার লেভেল দ্রুত বাড়িয়ে দিবে।
সারদিন উপবাস থাকার কারণে ঝাল খাবারের প্রতি আগ্রহ থাকে রোজাদারদের। সেক্ষেত্রে বাসায় সবজি ও ডিম দিয়ে নুডলস রাখতে পারেন ইফতারীতে যা সারাদিনের খনিজ ও ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করবে।
রোজায় স্বাস্থ্য সচেতনতা
রোজায় সেহরি এবং ইফতারী প্রসঙ্গ ছাড়াও আমাদের কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন
রোজায় দীর্ঘ সময় উপবাসের কারণে শরীরে পানির অনেক চাহিদা থাকে। সেহরী খাওয়ার পর যেন ৩-৪ গ্লাস পানি খেতে পারবেন এমন সময় হাতে রেখে খাবার গ্রহণ করুন। আবার ইফতারী থেকে সেহরী পর্যন্ত ৭-৮ গ্লাস পানি পান করুন। এতে অ্যাসিডিটির সমস্যা হবে না।
তেল চর্বি জাতীয় খাবার ইফতারীতে পরিহার করুন
তেলে ভাজা খাবার স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তা ছাড়া খাবারগুলো পুরনো তেলে ভাজা হলে ক্ষতির পরিমাণটা বেড়ে যায়। তেল বারবার গরম করলে ক্ষতিকর পলিনিউক্লিয়ার হাইড্রোকার্বন তৈরি হয়, যার মধ্যে থাকে বেনজোপাইরিন। এটা ক্যান্সার সৃষ্টি করে। তেলে ভাজা খাবারের পরিবর্তে অনেক ধরনের ফল দিয়ে তৈরী সালাদ গ্রহণ করতে পারেন। এতে হজমশক্তি বৃদ্ধি পাবে।
সেহরীর পর চা/ক্যাফেইন থেকে বিরত থাকুন
সেহরির পর অনেকেই চা পান করে থাকেন। চা অনেক উপকারী- এ কথা প্রায় সবার জানা। কিন্তু চায়ের মধ্যে রয়েছে ক্যাফেইন। এই ক্যাফেইন প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে শরীরে খনিজ লবণ ও পানিস্বল্পতা দেখা দিয়ে থাকে। এই পানিস্বল্পতা রোজাদারের জন্য কাম্য নয়। বরং সেহরির পর কলা খাওয়া যেতে পারে। কলায় রয়েছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম এবং কার্বোহাইড্রেট। তবে কলা কারো কারো ক্ষেত্রে কোষ্ঠকাঠিন্য করে থাকে। সে ক্ষেত্রে আঁশজাতীয় খাবার সাথে খেলে আর কোনো সমস্যা দেখা দেয়ার কথা নয়।
পরিমিত ঘুম
হজমে ঘুম অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যাক্তির প্রতিদিন ৫-৭ ঘন্টা টানা ঘুম প্রয়োজন। এজন্য চেষ্টা করবেন রাতে তারাবীহ্ নামাজের পর দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়ার। অনেকেই রাতে না ঘুমিয়ে একবারে সেহরীর পরে ঘুমাতে যান যা একদমই উচিত নয়। একইসাথে অধিক ঘুম রোজা রেখে খুবই ক্ষতিকর। এতে শরীর অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বদহজম হতে পারে।
সাধারণ অসুখ থাকলে করণীয়
উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের রোজার আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধের মাত্রা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ মেপে দেখা প্রয়োজন যাতে কম বা বেশি রক্তচাপ কোনোটাই না হয় এবং প্রয়োজনে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খেতে হবে। ইনসুলিন যারা নেন, তাদের ইনসুলিন দিয়ে ইফতারের মূল খাবার খাওয়া উচিত। মাঝে মধ্যে রক্তের গ্লুকোজ মেপে দেখবেন।
রোজা রাখা অবস্থায় ওষুধ নেওয়া যাবে কিনা
অসুস্থ রোগীদের জন্য, গর্ভবতী নারী, দুধদানকারী মা, মাসিক স্রাবের সময় রোজার বিষয়ে ধর্মীয় শিথিলতা আছে। সম্ভব হলে রোজার সময় (সেহরি থেকে ইফতার) ওষুধ ব্যবহার না করা উচিত। কিছু ওষুধ আছে; যেমন শ্বাসকষ্টের জন্য ইনহেলার, চোখের ওষুধ ব্যবহারে নিষেধ নেই।
রোজা শুধু আত্মশুদ্ধির মাসই নয়, এ মাস আত্মনিয়ন্ত্রণেরও। নিজেকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত করার মাধ্যমে শরীরে প্রতিষ্ঠিত হয় শৃঙ্খলা। সাথে সাথে সংযম শুধু খাবারে নয় বরং সংযম করতে হবে পঞ্চইন্দ্রিয়ের। তাহলেই আত্নশুদ্ধি হবে, সন্তুষ্টি মিলবে পরুম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর।