শীত কাটুক সুস্থতায়

হিম পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। শীত এই চলেই এলো! খেজুর গুড়, রস, পিঠা, নকশা করা জামা, চাদর আরও কত কিছুতে মিশে থাকে শীত। তবে শুধু কি এগুলোই ভালো ভালো সবকিছু? একদম নয়! শীত মানেই থাকে ঠান্ডা, জ্বর, সর্দির মতো ছোটখাট অসুখ থেকে শুরু করে নিউমোনিয়ার মতো বড় বড় অসুখ বাধিয়ে ফেলার সম্ভাবনাও। তবে আজ এমন কিছু অসুখের কথা জানাবো যেগুলো এতটা বেশি না হয়ে থাকলেও শীতে অনেকেই ভুগে থাকেন এই জটিলতাগুলোয়। চলুন, একবার জেনে নেওয়া যাক সেই অসুখগুলোর নাম আর সমাধানের ব্যাপারে।

শীতকাল মানেই বাড়তি কিছু অসুস্থতার যন্ত্রণাও; Image Source: Newshub

কানের সংক্রমণ

কানে নানারকম সংক্রমণ দেখা দিতে পারে পুরো বছরজুড়েই। তবে শীতে এই সমস্যা খুব মারাত্মক অবস্থায় চলে যেতে পারে। সাধারণত এক্ষেত্রে স্ট্রেপটোককাস নিউমোনিয়া বা হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ব্যাকটেরিয়া কানে প্রদাহ তৈরি করে, আর সেখান থেকেই কানের মাঝখানের অংশে তরল পদার্থ জমা হয়। এছাড়াও শীতে ঠান্ডা, ধূমপান, সাইনাস সংক্রমণ বা আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণেও এমনটা হতে পারে।

লক্ষণ: এই সংক্রমণের বেলায় আক্রান্ত ব্যক্তি কানে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করতে পারেন। সাথে কানে না শোনার মতো ব্যাপারও ঘটতে পারে।

সংক্রমণ থেকে দূরে থাকতে প্রতিদিন কান ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে; Image Source: nyallergy

সমাধান

কানের সংক্রমণ আপনি দূর করতে পারেন খুব সহজেই। এজন্য আপনাকে-

  • প্রতিদিন কান ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। এজন্য পানি দিয়ে কান ধুয়ে ফেলা এবং কটন বাড দিয়ে মুছে ফেলা হতে পারে বেশ কার্যকরী।
  • গোসল বা সাঁতারের পর ভালোভাবে কান শুকিয়ে নিতে হবে।
  • ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • আপনি যদি কোনো টিকা নিয়ে থাকেন সেটার যে মেয়াদ আছে তা নিশ্চিত হতে হবে।
  • আপনার কানের সংক্রমণের কারণ যদি হয়ে থাকে অ্যালার্জি, সেক্ষেত্রে এই অ্যালার্জির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে এবং নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে।
  • প্রাত্যহিক সাধারণ কাজ হিসেবেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।

আর একবার যদি কানের সংক্রমণ হয়েই যায়, সেক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে। সাথে ব্যথার জন্যও চিকিৎসক ওষুধ প্রদান করবেন আপনাকে।

নোরোভাইরাস

বছরের অন্যান্য সময়ে হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শীতে নোরোভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। নোরোভাইরাস আক্রমণ করলে একজন ব্যক্তি ডায়রিয়া, বমিভাব ইত্যাদি সমস্যা অনুভব করতে পারেন।

লক্ষণ: নোরোভাইরাসের সবচেয়ে প্রথম লক্ষণগুলোই হলো বমিভাব, ডায়রিয়া, পেটব্যথা, জ্বর ইত্যাদি। সাথে থাকতে পারে গায়ে হালকা কাঁপুনিও।

সমাধান:

এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করবে এমন কোনো টিকা এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার করা যায়নি। তবে নিজ থেকেই ভাইরাসটি থেকে দূরে থাকতে-

  • হাত পরিষ্কার রাখুন এবং ওরাল হাইজিন মেনে চলুন;
  • ভালোভাবে রান্না করা খাবার গ্রহণ করুন; এবং
  • ঘরের মেঝে নিয়মিত পরিষ্কার করুন।

নোরোভাইরাস যদি হয়ে যায় সেক্ষেত্রে কিছুদিন পরেই সেটা ঠিক হয়ে যাবে। তবে এই সময়ে চিকিৎসক আপনাকে সুস্থ থাকার জন্য ডায়রিয়ার কিছু ওষুধ সেবন করার পরামর্শ দিতে পারেন।

স্ট্রেপ থ্রোট

স্ট্রেপ্টোককাস ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে স্ট্রেপ থ্রোট তৈরি হয়। একইসাথে গলা আর টনসিল দুটোকেই আক্রান্ত করে এই অসুখ। ৫-১৫ বছর বয়সীদের ঠান্ডা সংক্রান্ত কারণে এমনটা বেশি হয়ে থাকে। তাই সংক্রমণ দূর করার জন্য শিশুদের বিশেষ করে এই সময়েই প্রয়োজন হয় বাড়তি যত্নের।

লক্ষণ: স্ট্রেপ থ্রোট অসুখ হলে প্রথমেই গলায় খুব ধারালো একটা ব্যথা অনুভব করবেন আপনি। সাথে থাকতে পারে জ্বর, মাথাব্যথা, সর্দি, বমিভাব ইত্যাদি।

একইসাথে গলা আর টনসিল দুটোই আক্রান্ত করে এই অসুখ; Image Source: Wellbeing Nutrition

সমাধান

স্ট্রেপ থ্রোট সমস্যার সমাধানে খেয়াল রাখুন যেন-

  • শীতকালে গরম পানি পান করা হয়,
  • পর্যাপ্ত পানি পান করা হয়,
  • নিয়মিত হাত ধোয়া হয়,
  • নিয়মিত পানি দিয়ে গার্গল করা হয়, এবং
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া হয়।

স্ট্রেপ থ্রোট হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে আপনাকে এন্টিবায়োটিক প্রদান করা হতে পারে। সাথে জ্বর ও ব্যথার জন্য ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন চিকিৎসকেরা।

কোল্ড অ্যাগ্লুটিনিন ডিজিজ

সিএডি বা কোল্ড অ্যাগ্লুটিনিন ডিজিজ একজন মানুষের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে আক্রান্ত করে। এতে করে লোহিত রক্তকণিকা নষ্ট হয়ে যায় খুব দ্রুতই। ঠান্ডার মাধ্যমে অবস্থাটি তৈরি হলেও এর প্রভাবে মাথা ঘোরা থেকে শুরু করে হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে। খুব কম সংখ্যক হলেও প্রতি ৩,০০,০০০ জন মানুষের মধ্যে একজনের কোল্ড অ্যাগ্লুটিনিন হয়ে থাকে।

লক্ষণ: এই রোগাক্রান্তদের মধ্যে মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, পা-পিঠ ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা, হলুদাভ বা সাদাটে ত্বক, বমিভাব, বুকে ব্যথা, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা, কানে শব্দ হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

সমাধান

আপনার শারীরিক অবস্থা কেমন তার উপর নির্ভর করে ঠিক কেমন চিকিৎসা প্রয়োজন। সরাসরি সিএডি হতে পারে, আবার অন্য কোনো সমস্যার ফলাফল হিসেবেও এই অসুখ হতে পারে। কোনো কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে সেটা নিশ্চিত করা গেলে চিকিৎসক ওষুধ, ব্লাড ফিল্টারিং ইত্যাদি করে দেখতে পারেন।

ইকথিয়োসাস

ইকথিয়োসাস ভালগারিস নামক এই অসুখ সম্পূর্ণ ত্বকের। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক মাছের আঁশের মতো হয়ে যায়। মূলত, মরা চামড়া অনেক বেশি জমা হয়ে ত্বকে এমন অবয়ব তৈরি করে, শীতকালে যার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়।

ইকথিয়োসাসে আক্রান্তদের জন্য শীতকালে প্রয়োজন হয় বিশেষ যত্নের; Image Source: Tamil Culture

অনেকের শুধু হাত বা পায়ে হলেও, অনেকের পেট, পিঠ, বাহুসহ শরীরের অন্যান্য স্থানেও এই রোগ দেখতে পাওয়া যায়।

লক্ষণ

  • খসখসে ত্বক
  • চুলকানি
  • মাছের মতো আকৃতির চামড়া
  • শুষ্ক ত্বক
  • মোটা ত্বক

সমাধান

ইকথিয়োসাস দূর করতে আপনি ঘরে বসেই বেশ কিছু সমাধান পাওয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। অলিভ অয়েল এজন্য বেশ ভালো কাজ করতে পারে। তবে এছাড়াও চিকিৎসকের কথানুসারে ল্যাক্টিক এসিড বা রেটিনয়েড ব্যবহার করতে পারেন।

শীত এলে শুধু উপরের অসুস্থতাগুলোই নয়, দেখা দেয় আরও নানাবিধ শারীরিক সমস্যা। এই সবগুলো সমস্যাকে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করতে নিচের ব্যাপারগুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন:

১। শীতকালের ঠান্ডা আর খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়া দিনে অনেকেই শরীরচর্চা ছেড়ে দেন। সেক্ষেত্রে দেখা দেয় অনেক নতুন অসুস্থতা। শরীর হয়ে যায় রোগপ্রতিরোধে দূর্বল। তাই অবশ্যই শীতকালে শরীরচর্চা ছেড়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। খুব বেশি ভারী শরীরচর্চা না করলেও হাঁটাহাঁটির অভ্যাস বজায় রাখুন।

২। যেকোনো অসুখ দূরে রাখতে চিকিৎসকেরা বার বার হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার কথা বলেন। শীতে এই অভ্যাসই আপনাকে অনেক সমস্যা থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে।

৩। খাবারে এবং এর বাইরে প্রতিদিন কিছু পরিমাণে ভিটামিন সি গ্রহণ করুন। আপনার শরীর সেক্ষেত্রে অসুখের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবে আরও শক্তিশালীভাবে।

৪। মেডিটেশন শীতকালীন জড়তা, উদ্বিগ্নতা, মানসিক চাপ ইত্যাদি থেকে দূরে রাখে। তাই শীতকালেও মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে মেডিটেশন অনুশীলন করুন।

শীত, গ্রীষ্ম বা যেকোনো ঋতুরই রয়েছে ইতিবাচক, আনন্দময় কিছু দিক। তবে এসবের কোনোটাই উপভোগ করা সম্ভব হবে না যদি আপনি সুস্থ না থাকেন। তাই এই শীতে সুস্থ থাকতে ছোট্ট কিছু নিয়ম মেনে চলুন আর ভালো থাকুন পুরো শীতকাল।

Related Articles

Exit mobile version