এই পৃথিবীতে শিকারী প্রাণীর সংখ্যা খুব একটা কম নয়। যে পাখি আকাশে উড়ে বেড়ায়, সে-ও শিকার করে। স্থলে থাকা জন্তুদের নানা কৌশল অবলম্বন করে শিকার ধরতে হয়। জলের প্রাণীরাও বাঁচার জন্য শিকারের খোঁজে বেড়িয়ে পড়ে। স্থলে-জলে-অন্তরীক্ষে সব প্রাণীর মধ্যে যারা যত শক্তিশালী ও বুদ্ধির ধার রাখে, সে শিকার ধরায় ততো কৌশলী। একেক প্রাণীর শিকার ধরার কৌশলেও ভিন্নতা রয়েছে। তেমনি কিছু শিকারী প্রাণীর শিকার করার নানা কৌশল প্রক্রিয়ার গল্প শোনাবো আজ।
পশুরাজ সিংহ
সিংহ যখন শিকার করে, তখন সেখানে পশুরাজ সিংহের চেয়ে সিংহীর ভূমিকায় থাকে সবচেয়ে বেশি। বলতে গেলে, সমস্ত শিকারই ধরে সিংহী। রাতের অন্ধকারই তার শিকার ধরার উপযুক্ত সময়। সিংহেরা যখন দৌড়ায়, তখন তারা যেতে পারে ঘন্টায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন কিলোমিটার বেগে। তবে তা একটানা নয়। আর তাই দৌড়ে হরিণের নাগাল পাওয়া সিংহের পক্ষে সম্ভব হয় না।
এজন্য রাতের অন্ধকারে ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তাদের শ্রবণেন্দ্রিয় বেশ তীব্র এবং অল্প আলোতেও সিংহীরা দেখতে পারায় শিকার ধরতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। সাধারণত সিংহীরা শিকার করে রাতের বেলায় দল বেধে। দল বেধে শিকারের সময় সহজে যে ফল পাওয়া যায়, একার বেলায় তেমনটি হয় না। দলে যখন অনেক সিংহী, তখন শিকার একেবারে অসহায়। পাঁচ সিংহ পাঁচ দিক থেকে আক্রমণ করে।
এক সিংহের তাড়া খেয়ে শিকার যখন উল্টো দিকে দৌড় শুরু করে, তখন সে পড়ে গেলো অন্য সিংহের একবারে সামনাসামনি। তৃতীয় দিকে ছুটতে আরম্ভ করলে, দেখা গেলো সেখানে ওৎ পেতে রয়েছে আরেক সিংহ। কতক্ষণ আর এভাবে বাঁচানো চলে নিজেকে। অবশেষে সিংহের থাবায় একেবারে লুটিয়ে পড়ে শিকার হওয়া প্রাণীটি।
বাঘ
বাঘ প্রায় সবসময় শিকারের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে একবারে পেছন থেকে এসে। চারপেয়ে খুরওয়ালা হরিণের মতো কোনো প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে আর ঘাস খাচ্ছে, বাঘের প্রথম লক্ষ্য হলো শিকারের গলা বা ঘাড়। তারপর সুযোগ বুঝে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে সামনের একটা পা তুলে, লেজ খাড়া করে দাঁড়ায় শেষ ঝাঁপ দেওয়ার আগে।
লেজ একটু একটু দোলাতে থাকে যাতে টাল সামলাতে অসুবিধে না হয়। এরপর বড় লাফ মেরে শিকারের ওপর গিয়ে পড়ে। অনেক সময় এই ঝাঁপেই শিকারের ঘাড়ে গিয়ে থাবা বসায় বাঘ আর সাথে সাথে গলা বা ঘাড়ের কাছে জোরে কামড়ে ধরে। আচমকা ধাক্কায় শিকার একদম কুপোকাত। মাথা ঝুঁকে পড়ে, ঘাড় মটকে যায়। পালানো তো দূরের কথা, দেখতে দেখতে শিকার মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে।
হায়েনা
হায়েনাদের অখাদ্য কিছু নেই। অন্যের শিকার করা খাদ্যের যা কিছু অবশিষ্ট, আর উচ্ছিষ্ট, হায়েনা তা দিয়েই নিজের উদরপূর্তি করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় একধরনের হায়নার বাস আছে, এদের বলা হয় চিতা হায়েনা। এরা প্রকৃত অর্থেই শিকারী। এই হায়েনারা থাকে দল বেধে। একেক দলে হায়েনার সংখ্যা শ’খানেকও হতে পারে। শিকার ধরায় এদের দারুণ ক্ষমতা। এরা যখন কোনো প্রাণীকে তাড়া করে, তখন কেমন করে তাদের বাগে নিয়ে আসে, তা এক দেখবার বিষয়।
এক দঙ্গল বাছুর চরে বেড়াচ্ছে মাঠে। হায়েনারা সবগুলোর দিকে না তাকিয়ে একটাকে বেছে নেয়। কেউ চললো সোজা শিকারের পেছনে। কিন্তু শিকার যদি ডানে-বামে সরে যায়, সেজন্য কোনে কোনো হায়েনা ধেয়ে গেল বাঁ দিক ধরে, কেউ আবার ডানদিকে। শীঘ্রই শিকার হায়েনার ফাঁদে ধরা পড়ে। হায়েনার চোয়ালের জোর খুব। তাই শিকারের ছাল-চামড়া ছাড়াতে তাদের বেশি সময় লাগে না।
কুমির
কুমির যখন শিকার ধরে তখন সে আস্তে আস্তে জীবটির দিকে এগিয়ে আসে। ধরা যাক, জল পান করতে একদল হরিণ নদীর কাছে এসেছে। সব জায়গা জল খাওয়ার উপযুক্ত নয়। কিন্তু যে জায়গা জল পান করার পক্ষে উপযুক্ত, সেই জায়গাটা সবাই পছন্দ করে, কুমির তার খবর রাখে।
এরকম একটা জায়গার খুব কাছাকাছি ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে থাকে কুমির। জলের ঠিক তলায় তার শরীরটি, জলের উপরে শুধু নাক আর চোখ দেখা যায়। শিকারের নজরে আসে না। যেই না হরিণ জল পান করতে আরম্ভ করে, অমনি কুমির আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে ধাঁ করে হরিণের একটি পা বা মুখটা কামড়ে ধরে। দলে থাকা অন্যান্য হরিণগুলো তখন টেনে দৌড় দেয়, কিন্তু কুমিরের শিকার হয়ে গেলো একজন।
ঈগল
ঈগল তার চওড়া ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়ায়। একেকটা অঞ্চল দেখতে দেখতে উড়ে চলে কোথায় তার শিকার আছে। যত রকম ঈগল পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া যায়, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় শিকারী ঈগল হচ্ছে স্বর্ণ ঈগল। ঘন জঙ্গলে, পাহাড়ি অঞ্চলে এদের দেখতে পাওয়া যায়। আকারে বড়, দেখতেও সুন্দর। লম্বায় প্রায় এক মিটার। স্বর্ণ ঈগল নানারকম শিকার ধরে খায়। ছোট ফড়িং যেমন এরা ধরে খায়, তেমনি তিমি মাছের মাংসেও এদের অরুচি নেই। তবে সাধারণভাবে খরগোশ, ইঁদুর ও নানা ধরনের ছোট ছোট পাখি ধরতে এরা ভালবাসে।
ডানা মেলে উড়বার সময় ঈগল যখন কোনো শিকার দেখে, মাথা নিচু করে তখন সে খুব দ্রুত খাড়া নিচে নেমে আসে। শিকার কিছু বুঝে উঠার আগে ঈগল তাকে ধরে ফেলে। যারা পশুপাখির নানা বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের মতে, ঈগলের দৃষ্টির জোর মানুষের চেয়েও আটগুন বেশি। তাই ১,৬০০ ফুট উপরে থেকেও ঈগল তার শিকার দেখতে পায়।
মাছরাঙা
মাছ শিকারে এ পাখির জুড়ি মেলা ভার। পুকুরপাড়ে কোনো গাছে বা ছোটখাট কোনো জলাশয়ের ধারে বাঁশ বা খুঁটির ডগায় মাছরাঙা এসে বসে মাছ ধরার আশায়। মাথাটা একদিকে একটু কাত, এক চোখ জলের উপরে। খানিক বাদে মাথা ঘুরিয়ে অন্য চোখ আবার জলে মাছ খুঁজতে থাকে। তারপর যেই মাছ দেখতে পায়, অমনি ত্বরিত গতিতে জলে নেমে মাছ শিকার করে মাছরাঙা।
জলের বাধাটা জোরালো হলে অসুবিধে হয় মাছরাঙার। সেজন্য নিজের শরীরটাাকে টান টান করে সে মুহূর্তের মধ্যে বাসা ছেড়ে জলের মধ্যে নেমে আসে। জলে ঠিক ঝাপানোর সময়ে ডানা বন্ধ, কিন্তু জলের ভিতরে আবার তা খুলে যায়, আর মাছরাঙা ঠোঁট খোলা রেখে তার শিকার ধরে ফেলে। তারপর জল ছেড়ে সে আবার বসবার জায়গাটাতে ফিরে আসে। গাছের ডাল বা বসার জন্য বাঁশের খুটি জলের খুব কাছাকাছি হয়, তাহলে সমস্ত ব্যাপারটা ঘটে যায় চোখের পলকে।
পেঁচা
উড়ে বেড়ানো প্রাণীদের মধ্যে রাতের অন্ধকারে শিকার ধরে এমন প্রাণীদের মধ্যে পেঁচা ও বাদুড় অন্যতম। পেঁচা যেন অনেকটা ডানা লাগানো বেড়ালের মতো। অন্ধকার রাতে যেমন বিড়ালের চোখ জ্বলে, তেমনি পেঁচারও। অনেক জাতেরই পেঁচা আছে এবং এদের মধ্যে বেশিরভাগ পেঁচাই শিকার করে রাতের অন্ধকারে। চারদিকে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না, এমন রাতে পেঁচা ঠিক ভালভাবে নিজের শিকার ধরতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে পেঁচার চোখ এমনি যে, মানুষের চোখে অন্ধকারে যতটা দেখতে পারে, পেঁচা দেখতে পায় তার চেয়ে প্রায় একশো গুন ভাল। পেঁচার কানও খুব সজাগ। মাটিতে কোনো ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে, সামান্য শব্দ হলো, সাথে সাথে পেঁচা বুঝতে পারে। পেঁচার দুটো কান একইসাথে শব্দটা শুনতে পারে না। যে কানের দিকে শব্দটা আসছে, সেই কান শব্দটা পাবে আগে। কাছের কান অন্য কানের চেয়ে এই শব্দটা শুনতে পারে সেকেন্ডের সামান্য এক ভগ্নাংশেরও আগে। কিন্তু এই সামান্য সময়ের হেরফেরেই পেঁচা বুঝতে পারে কোনদিক থেকে শব্দটা আসছে। এবার তার চোখের খেলা। কিন্তু শব্দ যদি চলে কিছুক্ষণ ধরে, তাহলে চোখের বদলে শিকার ধরায় কানই আসল ভূমিকা নিয়ে নেয়।
পিরানহা
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন আর সানফ্রানসিস্কো নদীতে এই মাছের বাস। পৃথিবীতে প্রায় ১৮ রকম প্রজাতির পিরানহা আছে, তার মধ্যে চারটি প্রজাতি মারাত্মক হিংস্র। অধিকাংশ পিরানহা মাছই সর্বভূক।
বেশিরভাগ পিরানহা শিকারের পূর্বমুহূর্তে আতঙ্ক জাগানোর চেষ্টা করে। তাই পিরানহা চোয়ালের সাহায্যে খটখট শব্দ করতে থাকে। তারপর শিকারের শরীর থেকে মাংস নিয়ে তা পানিতে চুবিয়ে খেতে থাকে। পিরানহার নিচের চোয়ালের পেশিগুলো মারাত্মক শক্ত; সেখানে লম্বাটে, ছুঁচলো দাঁতের সারি। সেই দাঁত মাংসে প্রায় ব্লেডের মতো কেটে বসে। ওপরের চোয়ালের দাঁতগুলো নিচের চোয়ালের থেকে একটু ছোট। আর তাই শিকার ধরতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না তাকে।
ফিচার ইমেজ- YouTube.com