Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মায়ানমারের জিরাফ নারীগণ

দৃশ্যটি খুবই অদ্ভুত। জিরাফের মতো অস্বাভাবিক রকমের লম্বা গলাবিশিষ্ট একদল নারীর কাঁধের উপর থেকে চিবুকের নিচ পর্যন্ত গলার চারপাশে পেঁচানো আছে ২০-২৫টি পিতলের চক্রাকার বলয়। দেখলে মনে হয়, তাদের শরীর এবং মাথার মধ্যে যেন কোনো সংযোগ নেই, মাথাটা বুঝি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পিতলের রিংয়ের তৈরি ভিত্তির উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। অথচ এই ভাসমান গলা নিয়েই তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই হাঁটা চলা করছে, দৈনন্দিন কাজকর্ম করে যাচ্ছে। মায়ানমার এবং থাইল্যান্ডের কিছু অঞ্চলে এটি অত্যন্ত পরিচিত একটি দৃশ্য। মায়ানমারের কায়াহ উপজাতির এই নারীদের পরিচয় ‘লম্বা গলা বিশিষ্ট নারী’ বা ‘জিরাফ নারী’ হিসেবে।

কায়ান জিরাফ নারী; Source: wetraveltolive.com

জিরাফ নারীরা প্রধানত মায়ানমারের কায়ান লাহুই গোত্রের সদস্য। একটা সময় প্রায় প্রতিটি কায়ান লাহুই পরিবারের অন্তত একটি করে মেয়ে রিং পরিধান করে গলা লম্বা করার ঐতিহ্য বজায় রাখত। কায়ান লাহুই গোত্রটি পূর্ব মায়ানমারের কায়াহ প্রদেশে বসবাসকারী কায়াহ আদিবাসীদের একটি গোত্র। কায়ান লাহুইরা স্থানীয়ভাবে পাদাউং নামেও পরিচিত। স্থানীয় ‘শান’ ভাষায় পাদাউং শব্দটির অর্থ লম্বা গলা। রিং পরিহিত অবস্থায় এদের গলা ১ ফুট বা তার চেয়েও বেশি লম্বা মনে হতে পারে।

দেখতে রিং বা বলয়ের মতো হলেও কায়ানদের পরিধান করা ধাতব অলঙ্কারগুলো আসলে পৃথক পৃথক রিং বা বলয় না, বরং পেঁচানো কুণ্ডলী। এগুলো নির্মিত হয় প্রধানত পিতল এবং সামান্য কিছু স্বর্ণের মিশ্রণে তৈরি সংকর ধাতু দ্বারা। কুণ্ডলীর এক পাকের ওজন ২৫০ থেকে ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। এগুলো কায়ানদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির পাশাপাশি নারীদের সৌন্দর্য, তাদের পরিবারের সামাজিক মর্যাদা এবং বিত্ত-বৈভবের পরিচয়ও বহন করে।

কায়ান জিরাফ নারী; Source: Wikimedia Commons

কায়ান নারীদের পরিহিত রিংগুলোকে দেখতে পৃথক পৃথক ২০-২৫টি রিংয়ের মতো মনে হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো ৩টি থেকে ৫টি কুন্ডলির সমন্বয়ে তৈরি হয়ে থাকে। সোজা পিতলের দণ্ডকে কুণ্ডলী পাকিয়ে বিভিন্ন বয়সে পর্যায়ক্রমে গলার চারপাশে পরিয়ে দেওয়া হয়। কুণ্ডলীগুলো হাতেই পরানো হয় বলে এতে প্রচুর সময় ব্যয় হয় এবং অত্যন্ত দক্ষ কারিগর প্রয়োজন হয়। ফলে একবার পরানোর পর সেগুলো বছরের পর বছর ধরে আর খোলা হয় না। কেবলমাত্র পুরনো কুণ্ডলী পাল্টে নতুন এবং বড় আকৃতির কুণ্ডলী প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হলেই তা খোলা হয়।

সাধারণত ৪-৫ বছর বয়সেই কায়ান মেয়েদেরকে প্রথম পিতলের কুণ্ডলী পরানো হয়। প্রথমে ১ কিলোগ্রাম ওজনের কুণ্ডলী পরানো হয়, এরপর ধীরে ধীরে ওজন বাড়ানো হয়। ৮ বছর বয়সে দ্বিতীয় কেজি এবং ১২ বছর বয়সে তৃতীয় কেজি কুণ্ডলী যুক্ত করা হয়। এরপরেও যদি গলায় জায়গা থাকে, তাহলে ১৫ বছর বয়সে আরো ২ কেজি ওজনের কুণ্ডলী যোগ করা হয়। অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারীই ৫ কেজি ওজনের কুণ্ডলী পরে থাকে। তবে ১০ কেজি ওজনের কুণ্ডলী দেখা গেছে।

একটিমাত্র কুণ্ডলী পরে আছে কায়ান শিশু @ Paula Bronstein / Getty Images

পিতলের কুণ্ডলীগুলো অবশ্য প্রকৃতপক্ষে গলা লম্বা করতে পারে না। থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া কায়ান শরণার্থী নারীদের গলা এক্সরে করে ডাক্তাররা দেখতে পান, দীর্ঘদিন ধরে রিং পরলেও তাদের গলার হাড়ের দৈর্ঘ্য বা হাড়গুলোর মধ্যবর্তী ব্যবধানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং কুণ্ডলীগুলোর চাপে তাদের বুকের খাঁচা এবং কাঁধ কিছুটা নিচের দিকে বসে যাওয়ার কারণেই তাদের গলাকে লম্বা বলে ভ্রম হয়। গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা গলার নারীও একজন কায়ান, যার গলার দৈর্ঘ্য ১৫.৭৫ ইঞ্চি

দীর্ঘদিন ধরে পিতলের কুণ্ডলী দ্বারা গলা আবৃত থাকার কারণে কায়ান নারীদের গলার চামড়া বিবর্ণ হয়ে যায় এবং পেশীগুলো দুর্বল হয়ে যায়। যারা সর্বোচ্চ সংখ্যক রিংয়ের কুণ্ডলী পরিধান করে, তাদের চিবুক প্রায় সময়ই রিং স্পর্শ করে থাকে। বছরের পর বছর ধরে মাথার ভার রিংয়ের উপর ন্যস্ত থাকায় তাদের গলা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে একটা বয়সের পরে যখন কোনো নারী তার গলার কুণ্ডলী খুলে ফেলে, তখন প্রথম কয়েক দিন তার প্রচন্ড অস্বস্তি হয়। যদিও সময়ের সাথে সাথে তা সহ্য হয়ে যায়।

রাতে ঘুমানোর সময়ও রিং পরে থাকে কায়ান নারীরা @ Harlibgue Roger Viollet / Getty Images

কুণ্ডলী পরিধান করা অবস্থায় কায়ান নারীরা প্রায় সব ধরনের কাজকর্মই করতে পারে। তাদের চলাফেরায় এটা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। অবশ্য মাথা খুব বেশি পরিমাণে ঝোঁকাতে না পারায় খাবার খেতে, বিশেষ করে তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে তাদের কিছুটা অসুবিধা হয়। সে কারণে অনেকেই পাইপের সাহায্যে পানি পান করে থাকে। ব্রিটিশ সাংবাদিক জে. জি. স্কটের ভাষায়, কুণ্ডলী পরা মেয়েরা যখন কথা বলে, তখন মনে হয় যেন তারা কুয়ার তলদেশ থেকে বলছে।

গলা লম্বা করার এই সংস্কৃতি কায়ানদের মধ্যে কোথা থেকে এসেছে, সেটা নিয়ে পরিষ্কার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সাধারণ কায়ানরা নিজেরাও এর উৎপত্তি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানে না। কায়ান নারীদের অধিকাংশই তাদের মা এবং দাদীদের ধারাবাহিকতায় এই সংস্কৃতি পালন করে থাকে। তাদের অনেকেই এটাকে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে দেখে।

এক বিদেশী পর্যটককে পিতলের কুণ্ডলী পরিয়ে দিচ্ছে কায়ানরা @ Thierry Falise / LightRocket / Getty Images

তবে অনেক সাংবাদিক এবং গবেষকের বর্ণনায় এর উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কায়ানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, তারা ড্রাগনের বংশধর। তারা মনে করে, অতীতে কোনো এক সময় এক নারী ড্রাগনের সাথে স্বর্গীয় দূতের মিলনের ফলে তাদের বংশের আদি পুরুষদের জন্ম হয়েছে। অনেকের মতে, সেই লম্বা গলা বিশিষ্ট আদি মাতা ড্রাগনের সম্মানার্থেই কায়ান নারীদের মধ্যে গলা লম্বা করার সংস্কৃতির প্রচলন হয়েছিল।

ভিন্নমতও অবশ্য আছে। কেউ কেউ দাবি করেন, এই রিংগুলো পরার প্রচলন হয়েছিল বাঘের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য। বাঘ সাধারণত গলায় বা ঘাড়ে কামড় দেয় বলেই তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য গলায় ধাতব রিং পরা হতো। আবার কারো মতে, প্রাচীনকালে গলায় রিং পরিয়ে মেয়েদেরকে অনাকর্ষণীয় করে রাখা হতো, যেন তারা পার্শ্ববর্তী গোত্রের পুরুষদের নজরে না পড়ে। অবশ্য পরবর্তীতে এই রিং পরাটাই সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ব্রিটেনে কার্ড খেলছে তিনজন কায়ান নারী @ Keystone / Getty Images

কায়ান নারীদের শত শত বছরের এই ঐতিহ্য অবশ্য এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে মায়ানমারের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোও আধুনিকতার ছোঁয়া পৌঁছে গেছে। সৌন্দর্যের সংজ্ঞাও তাই অনেকটা পাল্টে গেছে। গত কয়েক দশকে অনেক নারীই তাদের রিং বিসর্জন দিয়েছে। তারা এই রিংকে অপ্রয়োজনীয়, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং নারী স্বাধীনতার অন্তরায় হিসেবে দেখছে। গত শতকে যেখানে শুধুমাত্র কায়াহ প্রদেশেই ৩০০ থেকে ৪০০ জিরাফ নারী ছিল, সেখানে বর্তমানে সমগ্র মায়ানমারে এদের সংখ্যা ১০০ এর চেয়েও কম।

তবে তা সত্ত্বেও এখনও অনেক কায়ান নারীই এই সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে আছে। এদের মধ্যে যারা বয়স্ক, তারাই শুধু সত্যিকার অর্থে ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে ধারণের উদ্দেশ্যে এখনও রিং বিসর্জন দেয়নি। কিন্তু এর বাইরে একটি বড় অংশ আছে, যারা এখনও এই সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে রেখেছে শুধুমাত্র জীবিকা উপার্জনের স্বার্থে

পর্যটকের সাথে এক কায়ান নারী; Source: matadornetwork.com

কায়ান নারীদের অদ্ভুত দর্শনের এই ফ্যাশন বিদেশী পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তাই মায়ানমারে এবং পার্শ্ববর্তী থাইল্যান্ডে এই নারীদেরকে পর্যটকদের সামনে প্রদর্শন একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। মায়ানমারের গৃহযুদ্ধে সেখানকার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য অনেক কায়ান উপজাতিই পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। থাইল্যান্ডের সরকার তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে একটি পর্যটন কেন্দ্রিক গ্রামে, যেখানে এই নারীদেরকে দেখতে যাওয়া পর্যটকদের কাছ থেকে প্রবেশমূল্য হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে কর্তৃপক্ষ।

তবে শুধু প্রবেশমূল্য না, পর্যটকদের কাছে হস্তনির্মিত বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করেও কায়ানরা বেশ ভালো উপার্জন করতে পারে। যেখানে অন্যান্য গোত্রের শরণার্থীদেরকে সম্পূর্ণই ভাতার উপর নির্ভর করতে হয়, সেখানে কায়ানরা তাদের এই সংস্কৃতিকে ব্যবসায় রূপ দিয়ে বেশ স্বচ্ছলভাবেই জীবন ধারণ করতে পারছে। কিন্তু এই পর্যটনশিল্প একই সাথে প্রচন্ড সমালোচনার মুখেও পড়ছে। জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ধরনের নারীদেরকে মানব চিড়িয়াখানায় বন্দী হিসেবে বর্ণনা করেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া আর অধিকার সচেতনতার সাথে জীবিকার তাগিদ এবং ঐতিহ্য রক্ষার তাড়নার মধ্যকার দ্বন্দ্বে এই অদ্ভুত সংস্কৃতি কতদিন পৃথিবীর বুকে টিকে থাকবে, সেটাই এক বিরাট প্রশ্ন।

ফিচার ইমেজ- atlasofhumanity.con

Related Articles