দেখতে দেখতে শীত প্রায় এসেই গেলো। তাই বলে কি রোদের তেজ কমেছে? নাকি সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পর থেকেই সকলকে পোড়াতে থাকে কড়া রোদ? রোদের কারণে কিন্তু কোনো কাজই থেমে থাকে না। রাস্তায়, বাসে যানবাহন, ধোঁয়া, দূষণ আর মানুষের ভিড় পার করে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত আর বাজার-ঘাটে সমানে চলতে থাকে যাওয়া-আসা। এই ছোটাছুটিতে আপনার ত্বকও প্রচুর ধকল সহ্য করে। বিশেষ করে সূর্যের কড়া রোদে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি।
রোদে পোড়া ত্বক বুড়িয়ে যায় খুবই তাড়াতাড়ি। হারিয়ে যায় ত্বকের মসৃণতা ও স্বাভাবিক সৌন্দর্য। সূর্যের রশ্মির প্রভাবে ত্বকের উজ্জ্বলতা মলিন হয়ে যায় খুব দ্রুতই। অনেকেই মনে করেন, শুধু ফর্সা ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয় সূর্যের তাপে। কিন্তু তা কখনোই সত্য নয়। সকল ধরনের ত্বকই গনগনে রোদের মধ্যে পড়ে দারুণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। উজ্জ্বল ত্বকে তা ধরা পড়ে খুব দ্রুত। শ্যামলা ত্বকেও কিছুদিনের মধ্যে দেখা যায় স্থানে স্থানে অসম রঙের ছাপ। এসব ক্ষতিকর সূর্যালোকের প্রভাবেই ঘটে থাকে। আর শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় মুখের ত্বক সূর্যালোকের প্রতি অনেক বেশি সংবেদনশীল। মুখের শতকরা ৯০ ভাগ বলিরেখা, অতিরিক্ত ভাঁজ এবং মুখের বিভিন্ন স্থানে ছোপ ছোপ বাদামি বা কালচে দাগ সূর্যের তাপের প্রভাবেই হয় এবং এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এ তো গেলো ত্বকের সৌন্দর্যের ক্ষতির কথা। এখন বলা যাক ত্বকের স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে। সকল বর্ণের ত্বকই ক্যান্সারের হুমকিতে থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ স্কিন ক্যন্সার সূর্যালোকের প্রভাবে এবং ২০ বছরের কম সময়েই সৃষ্টি হওয়া শুরু হয়। পাশাপাশি সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির কারণে মাথার ত্বকে দেখা যেতে পারে ‘মেলানোমা’র উপস্থিতি, এই মেলানোমাই কম ও মধ্য বয়ষ্ক মানুষদের বেশিরভাগ ক্যান্সারের জন্য দায়ী। ক্যান্সার ছাড়া এলার্জির ক্ষেত্রেও সূর্যালোক ত্বকের জন্য কখনো কখনো হয়ে ওঠে চরম হুমকি। তাই সৌন্দর্য সচেতন মানুষদের যখন নিত্যদিন বাইরে রোদের মাঝে চলাফেরা করতে হয়, তখন তাদের জন্য কড়া রোদ থেকে ত্বককে বাঁচানো জরুরি হয়ে পড়ে।
বাইরের কড়া রোদ থেকে নিজেকে বাঁচানোর ব্যাপারে সূর্যরশ্মি নিরোধক ক্রিম বা লোশন ব্যবহারের কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এই ব্যাপারে কেবলমাত্র বোতলের গায়ে SPF লেখার ওপরে ভরসা করা ঠিক নয়। বরং তার সাথে আরো দেখতে হবে UV নিরোধক লোগো বা ‘Board spectrum’ লেখা আছে কিনা। সাধারণত SPF 30 বা SPF 50 এই অঞ্চলের আবহাওয়ার জন্য যথেষ্ট। SPF 30 প্রায় ৯৭% সুরক্ষা দেয় এবং SPF 50 দেয় ৯৮% পর্যন্ত সুরক্ষা। তবে দু’ঘন্টা পরপর মুখ ধুয়ে নতুন করে আবার এই ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করাই ভালো, কারণ এ সময়ের পরে এর কার্যক্ষমতা কমে যায়। আর হ্যাঁ, অপেক্ষাকৃত শ্যামলা বা কালো বর্ণের মানুষের জন্য SPF 15-ই যথেষ্ট বলা হয়। সকল সূর্যালোক নিরোধক প্রাসাধনীই বাইরে বের হওয়ার অন্তত ২০ মিনিট আগে ব্যবহার করতে হয়।
সূর্যালোক নিরোধক প্রসাধনী ব্যবহার করা মানেই যে তা আপনাকে সূর্যের সকল প্রকার ক্ষতিকর রশ্মি থেকে মুক্তি দেবে, তা নয়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বাইরে চলাফেরার সময় ছাতা, স্কার্ফ বা অন্তত টুপি ব্যবহার করতে হবে। শৌখিন টুপিগুলো এখানে কাজ করবে একইসাথে রক্ষাকবচ ও রুচিসম্মত ফ্যাশান হিসেবে। চোখের নিচের কালো দাগ প্রতিরোধ করতে বা রোদের কারণে সৃষ্ট এলার্জি থেকে চোখকে বাঁচাতে ব্যবহার করতে পারেন রোদ-চশমা।
কোনোভাবে যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই যায় আপনার ত্বকটি, আসুন জেনে নিই কীভাবে এর যত্ন করে ফিরিয়ে আনবেন আপনার আগের সৌন্দর্য? বিশেষ করে মুখের ত্বকের ক্ষেত্রে জেনে নিই করণীয়গুলো।
বাইরে থেকে ফিরে এক ঝাপটা ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন। রোদেপোড়া ভাব অনেকটাই কমে যাবে এতে, ত্বককেও দেবে সতেজতা। তারপর অ্যালোভেরা জেলের ম্যাসাজ ত্বকের পোড়া ভাব দূর করতে অনেক উপকারী। ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধোয়ার পর হাতে ঘৃতকুমারী পাতার তরল জেলের মতো অংশটি নিয়ে ক্লকওয়াইজ এবং অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ হালকা ম্যাসাজ মুখে সৃষ্ট কালোভাব অনেকাংশে দূর করবে। ত্বকে জেলটি শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেলুন।
এরপর ত্বকে তুলোয় করে ঠান্ডা গোলাপ জলের ব্যবহার ত্বকের স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে। গোলাপ জলের পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারেন অ্যালকোহলমুক্ত pH নিয়ন্ত্রিত অন্য কোনো তরল টোনারও। সবশেষে দিতে হবে ভালো কোনো ময়েশ্চারাইজার।
কখনো সাবধানতার অভাবে বা কাজের অতিরিক্ত চাপে যদি আপনার ত্বক কড়া রোদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও যায়, এই সহজ ও সাধারণ পদ্ধতিটি আপনার ত্বকের ক্ষতি অনেকটাই পূরণ করবে নিঃসন্দেহে।
এছাড়া রোদেপোড়া ভাব থেকে মুক্তির জন্য ত্বকে শশা বা আলুর ব্যবহারও বেশ উপকারী। অথবা দিনের রোদেপোড়া ভাব থেকে মুক্তির জন্য রাতে ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন লেবুর রস আর গ্লিসারিনের মিশ্রণ। আর মুখের মৃত কোষ অপসারণের জন্য সপ্তাহে একবার স্ক্রাবিং অবশ্যই দরকার। প্রতিবার স্ক্রাবিংয়ের পর ত্বকের কোমলতা নিজ থেকেই ফুটে ওঠে।
প্রবাদ আছে “মানুষ তা-ই, যা সে খায়”। আমরা যা রোজ খাই, তা-ই আমাদের শক্তি জোগায়, বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে শরীরকে বাঁচিয়ে তোলে। তাহলে এসব ক্ষতিকর রশ্মির প্রভাব থেকে শরীর ও ত্বককে বাঁচাতে ভেতর থেকে শক্তি দেবে, এমন খাবার আছে কী কী?
ত্বকে সূর্যালোক প্রতিরোধে সাহায্যকারী নিজস্ব উপাদান হলো ‘লাইকোপিন’ আর নির্দিষ্ট কিছু খাবার এর শক্তিকে বাড়িয়ে দেয় অনেকগুণ। বিশেষ করে টমেটো সহ অন্যান্য লাল ও কমলা ফল ও সবজি এক্ষেত্রে দারুণ উপকারী। এগুলো ত্বকের সূর্যরশ্মি প্রতিরোধ ক্ষমতা শতকরা ৩৩ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। উচ্চমাত্রায় ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ সবুজ চা-ও ত্বকের সুরক্ষায় প্রশংসার দাবি রাখে।
তাছাড়া ডার্ক চকলেট ‘ফ্লেভোনয়েড’ নামক এক উপাদানে পূর্ণ থাকে, তাই এটি সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির হাত থেকে ত্বককে বাঁচাতে বেশ পারদর্শী। আর চা, কফির মতো ক্যাফেইন জাতীয় খাবার কমায় ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি। তবে কি আপনার প্রিয় খাবারগুলোর নামই যোগ হচ্ছে একে একে তালিকায়? সৃষ্টিকর্তা নিজেই আমাদের রক্ষার কত ব্যবস্থা করে রেখেছেন চারিদিকে! প্রকৃতির রহস্যের কতটুকুই বা আমরা বুঝি? এবার তাহলে নিশ্চিন্তে সমুদ্রের বেলাভূমিতে পা ফেলার আগে মনের আনন্দে এক কাপ কফি পান করে নিন।
সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ থাকুক আমাদের পাঠকবৃন্দ এবং তাদের পরিবার।