বর্তমান যুগে আমাদের সবারই লক্ষ্য থাকে নিজেকে ভালো একটি অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার। পরিবারে চাহিদা পূরণ হোক কিংবা আত্মতুষ্টি, সবক্ষেত্রেই আমরা চাই উন্নতি করতে। চাকরির বাজারেও জিনিসটা এরকমই। নিজেকে ক্রমাগত ভালো একটি অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য সব রকমের পরিশ্রমই আমরা করে থাকি। এজন্য অনেক সময় আমরা একটি চাকরি ছেড়ে আরেকটি ভালো চাকরিতে যাওয়ার চিন্তা করি। অনেক ক্ষেত্রে আবার আমরা চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর চিন্তা করি।
এসব ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান চাকরি ছাড়ার কারণ অফিসের বস কিংবা ম্যানেজারকে বোঝাতে হয়। আপনি যদি অফিসের উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারী হয়ে থাকেন কিংবা অনেক দিন ধরে একটি অফিসের সাথে জড়িত থেকে থাকেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনার বর্তমান ম্যানেজার আপনাকে ছাড়তে চাইবেন না। আপনি তাদের সাথে যুক্ত হবার পর আপনাকে তারা ট্রেনিং দিয়েছে, তাদের অনেক ক্লায়েন্টের সাথে হয়তো আপনি সরাসরি জড়িত। তাই আপনার চাকরি থেকে সরে যাওয়াটা তাদের জন্য একটি বড় সমস্যাই বটে।
কিন্তু তাদের সমস্যার কথা দেখতে গিয়ে তো নিজের সুবিধার কথা ছেড়ে দিলে চলবে না। আপনাকে ভাবতে হবে আপনি কী চাচ্ছেন। আলোচনার সুবিধার জন্য ধরে নিলাম, আপনি বর্তমান চাকরি ছেড়ে অন্য কোনো ভালো চাকরিতে যোগ দিতে চাচ্ছেন অথবা নিজে কোনো ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে নিজে পক্ষ সামলিয়ে কথা বলাটা বেশ জরুরি। সেই সাথে এদিকেও খেয়াল রাখতে হয় যে, আপনার কোনো মন্তব্য বা কাজের জন্য আপনার সিভির উপর কোনো প্রকার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া যাতে না পরে। কারণ আপনি নতুন যেকোনো কর্মক্ষেত্রেই যোগ দিন না কেন, আপনার সিভি সবসময়ই আপনার ব্যাপারে একটি ধারণা তুলে ধরে। আপনার চেষ্টা থাকবে ধারণাটি ইতিবাচকের দিকেই রাখার। এক্ষেত্রে বর্তমান বস বা ম্যানেজারের সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে আপনার করণীয় কী হতে পারে, চলুন তা দেখে নিই।
শুরুতেই দরকার পূর্বপ্রস্তুতি
শুরুতেই আপনার নিজের একটি প্রস্তুতি দরকার। বস অথবা ম্যানেজারের সাথে কথা কীভাবে বলবেন, তাদের সাথে কী কী বিষয় তুলে ধরা উচিত, কোন বিষয়গুলো মোটেও বলা উচিত না, আপনি চাকরি কেন ছাড়ছেন, কবে ছাড়ছেন, আপনি চাকরি ছেড়ে যাওয়ার পর সেই প্রতিষ্ঠানে আপনার জায়গায় যে আসবে তাকে নিয়ে কী করণীয় এসব বিষয় নিয়ে আগে থেকেই চিন্তা করে যেতে হবে। কারণ আপনি এখানে যা বলবেন, তা পরবর্তীতে কোনো চাকরিতে যোগদানের সময় একটি প্রভাব ফেলবে। সব কর্পোরেট কোম্পানিই একটি অপরটির সাথে জড়িত। তাই কোনো চাকরিপ্রার্থীর অতীত খোঁজ করে দেখার জন্য তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। সেজন্য আপনার উচিত হবে সাক্ষাৎকারের সময় কীরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন, তা আগে থেকেই ধারণা করে নেয়া। এজন্য সবচেয়ে ভালো হয় আপনার কোনো বন্ধু বা পরিচিত কারো সাথে বিষয়গুলো নিয়ে আগেই চর্চা করে নেয়া, যাতে মূল সাক্ষাৎকারের সময় অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো প্রশ্নে ঘাবড়ে না যান।
যে সকল বিষয়ে আপনার আগে থেকেই তৈরি থাকা দরকার
একটি চাকরিতে না করার মানে এই নয় যে, আপনি বলার সাথে সাথেই কোম্পানি আপনার কথা মেনে নেবে। ট্রেনিংয়ের জন্য আপনার পেছনে কোম্পানি বেশ সময় দিয়েছে। আপনার পেছনে যে সময়গুলো ব্যয় করা হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে আপনার পরিবর্তে আরেকজনকে নিয়ে আনার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সময় দরকার। এজন্য আপনি যেদিন থেকে অবসর নিতে চান, তার অন্তত ২ সপ্তাহ আগে কর্তৃপক্ষকে জানানো উচিত। এতে করে আপনার বর্তমান কোম্পানি আপনার পরিবর্তে নতুন একজনকে আনার সময় পাবে।
এখন, ধরে নেয়া যাক, আপনি তাদের জানিয়ে দিলেন যে, আপনি আর থাকছেন না। এক্ষেত্রে তারা আপনার সাথে তিন ধরনের আচরণ দেখাতে পারে।
১. তারা আপনাকে তাৎক্ষণিক চাকরি ছেড়ে যেতে বলতে পারে।
২. তারা আপনার ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আরেকবার বিবেচনা করার জন্য বলতে পারে।
৩. ম্যানেজার বা বস আপনাকে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে রাজি না-ও হতে পারে।
আপনি যেহেতু জানেন না আপনার সাথে কোন আচরণ দেখানো হতে পারে, তাই ৩টির জন্যই আপনার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। তারা যদি আপনাকে এখনই চাকরি ছেড়ে চলে যেতে বলে, তাহলে আগে থেকেই আপনার অফিসের কম্পিউটারের ফাইলগুলো গুছিয়ে রাখা উচিত। কারণ যেকোনো সময়েই তারা আপনার অফিসের কম্পিউটারের সংযোগ বন্ধ করে দিতে পারে। তাই আপনার উচিত আগে থেকেই দরকারি ফাইল সরিয়ে রাখা।
কোম্পানি হয়তো মনে করতে পারে, আপনার শূন্যস্থান পূরণের জন্য তারা এখনই তৈরি নয়, অথবা তারা হয়তো এখনই নতুন কোনো সদস্য নিয়োগ দিতে চাচ্ছে না। এক্ষেত্রে তারা আপনার সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনা করার জন্য বলতে পারে অথবা ক্ষেত্র বিশেষে তারা আপনাকে চাকরি থেকে ইস্তফা না-ও দিতে পারে। এক্ষেত্রে আপনি কীভাবে অগ্রসর হতে পারেন, তা পরবর্তী ধাপ পড়লেই বুঝতে পারবেন।
কথাবার্তায় অগ্রসর হবেন যেভাবে
এবার আসা যাক আসল কথায়। সবরকম প্রস্তুতি শেষে এবার আপনার মনের কথা ঝেড়ে ফেলতে হবে। বস কিংবা ম্যানেজারের সামনে দাঁড়িয়ে আপনার নিশ্চয়ই কাঁচুমাচু হয়ে থাকা চলবে না। চেষ্টা করবেন নিজেকে যথাসম্ভব উৎফুল্ল রাখতে।
কথাবার্তার সুর যতটুকু সম্ভব নমনীয় রাখবেন। সবার আগে অবশ্যই আপনাকে তাদের সাথে কাজ করার সুযোগ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ যানাবেন। “চাকরি ছাড়তে চাচ্ছেন” কথাটি বলা মাত্রই পাল্টা প্রশ্ন আসবে, “কেন ছাড়তে চাচ্ছেন?” এখানে অনেকেই আসল কথা গোপন করার চেষ্টা করেন, যা মোটেও করা উচিত না। আপনি যদি একটি চাকরি ছেড়ে অন্য কোনো চাকরিতে যেতে চান, তাহলে আপনার নতুন কোম্পানি অবশ্যই আপনার অতীতের ব্যাপারে খোঁজ নেবে। সেক্ষেত্রে তারা যদি জানতে পারে আপনি আগের কোম্পানির কাছে তথ্য লুকিয়ে এখানে এসেছেন, তাহলে সেটা আপনার উপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তাই যখন জানতে চাওয়া হবে, আপনি কী কারণে বর্তমান চাকরি ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন, তাহলে অবশ্যই সত্যি কথাই বলে দেবেন। আপনাকে যদি তারা ছেড়ে দিতে সম্মত হয়, তাহলে তো আপনার জন্য ভালো। কিন্তু যদি যেতে দিতে না চায় কিংবা আপনার সিদ্ধান্ত আবার পর্যালোচনা করতে বলে, তখন কী করবেন? এবার আসি সেই কথায়।
সবার আগে আপনি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে, নতুন চাকরি বা ব্যবসার যাত্রাটি আপনার জন্য কতটুকু জরুরি। বর্তমান চাকরি ছেড়ে দেয়া ছাড়া আপনার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। এখানে তারা আপনাকে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারে যে, আপনাকে কাজ শেখানোর পেছনে কোম্পানি যে সময় ও অর্থ দিয়েছে সেগুলোর কী হবে? এক্ষেত্রে আপনি বলতে পারেন, নতুন যে ব্যক্তি কাজে যোগ দিবেন, তাকে কাজ শেখানোর দায়িত্ব আপনার। যেহেতু আপনি নিজে কাজ না করে নতুন একজনকে কাজ শেখাচ্ছেন, তাই এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক আপনি চাইতেই পারেন। এক্ষেত্রে তারা রাজি হয়ে থাকলে কোম্পানির ম্যানেজারের সাথে নতুন একটি চুক্তি সই করিয়ে নিতে পারেন। একটি জিনিস মনে রাখবেন, কাগজের সই ছাড়া মুখের কথার আজকাল কোনো দাম নেই।
কিন্তু এরপরও যদি কোম্পানি আপনাকে ছাড়তে রাজি না হয়, সেক্ষেত্রে আপনার উচিত নিজে থেকে চাকরি ছেড়ে চলে আসা। একটি বিষয় খেয়াল করে দেখবেন, কোম্পানি চাইলে আপনাকে বিনা নোটিশে চাকরি থেকে বের করে দিতে পারে। সেখানে আপনি তো বলে বের হচ্ছেন। এতে আপনার সিভিতে একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা থাকলেও, নতুন চাকরি বা নিজের ব্যবসার গুরুত্ব তার তুলনায় কতটুকু কম বা বেশি, সেটি আপনার বিবেচ্য।
তবে চাকরি ছাড়ার ক্ষেত্রে কিছু কথা কখনোই বলা উচিত না।
- বস/ম্যানেজার ভালো না।
- সহকর্মীরা কাজে ঠিকমতো সহায়তা দিতে পারে না।
- বেতন ঠিকমতো দেয়া হয়নি।
- কোম্পানি ভালো না।
বর্তমান বস কিংবা ম্যানেজার যদি ভালো না হয়েও থাকে, তাহলে আপনার পরবর্তী বস কিংবা ম্যানেজার যে ভালো হবে সেই কথা ভুলেও ভাবা উচিত নয়। কারণ আপনি তো এখনো নতুন জায়গায় কাজ শুরু করেননি। আর চাকরির জগতে আপনার সহকর্মীরা কেমন হবে, সেটা আপনি কখনোই নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না। সহকর্মী যে বা যারা হোক, সবসময় চেষ্টা করবেন সবার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে। আর নতুন কোনো কোম্পানিতে যাওয়ার আগে বর্তমান কোম্পানির ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করা উচিৎ না। এটি আপনার সিভিতে নিশ্চিতভাবেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সেক্ষেত্রে এ ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।
নিজের জীবনের মঙ্গলের জন্য চাকরি ছাড়া বা না ছাড়া এটি আপনার সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত যতটা সুপরিকল্পিতভাবে নিতে পারেন, ততই আপনার জন্য ভালো। একটি ভুল সিদ্ধান্ত আপনার জীবন ধারণের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। তাই যতটা সম্ভব সাবধানী হয়ে সিদ্ধান্ত নিন।