জাঙ্ক ফুড যে খাচ্ছেন, হিসাব রাখছেন তো?

মানুষের জৈবিক চাহিদা চাহিদাগুলোর একটি হলো খাদ্য। বেঁচে থাকতে হলে খাবার আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। কিন্তু ইদানিং এই খাবারই যেন আজ আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাঙ্ক ফুডের প্রতুলতা দিনদিন আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য একপ্রকার হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। নিয়মিত জাঙ্ক ফুড গ্রহণের ফলে মানুষ স্থূলকায় হবার পাশাপাশি অসুস্থও হয়ে পড়ছে। আর মানুষকে এভাবে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে গড়ে উঠেছে বিখ্যাত ফাস্ট ফুড ইন্ডাস্ট্রি, যার বিগত বছরে লাভই ছিল প্রায় ৫৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। টাকার হিসেবে প্রায় সাড়ে ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এসব খাবার এবং তার প্রচারণা চলছে আপনার আশেপাশেই। এসবই আপনাকে এগুলোর প্রতি দুর্বল করে তুলছে। অন্তত নিজের সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে হলেও, এগুলোর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্বন্ধে সকলের অবগত হওয়া দরকার।

তার আগে চলুন একটু পেছনে ফিরে তাকাই। খুব বেশি না, এই উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেও খাবার সাধারণত ঘরের মধ্যেই তৈরি করা হতো। এসব খাবার বেশ ভালো করে প্রক্রিয়াজাত করা হতো এবং ব্যবহৃত উপাদানের প্রায় সবটুকুই চাষ করা হতো। সেই শতাব্দীরই শেষ দিকে অর্থাৎ ১৮৯৩ সালে লুইস এবং ফ্রেডরিক রুইকহাইমের হাত ধরে সর্বপ্রথম প্যাকেটজাত খাবার বিক্রি শুরু হয়। শিকাগোর বিশ্ব-মেলাতে তারা পপকর্ন, বাদাম এবং মোলাসেসের সমন্বয়ে তৈরী তাদের খাবার বিক্রি করে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এই সাফল্যের হাত ধরেই, পরে তারা ১৮৯৬ সালে বাণিজ্যিকভাবে খাবার বিক্রি শুরু করেন। তাদের তৈরি সেই সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক খাবারের নাম ছিল ক্র্যাকার জ্যাক

সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয়কৃত স্ন্যাক; Source: thedailymeal.com

বর্তমানে নানা রকমেই জাঙ্ক ফুড পাওয়া যায়। এই খাবারগুলোর বেশিরভাগই মানুষের শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। প্রতিনিয়ত এসব খাবার গ্রহণে বাড়ছে স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা। Institute for Health Matrix and Evaluation-এর এক রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে পূর্ণবয়স্ক  মানুষের মধ্যে শতকরা প্রায় ১৭ শতাংশ এবং শিশুদের ক্ষেত্রে সাড়ে ৪ শতাংশ স্থূলকায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত ৪০ বছরে স্থূলকায় মানুষের হার প্রায় দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছে উচ্চ রক্তচাপ কিংবা বহুমূত্র রোগের মতো অনেক সমস্যা।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থূলকায় মানুষের পরিমাণ; Source: vox.com

হয়তো খেয়াল করেননি, বেশিরভাগ সময় আপনি কোনো না কোনো সম্পূরক খাবার গ্রহণ করছেন। যেমন ধরুন, বার্গার বা চিকেন ফ্রাই খাওয়ার সময় সাথে একটি কোমল পানীয় নিচ্ছেনই। এর পেছনেও রয়েছে কারণ। আপনি যখন চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণ করছেন, তখন আপনার মুখ হয়ে পড়ে শুষ্ক এবং খসখসে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাথে থাকছে কোমল পানীয়। এভাবেই ফাস্ট ফুড ইন্ডাস্ট্রি ভিন্ন রকমের খাবারের প্রতি মানুষকে প্রলুব্ধ করছে। কীভাবে প্রলুব্ধ করা যায়, তা নির্ণয়ের অবশ্য তারাও খরচ করেছে কোটি কোটি টাকা।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মাথাপিছু কোমল পানীয় গ্রহণের পরিমাণ; Source: vox.com

গবেষকেরা ধারণা করেন, আমাদের মস্তিষ্ক সাধারণত যে সকল খাবারে ক্যালোরির পরিমাণ বেশি থাকে, সেসব খাবারের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির এক পরীক্ষণে একদল ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হয়, তারা কিছু জাঙ্ক ফুড (যেমন চকলেট, চিপস) এর জন্য পুষ্টিকর খাবারের তুলনায় বেশি টাকা দিতে রাজি কিনা। অবাক করার মতো ব্যাপার হলেও, অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী জাঙ্ক ফুডই বেছে নেন।

বিজ্ঞাপনে ফাস্ট ফুড ইন্ডাস্ট্রি; Source: astfoodmarketing.org

তাহলে কেন মানুষ জেনেশুনে এই জাঙ্ক ফুডের দিকেই ঝুঁকে পড়ছে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদেরকে বিষয়টির আরেকটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে। খানিক আগেই বলা হয়েছে, জাঙ্ক ফুড কোম্পানিরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ করেই যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো রেস্টুরেন্টে দিয়ে চলেছে একটি কিনলে একটি ফ্রি জাতীয় বিজ্ঞাপন কিংবা খাবারে ডিসকাউন্ট জাতীয় বিজ্ঞাপন। এমন নয় যে শুধুমাত্র টিভি বা বিলবোর্ডের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। আজকের ডিজিটাল যুগে বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন হয়ে থাকে ফেসবুকের প্রমোশনাল পোস্টের মাধ্যমে।

রেস্টুরেন্টের লোভনীয় অফার; Source: twitter.com

২০১৭ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধুমাত্র আমেরিকাতেই বিজ্ঞাপনের জন্য খরচ করা হয়েছে ১৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অনেকে বলতে পারেন, আমি তো ফ্রি খাবার পাওয়ার আশায় আর খেতে যাচ্ছি না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখবেন আপনি এরকম অফারের খোঁজ করতেই থাকেন। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি মূলত কাজ করে, তা হলো আপনার বেশি পাওয়ার ধারণা। যেমন ধরুন, আপনাকে পাশাপাশি দুটি অফার দেয়া হলো: প্রথমটিতে একটির সাথে আরেকটি ফ্রি এবং দ্বিতীয়টিতে ২৫% ডিসকাউন্ট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে আপনি ৫০ শতাংশ লাভের আশায় প্রথম বিকল্পটিই বিবেচনা করবেন। কারণ আপনি সেক্ষেত্রে বেশি পাওয়ার একটি তৃপ্তি পাচ্ছেন।

পুষ্টিবিদ আন্ড্রেয়া গর্গেন-এর মতে, এসব জাঙ্ক ফুডে বিবিধ উপাদান থাকে যা আপনার দেহের জন্য ক্ষতিকর।

  • লুক্কায়িত চিনি: এসকল উপাদান সাধারণত সুগার বা চিনি হিসেবে উপস্থাপন করা হয় না, তবে চিনি বা চিনিতে রূপান্তরিত হয় খাবার বিপাকের সময়। এসকল উপাদান খাবারের ক্যালরির পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং তা ওজন বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। এরকম উপাদানের উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কর্ন সিরাপ, ফ্রুক্টোজ বা সুক্রালোজ। এসব খাবারে চিনি থাকে না কথাটি সত্য, কিন্তু যে সত্য গোপন রাখা হয়, তা হল সেখানে তারা কৃত্রিমভাবে প্রস্তুতকৃত চিনি ব্যবহার করে।

কৃত্রিম চিনির ব্যবহার; Source: coachcalorie.com

  • কৃত্রিম চিনি: গবেষণা অনুসারে, চিনির বিকল্পে সাধারণত ক্যালরির পরিমাণ কম থাকে। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, বিপাক ক্রিয়ায় এই চিনিগুলো বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই কৃত্রিম চিনির কারণে চিনির মোট গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সুক্রালোজ, এসিসালফেইম পটাশিয়াম এবং স্যাকারিন এর মধ্যে অন্যতম।
  • হাইড্রোজেনেট তেল: গবেষণার মধ্য দিয়ে হাইড্রোজেনেট তেলের ক্ষতিকর প্রভাব ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ড্রাগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এই তেলের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।

অতিরিক্ত পরিমাণে জাঙ্ক ফুড গ্রহণের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং স্থূলকায় হবার আশংকা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু টাইপ-২ ডায়াবেটিস আর জাঙ্ক ফুডের মধ্যে কী সম্পর্ক আছে? সাধারণত আমেরিকানরা ক্যান্ডি বার এবং সফট ড্রিংক হিসেবে প্রায় ২২ চা চামচ পরিমাণ চিনি গ্রহণ করে। ফলে রক্তে চিনির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং অগ্ন্যাশয় হতে নিঃসৃত হয় ইনসুলিন, যাতে কোষ এই অতিরিক্ত চিনি শোষণ করতে পারে। প্রতিনিয়ত এরকম চিনির মাত্রা ওঠানামা করার কারণে অগ্নাশয়ের কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং ধীরে ধীরে ইনসুলিনের নিঃসরণের পরিমাণও হ্রাস পেতে থাকে। ফলাফল হয়ে দাঁড়ায় টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ-২ ডায়াবেটিস হৃদরোগ, বেদনাদায়ক স্নায়ুজনিত ক্ষতি, কিডনির ক্ষতি, আলঝেইমারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া পায়ে সংক্রমণ হলে তা কেটে ফেলার হুমকির সম্মুখীন হতে পারে রোগী।

জাঙ্ক ফুড আমাদের জন্য ক্ষতিকর, এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু মানুষের স্থূলকায় হয়ে যাওয়ার জন্য শুধুমাত্র এই খাবার দায়ী নয়। এর পেছনে রয়েছে আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাও। জাঙ্ক ফুডের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানুষ ঝুঁকে পড়ছে সেসব খাবারের প্রতি। এই সমস্যা এমন প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কিছু এলাকায় প্রক্রিয়াজাত খাবার বাদে অন্য খাবার খুঁজলেও পাওয়া যায় না। এমন এলাকাকে নাম দেয়া হয়েছে ‘খাবারের মরুভূমি’। তাছাড়া প্রতিনিয়ত ছুটে চলা আজকের জনগণের কাছে খাবার তৈরির সময়টুকুও হয়ে উঠে না অনেক সময়। তাই তারা ঝুঁকে পড়ছেন এই ফাস্ট ফুডের দিকে। কিন্তু আপনার নিজের চিন্তা করে হলেও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণে আগ্রহী হওয়া উচিত। এসব খাবার খেয়ে আপনি যতই ডায়েটিং বা ব্যায়াম করুন না কেন, ওজন কমাতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে।

Featured Image: corpuslabs.com

Related Articles

Exit mobile version