পৃথিবীতে মানবজাতির পদচারণা শুরুর পর অনেক কাল অতিবাহিত হয়ে গেছে। আদিম গুহামানবদের উত্তরসূরীরা জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত হয়েছে, আধুনিক সভ্যতা গড়ে তুলেছে, রহস্যময় প্রকৃতি আজ তাদের কাছে অনেকটাই সহজবোধ্য। সভ্যতার এ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে ‘প্রস্তর যুগের মানুষেরা কি আমাদের চেয়ে সুখী ছিলেন?’ এ ধরনের একটি প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এ প্রশ্নটিকে স্রেফ অবান্তর বলে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই যান্ত্রিক সভ্যতায় সুখের সন্ধান করতে গিয়ে মানবজাতি যখন রীতিমত দিশেহারা, তখন এ প্রশ্নটি মাথায় ঢোকার পর আমরা এটিকে এক লহমায় ঝেড়ে ফেলতে পারি না; এটি আমাদের চিন্তাজগতে ঘুরপাক খেতে থাকে, দাবি জানায় আরো গভীর বিবেচনার।
আধুনিক সমাজে সংঘবদ্ধ থাকার প্রবণতার অবসান ঘটেছে, উদ্ভব হয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের। ব্যক্তিগত সুখই এখন মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। আমরা যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাচ্ছি, চাচ্ছি মানুষের জীবনধারনের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য, ভালো বাসস্থান, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে; এসব কিছুর পেছনেও যে ধারণাটি কাজ করে তা হলো, ‘এসব নিশ্চিত হলে মানুষ সুখে থাকবে’। কিন্তু আসলে কি তাই হচ্ছে?
দেখা যাচ্ছে, এসব মৌলিক চাহিদা ভালোভাবে নিশ্চিত হওয়ার পরও এ সমাজের অধিকাংশ মানুষ সুখে নেই। আসলে ঠিক কী মানুষকে সুখী করে, তা বলা মুশকিল। কারণ বিশেষজ্ঞরা মানুষের হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের রাজনীতি, অর্থনীতি, খাদ্য, যৌনতা এসব কিছু নিয়ে বিস্তর মাথা খাটালেও এসব কিছু মানুষের সুখকে কতটা প্রভাবিত করেছিল সে বিষয়টি কিছুটা এড়িয়ে গেছেনই বলা যায়। আজকের লেখায় আমরা সে দিকেই দৃষ্টিপাত করার চেষ্টা করবো।
মানবজাতির ইতিহাসকে কয়েকটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যায়। তন্মধ্যে মানুষের এ পথচলাকে আবিষ্কার এবং উন্নয়নের সাফল্যগাঁথা হিসেবে দেখার প্রবণতাটি বেশ প্রচলিত। ইতিহাসের প্রতিটি সহস্রাব্দে পৃথিবী স্বাক্ষী হয়েছে নিত্য নতুন আবিষ্কারের। সেই প্রাচীনকাল থেকে চাকার আবিষ্কার, চাষাবাদের উদ্ভব, লেখার প্রচলন, ছাপার হরফের আবিষ্কার থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক এন্টিবায়োটিক বা বাষ্প ইঞ্জিনের মতো আবিষ্কারগুলো মানুষকে দিনকে দিন অধিক ক্ষমতাধর করে তুলেছে।
এসব আবিষ্কার মানুষের দুরবস্থা দূর করার সুযোগ এনে দিয়েছে, সুযোগ করে দিয়েছে নিজেদের উচ্চাশাগুলো পূর্ণ করার। মানুষের ইতিহাসকে এভাবে আবিষ্কার ও সমৃদ্ধির উপাখ্যান হিসেবে দেখার এ দৃষ্টিকোণটিকে হুইগ দর্শন নামে অভিহিত করা হয়। এ অনুসারে এভাবে দিনদিন ক্ষমতাধর হওয়ার ফলে মানুষ অধিক সুখীও হয়েছে। সুতরাং প্রাচীন যুগের মানুষের তুলনায় মধ্যযুগের মানুষ, আর তাদের চেয়ে আধুনিক যুগের মানুষ অধিক সুখী হওয়ার কথা।
কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, মানবসমাজের অগ্রগতি সবসময় ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষকে সুখী করতে পারেনি। যেমন শিকার যুগের পর কৃষিযুগকে বিশাল অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করা হলেও, ব্যক্তি মানুষের জন্য এটি ভালো ছিল এমনটি বলা যাবে না। কারণ শতকের পর শতক ধরে শিকারে অভ্যস্ত আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় নিরন্তর পরিচর্যা ছিল খুবই ক্লান্তিকর এবং পরিশ্রমসাধ্য একটি কাজ।
শারীরিক দিক থেকেও কৃষিকাজ তাদের জন্য অনুকূল ছিল না তখন। এ থেকে প্রাপ্ত খাদ্যও ছিলো না তাদের উপযোগী। আর গবাদি পশু পালন করতে গিয়ে তারা আক্রান্ত হয়েছে নানান ধরনের রোগে। এছাড়া এই কৃষিযুগেই উদ্ভব হয়েছে শ্রম বিভাগের, প্রতিষ্ঠা হয়েছে সামন্ততন্ত্রের, সমাজে দেখা দিয়েছে শ্রেণীবৈষম্য। এসব কিছু বিবেচনা করেই বিজ্ঞানী জারেড ডায়মন্ড কৃষি বিপ্লবকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘মানবজাতির সবচেয়ে বড় ভুল’ হিসেবে। অথচ হুইগ দর্শন থেকে দেখলে এটি বিশাল অগ্রগতি।
সেই কৃষিযুগের কথাই বলছি কেন? একজন সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা করলে, আঠারো শতকের একজন সাধারণ মানুষের চেয়েও সেই আদিম গুহাবাসীরা অনেক ভালো অবস্থায় ছিলেন। শতকের পর শতক ধরে মানবজাতি বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উন্নত হলেও উন্নয়নের কল্যাণে আহরিত সম্পদ বরাদ্দ ছিল স্বল্প কিছু মানুষের জন্যই।
এমনকি আঠারো শতকে মানুষের গড় আয়ুও আদিম মানুষের চেয়ে বেশী ছিল না, সেই তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর। শিশুদের রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতারও কোন অংশে উন্নতি হয় নি। উপরন্তু শিকার যুগের একজন মানুষকে মোটামুটি চলনসই একটি জীবন যাপন করতে হলে তুলনামূলক অল্প পরিশ্রম করতে হতো, অথচ আঠারো শতকের একজন মানুষকে একই মানের জীবন যাপনের জন্য নিরন্তর গাধার খাটুনি খাটতে হতো।
এসব বিচার করেই বিখ্যাত অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ গ্রেগরী ক্লার্ক তার বইয়ে, আঠারো শতকের তুলনামূলক সম্পদশালী সমাজ, যেমন: ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডের একজন সাধারণ মানুষের জীবনমানকে প্রস্তর যুগের মানুষের কাছাকাছি বললেও, এশিয়ান বা অন্যান্য পশ্চাতপদ সমাজের মানুষের জীবনকে বর্ণনা করেছেন ‘শিকার যুগের চেয়েও অধম।
যা-ই হোক, এতক্ষণ আঠারো শতকের উদাহরণ দিলাম, তবে কি আমরা এই একুশ শতকে এসে উন্নত হয়ে গেছি? এটি অস্বীকার করার জো নেই যে শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষের জীবনমানে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গড়পড়তা মানুষের জীবনমান অনেকটা বেড়েছে। কিন্তু সব সমাজে তা হয়নি। সাহারা অঞ্চলের আফ্রিকান দেশগুলোতে শিল্প বিপ্লব পরবর্তী যুগ এক অভিশাপ হয়েই এসেছে বলা যায়।
শিল্প বিপ্লবে উন্নত পৃথিবীর সাথে কোনরকম সংযোগ না হলেই এ দেশগুলো ভালো থাকত। উন্নত পৃথিবীর আধুনিক প্রযুক্তি এ দেশগুলোকে মালথুসিয়ান ফাঁদে আটকে দিয়েছে। অর্থাৎ আধুনিক আবিষ্কারের কল্যাণে এসব দেশে জন্মহারই বেড়েছে কেবল, কিন্তু জীবনমান নেমে গেছে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নিম্নস্তরে। বলা যায়, বর্তমান পৃথিবীতে ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তি একইসাথে হাঁটছে।
আমরা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে এতক্ষণ মানবজাতির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছি। সে হিসেবে বিচার করেছি আমরা কতটা সুখী। কিন্তু সুখ জিনিসটা ঠিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উপর নির্ভর করে না। সুখ নিয়ে কথা বলতে গেলে একটু রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়গুলো দেখা দরকার। মানুষের ইতিহাস নিয়ে একধরনের কট্টর রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গীও বেশ প্রচলিত।
এ দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী, এই আধুনিক কাঠখোট্টা যান্ত্রিক পৃথিবী কোনভাবেই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অনুকূল নয়। আমরা দিনদিন যত আধুনিক হচ্ছি, ততই যেন একেকটি যন্ত্রে পরিণত হচ্ছি। রোম্যান্টিক দর্শনে বিশ্বাসীরা মোটামুটি সকল নতুন আবিষ্কারের নেতিবাচক দিক খুঁজে বের করেন। তাদের মতে ছাপার মেশিন প্রোপাগান্ডা ছড়ানো বা ব্রেইনওয়াশ করার কাজ করছে, কম্পিউটার আমাদের জম্বি বানিয়ে দিচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের করে তুলছে আরো অসামাজিক।
আর তাদের সবচেয়ে কড়া বিদ্ধেষের শিকার হতে হয় শিল্প বিপ্লব, পুঁজিবাদ, ভোগবাদ এই তিনের সমন্বিত ব্যবস্থাকে। তাদের মতে এগুলো মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। কারখানার শ্রমিকদের পরিণত করেছে যন্ত্রে; যারা কল কারখানার অন্যান্য যন্ত্রের মতো পুঁজিবাদীদের টাকা বাড়ানোর উপায় ছাড়া ভিন্ন কিছু না। মধ্যবিত্তরা হয়তো একটু আয়েশী জীবন যাপন করতে পারেন, কিন্তু প্রাত্যহিক টানাপোড়নের জীবন তাদের অন্তরকে বঞ্চিত করে আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা থেকে।
তাই রোম্যান্টিক দর্শনের মতে, আধুনিক যুগের কারখানার যন্ত্র বা অফিসের কেরানি হওয়ার চেয়ে মধ্যযুগীয় জীবনই ভালো ছিল। আর আমাদের প্রস্তরযুগের পূর্বসূরিরা কাটিয়ে গেছেন শ্রেষ্ঠ জীবন। কিন্তু এসব কথাও ঠিক মেনে নেয়া চলে না। এসব আবিষ্কারের দোষ খুঁজে বেড়ানোর বিষয়টি হুইগ দর্শনের মতোই গোঁড়া চিন্তাধারা। উদাহরণ হিসেবে আধুনিক চিকিৎসার কথাই বলা যাক, গত দু’শ বছরে মেডিসিনের জগতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, মানুষকে সুখী করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে?
যক্ষ্মা, কলেরা, ডায়রিয়ার মতো মহামারী অসুখগুলো থেকে মানুষের মুক্তি মিলেছে। মানুষের গড় আয়ু এখন ইতিহাসের সবচেয়ে অসাধারণ পর্যায়ে আছে। শিশু মৃত্যুহার শতকরা ৩৩ ভাগ থেকে ৫ ভাগ পর্যন্ত কমেছে। এসব বিষয় যে মানুষকে অনেকটাই সুখী করে তুলেছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কারণ একটা মানুষের জীবনের সাথে স্রেফ ঐ মানুষটিই না, তার অনেক আপনজনের হাসি-কান্না জড়িয়ে থাকে।
রোম্যান্টিকদের কথা সম্পূর্ণ উড়িয়েও দেয়া যায় না। কারণ হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে জীবনযাপন করেছে। তাই এ যুগের দামী গাড়ি, উঁচু বাড়ী বা জৌলুসময় জীবন আমাদের সুখী করতে পারে না। নিরাপত্তা বা আরাম আয়েশের গুরুত্ব অস্বীকার না করেও বলতে হয়, আমাদের সুখে থাকা আসলে নির্ভর করে প্রকৃতির সাথে, অন্য মানুষদের সাথে আমাদের সম্পর্কের উপরে।
কিন্তু এ যুগের সমৃদ্ধ দেশগুলোর দিকে তাকান। মানুষ দিনদিন কেমন ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। যেহেতু এই আধুনিক যুগে সব কিছুর নিশ্চয়তা আছে, তাই মানুষ দৃঢ় পরিবারিক বন্ধন বা প্রকৃত বন্ধুবান্ধব ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারছে। আজকালের ব্যস্ত শহরগুলোতে প্রতিনিয়ত মানুষের ভিড় বাড়ছে, কিন্তু মানুষের সাথে মানুষের বন্ধন কি বাড়ছে? আজ বন্ধুত্ব বলতে আমরা বুঝি সময়ের প্রয়োজন বা স্রেফ আনন্দ-ফুর্তি করার সঙ্গী।
প্রয়োজন ছাড়াতো আজকাল কাউকে কুশলাদিও জিজ্ঞেস করা হয় না; প্রয়োজন হলে বন্ধুর ডাক পড়ে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে দিনশেষে আবার ভীষণ একলা হয়ে যায় সবাই। অপরদিকে প্রাচীন যুগে মানুষ গভীর বন্ধনে আবদ্ধ থাকতো। ব্যক্তি মানুষের চেয়ে তাদের কাছে তাদের সংঘবদ্ধ অস্তিত্বই অধিক প্রাধান্য পেত। তাদের জীবনের সব চরম মুহূর্তে প্রতিনিয়ত ভরসা করতে হতো আরেকজনের প্রতি।
সেসময়ে আশেপাশের মানুষের দুঃসময়ে সাহায্য করার জন্য, অসুস্থ হলে সেবা করার জন্য সবাই সজাগ থাকতো। অথচ আজকে পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দার খোঁজখবরই আমাদের জানা থাকে না। আসলে অন্যদের বাদ দিয়ে ব্যক্তি নিজের আলাদা স্বার্থের কথা ভাবা আদিম মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তারা স্বার্থপর হবেন কীভাবে? কিন্তু আধুনিক সমাজে মানুষ খুব ভালোভাবেই স্বার্থপর হতে শিখে গেছে। এসব বিষয়গুলো আমাদের অসুখী করে তুলতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে।
যা-ই হোক, আসলে কারা বেশী সুখী ছিল এ নিয়ে বিতর্ক শেষ হবার নয়। তবে আমরা এই কামনা করতে পারি যে, এই আধুনিক পৃথিবী, তার বিজ্ঞান প্রযুক্তি দিয়ে সব সমাজের, সব মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করবে। পাশাপাশি মানুষ যন্ত্র শাসিত সমাজের ক্রীড়ানকে পরিনত না হয়ে, আধ্যাত্মিক ভাবেও সমৃদ্ধ হবে।