বুনো পশ্চিম, শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে লালচে পাহাড় আর ধুলিমলিন বিষণ্ণ মরুভুমির দেশের কথা। যেখানে জীবন মানেই সত্যিকারের যুদ্ধ। আঊট ল, কাউবয় এবং রাসলারদের বন্দুকযুদ্ধের কথা চোখে ভাসে। দুর্দান্ত সব অভিযানের নায়ক, ঘোড়া সওয়ারি, রুক্ষ চেহারার হ্যাট পরিহিত কাউবয়দের ধূলা উড়িয়ে ঘোড়া নিয়ে ছুটে চলার বুনো পশ্চিম। বুনো পশ্চিম মানেই লালচে পাহাড়ের সারি, মাঝে মাঝে কিছু ফার্মহাউজ। কৈশোরের অনেকটা সময় আমাদের কাটে এই বুনো পশ্চিমের গল্প পড়ে পড়ে। আজ বুনো পশ্চিম নিয়ে আমরা আরেকটু বিস্তারিত জানব। কেমন সেসব এলাকা, অধিবাসীদের জীবনযাপন আর তাদের জীবন যুদ্ধের কথকতা।
বুনো পশ্চিমের যে গল্পগুলো আমরা পড়েছি সেগুলো মূলত আমেরিকার ১৮০০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যকার কাহিনী। টেক্সাস, ক্যানসাস, নেব্রাস্কার পূর্বাংশ এবং ডাকোটাকে বুনো পশ্চিম বলা হয়ে থাকে। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মিসিসিপি বা মিসৌরি নদীর অঞ্চলগুলোকেও এর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন। এসব অঞ্চলের শুষ্ক আবহাওয়া এবং রুক্ষ মাটির জন্য সেখানে বসবাস করা অত্যন্ত কঠিন। তবে এর কিছু কিছু অঞ্চল উর্বর। শুধু তাই নয় এসব অঞ্চল অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় এখানে জীবন এক প্রকার যুদ্ধই বলা চলে।
১৮০০-১৮৪০ সাল, এর মধ্যবর্তী সময়ে আমেরিকার সীমান্তের অধিবাসীগণ পশ্চিমের দিকে যাত্রা শুরু করেন। পশ্চিমের এসব অঞ্চল অত্যন্ত দুর্গম এবং জীবন যাপনের বেশ অনুপযোগী হওয়ায় তারা উর্বর অঞ্চলের খোঁজে ক্যালিফোর্নিয়া এবং ওরিগনের দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু ১৮৪৯ সালে ২টি ঘটনা তাদের বুনো পশ্চিমে থাকতে বাধ্য করে। তা হলো-
১। মেক্সিকো যুদ্ধে আমেরিকার জয়ের ফলে আমেরিকা পশ্চিমে অনেক জমি পেল।
২। ১৮৪৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় স্বর্ণের সন্ধানে একদল আশাবাদী মানুষ পশ্চিমে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়। আমেরিকান এই ভাগ্য অন্বেষণকারীদের Forty-Niners বলা হয়ে থাকে। স্বর্ণের সন্ধানে চাইনিজ, ইউরোপিয়ান, দক্ষিণ আমেরিকান এবং অন্যান্য দেশের ভাগ্য অন্বেষকারীদের দল একে একে পাড়ি জমাতে থাকে পশ্চিমে।
শুরু হল খননের পালা। ভাগ্য অন্বেষকারীদের দল পশ্চিমের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কলোরাডোর পাইক্স পিক, নেভাদার কমস্টক লোড এবং দক্ষিণ ডাকোটাসহ নানা অঞ্চলে। এভাবে তৈরি হল শহর, আর শহরবাসীর খাদ্যভাব দূর হত রাঞ্চগুলো থেকে প্রাপ্ত মাংস এবং ফসল দ্বারা।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
১৮৫০ সালের দিকে বুনো পশ্চিমের যানবাহন বলতে ওয়াগন আর নৌকাই ছিল। সেই সাথে ঘোড়াও ছিল যাতায়াতের অন্যতম বাহন। পরবর্তীতে ১৮৬০ সালে প্যাসিফিক অ্যাক্ট নীতির ফলে আন্তমহাদেশীয় রেল লাইন স্থাপন করা হয়। এই রেললাইনটিকে পশ্চিমের যাতায়াত ব্যবস্থার একটি লাইনফলক বলা চলে। শুধু তাই নয়, এই রেলরোডের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য আমদানি এবং রপ্তানি চলত। ১৮৮০ সালের দিকে পশ্চিমের র্যাঞ্চারদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ায় তারা রেলে কামরা ভাড়া করে পরিবার নিয়ে দূর দূরান্তের র্যাঞ্চে ভ্রমণে যেত।
এ তো গেল যাতায়াত ব্যবস্থার কথা। এবার আসা যাক জীবিকার কথায়। বুনো পশ্চিমের পেশাগুলোর মাঝে খনি খনন, র্যাঞ্চিং এবং কৃষি অন্যতম।
প্রথমেই আসা যাক কৃষিতে। শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে পশ্চিমের মাটি রুক্ষ, কঠিন এবং আবহাওয়া অত্যন্ত শুষ্ক। সেখানে কদাচিৎ বৃষ্টির দেখা মেলে। আর সাধারণ কৃষি পদ্ধতিতে এখানে ফসল ফলে না। পশ্চিমের কৃষিপদ্ধতিকে Dry Farming বলে। Dry Farming পদ্ধতিতে রুক্ষ কঠিন মাটি বার বার খুঁড়ে বীজ বপন করতে হয়। এ পদ্ধতিতে পানি ছাড়াই চাষবাস করতে হয়। পরবর্তীতে অবশ্য আধুনিক কৃষি পদ্ধতি বুনো পশ্চিমের জীবন যাপনকে সহজ করে দেয়। জন ডিরের মোল্ডবোর্ড এবং সাইরাস ম্যাকরমিকের হস্তচালিত ফসল উত্তলনের মেশিন পশ্চিমের কৃষিকে দেয় নতুন মাত্রা। ১৮৫৮ সালে লুইস মিলার ফসল বাঁধার মেশিন তৈরি করে শস্য বাজারজাতকরণে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন। অতঃপর ১৯০০ সালের দিকে ট্রাক্টর এবং ট্রাক নেমে এল পশ্চিমের জমিতে। বীজ, কৃষির যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, গৃহপালিত পশুদের খাদ্য ইত্যাদির ব্যবসা শুরু হল। একে একে গড়ে উঠল ব্যাংক, স্কুল, গির্জা এবং সমাজ ব্যবস্থা।
এবার আসা যাক ভাগ্য অন্বেষণকারী সেই মানুষদের কথায় যারা স্বর্ণ ও অন্যান্য রত্নের আশায় ক্যালিফোর্নিয়ায় এসে জড়ো হয়। ১৮৪৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার স্টাটার মিল এলাকায় জেমস মার্শাল নামক এক কারখানা মালিক সর্বপ্রথম স্বর্ণের সন্ধান পান। ২ বছরে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ সেখানে স্বর্ণ উত্তোলনের জন্য জড়ো হয়। এছাড়াও অরিগনের দক্ষিণাংশে, কলোরাডোর পাইক্স পিকে, নেভাদার কমস্টক লোডে ১৮৫০-৫৯ পর্যন্ত অনেকগুলো স্বর্ণখনি আবিষ্কৃত ও উত্তোলিত হয়। এসব খনি বিস্ফোরণ স্বর্ণসহ অন্যন্য মুল্যবান সামগ্রী পাওয়া যেত যা বেশ দামে বিক্রি হত। ১৮০০ সালের শেষের দিকে ব্ল্যাক গোল্ড নামক এক ধরণের তেল বিক্রি করে পশ্চিমের অনেকেই বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছিল।
খনি শ্রমিকরা প্রথমে প্যানিং পদ্ধতিতে মাটি স্বর্ণ আলাদা করে থাকে। প্রথমে একটি লোহার প্যানে নদীগর্ভ থেকে বালি এবং পাথর মিশ্রিত মাটি নেয়। তারপর তা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘোরাতে থাকে। এতে খুব সহজে ভারি স্বর্ণগুলো একদম উপরে চলে আসে। কখনো কখনো তারা বড় বড় পাথর সাথে রাখে যাতে প্রাপ্ত নুড়িগুলো ভেঙ্গে চূর্ণ করে ফেলা যায়। ছোট ছোট দানাদার স্বর্ণগুলো আলাদা করতে অবশ্য পারদ মেশাতে হত যাতে খুব সহজে দানাদার স্বর্ণ আলাদা করা যায়। স্বর্ণের সাথে সাথে তারা কোয়ার্টজও উত্তোলন করত।
অন্যন্য ওয়েস্টার্নবাসীদের মতো খনি শ্রমিকদেরও কঠোর জীবনযাপন করতে হতো। কখনো প্রচন্ড গরমে সোনা রুপা খোঁজা, কখনো পাহাড়ের প্রচন্ড ঠাণ্ডা পানিতে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হত। সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা হত তা হলো খনির কাঁকর, পাথর এবং নুড়ি কাপড়ে ঢুকে পড়ত, খুব সহজেই কাপড় ফুটো হয়ে যেত এবং শ্রমিকদের হাত পায়ে ফুটতো।
খনি আশেপাশের এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত নগর। পশ্চিমের সবচেয়ে বিশৃঙ্খলা সংঘটিও হত খনি প্রধান শহরগুলোতে। খনি প্রধান এলাকাগুলোয় প্রচুর হত্যা, রাহাজানি, ছিনতাই এবং বন্দুকবাজি বেশি হত। এতই অপরাধ সংঘটিত হত যে পুরো পশ্চিমে খনি এলাকাগুলোতে কাউন্সিলের ব্যবস্থা করা হয় যেখানে বিচার এবং শাস্তি প্রদান করা হত। শুধু তাই নয় খনি শ্রমিকদের বিনোদনের অন্যতম স্থান ছিল পতিতালয়।
এবার আসা যাক র্যাঞ্চিং এর কথায়। ১৭০০ সালের আগ পর্যন্ত র্যাঞ্চার বলতে শুধু স্প্যানিশ এবং মেক্সিকানরাই। কিন্তু গৃহযুদ্ধের সময় অধিকাংশ সমর্থ যুবা পুরুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। র্যাঞ্চিং ব্যবসাও ধ্বসের মুখে পড়ে। যুদ্ধফেরত নাগরিকেরা তখন কানসাসে পশু বিক্রির সিদ্ধান্ত নিল। লাভের মুখ দেখায় পুরো টেক্সাস এবং ক্যালিফোর্নিয়া জুড়ে পশু পালন, র্যাঞ্চিং শুরু হল।
ময়লা ছোট ঘাসের তৈরি র্যাঞ্চহাউজ থেকে শুরু করে কাঠের বড় বড় র্যাঞ্চ হাউজও দেখা যেত সেসময়। তবে র্যাঞ্চ মালিক যদি বনভুমির মালিক হন তবে তার বাড়িতে একটি কাঠের তৈরি লগ কেবিন থাকবেই। একটি ফায়ারপ্লেস, কাঠ পুড়িয়ে রান্না হয় এমন স্টোভ নিয়ে তৈরি ছোট ছোট র্যাঞ্চ হাউজ। আর বড় বড় র্যাঞ্চ হাউজে আলাদা একটি শস্যঘর, আউটহাউজ, রান্নাঘর এবং কাউবয়দের জন্য বাঙ্ক হাউজও থাকে। বাঙ্কহাউজগুলোর দেয়ালে কাগজ দিয়ে সাঁটা থাকে যাতে ঠান্ডা বাতাস ভেতরে না ঢুকতে পারে। তাছাড়া কাউবয়দের জন্য কাঠের তৈরি বিছানার ব্যবস্থা থাকে প্রত্যেক বাড়িতেই। কাউবয়দের বিনোদন গান গেয়ে, গল্প গুজব করে এবং ঘোড় দৌড়ের মাধ্যমে।
টেক্সাস থেকে কানসাসের The Chisholm Trail প্রায় ১,০০০ মাইলের এই ট্রেইল দিয়ে হাজার হাজার গবাদি পশু বিক্রির উদ্দেশ্য নিয়ে যাওয়া হয়। পথে নানা ধরনের বিপদের ঝুঁকি থাকে। বজ্রপাত, বৃষ্টি, রাসলারদের আক্রমণ, টর্নেডো, প্রেইরি ফায়ার ছাড়াও পশুদের চারণভুমির সমস্যা তো রয়েছেই। পশুদের নিয়ে বন্দুকসহ কাউবয়রা কানসাস যেত। প্রথম ৫০ কিলোমিটার যেতে একটু বেশি কাঠ খড় পোড়াতে হত। কারণ গবাদি পশুগুলো র্যাঞ্চহাউজে ফিরে আসতে চাইত। তখন পশু সামলাতে কাউবয়দের বেশ বিপদে পড়তে হয়।