ধরা যাক, আপনি একজন সাধারণ ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হয়েছেন। আপনার স্বপ্ন ছিল বের হবার পরে চাকরি পাবেন। সিভি নিয়ে অনেক জায়গায় গেলেনও, কিন্তু দেখতে পেলেন যে, কোনো একটা কারণে চাকরি হচ্ছে না। কিন্তু আপনি পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, পাশ করেই চাকরি করবেন, নানা স্বপ্ন পূরণ করবেন ইত্যাদি।
অথবা ধরা যাক, আপনি একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসা শুরু করার সময় অনেক পরিকল্পনা ছিল আপনার, কিন্তু শুরু করার পর দেখলেন কিছুই পরিকল্পনা মতো হচ্ছে না। নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
এ ধরনের অবস্থায় প্রায় সব মানুষই পড়ে থাকেন। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় চারশ বছর আগে চীনা দার্শনিক মেনসিয়াসও এমন সমস্যায় পড়েছিলেন। তার সমস্যাটির কথা বিস্তারিতভাবে একটু বলা যাক, কারণ, তিনি পরবর্তীতে জীবন সম্পর্কে কিছু একটা বুঝতে পেরেছিলেন। তার সেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আমাদের এ ধরনের সমস্যায় সাহায্য করতে পারে।
মেনসিয়াস ছিলেন একজন কনফুসিয়ান ধারার পণ্ডিত। তিনি মনে করলেন, এখনই সময় কনফুসিয়ান ধারার একটি রাজ্য গঠনের। তিনি তখন বৃদ্ধ, তবুও এক রাজার কাছ থেকে আরেক রাজার কাছে যেতে লাগলেন তার বার্তা নিয়ে। তিনি তাদের বোঝাতে লাগলেন কনফুসিয়াসের শিক্ষা এবং কেন একটি কনফুসিয়ান ধারার রাজ্য দরকার। তাদের তিনি বলতে লাগলেন, তারা যেন তাকে রেখে দেন কনফুসিয়াসের দর্শন শিক্ষা দেবার জন্য এবং কনফুসিয়াস যেভাবে বলেছেন সেভাবে দেশ চলছে কিনা তা দেখার জন্য।
অনেক বছর গেল এভাবে। এরপর কুই রাজ্যের রাজা মেনসিয়াসকে মন্ত্রীর মতো এক পদ দিলেন, তার কথা শোনার জন্য একদল শ্রোতা দিলেন। মেনসিয়াসের স্বপ্ন পূরণ হলো তার বৃদ্ধ বয়সে এসে। তিনি আজীবন স্বপ্ন দেখে এসেছেন তিনি একজন ভালো রাজার দার্শনিক উপদেষ্টা হবেন। ভালো রাজা দেশ চালাবেন আর তিনি তাকে উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে যাবেন। তৈরি হবে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ।
কিন্তু শীঘ্রই মেনসিয়াস দেখতে পারলেন কুই রাজ্যের শাসকের দর্শনে বিশেষ আগ্রহ নেই। তিনি পাশের রাজ্যের সাথে যুদ্ধ করেন আর জনগণকে বলেন, দার্শনিক মেনসিয়াস কনফুসিয়াসের দর্শন মোতাবেক তাকে এ কাজ করতে বলেছেন। এই বলে রাজা জনসমর্থন আদায় করতেন ও নিজের অন্যায় আক্রমণকে ন্যায্যতা দিতে শুরু করলেন।
মেনসিয়াস এতে ব্যথিত হলেন। তখন তার বয়স এতই বেশি যে, আর কোনো রাজার কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। মর্মাহত বৃদ্ধ দার্শনিক মেনসিয়াস হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি রাজার প্রাসাদ ছেড়ে গ্রামে তার নিজের বাড়িতে চলে এলেন। বিষণ্ন মেনসিয়াস তার গ্রামের বাড়িতে বসে ভাবতে লাগলেন। তিনি সারা জীবন যা চেয়েছেন, তা পেয়েও তিনি তার দার্শনিক শিক্ষা দিয়ে একটি রাজ্য তৈরি করতে পারলেন না। জীবনের এই ঘটনা তাকে জীবন সম্পর্কে ভিন্নভাবে ভাবতে বাধ্য করল।
তিনি ভাবলেন, আমরা মনে করি পৃথিবী নিশ্চিত এবং আমাদের পরিকল্পনা মতো সব হলেই ঠিকঠাক হবে আমাদের জন্য। আমরা ভবিষ্যতকে নিশ্চিত ধরেই পরিকল্পনা করি। কিন্তু আমাদের এই বিশ্বাস আমাদের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। সত্যিকার অর্থে এই পৃথিবী বিশৃঙ্খল ও অনিশ্চিত। এই বিশৃঙ্খল ও অনিশ্চিত পৃথিবীতে আমরা কীভাবে সিদ্ধান্ত নেব? কীভাবেই বা পরিকল্পনা করবো ভবিষ্যতের?
মেনসিয়াসের পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টি বদলে গেল। তিনি দেখলেন, এই পৃথিবীতে কঠোর পরিশ্রম সবসময় সফলতা নিয়ে আসে না। খারাপ লোক সবসময় শাস্তি পায় না। পৃথিবীতে কোনো কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না, এখানে শৃঙ্খলা নেই। যখন মানুষেরা এই মূল ধারণাটি নিয়ে জীবনযাপন করবে, তখন তারা আরো ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারবে বলেই মনে করতেন মেনসিয়াস।
মেনসিয়াসের দর্শনে মিং বলতে একটি জিনিস আছে। এই মিং ভাগ্য, স্বর্গের নির্দেশ এরকম নানাভাবে অনূদিত হয়েছে। কিন্তু মেনসিয়াস মিং বলতে বুঝিয়েছেন এমন সব ঘটনা, ভালো বা মন্দ, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। যেমন- এই লেখা আমি কম্পিউটারে লিখছি। এখন যদি হার্ড ডিস্ক ক্র্যাশ করে, আমি লেখাটি হারাবো। এই ঘটনাটি আমার জন্য হবে বেদনাদায়ক, কিন্তু এর উপর আমার তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
মিং বলেন যে, একজনের জীবনে সুখের ঘটনা এবং দুঃখের ঘটনা ঘটতে পারে, তার পরিকল্পনা যা-ই হোক না কেন। যেমন- কোনো অল্প বয়স্ক মানুষ তার ছোট সন্তান রেখে মারা যেতে পারেন, কোনো প্রতিভাবান ব্যক্তি চাকরি হারাতে পারেন ইত্যাদি। এসব দুঃখজনক ঘটনা আমরা জীবনে প্রায়শই দেখে থাকি। কনফুসিয়াসেরই এক প্রিয় শিষ্য খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিল।
কিউ রাজ্যের রাজা যেভাবে মেনসিয়াসকে ব্যবহার করেছিলেন, যেভাবে তার এতদিনের পরিকল্পনা ও সাধনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো, তা প্রথমে মেনে নিতে পারছিলেন না মেনসিয়াস। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি তা কাটিয়ে ওঠেন ও অনিশ্চিত পৃথিবীর চরিত্র সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন।
প্রাচীন গ্রীস ও রোমে একধরনের দর্শন ধারা গড়ে উঠেছিল দার্শনিক জেনোর হাত ধরে। তারা ছিলেন একধরনের সক্রেটিস পন্থী ও সিনিকদের দ্বারা প্রভাবিত। এই দর্শন ধারাটির নাম স্টোয়িসিজম। স্টোয়িকদের দর্শনের একটি মূলকথা হচ্ছে, একজন মানুষের বুঝতে হবে কী তার নিয়ন্ত্রণে আছে এবং কী তার নিয়ন্ত্রণে নেই। কোনো সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা করার সময় মানুষ যখন এই কথাটি মনে রাখে, তখন তার পক্ষে অপেক্ষাকৃত ভালো পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব।
মেনসিয়াসের মিং যে কেবল খারাপ এবং দুঃখজনক জিনিস এমন নয়। যেকোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া, পরিকল্পনাহীন ভালো জিনিসও এর মধ্যে পড়ে। যখন আমরা ভালো জিনিসগুলোকেও হিসেবের মধ্যে আনবো, তখন জীবন অধিক সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে। অনেক ভালো জিনিসও ঘটে যেতে পারে আকস্মিকভাবে। মেনসিয়াসের কথা হলো, ভালো বা খারাপ যা-ই ঘটুক না কেন, একজন মানুষ যেন এর অনিশ্চয়তা সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং এজন্য তৈরি থাকে।
জীবনের অনিশ্চয়তার বোধ যদি না থাকে, তাহলে কোনো কাজে সফল হলে মানুষ মনে করে যে কেবলমাত্র তার নিজের প্রতিভা ও পরিশ্রমের কারণেই সে এটা অর্জন করতে পেরেছে। এই ধরনের ভুল চিন্তার কারণেই ‘ন্যারেটিভ ফ্যালাসি’র মতো বিভ্রান্তির তৈরি হয় সফল মানুষের সফলতা বর্ণনার ক্ষেত্রে। প্রতিটি সফলতায় ব্যক্তির প্রতিভা ও পরিশ্রমের বাইরেও আরো নানা আর্থ-সামাজিক বিষয় কাজ করে। এসব আর্থ-সামাজিক বিষয় বিবেচনায় না নিলে আমরা একটি ভুল চিত্র পাব সফলতার গল্পের এবং ব্যক্তিটি হয়ে উঠতে পারেন অহংকারী।
আবার পর্যাপ্ত পরিশ্রম করে কোনো ব্যক্তি যদি ব্যর্থ হন এবং জীবনের অনিশ্চয়তা সম্পর্কে তার ধারণা না থাকে, তখন তিনি হয়ে পড়বেন বেশি হতাশ। তার এই হতাশা তাকে আরো ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যাবে, নিয়ে যাবে আরো দুঃখবোধের দিকে। আধুনিক সমাজে যখন সেলফ মেইড ম্যান সহ আরো নানা সফলতার প্রপঞ্চ ব্যবহার করে মিডিয়া এবং এভাবে তরুণদের অনুপ্রেরণা দিতে যায়, এই সফলদের পথ অনুসরণ করে অনেকেই ব্যর্থ হয়ে বেশি হতাশ হয়ে পড়ে। তাই এই আধুনিক সমাজেও মেনসিয়াসের শিক্ষা আমাদের কাজে লাগতে পারে।
মাইকেল পুয়েট এবং ক্রিস্টিন গ্রস লো চীনা দর্শন কীভাবে সুন্দর জীবন সম্পর্কে আধুনিক মানুষদের শিক্ষা দিতে পারে এ নিয়ে একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম দ্য পাথ। পুয়েট হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা দর্শন নিয়ে একটি কোর্স পড়ান এবং তা হার্ভার্ডের সবচাইতে জনপ্রিয় কোর্সগুলোর একটি। বইটি আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।
তথ্যসূত্র: Michael Puett, Christine Gross-Loh; The Path: What Chinese Philosophers Can Teach Us About the Good Life; 2016; Simon & Schuster; USA.
ফিচার ইমেজ- Encyclopedia Britannica