ফ্যাশন জগতে ইউরোপের অবদান ও প্রভাব অনস্বীকার্য। বিশ্বের প্রধান ফ্যাশন রাজধানী হিসেবে খ্যাত চারটি শহরের- নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, মিলান ও প্যারিস- তিনটিই ইউরোপে অবস্থিত। ফ্যাশন জগতে ইউরোপের এই আধিপত্যের কারণ আসলে কী? এর উত্তর মোটেও জটিল নয়। এই আধিপত্যের কারণ, বিশ্ব ফ্যাশনে ইউরোপীয় ফ্যাশন ডিজাইনারদের অবদান। আর এ অবদান রাখতে সবচেয়ে সফল ফ্যাশন ডিজাইনারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- ইভস্ সাঁ লরঁ।
জীবনের প্রথমভাগ
ইভস্ হেনরি ডোনাট ম্যাথিউ-সাঁ-লরঁ –এর জন্ম ১৯৩৬ সালের ১ আগস্ট, আলজেরিয়ার ওরানে এবং ২০০৮ সালের ১ জুন ফ্রান্সের প্যরিসে তিনি মস্তিষ্কের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার বাবা চার্লস আন্দ্রে ম্যাথিউ-সাঁ-লরঁ ছিলেন একজন আইনজীবী ও ইনস্যুরেন্স কর্মকর্তা। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে উঠলেও, সাঁ লরঁর ছেলেবেলা মোটেও সহজ ছিল না। সমকামী আচরণের জন্য স্কুলে তাকে প্রায়ই হয়রানির শিকার হতে হতো। এ কারণে তিনি খুব অল্পতেই ঘাবড়ে যেতেন এবং বেশিরভাগ সময়েই অসুস্থ থাকতেন।
কিন্তু ফ্যাশন জগৎ, সাঁ লরঁকে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। তিনি কাগজ দিয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ডিজাইনের পুতুল তৈরি করতেন। কৈশোরের শুরুতে তিনি তার মা ও দুই বোনের জন্য পোশাক ডিজাইন করতেন। ১৭ বছর বয়সে মায়ের সাথে প্যারিসে গিয়ে সাঁ লরঁ একটি সম্পূর্ণ নতুন জগতের সাথে পরিচিত হন। সেখানে তার মা, ফরাসি ভোগ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ‘মাইকেল ডি বার্নফ‘-এর সাথে একটি সাক্ষাতের আয়োজন করেন।
ওরানে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর, মঞ্চের শিল্পীদের ও নারীদের পোশাক ডিজাইন বিষয়ে শিক্ষা লাভের জন্য সাঁ লরঁ, ওরান ত্যাগ করে প্যারিসে চলে যান। সেখানে তিনি ‘শম্ব্রে সিণ্ডিকেল দে লা কুতুর’- এ ভর্তি হন। তিনি খুব অল্প সময়ের জন্য ফ্যাশন স্কুলে পড়াশোনা করেন। এই সময়েই তিনি একটি আন্তর্জাতিক ডিজাইন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। ফরাসি ভোগ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ক্রিশ্চিয়ান দিওরকে, সাঁ লরঁ-এর কিছু ডিজাইন দেখালে, দিওর এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি সাথে সাথেই নিজের সহকারী হিসেবে সাঁ লরঁকে নিয়োগ দেন। সেসময়ে লরঁর বয়স ছিল মাত্র সতের বছর।
দিওর আমাকে বিমোহিত করেছিলেন। আমি তার সামনে কথাই বলতে পারতাম না। তিনি আমাকে আমার শিল্পের মূল ভিত্তি শিখিয়েছেন। এরপরে যা-ই ঘটে থাকুক, তার সাথে কাটানো বছরগুলো আমি কখনই ভুলতে পারবো না।
দিওরের মৃত্যুর পরে ১৯৫৭ সালে, দিওরের শিষ্য হিসেবে, সাঁ লরঁ, ‘হাউস অফ দিওর’ এর প্রধান নিযুক্ত হন। দিওরের একটি স্বকীয় ডিজাইন ছিল ‘লিটল্ গার্ল লুক’। হাউসটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরে সাঁ লরঁ এই স্বকীয়তার ধারা বজায় রেখেই এ-লাইন পোশাকের পাশাপাশি আরও পরিশীলিত ও দীর্ঘকায় স্কার্টের প্রচলন করেন। কিন্তু ১৯৫৯ সালে তিনি হঠাৎ করেই লম্বায় বেশ ছোট আকারের স্কার্ট ডিজাইন করেন। আর ১৯৬০ সালে তিনি, ‘বীটনিক’ হিসেবে পরিচিত বাউণ্ডুলে তথা সমাজের চিরাচরিত প্রথাবিরোধী সম্প্রদায়ের পোশাকের মত করে টার্টলনেক টপ (কচ্ছপের মতো গলার চারদিকে উঁচু কলারওয়ালা) ও ধারের দিকে পশুর লোম বসানো কালো রঙের চামড়ার জ্যাকেটের প্রবর্তন করেন।
কিংবদন্তির যাত্রার শুরু
১৯৬০ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সাঁ লরঁ, তার দেশ আলজেরিয়াতে ফিরে যেতে বাধ্য হন। তবে, স্নায়বিক অসুস্থতার কারণে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার অনুমতি লাভ করেন। কিন্তু প্যারিসে ফিরে তিনি জানতে পারেন, হাউস অফ দিওর-এ তার জায়গায় অন্য এক ডিজাইনারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তরুণ, সংবেদনশীল এই ডিজাইনারের জন্য প্রাথমিকভাবে সেই সংবাদটি ছিল খুবই দুঃখজনক। কিন্তু এর পরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। তাই সাঁ লরঁ আইনের সহায়তা নিতে বাধ্য হন। সে মামলায় বিজয়ী হয়ে তিনি ৪৮,০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড লাভ করেন।
হঠাৎ করে পাওয়া সেই অর্থ তার জন্য এক নতুন সুযোগের অবতারণা করে। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে বন্ধু ও প্রেমিক পিয়ের বার্জে’র সাথে ১৯৬২ সালে সাঁ লরঁ, প্যারিসে তার নিজস্ব ফ্যাশন হাউস প্রতিষ্ঠা করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি প্যারিসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
ফ্যাশন জগতে ইভস্ সাঁ লরঁর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ অবদান হল- নারীদের জন্য তৈরি ট্রাউজার্স বা ‘লু স্মোকিং’ টাক্সিডো (বিশেষ ধরনের জ্যাকেট ও ট্রাউজার্স, যা ফর্মাল পোশাক হিসেবে সাধারণত পুরুষেরা পরিধান করে থাকে)। এই ট্রাউজার্স শুধুমাত্র শহরের নারীদের জন্যই না, বরং গ্রামের নারীদের কথা মাথায় রেখেও ডিজাইন করা হয়। ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে তার তৈরী পোশাকে ধাতব রঙের ও স্বচ্ছ কাপড়ের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। আর ১৯৭০ এর দশকে তিনি গ্রামের মানুষের চিরাচরিত পোশাকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, ‘হ্যত কুতুর’ কালেকশনে এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ডিজাইন করেন। তার তৈরী উল্লেখযোগ্য পোশাকের মধ্যে আরও ছিল স্বচ্ছ ব্লাউজ বা টপ এবং জাম্পস্যুট।
১৯৬০ ও ১৯৭০– এই দুই দশকে ইভস্ সাঁ লরঁ’র ফ্যাশন ব্যবসায় বিশেষভাবে ব্যাপ্তিলাভ করে। এগুলোর মধ্যে ছিল রেডি-টু-ওয়্যার তথা তৈরী পোশাক ব্যবসায়ের লাইসেন্স প্রাপ্তি, অ্যাক্সেসরিজের অন্তর্ভুক্তি, গৃহস্থালির সাজসজ্জার জন্য ব্যবহৃত লিনেনের ডিজাইনের যাত্রা, সুগন্ধির প্রচলন– বিশেষত: ১৯৬৪ সালের ওয়াই, ১৯৭১ সালের রিভ গশ এবং ১৯৭৭ সালের ওপিয়াম উল্লেখযোগ্য, পুরুষদের পোশাকের কালেকশনের যাত্রা এবং তার কুতুর ব্যবসায়ের প্রচলন। ১৯৮৬ সালে পিয়েরের সাথে তার সম্পর্ক ভেঙে গেলেও তাদের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এই ব্যবসা আরও বেশ কয়েক বছর যাবৎ লাভজনকভাবেই চলেছিল।
সাঁ লরঁ একজন সত্যিকারের কিংবদন্তি ডিজাইনার ছিলেন। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যময় ছিল না। তিনি মদ্যপান ও মাদকাসক্তির কারণে বেশ ভুগেছেন। এমনও শোনা গিয়েছিল যে, তার ডিজাইনে আর আগের মতো আকর্ষণ নেই, একঘেয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু ১৯৯০ এর দশকে তিনি আগের চেয়েও বেশি প্রভাবশালী ডিজাইনার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এবারে তার ক্রেতাও ছিল আরও আধুনিক মানসিকতার।
২০০২ সালে ম্যারাকেশ-এ তার শেষ ফ্যাশন শো সম্পন্ন করে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পূর্বে তিনি তার কুতুর ব্যবসায়টি বন্ধ করে দেন।
অবসর পরবর্তী জীবন
১৯৮৩ সালে ‘মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অভ আর্ট‘, নিউ ইয়র্কে, সাঁ লরঁ’র অতীতের উল্লেখযোগ্য সব ডিজাইন নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এটি ছিল একজন একক ডিজাইনারের কাজ নিয়ে আয়োজিত প্রথম প্রদর্শনী। ১৯৯৯ সালে তিনি প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যে তার তৈরি পোশাকের ব্যবসাটি আরেক বিখ্যাত ফ্যাশন হাউস গুচ্চি’র কাছে বিক্রি করে দেন।
২০০৭ সালে সাঁ লরঁকে, ফ্রান্সের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নিকোলাস সারকোজি, ‘লিজিওঁ দে অনারার’-এর গ্র্যান্ড অফিসার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। দু বছর পরে অর্থাৎ ২০০৯ সালে, তার বন্ধু পিয়ের বার্জে’র সাথে তিনি যে শিল্পকর্ম সংগ্রহ করেছিলেন, সেগুলো প্যারিসে একটি নিলামে তোলা হয়। একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহ বিক্রির বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থের হিসাবে, তার এই সংগ্রহের বিক্রীত মূল্য ২৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার- এক্ষেত্রে একটি নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি করে।