ট্রনরা সেই যে ভয়ানক হামলা চালালো, ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর বুক চিরে হৃদপিন্ড নিয়ে গেলো তারা, সেই ভয়াবহ ঘটনার তিন মাস পেরিয়েছে। লানা সেই হামলায় অনাথ হওয়া শিশুদের জন্য একটা আশ্রয়কেন্দ্র খুলে বসেছেন। ঝড়-বাদলের সেই দিনটাতে অনাথ আশ্রমের কাজ সেরে কুনিল আর লানা যখন ঘরে ফিরছে, সমুদ্রের তীরে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা এক মানুষ নজর কাড়লো লানার। কে সে? ঝড়ের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নির্ভয় বসে আছে সাগরের ধারে?
যারা বায়োবট
মুহম্মদ জাফর ইকবালের দারুণ এক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী যারা বায়োবট। অত্যাচারী এক গোষ্ঠী আর তাদের শিকার দুর্বল একদল মানুষের জীবনযাত্রায় সময়ের আরেক প্রান্ত থেকে এসে জুড়ে যাওয়া রহস্যময় এক তরুণের গল্প এটি। যন্ত্র বনাম মানবের চিরন্তন দ্বন্দ্ব নিয়ে এই গল্প, যা লেখকের অনেক অনেক লেখায় বহুভাবে এসেছে বারবার। এই কাহিনী এক বিশেষ তরুণের, যাকে প্রকৃতি বারবার রক্ষা করেছে বিপদের হাত থেকে, কেননা সে বহন করে চলেছে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ।
কুনিলদের জীবন
তেরো বছরের কিশোর কুনিল, সাগরের ধারে বেড়ে ওঠা এক জনপদে মা লানাকে নিয়ে তার বাস। কুনিলের বাবা কুশানের প্রচেষ্টায় ট্রনদের নৃশংসতার মাঝেই একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে জনপদটির সভ্যতা। কুশানই এই মানুষগুলোকে শিখিয়েছিলো, এই পৃথিবীতে তাদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। কুশান মারা যায় ট্রনদের হাতে। এই অঞ্চলের মানুষেরা কুশানকে বড় ভালোবাসে। কুনিল তার বাবাকে দেখেনি বটে, কিন্তু সে জানে, কুশানের সন্তান বলে তার জন্যেও এই মানুষগুলো বড় ভালোবাসা পুষে রেখেছে।
ভাঙ্গাচোরা বসতিটাকে আরেকটু উন্নত করতে খেটে চলে এই জনপদের মানুষগুলো। চৌদ্দ বছরের কিরীণা, কুনিলের পছন্দের মানুষ সে। ইলির সংগ্রহে থাকা বইয়ের কথা বলে কুনিল কিরীণাকে। লুকিয়ে একখানা ক্রিস্টাল রিডার কিনেছে কুনিল। পড়ার ভারী শখ তার। কিন্তু এই অঞ্চলে বই পড়া যে নিষিদ্ধ! ট্রনরা চায় না তারা শিক্ষালাভের সুযোগ পাক। এই মানুষেরা পশুর মতো জীবন কাটাবে, নিজেদের মাঝে যুদ্ধ করে ধ্বংস হয়ে যাবে, এমনটাই ইচ্ছা নিষ্ঠুর ট্রন জাতির।
ইলি এই অঞ্চলের মানুষগুলোর জীবনযাত্রার দৈন্যদশা তাড়ানোর কথা ভাবে। সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করে। ইলির বাসায় তাই কুনিলের নিত্য যাতায়াত। কুনিল ইলেক্ট্রনিক্সের বই পড়ে উপগ্রহ স্টেশন তৈরি করতে শিখেছে, মানবজন্ম রহস্যও তার পড়া। বই পড়ার কারণে যদি ধরা পড়ে যায় কোনোদিন, হত্যা করা হবে তাকে। ট্রনদের শাসনের আড়ালে তাই নিষিদ্ধ জীবন কাটে কুনিলের।
দুঃস্বপ্নের রাত
কুনিলের স্মৃতিতে বিষাক্ত এক অধ্যায় যোগ হয় সেই রাতে। শঙ্খের শব্দের মতো সাইরেন বাজিয়ে ট্রনরা আসে। কুনিলদের মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকা সভ্যতাকে গুঁড়িয়ে দিতে আসে ট্রনরা। ছোট বাচ্চাদের খুন করতে আসে। তুলে নিয়ে যায় সুন্দরী মেয়ে আর সুদর্শন পুরুষদের। কুনিলদের ছোট্ট জনপদ রূপান্তরিত হয় নরকে, আকাশ ভারী হয়ে যায় স্বজন হারানোর আর্তনাদে। আবার কি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে তারা?
রহস্যময় তরুণ
ঝড়ে উত্তাল সমুদ্রের ধারে নির্বিকার থাকা মানুষটা অপূর্ব সুন্দর এক তরুণ। কুনিলদের জনপদের বাসিন্দা নয় সে। এসেছে ভিন্ন কোনো অঞ্চল থেকে। তার মুখে কোনো ভাষা নেই। যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টাও নেই। বিষণ্ণ এই তরুণকে লানা তাদের ঘরে নিয়ে যায়। কুনিল তখনো জানে না, ট্রনদের ত্রাসের রাজত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার যে স্বপ্ন তারা দেখে চলেছে, সেই স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।
সেই রাতে ঝড় বাড়লো আরো। জলোচ্ছ্বাস এলো। কুনিলদের ঘরটা পানিতে তলিয়ে যায়। গাঢ় অন্ধকার কাটছে তেমন সময়টাতে কুনিলের ঘুম ভাঙালো লানা। কথা না বলা সেই পাগল ছেলেটা লানাদের সাথে থাকে না, সোজা হেঁটে যায় সমুদ্রের দিকে। ভয়ানক ঢেউয়ের আক্রোশ তার সামনে, ক্ষণে ক্ষণে ফুঁসে উঠছে সাগর, তাতে কিচ্ছুটি হচ্ছে না তার। বিরাট একটা ঢেউ ছেলেটাকে ভাসিয়ে নিতে আসছিলো যেন, কিন্তু তারপর খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটলো। ছেলেটার পায়ের কাছে এসে ঢেউ ভেঙে গেলো হঠাৎ! সে যত এগোচ্ছে, ঢেউয়ের দল ততবার তার পায়ের কাছে এসে চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। হিংস্র সমুদ্র বশ মানছে এক পাগলের কাছে! কুনিল হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, প্রকৃতি এ কী খেল দেখাচ্ছে তাদের! তবুও এই তরুণ কুনিলের কাছে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন অস্বাভাবিক সৌভাগ্যবান মানুষ, আর কিছুই নয়।
তরুণের নাম রুকাস
কথা বলে না ছেলেটা। তার নাম-পরিচয় নেই। কিন্তু দিব্যি সে কুনিলদের ঘরে ঠাঁই গেড়ে ফেলেছে। কুনিল তাই তার একখানা নাম দিলো। সেই প্রথমবার বুলি ফুটলো ছেলেটির মুখে। খুব ধীরে নতুন নামটা উচ্চারণ করলো সে। রুকাস! রহস্যে ভরা তরুণের নতুন জীবন শুরু হলো ‘রুকাস’ নাম নিয়ে।
বয়স ঋণাত্মক
জিন বিশ্লেষণ করে একজন মানুষের জাত, বয়স বলে দেয় এমন একটা নতুন যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হলো রহস্যময় আগন্তুককে। যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে ইলির ভ্রূ কুঁচকে গেলো, বিগড়ে গেছে সেটা। আগন্তুকের বয়স লিখেছে ২,৩০৯, তা-ও কি না সামনে একটা বিয়োগ চিহ্নসহ! সময়ের উল্টোদিকে কারো বয়স হয় নাকি! রুকাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চমকে যায় কুনিল, খুব অদ্ভুত একটা সম্ভাবনা উঁকি দেয় তার মাথায়। কিন্তু আদৌ কি সেটা সম্ভব? ইলিকে কথাটা জানাতে গিয়ে রুকাসের দিকে আবার চোখ ঘোরায় কুনিল। মুখের হাসি মুছে গেছে রুকাসের। চেহারায় বিষাদের ছাপ। কুনিল কি তবে এমন কিছু বুঝে ফেলেছে, যা রুকাস চায়নি?
রুকাস দিব্যি মানিয়ে নেয় কুনিলদের পরিবারে। কুনিল বোঝে, রুকাস একদিন এমন করেই চলে যাবে, ঠিক যেমনটা সে এসেছিলো। কুনিলের ভারী মন খারাপ হয়। বাতাসে তখন ভাসছে আতঙ্কের খবর, ট্রনরা আসছে আবার। নৃশংস আক্রমণ চালালো ট্রনরা। বিশাল মহাকাশযানের মতো দেখতে ছয়টা প্লেন নিয়ে এলো তারা। তুলে নিতে লাগলো কিশোর-কিশোরীদের। মরণ তান্ডব চলে নির্বিচারে। কিরীণাকে তুলে নেয় ট্রনবাহিনীর রোবট, শেষবারের মতো কুনিলের দিকে হাত বাড়ায় কিরীণা!
শান্ত, ধীরস্থির রুকাস সামনে এগোয় এবার। ট্রনরা জানতো না এখানে বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো তাদের জন্য। ফিরে যায় তারা, যা নিতে এসেছিলো সব রেখেই। কিন্তু ধরা পড়ে যায় সময়ের উল্টোদিকে লুকিয়ে রহস্যময় তরুণ, ভবিষ্যৎয়ের মানুষ রুকাস!
রুকাস, এবং যারা বায়োবট
পালিয়ে বেড়াচ্ছে রুকাস তাদের থেকে, পাশাপাশি বাস করেও যারা পূর্ণাঙ্গ মানুষ নয়, যারা বায়োবট।
ভবিষ্যৎ পৃথিবীর একটা সময়ে এক সামান্য দুর্ঘটনা থেকে বায়োবট জাতির উত্থান। একসময় মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের জৈবিক হাত-পা কেটে কৃত্রিম হাত-পা প্রতিস্থাপন শুরু করলো, অনেক বেশি কর্মদক্ষতার লোভে। আর তারপর এই ইচ্ছাকৃত কাজকে বাধ্যতামূলক বানানোর চেষ্টা শুরু হয়। শিশু জন্মানোর সাথে সাথেই তার হাত-পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় শরীর থেকে, কৃত্রিম অঙ্গ লাগানোর জন্য। একটা সময় শুরু হয়ে যায় আরো অসুস্থ সব গবেষণা। মাতৃগর্ভেই বিকলাঙ্গ করে দেয়া হয় শিশুদের, বাধ্য হয়েই যেন বায়োবট করা লাগে তাদের। মানুষের চিন্তা আর বংশবৃদ্ধির ক্ষমতার সাথে যন্ত্রের নিখুঁত কর্মদক্ষতা, জৈবিক প্রাণীদেহে রোবটের অঙ্গ, এরাই বায়োবট জাতি। আর তারা শাসন করছে ভবিষ্যৎ দুনিয়া।
বায়োবট হওয়ার বাধ্যতামূলক সময়ে তাই দুই হাজার বছর পরের পৃথিবীতে সংঘাত ঘটে বায়োবটদের সাথে মানুষদের। তখনো এমন কিছু মানুষ রয়ে যায়, যারা যন্ত্রের নিখুঁত জীবন চায়নি। ত্রুটিপূর্ণ মানবজীবনের ইচ্ছায় তারা যুদ্ধের পথ বেছে নেয়। রুকাস যখন শিশু, তাদের এলাকায় হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে বায়োবটরা। বাদ যায় না রুকাসের গোটা পরিবারও। তাদের লক্ষ্য ছিলো রুকাস। পরবর্তী সময়ে মানুষ বুঝে যায়, রুকাস অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি, যার হাতে লেখা হতে পারে মানব আর বায়োবটের যুদ্ধের পরিনাম। সেই থেকে শুরু হয় রুকাসকে রক্ষা করার ভিন্ন আরেক যুদ্ধ। রুকাস লুকিয়ে পড়ে সময়ের ভিন্ন এক অধ্যায়ে।
বায়োবট দলপতি
বায়োবটদের দলপতি ক্লডিয়ান। বয়সে তরুণ, নিষ্টুরতায় বায়োবটদের মাঝে শ্রেষ্ঠ। কুনিলদের সময়ে এসে রুকাসের মুখোমুখি দাঁড়ায় ক্লডিয়ান। ক্লডিয়ান আর রুকাসের মাঝে হয়তো কোনো একজন বেঁচে থাকবে, নির্ধারিত হবে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ! রুকাস পালায় না। বিদায় নেয় সে লানা আর কুনিলের থেকে। ভালোবাসা জানিয়ে শেষবারের মতো আলিঙ্গন করে বন্ধু রোবট টুবুকে। তারা এগিয়ে যায় সাগরের দিকে, রাতের অন্ধকারে যেখানে রচিত হতে চলেছে বায়োবট আর মানবের যুদ্ধের আখ্যান। বায়োবটদের বিশাল বাহিনী নেমে আসে আকাশ থেকে সমুদ্রতীরে।
যুদ্ধের শেষ অধ্যায়
আর কিছুক্ষণ পরেই সবটা শেষ হয়ে যাবে। কুনিলের বুকের ভেতরটা ভেঙে যেতে চায়! ঠিক তখন কুনিলের মনে পড়ে কিরীণার কথা। এখন, এই সময়ে কিরীণাকেই তাদের প্রয়োজন! কুনিল জানে, ক্লডিয়ান ভয় পায় সংগীতকে। সুর তার কাছে অসহনীয়। কুনিলের মনে কিরীণার জন্য থাকা ভালোবাসা তার কাছে অবোধ্য। আর তাই কুনিল কিরীণাকে ডেকে আনে এক মহাবিপর্যয় ঠেকাতে। এই যুদ্ধটা অস্ত্র দিয়ে লড়ার নয়। মানবসত্তা আর যান্ত্রিকতার অসম লড়াই এটা। বায়োবট জাতির হার হবে তো একমাত্র মানুষের তীব্র অনুভূতির কাছে। কিরীণা তার কণ্ঠে সকল আবেগ ঢেলে দেয়। বাতাসে ঝাউবনের করুণ সুর মিলেমিশে যায় কিরীণার গানে, বড় দুঃখের সেই গান, সেই গান ক্লডিয়ানকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। ক্লডিয়ান থরথর করে কাঁপতে থাকে। দুই হাতে কান চেপে ধরে হাঁটু ভেঙে সমুদ্রতীরে পড়ে যায় নিষ্ঠুর বায়োবট দলপতি ক্লডিয়ান।
রুকাস হাত বাড়ায় ক্লডিয়ানের দিকে। মহা শক্তিশালী একজন বায়োবট না, অতি সাধারণ এক দুর্বল মানুষ ক্লডিয়ানকে টেনে তোলে রুকাস। আর নিশি রাতে সময়টা কেমন থমকে যায়, সাগরপাড়ে একদল বায়োবট আর রুকাস ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।