ভারতের নবীন লেখকদের মধ্যে অন্যতম একজন তিনি, খুব দ্রুতই তার লেখা বইগুলো বেস্ট সেলার উপাধি পেয়ে যায়। কেন? তার সহজ ইংরেজিতে তরতর করে এগিয়ে যাওয়া গল্পগুলোর জন্য। বলছি চেতন ভগতের কথা, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস যাকে বলেছে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ইংরেজি উপন্যাসের রচয়িতা। টাইম ম্যাগাজিনের মতে তিনি বিশ্বের শীর্ষ ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে একজন। তার খ্যাতির কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি যে ক্ষেত্রকে দেয়া যায়, তা হলো তার উপন্যাসগুলো, যা থেকে অধিকাংশই চলচ্চিত্রের পর্দায়ও দেখা গিয়েছে। আজ সেগুলোর সম্পর্কেই কিছুটা জানতে যাচ্ছি আমরা।
ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান (২০০৪)
বলিউডের ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমাটির কল্যাণে এই বইয়ের কাহিনী আজ প্রায় সবার কাছেই পরিচিত। শুধু পরিচিতই বা বলছি কেন, এটি অনেক জনপ্রিয়ও। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে, তা সে ভারতেরই হোক কিংবা বাংলাদেশেরই হোক, এই গল্পটি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পেরেছে।
বইটিতে আমরা দেখা পাই তিন বন্ধুর, যারা IIT’র ছাত্র, কিন্তু কিছুতেই শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজেদের মধ্যে যারা ধারণ করতে পারছে না। তিনজনেরই কারণ ভিন্ন এবং মানিয়ে নিতে পারার ভিন্ন কারণগুলো থেকেই গতি পায় বইটি। বইয়ের শুরুতে লেখক বলে দিয়েছেন,
“এটি এমন কোনো বই নয় যাতে বলা আছে কীভাবে IIT-তে ভর্তি হওয়া যাবে অথবা কীভাবে কলেজে থাকতে হয়। এতে বলা আছে যদি সহজভাবে চিন্তা না করা যায় তবে কী করে সবকিছু গোলমেলে হয়ে যায়”।
এখানে হয়তো সফলদের কথা বলা নেই, কিন্তু যারা প্রচলিত গ্রেড সিস্টেমের সাথে তাল না মেলাতে পারে না, তাদের কথা বলা হয়েছে। এরা কি তাহলে সফল হয়, নাকি মুখ থুবড়ে পড়ে? নাকি হয়ে ওঠে ‘ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান?
ওয়ান নাইট অ্যাট দ্য কল সেন্টার (২০০৫)
এক শীতের রাতে ট্রেনে সফর করার সময় লেখকের দেখা হলো এক অদ্ভুত তরুণীর সাথে। তরুণী তাকে একটি গল্প বলতে চাইলো, এবং এই গল্পই মূলত ‘ওয়ান নাইট অ্যাট দ্য কল সেন্টার’ এর কাহিনী। কী সেই গল্প?
ছয়টি অতৃপ্ত জীবন, আর একটি অদ্ভুত রাত, একটি ফোনকল যা এসেছে সরাসরি ঈশ্বরের কাছ থেকে! তারা সবাই একটি কল সেন্টারে কাজ করেন, কিন্তু কেউই নিজের ইচ্ছায় আসেননি এখানে, তাদের সবার শেষ পছন্দ ছিলো এই চাকরিটি। ভাগ্যই হোক, সাহসের অভাবই হোক, জীবনকে নিজের ইচ্ছেমতো বয়ে যেতে দিতে পারেননি তারা। কিন্তু একরাতে, ঐ একটি ফোনকল কি সত্যিই বদলে দিতে পেরেছিলো তাদের জীবনকে, কিছুটা হলেও কি প্রাপ্তি যোগ করতে পেরেছিলো?
দ্য থ্রি মিসটেইকস অফ মাই লাইফ (২০০৬)
‘৩’ অঙ্কটি পিথাগোরাসের মতো চেতন ভগতেরও মনে হয় খুব পছন্দের। কারণ তার প্রায় বইয়েই এর প্রভাব দেখা যায়। এখানেও সেই তিন বন্ধুর গল্প, আর সেই সাথে তিনটি ভুলেরও। এক সকালে চেতন ভগত তার ইমেইল অ্যাকাউন্টে অদ্ভুত একটি মেইল পান, এক যুবক তাকে তার তিনটি ভুলের গল্প বলতে চায়, কী সেই ভুলগুলো? এ নিয়েই রচিত বইটি।
লেখককে মেইল পাঠানো যুবকটি গোবিন্দ, যে সবসময়ই বড় কিছু একটা করতে চাইতো ব্যবসাক্ষেত্রে। সফলতার প্রতি বিশ্বাসী এই চরিত্রটি ঝুঁকি নিতে চায় বরাবরই এবং তার এই ঝুঁকির কারণেই সূত্রপাত হয় তার ‘ভুল’-এর। বইয়ে আমরা দেখা পাই তার দুই বন্ধু ঈশাণ এবং ওমি’র, যারা তার ঝুঁকির সঙ্গী হয়, সফলতার ও ব্যর্থতারও ভাগীদার হয়।
এসবের সাথে সমান্তরালভাবে উঠে এসেছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, দাঙ্গা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বিপর্যয়ও যা সবার জীবনকে খুব কম সময়ের মধ্যেই গ্রাস করে নেয়। গোবিন্দ ও তার বন্ধুদের স্বপ্ন কি তারপরও সত্যি হয়, সফলতা কি তারপরও তাদের কাছে আসে?
কিছু বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা চেতন ভগতের এই বইটি থেকেও বলিউডে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত ‘কাই পো চে’, বইয়ের মতো চলচ্চিত্রটিও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
টু স্টেটস (২০০৯)
এককথায় একটি সাধারণ প্রেমের কাহিনী নিয়ে বইটি রচিত। ভিন্ন সংস্কৃতি, পিতা-মাতার অমত, কিছু উত্থান-পতন এবং প্রেমকে স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে কৃষ ও অনন্যার অভিযানের কথাই উঠে এসেছে ‘টু স্টেটস’ এ।
এটি আংশিক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। একই দেশের দুটি রাজ্যের সংস্কৃতি কীভাবে এত বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে একে অপরের জন্য এবং যখন এই বিপরীত সংস্কৃতিরই দুজন মানুষ একে অপরকে বেছে নিচ্ছে, তখন তার প্রভাব কি পুরো পরিবারের ওপরই পড়ে না? আর যদি প্রভাব পড়ে, তবে সেটাকে কীভাবে ইতিবাচক করে তোলা যায় এটি বর্ণিত হয়েছে মূল চরিত্র ‘কৃষ’ ও ‘অনন্যা’ এবং তাদের পরিবারের মধ্য দিয়ে।
এটি নিয়ে বলিউডে সিনেমা নির্মিত হয়েছে কিন্তু অন্য সিনেমাগুলোর মতো এতটা জনপ্রিয় হয়নি।
রেভল্যুশন ২০২০ (২০১১)
এখানে প্রেম নিয়েছে ভিন্নরূপ, ত্রিভুজ প্রেমের সাথে আত্মউন্মোচনের গল্প পাই এতে। দুর্নীতির শিকার হতে হতে কীভাবে আমরা নিজেরাই সে দুর্নীতির একটি অংশ হয়ে উঠি, কে জানে! শাসনব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থার প্রতি অভিযোগের পাল্লা ভারি করতে করতে একসময় সবাই অন্যের অভিযোগের কারণ হয়ে উঠি, আমরা জানি না।
এই বইয়ের মূল চরিত্রের মধ্য দিয়ে চেতন ভগত এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর দিয়ে গিয়েছেন। আসলে আমরা অপরকে যত ভালো করে জানতে চাই, ততটা আগ্রহ নিজেকে জানার প্রতি থাকে না। কখনো কখনো আত্মোন্মোচন তাই খুব জরু্রি হয়ে পড়ে! এই বইয়ে লেখক বারবার আত্মোন্মোচন করে গেছেন চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে।
হাফ গার্লফ্রেন্ড (২০১৪)
এই বইয়ের সবচেয়ে মজার দিক হচ্ছে হঠাৎ করে মোড় ঘুরে যাওয়ার ব্যাপারটি। যখনই পাঠক কোনো একটি ধারণাকে স্থায়ী ধরে নিয়ে এগোতে যাবেন, তখনই কাহিনী এমনভাবে মোড় নেবে যে একটু থমকে যেতেই হবে! মানব সম্পর্কের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক এতে।
মানুষ যখন কোনো একটি জিনিস খুব বেশি করে চায়, তখন তার প্রতি ছুটে যাবার চেয়েও বেশি কাজ করে পালানোর বিষয়টি। কেউ দায়বদ্ধতা স্বীকার করতে চায় না বন্ধনের ভয়ে। কিন্তু দায়বদ্ধতাও কি কখনো কখনো প্রয়োজন হয়ে ওঠে না? রিয়া সোমানী ও মাধব ঝা, এদের স্বভাবের বৈপরীত্য যেমন রয়েছে, তেমনি কিন্তু রয়েছে দুর্নিবার আকর্ষণও। কিন্তু তাদের এই আকর্ষণ যখনই দায়বদ্ধতার রূপ নিতে যায়, তখনই এরা কেমন ছিটকে পড়ে! মাধবের বর্ণনায় তার ‘হাফ গার্লফ্রেন্ড’ এর কথা।
ওয়ান ইন্ডিয়ান গার্ল (২০১৬)
রাধিকা মেহতা’র আগামী সপ্তাহে বিয়ে, একটি ঐতিহ্যবাহী পাঞ্জাবী পরিবারের মেয়ের যা যা করা উচিত তা সবই সে করছে, কিংবা বলা যায় করার ভান করছে!
বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠায়ই রাধিকার দুটো সত্ত্বার দেখা পাই আমরা, যারা অনবরত কথা বলে চলে। রীতি-নীতি, প্রথাকে যখন কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না, তখন রাধিকা তা মেনে চলে। কিন্তু প্রতিনিয়তই সে প্রতিক্রিয়াশীল হয়। কিন্তু তার সব প্রতিক্রিয়াই তার নিজের মধ্যে ঘটতে থাকে।
এই বইয়ে ‘রাধিকা মেহতা’ চরিত্রটির মধ্য দিয়ে চেতন ভগত প্রচলিত অর্থে ভারতীয় নারীরই প্রতিনিধিত্ব করিয়েছেন। রাধিকা ভান করতে চায় না, যা মনে আসে তাই বলতে চায় তাই করতে চায়, কিন্তু…! এই ‘কিন্তু’ এসে পড়ে সবখানেই, আর এই ‘কিন্তু’টিকেই চেতন ভগত দেখিয়ে গিয়েছেন একেকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে।
চেতন ভগতের উপন্যাসগুলো পড়বার পর পাঠকের মনে একটি প্রশ্ন আসতে বাধ্য, “যাকে আমরা সফলতা বলি, তা কি সত্যি সফলতা? যেভাবে সবসময় সফলতাকে সংজ্ঞায়িত করে এসেছি, তা কি সত্যিই সফলতা?” কিন্তু এর উত্তর তার বইয়ে হয়তো পাওয়া যাবে না, উত্তর খুঁজতে হবে নিজের মধ্যেই।