সাহিত্য কি শুধু জীবনকে উদযাপন করে? মৃত্যুকে নয়? হ্যাঁ, সাহিত্য জীবনের পাশাপাশি উদযাপন করে মৃত্যুকেও, উদযাপন করে জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট, ঘৃণা আর না পাওয়ার হতাশাকেও। আর কবিতা হলো মনের চিন্তা-আবেগের সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে তীব্র বহিঃপ্রকাশ। কবিতার একেকটা শব্দ তো মানুষের হৃদয়েরই প্রতিধ্বনি, তাই কবির হৃদয় যদি হয় বিশ্বাসঘাতকতা আর ঘৃণার আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, কবিতা তো তখন হবেই সেই আঘাতের পদ্য। আজ আমরা এমনই এক দুঃখী আর মানসিকভাবে বিধ্বস্ত কবির জীবনের গল্প শুনবো, যার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা আর ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা যেন ভাষা পেয়েছিলো তাঁর কবিতায়। তার কবিতা জীবনের নয়, বলে মৃত্যুর কথা। তার কবিতা উদযাপন করে ধ্বংস, কষ্ট আর পীড়ার কথা। চিরদুঃখী সেই কবি জীবনের কোথাও পাননি সুখ বা প্রশান্তি। কেউ কেউ তাঁর দুর্বল মনের কথা বলেন, কিন্তু তাঁর হৃদয়ের আঘাত উপেক্ষা করার মতো নয় কখনোই। উপেক্ষা করার মতো নয় তাঁর স্বেচ্ছায় টানা জীবনের এক করুণ ইতি আর সেই সমাপ্তির পিছনের নিঠুর গল্প। সেই কবির নাম সিলভিয়া প্লাথ, অপূর্ব রূপসী ইংরেজি সাহিত্যের এই নক্ষত্রকে জীবনের চেয়ে বেশি শান্তি দিয়েছিলো মৃত্যু। স্বীকৃতিও দিয়েছিলো মৃত্যু জীবনের চেয়ে বেশি, তাই তো তিনিই প্রথম সাহিত্যে পান মরণোত্তর পুলিৎজার পুরষ্কার।
সিলভিয়া প্লাথের বিষাদময় জীবনের শুরু হয়েছিলো সেই ছোটবেলা থেকেই। বাবা ছিলেন বলতে গেলে ছোট্ট সিলভিয়ার শৈশবের প্রধান নিয়ন্ত্রক। অধ্যাপক বাবার কঠোর শাসন ও নিয়ন্ত্রণ পরবর্তীতে কবির মন ও মননে গভীর ছাপ ফেলে। সিলভিয়ার বিখ্যাত কবিতা ‘Daddy’ ই যেন কবি ও তাঁর পিতার সম্পর্কের টানাপোড়নের সবচেয়ে বাস্তব কাব্যিক রূপ।
১৯৩২ সালের ২৭ অক্টোবর বোস্টনের ম্যাসাচুসেটসে জন্মগ্রহণ করেন সিলভিয়া প্লাথ। সিলভিয়ার বাবা অট্টো প্লাথ এসেছিলেন জার্মানির জ্রাবো থেকে। তিনি ছিলেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। অট্টো প্লাথ বিয়ে করেছিলেন তাঁর থেকে একুশ বছরের ছোট অরেইলিয়া স্কুবেরকে, যিনি ছিলেন একজন কীটবিজ্ঞানী এবং একইসাথে তাঁর ছাত্রীও।
খুব অল্প বয়সেই তাঁর মধ্যে লেখনী প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র আট বছর বয়সে সিলভিয়ার কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো বোস্টন হেরল্ড পত্রিকার শিশু শাখায়। শিল্পের প্রতি আগ্রহও ছিলো বরাবরই। মাত্র পনেরো বছর বয়সে ১৯৪৭ সালে জিতেছিলেন চিত্রশিল্পের জন্য দ্য স্কলাস্টিক আর্ট অ্যান্ড রাইটিং অ্যাওয়ার্ড। জন্ম থেকে শিল্প ও সাহিত্যে ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন তিনি, যদিও তাঁর শৈল্পিক মন জীবনে আশার চেয়ে, আনন্দের চেয়ে হতাশা, বিষাদ আর যন্ত্রণা খুঁজে পেতেন বেশি। অবশ্য এই যন্ত্রণাই তাঁর লেখনীর শক্তি জুগিয়েছে।
যতদিনে প্লাথ স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হবেন, ততদিনে তিনি কেবল ছোটগল্প লিখেছিলেন পঞ্চাশটিরও বেশি। এইসব গল্পগুলো ছাপা হয়েছিলো সেসময়ের বিভিন্ন ভাসমান পত্রিকায়। নিজের দক্ষতা ও প্রতিভাগুণে ১৯৫০ সালে তিনি স্মিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি অর্জন করেন এবং অনেক মানসিক চড়াই- উৎরাই পার করে ১৯৫৫ সালে সম্মানের ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে প্লাথের প্রতিভা তাঁকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ার সুযোগ করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার এই সময়টা থেকেই হতাশা প্লাথকে জীবনযুদ্ধে হারিয়ে দিতে থাকে। বিষাদগ্রস্ততা তাঁর জন্য হয়ে উঠেছিলো এক ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি। চোরাবালির মতো এটা কবিকে গ্রাস করতে শুরু করে তরুণী বয়স থেকেই। তারই ফলস্বরূপ জীবনের শুরুতেই স্মিথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই দুঃখী কবি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এরপরও তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার জীবনের ইতি টানতে উদ্যোগী হয়ে ব্যর্থ হন।
দুর্বল-দুঃখী কবিহৃদয় তাঁর আশ্রয় খুঁজেছিলো সমসাময়িক নামকরা কবি টেড হিউজের প্রেমে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁরা দুজন দুজনার প্রেমে পড়েন, সেই প্রেমকে সার্থক করতে একসময় ঘরও বাঁধেন লন্ডনের বুকে, ঘর আলো করে আসে ফুটফুটে দুটি সন্তান। কিন্তু সেই ভালোবাসার ঘরের সমাপ্তিটা শেষ পর্যন্ত সুখের হয়নি। ১৯৫৬ সালে বিয়ে করে ১৯৬২ সালেই দু’জনের পথ দু’দিকে ঘুরে যায়। যদিও বলা হয়, বিয়ের পরেও প্লাথের মানসিক হতাশার কোনো কিনারা হয়নি। কিন্তু এও তো নিশ্চিত করে বলা যায় না যে জীবনসঙ্গীও তাঁর মানসিক যুদ্ধটা সহজ করতে তেমন সাহায্যকারী হিসাবে ভূমিকা নিয়েছিলেন কি না, বিশেষ করে তখন, যখন জানা যায় হিউজ অন্য এক নারীর প্রেমে পড়েই তাঁদের বিয়েটা ভাঙনের দিকে নিয়ে যান। আজন্ম আহত প্লাথের হৃদয়টা একটু স্নেহ আর বিশ্বাসের মলম পায়নি কোথাও। জীবনের চেয়ে মৃত্যুটাই তাঁর কাছে সহজ হয়ে উঠছিলো বহুগুণ। আর তাঁর লেখনী ছিলো সেই ভঙ্গুর মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র উপন্যাস ‘The Bell Jar’। এটা ছিলো মূলত তাঁর নিজের জীবনের ওপর ভিত্তি করেই লেখা একটা উপন্যাস, যা এক অনুভূতিপ্রবণ মেয়ের মানসিক ভাঙা-গড়ার গল্প শোনায়।
যে বছর কবি প্রথমবার মা হন, সে বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘The Colossus’। তাঁর রচিত শিশুতোষ বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘The Bed Book’, ‘Mrs. Cherry’s Kitchen’, ‘Collected Children’s Stories’ ইত্যাদি। প্লাথের রচিত শেষ কবিতা সংকলন ‘Ariel’ নামে প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে, ১৯৬৫ সালে। এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘Daddy’ এবং ‘Lady Lazarus’ এর মতো অসাধারণ কবিতাগুলো তাঁকে এনে দেয় জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মাননাগুলো। প্রথম ব্যক্তি হিসাবে তিনি মরণোত্তর সাহিত্যে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হন।
প্লাথের মৃত্যু নিয়ে রহস্যের ধোঁয়াজাল তাঁর জীবনের চেয়ে কিছু কম নয়। জীবনের কাছে হেরে গিয়ে ১৯৬৩ সালের ১১ ই ফেব্রুয়ারি প্লাথ নিজেকে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন, কিন্তু আত্মহত্যার আগে তাঁর স্নেহপূর্ণ মন নিশ্চিত করেছিলো দুই শিশু সন্তানের নিরাপত্তা। তাই তো একই বাসায় থাকলেও প্লাথের গ্যাস প্রয়োগে আত্মহত্যার সময় শিশুদের কোনো ক্ষতিই হয়নি। রান্নাঘরের দরজায় কাপড় গুঁজে দিয়েছিলেন, যেন বন্ধ দরজা দিয়েও কোনোভাবে গ্যাস তাঁর সন্তানদের কাছে না পৌঁছায়। কিন্তু শুধু বিষাক্ত গ্যাসই কি জীবন নিয়েছিলো প্লাথের? এই পৃথিবীর রুক্ষতা কি দায়ী ছিলো না তাঁর অনুভূতিশীল মনের মৃত্যুর জন্য? ১৯৬২ সালের কনকনে শীত যখন দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে একা কাটিয়েছিলেন, তখন কে ছিলো তাঁর পাশে?
কবি হিউজের পরবর্তীতে দেওয়া সাক্ষাৎকার অনুযায়ী সে সময় নাকি হিউজ আর প্লাথ তাঁদের সম্পর্ককে আরেকবার সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। হিউজ নিয়মিত প্লাথ আর সন্তানদের সাথে দেখা করতে যেতেন, কিন্তু প্লাথের হতাশাগ্রস্ত মন বারবার নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। অন্যদিকে সুসান এলিস্টন নামের অন্য এক নারীর সাথেও দ্রুত জড়িয়ে যান হিউজ। প্লাথ যে রাতে আত্মহত্যা করেন, সে রাতে সুসানকে নিয়ে যে বাসায় থাকেন সেই একই বাসায় হিউজ- প্লাথ তাঁদের বিয়ের পর প্রথম দিনগুলো কাটান। প্লাথ কি কোনোভাবে জেনে গিয়েছিলেন এই কথাটি? অন্যদিকে মৃত্যুর আগে শেষ একটা চিঠি লিখে যান প্লাথ, সেই চিঠিও আর পাওয়া যায়নি কোনদিন। বলা হয়, চিঠিটি নাকি প্লাথের সাথেই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। কী লেখা ছিলো সেই চিঠিতে? প্লাথ কী বলে গিয়েছিলেন সেই চিঠিতে? মানসিক অসুস্থতা নাকি মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা- সিলভিয়া প্লাথের অপার সম্ভাবনাময় জীবনের আকস্মিক ইতি টানার দায়টা কার ওপর বর্তায়, তার বিতর্ক অত সহজে শেষ হবার নয়।
ফিচার ইমেজ: npg.si.edu