২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। স্কটল্যাণ্ডের অধিবাসী ওয়াল্টার এলিয়টের দিন শুরু হলো অন্যসব দিনের মতোই। অবসর নেয়ার আগে পেশায় কাঠুরে ছিলেন। এখন বয়স হয়েছে, আশি বছর বয়সের মানুষ হিসেবে তবু বেশ কর্মক্ষম আছেন বলা চলে। ঘরের কাজকর্ম করেন, বই পড়েন। সেই সাথে স্থানীয় ইতিহাসের ওপরও বেশ ঝোঁক রয়েছে। সেদিন বাড়ির চিলেকোঠা পরিষ্কারের চিন্তা ছিল এলিয়টের। পুরনো পোকায় খাওয়া কাগজপত্র আর বইয়ের স্তূপ ঘাটতে গিয়ে তিনি খুঁজে পেলেন এমন এক বই, যেটি তিনি ঠিক কবে কিনেছিলেন বা আদৌ কিনেছিলেন কিনা ঠিক মনে করতে পারলেন না।
বই না বলে পুস্তিকা বললেই মনে হয় ভালো শোনাবে। মোট ৪৮ পাতার হালকা-পাতলা গড়নের পুস্তিকা সেটি। বয়সের ভারে ফিকে হয়ে আসা, এখানে-ওখানে ছাল-চামড়া উঠে যাওয়া খয়েরী মলাটের বইয়ের ওপরে লেখা নামটি পড়লেন ওয়াল্টার এলিয়ট- দ্য বুক ও’ দ্য ব্রিগ (The Book o’ the Brig)। উপরের অবস্থা নাজুক হলেও ভেতরের পাতাগুলো বেশ ভালো অবস্থাতেই রয়েছে। বইটির ব্যাপারে কোনো কিছু মনে করতে পারেন কিনা সেটা খুঁজে বের করতে নিছক কৌতূহলের বশে পাতা ওল্টাতে শুরু করলেন তিনি।
৪০-৪২ পাতার মাঝে এসে তার চোখ আটকে গেল এক লেখার শিরোনামে- ‘শার্লক হোমস’। তিনি আরো অবাক হলেন গল্পের নামটি পড়ে- ডিস্কভারিং দ্য বর্ডার বার্গস, অ্যান্ড, বাই ডিডাকশন, দ্য ব্রিগ বাজার (Discovering the Border Burghs, and, by Deduction, the Brig Bazaar)। তার নিজের এলাকার উপর শার্লক হোমসের আস্ত একটি গল্প আছে! অথচ তিনি জানেন না, সেটা তো হবার কথা নয়। নতুন কিছু আবিষ্কারের উত্তেজনা তাকে পেয়ে বসল।
মাত্র ৩ পাতার গল্প। ১,৩০০ শব্দের এই গল্পটি মূলত শার্লক হোমস আর ডা. ওয়াটসনের মধ্যকার আলাপচারিতা, যেখানে শার্লক কোনো তথ্য জিজ্ঞেস না করেও আশ্চর্য বুদ্ধিবলে বের করে ফেলেন যে ওয়াটসন সীমান্তবর্তী এলাকা সেলকির্কে যাচ্ছেন। গল্পের প্রবাহে ওয়াটসনও এক জায়গায় উল্লেখ করেন, তিনি সেলকির্কে ব্রিজের মেরামতির কাজে অংশ নিতে যাচ্ছেন।
সত্যিই যদি লেখাটি কিংবদন্তি লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের হয়ে থাকে, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, এলিয়ট এমন এক বই হাতে নিয়ে বসে আছেন যার কথা আজ আর কারো মনে নেই, হোমস বিষয়ক কোনো গ্রন্থে যার উল্লেখ নেই, এবং এর থেকেও বড় ব্যাপার- যে সময়ের কথা বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে ঠিক সেই সময়ে কোনান ডয়েল নিজে এই অঞ্চলে উপস্থিত ছিলেন।
বইটি আরও ভালোভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন ওয়াল্টার এলিয়ট। কম হলেও ৪০-৫০ বছর ধরে বইটি তার চিলেকোঠায় পড়ে আছে। হয়তো কোনো বন্ধুর কাছ থেকে এনেছিলেন, আর দিতে মনে নেই। জর্জ লুইস এন্ড কো. থেকে ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় বইটি। ১১২ বছর আগের ঘটনা! নিজের চোখের সামনে সাদাকালো নির্বাক সিনেমার মতো ইতিহাসগুলো যেন ভেসে উঠতে শুরু করল এলিয়টের।
১৯০২ সালে বন্যায় স্কটিশ শহর সেলকির্ক বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে লোকজনের যাতায়াতের জন্য থাকা কাঠের ব্রিজ বন্যায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন সকলে। ব্রিজটি পুনর্নির্মাণের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু হয় এবং সেজন্য সেলকির্কে তিনদিনের বিশেষ এক বাজারের আয়োজন করা হয়। ১৯০৩ সালের ডিসেম্বরে আয়োজিত সেই বাজারে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল উপস্থিত ছিলেন, এবং সেখানেই বইটি বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয় ব্রিজ তৈরির তহবিল সংগ্রহের জন্য।
১০-১২ ডিসেম্বর, ১৯০৩ সালে আয়োজিত সেই বাজার প্রতিদিন কোনো না কোনো প্রখ্যাত ব্যক্তির হাতে উদ্বোধন করান হয়েছিল। শেষদিন উদ্বোধন করেন স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। সেদিনের কর্মসূচির যে তালিকা পাওয়া গেছে, সেখানে উদ্বোধনকারী হিসেবে কোনান ডয়েলের নামের পাশাপাশি পদবি হিসেবে লেখা ছিল ‘বিখ্যাত সাহিত্যিক’।
সেলকির্কের বাজার উদ্বোধনের সাথেই যে কেবল বিখ্যাত এই সাহিত্যিকের নাম জড়িয়ে আছে তা কিন্তু নয়। ৮ ডিসেম্বর সেলকির্কের ভিক্টোরিয়া হলে নিজের লেখা উপন্যাস থেকে কিছু অংশ পড়ে শোনান স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। সেই সাথে ঘোষণা করেন, তাঁর এই পাঠ থেকে যা কিছু আয় হবে সেটা যেন সেলকির্কের নতুন ব্রিজ তৈরির ফান্ডে দেওয়া হয়।
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে- তার মতো বিখ্যাত লেখক সীমান্তবর্তী কোনো এক অঞ্চলে এমন কাজ করে বেড়াচ্ছিলেন কেন? ব্যাপারটা কোনান ডয়েলের লেখা শার্লক সিরিজের গল্পের মতো রহস্যময় মনে হলেও আদতে খুব জটিল কিছু না। কোনান ডয়েল বর্ডার বার্গ অঞ্চলের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। এবং সে সময় তিনি পরবর্তী নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য ইউনিয়নবাদী প্রার্থীও ছিলেন।
সেলকির্কের এসব কাজের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি কাছের শহর হাউক এবং গ্যালাশিয়েলসে রাজনৈতিক বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়। নিজের রাজনৈতিক অবস্থান পোক্ত করতে এই কাজ তিনি করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দ্য বুক ও’দ্য ব্রিগের লেখক পরিচিতির পাতায় কোথাও কোনান ডয়েলের নামোল্লেখ নেই!
অথচ বাজার উদ্বোধনের ফিরিস্তির পাতায় রয়েছে তার নাম। এমন বিখ্যাত লেখককে দিয়ে গল্প লিখিয়ে শেষপর্যন্ত লেখকের নামটাই উল্লেখ না করা বেশ অস্বাভাবিক। অনেক বিশেষজ্ঞ দাবি করেন, এই লেখার ধরনে বা বুননে ঠিক ডয়েলীয় মুনশিয়ানার ছাপ নেই। তবে পুরো ব্যাপার আরও তালগোল পাকিয়ে যায় যখন সেলকির্কের অধিবাসী জিন নাম্নী এক নারী দ্য বুক ও’দ্য ব্রিগের আরও একটি কপি সবার সামনে নিয়ে আসেন। এই কপির বিশেষত্ব হলো- এর মলাটে স্বাক্ষর করেছেন স্বয়ং কোনান ডয়েল!
শার্লক নিয়ে লেখা আবিষ্কারের ঘটনা কিন্তু এটাই প্রথম নয়। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে কোনান ডয়েলের কাগজপত্রের ভেতরে খুঁজে পাওয়া যায় শার্লক হোমসের উপর লেখা অপ্রকাশিত একটি লেখা, যার নাম- দ্য ম্যান হু ওয়াজ ওয়ান্টেড। প্রথমে সেই লেখাকেও কোনান ডয়েলের হারিয়ে যাওয়া লেখা হিসেবে উল্লেখ করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।পরবর্তীতে জানা যায়, সেটি ছিল আর্থার হুইটেকার নামে এক লেখকের, যিনি কোনান ডয়েলের কাছে লেখাটি পাঠান যাতে তিনি পড়ে নিজের মন্তব্য জানান।
দ্য বুক ও’দ্য ব্রিগে থাকা লেখাটি আবিষ্কারের খবর পত্রপত্রিকায় এবং ইন্টারনেট-বিশ্বে সাময়িক ঝড় তুললেও পরবর্তীতে লেখাটি আদতেই কোনান ডয়েলের ছিল কিনা সেই বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। ধুলোর পাহাড় থেকে খুঁজে পাওয়া এই লেখাটি সত্যিই কোনান ডয়েল রচনা করেছিলেন কিনা সেই বিষয়ে উপযুক্ত প্রমাণ যেমন নেই, তেমনই লেখার সাথে তার অসম্পৃক্ততাও প্রমাণ করা সম্ভব না। হয়তো কোনো একদিন সত্যিকারের কোনো শার্লক হোমস এসে এই রহস্যের সমাধান করবে! ততদিন পর্যন্ত রহস্য দিয়ে জীবন গড়া শার্লকের গল্প নিয়েও নাহয় আরেকটু রহস্য থেকেই যাক।