আচ্ছা বলুন তো, ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি জীবনের সবচেয়ে সাংঘাতিক শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী কে?
এ প্রশ্ন শুনে আপনি নির্ঘাৎ বিরক্ত হচ্ছেন। ভাবছেন, এ আবার কেমনধারা প্রশ্ন। এ-ও কি আবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন আছে! উত্তরটি যে মগনলাল মেঘরাজ, তা আর নতুন করে বলবারও কিছু নেই। মগনলালই যে প্রদোষচন্দ্র মিত্রের আর্চ এনেমি বা পরম শত্রু, এটি একটি প্রতিষ্ঠিত ও অলঙ্ঘ্যনীয় সত্য, যেমন সত্য সূর্যের পূর্ব দিগন্তে উদয় হওয়া এবং পশ্চিমাকাশে অস্ত যাওয়া।
এবার তবে আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটি হবে, মগনলালই যে সেই ব্যক্তি, এবং আর কেউ নয়, সেটি কীভাবে প্রমাণিত হলো? শয়তানদের শয়তানি পরিমাপের কি কোনো স্কেল আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখানে মগনলাল মেঘরাজের স্কোর অন্য আর সবার থেকে বেশি এসেছে?
এ প্রশ্নেও হয়তো আপনি নাক সিঁটকাচ্ছেন; মনে মনে ভাবছেন, তুমি বাপু গল্পের কিস্যু বোঝো না! মগনলাল মেঘরাজের সাথে ফেলুদার টক্করের গল্পগুলো পড়লে ন্যূনতম বোধবুদ্ধিসম্পন্ন যে কেউ মানতে বাধ্য হবে, এর চেয়ে সাংঘাতিক শত্রু আর কেউ হতেই পারে না।
কিন্তু সমস্যাটা কী জানেন, আপনি যেমনটি ভাবছেন যে মগনলালই সবচেয়ে সাংঘাতিক, এবং এ সত্যটি আপনি আপনার মগজাস্ত্রের সহায়তায় উদ্ঘাটন করেছেন, বাস্তবতা কিন্তু তেমনটি নয়। ছোট বাচ্চারা যেমন পূর্ব-পশ্চিম জ্ঞানলাভের পূর্বেই সূর্যের উদয়-অস্তের রহস্যগুলো জেনে ফেলে, তেমনই মগনলাল মেঘরাজের সাংঘাতিকত্বও আপনি একইভাবে জেনেছেন। কিংবা বলা ভালো, আপনাকে জানানো হয়েছে। সেটি সত্য কি মিথ্যে, তা আপনার নিজে থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয়নি।
অর্থাৎ এক্ষেত্রে আপনার গোড়াতেই গলদ রয়ে গেছে। আর সেটি যেন থাকে, তা খুব সূক্ষ্মভাবে নিশ্চিত করেছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। আপনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, কীভাবে তিনি আপনার মধ্যে কনফার্মেশন বায়াস সংস্থাপন করে দিয়েছেন।
কনফার্মেশন বায়াস কী? এটি একটি কগনিটিভ বায়াস। এর মূল কথা হলো, আপনি একপেশে চিন্তাভাবনা করবেন। যে বিশ্বাস বা আদর্শ ইতোমধ্যেই আপনার মাঝে অন্তর্নিহিত রয়েছে, আপনি চাইবেন যেকোনো তথ্য বা ঘটনা থেকে ওই বিশ্বাসের জায়গাটিতেই পৌঁছে যেতে। বিদ্যমান তথ্য বা ঘটনা যে সম্পূর্ণ বিপরীত কিছুরও ইঙ্গিত দিতে পারে, তা আপনি স্বীকার করবেন না।
যেমন ধরুন, আপনি বিশ্বাস করেন বাঁহাতি লোকেরা ডানহাতি লোকদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি সৃজনশীল হয়। তাই আপনার সামনে দিয়ে হাজারটা ডানহাতি সৃজনশীল ব্যক্তি ঘুরে বেড়ালেও আপনি খুব একটা পরোয়া করবেন না, অথচ একজন বাঁহাতি মানুষ খানিকটা সৃজনশীলতার পরিচয় দিলেই আপনি বলবেন, ওই তো, বাঁহাতি বলেই লোকটা সৃজনশীল।
ফিরে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। সত্যজিৎ রায় কীভাবে আপনার মনে কনফার্মেশন বায়াস ঢুকিয়ে দিয়েছেন? যতবারই তিনি মগনলালের কথা লিখেছেন, তোপসের জবানিতে মানুষটিকে আপনার সামনে এমনভাবে হাজির করেছেন যে, আপনি ধরে নিতে বাধ্য হয়েছেন লোকটি আসলেই সাংঘাতিক।
বিশ্বাস হচ্ছে না তো? তাহলে চলুন ফিরে দেখি, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ গল্পে তিনি কীভাবে মগনলাল মেঘরাজ চরিত্রটির প্রাথমিক পরিচয় আপনার সামনে তুলে ধরেছেন:
“ফেলুদার জীবনে সবচেয়ে ধুরন্ধর ও সাংঘাতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে তাকে এই বেনারসেই লড়তে হয়েছিল। ও পরে বলেছিল—এই রকম একজন লোকের জন্যই অ্যাদ্দিন অপেক্ষা করছিলাম রে তোপসে। এ সব লোকের সঙ্গে লড়ে জিততে পারলে বেশ একটা টনিকের কাজ দেয়।”
অর্থাৎ মূল কাহিনীতে প্রবেশের আগেই তিনি আপনার মনে একটি বদ্ধমূল ধারণার বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছেন, এর আগে ফেলুদা যত খলনায়কের মোকাবিলা করেছে তারা কেউই মগনলালের ধারে-কাছে নয়। এরপর যতবার মগনলালের উল্লেখ এসেছে গল্পে, আপনার মাথার ভেতর ঘুরপাক খেয়েছে পূর্বপঠিত ওই কথাগুলো- “সবচেয়ে ধুরন্ধর ও সাংঘাতিক প্রতিদ্বন্দ্বী।” ফলে মগনলাল যা-ই করেছে, তাতেই আপনি তার ধুরন্ধরতা-সাংঘাতিকতার গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন।
এই একই কাজ সত্যজিৎ মগনলালকে নিয়ে লেখা পরের দুটি গল্পেও অব্যাহত রেখেছেন। ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ গল্পের কাহিনীতে মগনলালের প্রবেশের পর প্রথম সুযোগেই তিনি বলে দিয়েছেন:
“মগনলাল মেঘরাজ। যার মাইনে করা নাইফ থ্রোয়ার লালমোহনবাবুকে টার্গেট করে খেলা দেখিয়ে ওঁর আয়ু কমিয়ে দিয়েছিল অন্তত তিন বছর। কাঠমাণ্ডুতে কী করছে এই সাংঘাতিক লোকটা?”
আর ‘গোলাপী মুক্তা রহস্য’ গল্পে মগনলালের সাথে ফেলুদার আরেকবার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতেই তিনি লিখেছেন:
“আর কতবার এই লোকটার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে? প্রতিপক্ষ হিসেবে এর চেয়ে সাংঘাতিক আর কাউকে কল্পনা করা যায় না।”
সুতরাং দেখতেই পাচ্ছেন, মগনলালকে নিয়ে আপনি যেন কনফার্মেশনে বায়াসে ভোগেন, সে ব্যবস্থা সত্যজিৎ নিজেই বারবার করে গেছেন। ফলে ফেলুদার সবচেয়ে সাংঘাতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কে ভাবতে বসলে মগনলাল মেঘরাজ নামটিই সবার আগে আপনার মস্তিষ্কের দরজাতে কড়া নাড়ে। আপনি ভুলে যান ‘বাদশাহী আংটি’-র বনবিহারী সরকার, ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’-র চট্টোরাজ, ‘সোনার কেল্লা’-র বর্মন, মন্দার বোস কিংবা ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’-র মিঃ গোরের কথা।
এবার একটি মজার ব্যাপার লক্ষ্য করুন। মগনলালের চরিত্র বিশেষায়িত করতে গিয়ে সত্যজিৎ তিনবারই ‘সাংঘাতিক’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আসলে এই শব্দটির প্রতি সত্যজিতের সাংঘাতিক রকমের দুর্বলতা। তাই তো ‘সোনার কেল্লা’ ছবির পোস্টারেও তিনি লিখেছেন: “সত্যজিৎ রায়ের সাংঘাতিক ছবি।”
আপনি হয়তো আবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন। ভাবছেন, সত্যজিতের ‘দুর্বলতা’ ধরার সাহস কীভাবে হয় আমার। কিন্তু মনে করে দেখুন, সত্যজিৎ নিজেও কিন্তু তার বর্ণনাভঙ্গির একঘেয়েমির বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন, এবং সেটি স্বীকারও করে নিয়েছিলেন অকপটে। তাই তো ‘নয়ন রহস্য’ গল্পে আমরা দেখতে পাই এক পাঠকের চিঠিতে অনুযোগ:
“ফেলু মিত্তিরের মামলা আর তেমন জমাটি হচ্ছে না, জটায়ু আর তেমন হাসাতে পারছেন না, তপেশের বিবরণ বিবর্ণ হয়ে আসছে…”
বিবরণের বিবর্ণতার মধ্যে একই শব্দের বহুল ব্যবহারও নিশ্চয়ই পড়ে, তাই না? তাছাড়া ফেলুদা নিজেই তো লালমোহন বাবুকে বারবার একই রকম বিশেষণ ব্যবহার নিয়ে খোঁচা দিত। তাই সত্যজিতেরও নিজের লেখনীর এই দিকটি নিয়ে খোঁচা হজমে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
তবে যা-ই হোক, স্রেফ কনফার্মেশন বায়াসের জোরেই যে মগনলালকে সত্যজিৎ ফেলুদার সবচেয়ে সাংঘাতিক শত্রুতে পরিণত করেছেন, এ দাবি আমি করছি না। বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি আরো নানা ফন্দিও এঁটেছেন।
প্রথম কথা হচ্ছে, আগাগোড়াই মগনলাল চরিত্রটিকে নেতিবাচকভাবে এঁকেছেন সত্যজিৎ। ফেলুদা সিরিজের অন্যান্য কাহিনীতে যেমন শুরুতে বোঝা যায় না খারাপ মানুষটি কে, কারণ তারা মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, সেরকম কোনো ক্লিশে রাস্তায় মগনলালের ক্ষেত্রে অন্তত হাঁটেননি তিনি।
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ প্রথম মগনলালের নামটি শুনেই ফেলুদা বলেছিল:
“মগনলাল মেঘরাজ… নামটা চেনাচেনা মনে হচ্ছে।”
অর্থাৎ, মগনলাল যে একজন জাত পাপী, তা শুরু থেকেই ফেলুদার জানা ছিল। এবং অব্যবহিত পরেই জানিয়ে দেয়া হয়, চোরা কারবার, কালো টাকা—হেন অপরাধ নেই, যা লোকটি করেনি।
বাংলা ভাষার গোয়েন্দা গল্পের পাঠকদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কাই বলতে হবে। কেননা অপরাধী কে, শুরুতেই বলে দেয়া হলে যে হুডানিটের মজাটা আর থাকে না। অথচ কী অদ্ভূত ব্যাপার, এরপরও কিন্তু ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ গল্পটি একদম শেষ পর্যন্ত শুধু হুডানিটই নয়, পাশাপাশি হাউডানিট, হোয়াইডানিট, হোয়্যারডানিট ইত্যাদি সব ধরনের রোমাঞ্চের যাবতীয় উপাদান বজায় রাখতে পারে। এখানেই সত্যজিতের মুনশিয়ানা, যাকে কুর্নিশ না করে উপায় নেই।
এবার যাওয়া যাক প্রথমবার ফেলুদা ও মগনলালের মুখোমুখি বাতচিতের ঘটনাটায়। তবে তার আগে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এড়িয়ে গেলে চলবে না।
প্রথমত, বেনারসের ইন্সপেক্টর তেওয়ারির ফেলুদার কাছে এসে বলা যেন সে গণেশ চুরির বিষয়টি নিয়ে মাথা না ঘামায়। মগনলাল যে ব্যাপারে আছে, সে ব্যাপারে সরাসরি পুলিশের কাছ থেকেই এমন পরামর্শ। তাহলে বুঝুন, আরো একবার কীভাবে সত্যজিৎ মগনলালকে সুপার ভিলেন বানানোর চেষ্টা করেন!
আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, তেওয়ারির সাবধানবাণী সত্ত্বেও ফেলুদার চনমনে ভাব ও যেচে পড়ে মগনলাল নামক সিংহের গুহায় প্রবেশ। তার আগে অবশ্য সে বেশ স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেয়, একজন ডাকসাঁইটে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাপ্তির সম্ভাবনাই তার এমন উৎসাহী ভাবের কারণ। শার্লক হোমসের যেমন প্রফেসর মরিয়ার্টি, ফেলুদাও যে তেমন কারো প্রত্যাশা করে যাচ্ছিল এবং অবশেষে তেমন কাউকে পাওয়ার পূর্বাভাস তাকে রোমাঞ্চিত করে তুলেছিল, এ বিষয়টিও আপনার সামনে মগনলালকে আরো অসাধারণ রূপে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
সব মিলিয়ে মগনলাল চরিত্রটিকে সাক্ষাতের আগেই যেভাবে উপস্থাপন করেন সত্যজিৎ যে তোপসে-জটায়ুর মতো আপনিও হয়তো ধরেই নেন, তুমুল মারামারি-ফাটাফাটি কিংবা ডুয়েল হবে মগনলাল আর ফেলুদার। কিন্তু আসলে তার কিছুই হয় না। হয় একেবারেই ভিন্ন ও অপ্রত্যাশিত কিছু, যার ফলে মগনলাল চরিত্রটির মহিমা আপনার কাছে এক ধাক্কায় কয়েকগুণ বেড়ে যায়, যেহেতু ইতোমধ্যেই আপনি নিশ্চিত লোকটা সাংঘাতিক।
কী করে মগনলাল? ফেলুদার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করে না সে, বরং শিকার হিসেবে বেছে নেয় রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক জটায়ুকে। যেমনটি আগেই বলেছি, জটায়ুকে দিয়ে নাইফ থ্রোয়িংয়ের খেলা দেখিয়ে তাকে পুরোপুরি নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে সে।
এ ঘটনাটি কিন্তু কেবলই গায়ের পশম খাড়া করে দেয়ার মতো উত্তেজক নয়। বরং এ ঘটনা আপনার মনে দুইটি ছাপ ফেলে যায়।
একটি হলো, মগনলালের মাইন্ডগেমে চমৎকৃত হন আপনি। সে যদি ফেলুদাকে সরাসরি বন্দুক নাচিয়ে ভয় দেখাত বা তাকে আটকে রেখে মারধোর করত, তাহলে তাকে আপনার সিনেমায় দেখা টিপিক্যাল ভিলেন বৈ আর কিছু মনে হতো না। কিন্তু এই যে সে নিজের স্বরূপ পুরোটা উন্মোচন না করে ফেলুদার সাথে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে নামল, এতে আপনার মনে যদি ইতোপূর্বে বিন্দুমাত্র সংশয়ও থেকে থাকে মগনলালকে নিয়ে, তা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল। শিকারী শিকার করে ফেলা মানে তো সব শেষ হয়ে যাওয়া। কিন্তু সে তা না করে যে ওঁত পেতে থাকল, শিকারকে ভয় দেখাল, এতেই না আপনার মনে হলো কাহিনী একটি নতুন মাত্রায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
দ্বিতীয় ছাপটির গুরুত্ব আরো বেশি। এটি পাঠক হিসেবে আপনার মনে মগনলালের প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ জন্মাল। এক্ষেত্রে সত্যজিৎ সাহায্য নিলেন ইন-গ্রুপ বায়াসের। এই বায়াসটির মূল কথা হলো, নিজ দল বা গোষ্ঠীর কাউকে বেশি প্রাধান্য দেয়া। অর্থাৎ আপনি চাইলেও শতভাগ নিরপেক্ষ হতে পারবেন না। ধরুন আপনার দলের বা আপনার পরিচিত কেউ ছোটখাট একটি বিপদে পড়ল, অন্যদিকে আপনার অপরিচিত কেউ খুব বড় ধরনের কোনো বিপদে পড়ল। আপনি কিন্তু কম বিপদে পড়া সত্ত্বেও আপনার পরিচিত মানুষটির জন্যই বেশি উৎকণ্ঠিত হবেন। সত্যজিতও করলেন কী, মগনলালের হাতে জটায়ুকে নাস্তানাবুদ করানোর মাধ্যমে আপনাকে বাধ্য করলেন মগনলালকে ঘৃণা করতে। কারণ জটায়ু চরিত্রটিকে যে আপনি খুবই ভালোবাসেন।
এই জায়গায় ‘হাফ সামোসা’ নামক একটি ওয়েবসাইটে মগনলালের ব্যাপারে মূল্যায়নকে উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। তারা লিখেছে:
“মগনলাল খুব, খুব বাজে ভিলেন। আমরা হয়তো তার চোরাকারবারি বা খুনখারাবিকে ক্ষমা করে দিতে পারি, কিন্তু ভালোমানুষ লালমোহনবাবুর সাথে সে যা করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য।”
নিঃসন্দেহে একজন পাঠক হিসেবে আপনার মনেও একই অনুভূতিই জন্মাবে। সত্যজিৎ নিজেও সেটি খুব ভালো করেই জানতেন। তাই ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’-ও তিনি মগনলালকে দিয়ে ফের জটায়ুকে যন্ত্রণা দিয়েছেন। এবার মগনলাল জটায়ুর চায়ে এলএসডি মিশিয়ে দিয়েছে, যার ফলে জটায়ু সাময়িকভাবে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। আবার ‘গোলাপী মুক্তা রহস্য’ গল্পেও মগনলাল জোর করে জটায়ুকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েছে। সহজ কথায় বলতে গেলে, বারবার মগনলাল জটায়ুকে উত্যক্ত করেছে, যেন পাঠকের কাছে সে ক্রমেই ঘৃণ্য থেকে ঘৃণ্যতর ব্যক্তিতে পরিণত হয়।
জটায়ুকে নাস্তানাবুদ করার জায়গাগুলোতে রুদ্ধশ্বাস অবস্থার পাশাপাশি কিছুটা যে কমিক রিলিফও আছে, সেটিও খেয়াল করুন। আপনি ভাবতে পারেন, সত্যজিৎ জটায়ুর মতো রহস্য রোমাঞ্চ লেখকদেরকে নিজের প্রতিপক্ষ ভাবেন, কিংবা তাদেরকে অপছন্দ করেন, যে কারণে বইয়ের পাতায় তাদের হেনস্তা করার সুযোগ তিনি ছাড়তে চান না।
আদতে কিন্তু বিষয়টি তা নয়। সত্যজিৎ বরাবরই বলতেন,
“ভিলেনরা আমাকে বোর করে।”
অর্থাৎ সাধারণভাবে পপুলার কালচার কিংবা মূলধারার বই, চলচ্চিত্র ইত্যাদিতে ভিলেনদেরকে যেভাবে উপস্থাপিত করা হয়, তা তার কাছে অনাকর্ষণীয় লাগত। তিনি মনে করতেন, মানবমন আরো অনেক জটিল ও প্যাঁচালো। তাকে একপেশে করে তোলার কোনো মানেই হয় না। এজন্য তিনি সচেতনভাবেই তার কয়েকটি ভিলেন চরিত্রের মাঝে হাস্যরসের উপাদান পুরে দিয়েছিলেন। যেমনটি দেখা গেছে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ কিংবা ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে। এবং যখন তিনি ফেলুদার জন্যও পরম শত্রু নির্মাণ করলেন, তখনও খেয়াল রাখলেন যেন চরিত্রটির মাঝে রসবোধ থাকে, সে যেন একঘেয়ে ও অনুমেয় হয়ে না পড়ে।
এছাড়া অনেকে যে অভিযোগ করে, কেন সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মগনলাল ফেলুদাকে খুন করল না বা তার বড় কোনো ক্ষতি করল না, এখানে কিন্তু আমরা মগনলালের মাঝেও ফেলুদার মানসিকতার ছায়া দেখতে পাই। ফেলুদা যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মগনলালকে পেয়ে মনে মনে উৎফুল্ল, মগনলালও যে তা-ই। সে কারণে সে ফেলুদার সাথে মাইন্ডগেম খেললেও, সরাসরি ছোবল হানে না। কঠিনতম প্রতিপক্ষকে শেষ করে দিলে সে খেলবে কার সাথে? কাকে হারিয়ে দিয়ে আত্মসুখ পাবে? ঠিক এই কারণেই কিন্তু জোকারও চায় না ব্যাটম্যানকে মেরে ফেলতে।
তো যা-ই হোক, খেয়াল করে দেখবেন, বইয়ের পাতার ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ আর চলচ্চিত্রের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ কিন্তু মগনলালের কাছে জটায়ুর নাস্তানাবুদ হওয়ার পর ফেলুদার প্রতিক্রিয়ায় বেশ মোটা দাগে পার্থক্য রয়েছে।
বইয়ে কী দেখেন আপনি? দেখতে পান, মগনলালের বাড়ি থেকে ফেরার পর ফেলুদা কী করবে না করবে দিশা খুঁজে না পেয়ে অনেকটাই হাল ছেড়ে দেয়, এবং এরই মাঝে শশীবাবুর আকস্মিক মৃত্যু তাকে এতটাই ধাক্কা দেয় যে, সে বেমক্কা তোপসেকে বলে বসে:
“গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব রে।”
এভাবেই প্রথমবারের মতো ফেলুদাকে পরাজিত সৈনিকের মতো মনে হয়। সবসময় আত্মবিশ্বাসে টগবগ করতে থাকা আপনার প্রিয় চরিত্রটির মুখে এ সংলাপ বসালে আপনি গোটা ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারবেন, মগনলাল আসলেই কতটা সাংঘাতিক সে সত্যটা আপনার মর্মমূলে আঘাত হানবে—এমনই ছিল সত্যজিতের পূর্বানুমান।
কিন্তু বুকে হাত রেখে বলুন তো, ফেলুদার মুখে এ কথা শুনে আপনি কি দুঃখ পাননি? আপনার কি মগনলালের প্রতি ঘৃণা জন্মানোর বদলে ফেলুদার প্রতিই খানিকটা রাগ বা অভিমানের উদয় হয়নি যে, কী এমন ঘটল যার কারণে ফেলুদা এমন করছে! তারচেয়েও বড় কথা, জটায়ুর সাথে যা হলো, তারপর বদলা নেয়ার বদলে সে কীভাবে হাল ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবতে পারে!
তার মানে দাঁড়াচ্ছে, মগনলালকে মহা শয়তান প্রমাণ করতে সত্যজিৎ এতটাই মরিয়া ছিলেন যে, নিজের হাতে তিলতিল করে গড়ে তোলা ফেলু মিত্তির চরিত্রটিকেও ভঙ্গুর রূপে উপস্থাপন করতে তার দ্বিধা হয়নি।
ধারণা করতে পারি, সত্যজিৎ এমনটি করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন স্বয়ং স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের থেকে। কোনান ডয়েলও যে ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ গল্পে প্রফেসর মরিয়ার্টিকে এমন ভয়ঙ্কর রূপেই তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু কোনান ডয়েলের অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ যে একটি মস্ত বড় ভুল চাল চেলে ফেলেছিলেন, তা আপনাকে মানতেই হবে।
ভুলটি হলো, তিনি ভুলে গিয়েছিলেন ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ গল্পে কোনান ডয়েল চেয়েছিলেন শার্লককে মেরে ফেলতে, চিরতরে তার অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতে। আর সেজন্যই তিনি বাধ্য হয়েছিলেন প্রফেসর মরিয়ার্টির চরিত্রকে অত বেশি শক্তিশালী করে তুলতে। কিন্তু সত্যজিৎ তো ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ ফেলুদাকে মারতে চাননি। নামই বলে দেয় এখানে ফেলুদার জয় হবে। তাই সেখানে ফেলুদাকে এত বেশি নাজুক অবস্থায় দেখানোটা হিসেবের ভুলই বটে।
আবারো বলছি, সত্যজিতের ভুল ধরছি বলে মারতে আসবেন না আমাকে। কারণ এই ভুলটিও সত্যজিৎ নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন। এবং সেই ভুলটি তিনি সংশোধনও করেছিলেন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ গল্পের চলচ্চিত্র রূপান্তরে।
সত্যজিৎ নিজেই একবার বলেছিলেন:
“চিত্রনাট্য রচনার প্রয়োজনে যখন মূল কাহিনীর নির্মম বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়, যখন চরিত্রগুলিকে রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে কল্পনা করতে হয়, গল্পের পরিবেশ চোখের সামনে মূর্ত করে তুলতে হয়, সময়ের পরিষ্কার সূত্র ধরে ঘটনাবলীর একটা ধারাবাহিকতা তৈরী করতে হয় — তখনই এ জাতীয় ত্রুটি চোখে পড়ে।”
ভুলটি হলো, লাখো শিশু-কিশোরের স্বপ্নের নায়ক ফেলুদাকে ভেঙে পড়তে দেয়া। এর বদলে করণীয় ছিল, ফেলুদাকে আরো তাতিয়ে তোলা, এবং মগনলালকেও চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত করে লালমোহনবাবুর অপমানের প্রতিশোধ নেয়া।
এজন্য আপনি ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে কী দেখতে পান? দেখতে পান ছুরি খেলার দৃশ্যের পর ফেলুদা মোটেই হাল ছেড়ে দিচ্ছে না, বরং গঙ্গার ঘাটে বসে সে অনুতপ্ত অথচ দৃপ্ত কণ্ঠে বলছে:
“আমি হয় এর বদলা নেব, না-হয় গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব।”
এবার আপনি নিজেই নির্মোহ বিশ্লেষণ করে দেখুন, গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেয়ার কথা, আর প্রতিশোধ নিতে না পারলে গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেয়ার কথা, এই দুইয়ের মাঝে কী আকাশ-পাতাল তফাৎ!
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবির জন্য চিত্রনাট্য নির্মাণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ কিন্তু মূল কাহিনীর আরো বড় একটি ত্রুটি খুঁজে পেয়েছিলেন। কী সেটি? সেটি হলো, মগনলাল মেঘরাজ আসলে গল্পে অতটাও সাংঘাতিক ছিল না, যতটা তোপসের জবানিতে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলা হয়েছে।
কারণ মগনলাল এতই যদি দুর্ধর্ষ হবে, তাহলে সে কেন গোটা কাহিনীতে জটায়ুকে ছুরির খেলার মাধ্যমে ভয় দেখানো ছাড়া আর তেমন কোনো নৃশংসতা দেখাবে না? অথচ বিকাশ সিংহ, সে যতই লোভী হোক তবু ছাপোষা তো বটেই, তার মতো একজন মানুষ খুনোখুনি করে ফেলবে?
আপনি দেখবেন, এই ভুলেরও যৌক্তিক সংশোধন সত্যজিৎ ছবির চিত্রনাট্যে করেন। ছবির একমাত্র খুনটিতে বিকাশ সিংহের পরোক্ষ অবদান থাকলেও, মূল হোতা ওই মগনলালই। ৭০ বছরের অতি ভালো একজন মানুষকেও সে নির্মমভাবে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়, যেন পরবর্তীতে তার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে না পারে।
এখানে একটি কথা না বলে পারছি না, এরকম ছোট ছোট ব্যাপারই কিন্তু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কেন সত্যজিৎ একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে যতটা অসাধারণ ও প্রায় নিখুঁত, একজন সাহিত্যিক হিসেবে তা নন।
তবে হ্যাঁ, আবার ফিরি মগনলালে। মগনলাল ফেলুদার পরম শত্রু, এ বিষয়টি না হয় ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা গেল। আপনাকে বিশ্বাস করানো গেল, বুদ্ধির খেলায় ফেলুদার সাথে সমানে সমানে টেক্কা দিতে পারে এই মগনলালই।
কিন্তু ভেবে দেখুন তো, এই গল্পে মগনলাল যা করেছে, তা তো প্রায় ব্যক্তিগত কামনা থেকে, নিজস্ব লোভ চরিতার্থ করার অভিপ্রায় নিয়ে। এজন্যই কি তাকে ‘সবচেয়ে সাংঘাতিক’ উপাধি দিয়ে দেয়া যায়? সে একটা খুন করেছে বটে, এবং আপনি জানেন সে আরো অনেক কুকাজের সাথে জড়িত, (ছবিতে টাকার লোভে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারের উল্লেখও ছিল) তবু আপনি কি তাকে পুরো সমাজের শত্রু হিসেবে ভাবতে পারেন? যদি না পারেন, তাহলে কি মগনলালকে ভিলেন হিসেবে এতটা উচ্চাসনে বসাতে পারেন?
আপনার হয়ে আমিই দিয়ে দিচ্ছি উত্তরটা, পারেন না। আমি এটি বলার সাহস দেখাচ্ছি সেই অভিন্ন কারণে যে, সত্যজিৎ নিজেও এমনটি ভেবেছিলেন। এবং সে কারণেই মূলত তিনি মগনলালকে আবারো ফিরিয়ে এনেছিলেন ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডু’ গল্পে।
লক্ষ্য করে দেখুন, ফেলুদা সিরিজের প্রায় সবগুলো গল্পের কাহিনীই কিন্তু নিতান্ত ব্যক্তিগত। সেখানে খলনায়করা প্রধান যে রিপুর তাড়নায় ভোগে, সেটি হলো লোভ। তবে সেই লোভের ফলে ভুক্তভোগী হয় দুই-একজন লোক। গোটা সমাজের শত্রুরূপী খলনায়ক তেমন একটা দেখা যায় না। সমসাময়িক সমাজবাস্তবতারও খুব একটা প্রতিফলন কোনো গল্পে উপস্থিত থাকে না, যেটিকে ফেলুদা সিরিজের সমালোচকরা প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। (এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ গল্পটিকে)
এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ ব্যতিক্রম, আর সেটির খলনায়ক হিসেবে মগনলালের তাৎপর্য এত বেশি।
মনে করে দেখুন, ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ গল্পে মগনলালের প্রধান অপরাধ কী ছিল? জাল ওষুধ চোরাচালান করা, যে ওষুধ খেয়ে হাজার হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। জাল ওষুধের এই ভয়াবহতা অবশ্য সত্যজিৎ সরাসরি ফেলুদার মুখ দিয়ে না বলিয়ে, বলান বিপুল ভৌমিককে দিয়ে:
“আপনাকে বললাম না সেদিন, ওষুধ নিয়ে যাচ্ছেতাই কারবার হচ্ছে? মিল্ক পাউডারে খড়ি মিশিয়ে দেয়, জানেন? শিশুদের পর্যন্ত বাঁচতে দেবে না এরা।”
অর্থাৎ তৎকালীন সময়ে, এমনকি আজকের দিনেও, ভেজাল ওষুধ তৈরী ও চোরাচালান যে একটি ভয়াবহ সামাজিক অপরাধে রূপ নিয়েছে, সেটির পিছনে অন্যতম প্রধান হোতা হিসেবে সত্যজিৎ দেখিয়েছেন মগনলালকে। মগনলালই সেই লোক, যে ভারত ও নেপালের অগণিত মানুষের প্রাণহানির কারণ।
ফলে নিঃসন্দেহে ফেলুদা সিরিজের সবগুলো গল্পের মধ্যে অপরাধের তীব্রতার দিক থেকে ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ গল্পটিই সবচেয়ে এগিয়ে। সেখানে ভিলেন হিসেবে মগনলালকে উপস্থাপন আসলে ভিলেন হিসেবেই তাকে অন্যদের তুলনায় একদম অস্পৃশ্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।
সুতরাং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ গল্পে সত্যজিৎ মগনলালকে প্রত্যাশিত মাত্রার সাংঘাতিক হিসেবে দেখাতে না পারলেও, ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডু’-তে সেটি পেরেছেন। কিন্তু হতাশার বিষয়, এই গল্পের মাধ্যমে মগনলালের সাংঘাতিকতা যেমন সুনিপুণভাবে প্রকট হয়েছিল, ‘গোলাপী মুক্তা রহস্য’-র মতো একটি সার্বিকভাবে দুর্বল গল্পে মগনলালকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে তা অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে গেছে। আমি এটি বলতে চাচ্ছি না যে এ গল্পে মগনলালকে আনা উচিৎ হয়নি। আমি বলছি, এই গল্পটিই একেবারে না লিখলে ভালো করতেন সত্যজিৎ। একই কথা প্রযোজ্য শেষ দিকের আরো কয়েকটি গল্পের ক্ষেত্রেও।
বলুন তো, মগনলালকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কোন প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব? সেটি হলো উৎপল দত্ত। আমার এতক্ষণের কথাবার্তা থেকে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, আমার কাছে বইয়ে লিপিবদ্ধ ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ গল্পটি যথেষ্ট নয় মগনলালকে সাংঘাতিক হিসেবে বিবেচনার জন্য। একইসাথে প্রয়োজন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিটিও। সেখানেই যে মগনলাল চরিত্রটির প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন উৎপল দত্ত। তিনি যদি এই চরিত্রটিতে অভিনয় না করতেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত মগনলালকে ফেলুদার মরিয়ার্টি হিসেবে গড়ে তোলার যে উদ্যোগ সত্যজিৎ নিয়েছিলেন, সেটি সফল হতো না বলেই মনে হয়।
ভুলে গেলে চলবে না সন্তোষ দত্তকেও। তিনি মগনলাল চরিত্রে অভিনয় করেননি বটে, কিন্তু জটায়ুর ভূমিকায় অভিনয় তো করেছেন। এবং তিনি যদি ছুরি ছোঁড়ার সেই আইকনিক দৃশ্যটিতে অমন অনবদ্য অভিনয় না করতেন, গোটা বিষয়টিকে জীবন্ত করে না তুলতেন, দর্শকের রুদ্ধশ্বাসের ব্যবস্থা না করতেন, তাহলে সামগ্রিকভাবে মগনলাল চরিত্রের ভয়াবহতাও যে প্রস্ফূটিত হতো না।
চলুন মগনলাল চরিত্রটিকে আরেকবার মূল্যায়ন করা যাক। ইতোমধ্যেই কয়েকবার বলে ফেলেছি, মগনলাল হলো ফেলুদার মরিয়ার্টি। তবে তাকে আরেকটি অভিধা দেয়া যায়। সে হলো অনেকটা অক্রুর নন্দীর লেখা রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের ডাকু গণ্ডারিয়া, ক্যাপ্টেন স্পার্ক যাকে বারবার বোকা বানায়।
আসলেই তো, মগনলাল যত সাংঘাতিকই হোক না কেন, জয় যে শেষ পর্যন্ত ফেলুনাথেরই হয়। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ বইয়ে সত্যজিৎ ব্যাপারটি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, কিন্তু ছবিতে তিনি ঠিকই দেখান যে, ফেলুদা মগনলালকে ঠিক সেভাবেই নাস্তানাবুদ করছে, যেভাবে মগনলাল নাস্তানাবুদ করেছিল জটায়ুকে।
‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডু’-তে আর সে ভুল করেননি সত্যজিৎ। মূল বইটিতেই তিনি লিখে দিয়েছেন, জটায়ুকে এলএসডি খাওয়ানোর প্রতিশোধস্বরূপ ফেলুদাও মগনলালের উপর একই ওষুধ প্রয়োগ করেছে। আর ‘গোলাপী মুক্তা রহস্য’ গল্পে তো ফেলুদাও না, মগনলাল হার মেনে যায় জটায়ুর (সঙ্গে তোপসে) বুদ্ধির কাছেই!
তবে শেষ পর্যন্ত মগনলাল যতই ফেলুদার কাছে হার মানুক, তার অরিজিন স্টোরি নিয়ে একক কোনো বই বা ছবি হলে বোধহয় মন্দ হতো না!