“জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব”
আজ থেকে প্রায় ৯২ বছর আগের কথা। ৮ই এপ্রিল, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাস। প্রকাশিত হয় একটি বার্ষিক পত্রিকার প্রথম সংস্করণ। পত্রিকার প্রথমে বড় করে লেখা ‘‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র মুখপত্র’। সম্পাদকের নাম অধ্যাপক আবুল হুসেন এম.এ.বি.এল.। সেই পত্রিকার শুরুতে উপরের এই কথাগুলোও লেখা রয়েছে, যার টাইটেল পৃষ্ঠায় ছিলো একটি ক্ষুদ্র রেখাচিত্র। ছিলো মুসলমানদের প্রাণের গ্রন্থ একটি খোলা কোরআন শরীফের ছবি। যেন কোরআন শরীফ একটি আলো হয়ে আছে, যাকে আঁকড়ে শাণিত হবে চিন্তার তরবারি।
উপমহাদেশের মুসলমানদের তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ব্রিটিশরা জেঁকে বসেছে দেশ পরিচালনার গদিতে। এই পত্রিকা প্রকাশিত হবার প্রায় একশো বছর পূর্বে সমাজ সংস্কারে জেগে উঠেছিলো উপমহাদেশের হিন্দুরা। তাদের নেতৃত্ব দেন রাজা রামমোহন রায়। হিন্দুদের সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অশিক্ষা থেকে রেহাই দেয়ার হাতিয়ার হাতে নেন তিনি। মানুষকে চিন্তার জগতে বিচরণের সুযোগ দেন। আর এই সংস্কারের দিকে পরবর্তিতে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান আরেকজন সমাজসংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
তখনকার সময় থেকেই ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়তে থাকে উপমহাদেশের মুসলিমরা। বিশেষ করে বাংলার মুসলিমরা। ডিরোজিওর মতো একজন বিদেশী এসেও বুদ্ধির চর্চায় শাণ দিয়েছিলো হিন্দুদের। কিন্তু মুসলমানরা কাউকে পায়নি তাদের চর্চা এগিয়ে নেয়ার জন্য। ফলে এখানে তৈরি হয় ধর্মীয় গোঁড়ামি।
বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচার হবার পর তার সাথে খাপ খাওয়াতে সময় লাগে মুসলমানদের। কিন্তু তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সমাজে তৈরি হয় স্বার্থবাদী চিন্তার বার্তাবাহক। তাদের সুবিধা এবং স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে তারা ব্যবহার করে সদ্য গ্রহণ করা ইসলামকে। ধর্মের নানান নিয়ম-নীতি এবং ভীতি দেখিয়ে হাসিল করে তাদের উদ্দেশ্য। ফলে জাগরণ তো হলোই না, উল্টো বাঙালি মুসলমানরা কূপমণ্ডূক হতে শুরু করে।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে। প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলার মুসলমানরা নিজেদের চিন্তাকে নিয়ে ভাববার এবং প্রকাশ করবার সুযোগ পায়।
এর কয়েক বছর পর ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত হয় এক বৈঠক। তখন এই হলের নাম ছিলো মুসলিম হল। সেখানকার ছাত্র সংসদের অফিস রুমের এক বৈঠকে সভাপতি হিসেবে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯)। উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮), কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) প্রমুখ। তাদের এই বৈঠকে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মুসলমানদের চিন্তা থেকে গোঁড়ামি দূর করা, অশিক্ষা দূর করা, সমাজের অনিয়ম নিয়ে ভাবানো এবং কুসংস্কার বিষয়ে সচেতন করাই ছিলো এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য, যার নাম দেয়া হয় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’।
তাদের চিন্তাভাবনা এবং কার্যক্রমের মুখপত্র হিসেবে একটি পত্রিকা প্রকাশ করার চিন্তা করা হয়। ‘শিখা’ নামের বার্ষিক পত্রিকাটি তখন জন্ম নেয়। সম্পাদক হিসেবে ছিলেন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এর অন্যতম সদস্য আবুল হুসেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স বিভাগের অধ্যাপক এবং তৎকালীন মুসলিম হলের হাউজ টিউটর। প্রকাশনার দ্বায়িত্বে ছিলেন আবদুল কাদির, যিনি তখন ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজ থেকে সদ্য আইএসসি পাশ করেছেন।
“সর্ব্বস্বত্ব ‘সমাজে’র জন্য সংরক্ষিত”
উপরের লাইনগুলো লেখা ছিলো তাদের পত্রিকাটির সম্পাদকের নামের পরেই। এই গুটিকয়েক শব্দ থেকেই তাদের ত্যাগের ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়। ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর প্রকাশিত হয় এটি। তারপর সমাজের স্বার্থবাদী সমাজপতিদের চাপে পড়ে এবং হুমকির মুখে পত্রিকাটি প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়া হয়। মূলত শিখার প্রকাশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো অধ্যাপক আবুল হুসেনের ইস্তফা দেয়ার কারণে। ১৯২৯ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি মুসলিম সাহিত্য সমাজ থেকে ইস্তফা দেন। এর আগের দিনই তাকে আহসান মঞ্জিলে ডেকে নিয়ে তার বিরুদ্ধে বিচারালয় বসানো হয়। তাকে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। তিনি পরবর্তিতে ১৯৩২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে ইস্তফা দেন। চলে যান কলকাতায়।
প্রকাশিত পাঁচটি সংস্করণে শিখা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আবুল হুসেন (প্রথম সংস্করণ), কাজী মোতাহার হোসেন (দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণ), মোহাম্মদ আবদুর রশীদ (চতুর্থ সংস্করণ) এবং আবুল ফজল (পঞ্চম সংস্করণ)। তবে সম্পাদক যারাই থাকুক না কেন মূল সম্পাদনার কাজে থাকতেন আবুল হুসেন। তিনি পত্রিকাটি চালানোর অর্থও যোগান দিতেন।
কী ছিলো ‘শিখা’ পত্রিকায়?
তৎকালীন সমাজের মুক্তচিন্তার ধারকদের কাছে পত্রিকাটি ছিলো মত প্রকাশের জন্য উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম। সেখানে সকল প্রকার সামাজিক কুসংস্কার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে সমাজের অন্ধ বানিয়ে রাখা লোকদের সজাগ করার লেখনি থাকতো। সেখানে ঘুণে ধরা সমাজকে সংস্কারের ব্যাপারে আলোকপাত করা হতো।
প্রথম সংখ্যার শুরুতেই ছিলো কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘খোশ আমদেদ’ শিরোনামের একটি শুভেচ্ছা নিবন্ধ। যেখানে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয় মুক্তির পথে আসা পাঠকদের। প্রথম সংস্করণের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লেখনির মধ্যে ছিলো অধ্যাপক কাজী আবদুল ওদুদের ‘বাঙ্গালী মুসলমানের সাহিত্য-সমস্যা’, আবুল হুসেনের ‘বাঙ্গালী মুসলমানের শিক্ষা-সমস্যা’, আবদুর রশীদের ‘আমাদের নবজাগরণ ও শরিয়ত’, আবদুস সালাম খাঁর ‘নাট্যাভিনয় ও মুসলমান সমাজ এবং আবদুল কাদেরের ‘বাঙলার লোক-সঙ্গীত’।
দ্বিতীয় সংস্করণের সূচনা লেখাটিও ছিলো জনপ্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের। এবারও তিনি জয়গান গেয়েছেন মুক্তির ধারক, বাহক এবং পাঠকদের। এই সংস্করণের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লেখনি হলো- খান বাহাদুর মৌলভী কমরুদ্দীন আহমদের ‘সমবায় আন্দোলনে মুসলমানের কর্তব্য’, অধ্যাপক রকীবউদ্দিন আহমদের ‘বাংলার লুপ্ত শিল্প’, সৈয়দ আবদুল ওয়াহেদের ‘বাংলায় পীর পূজা’, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের ‘মানব মনের ক্রমবিকাশ’ এবং মিস ফজিলাতুন নেসার ‘নারীজীবনে আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ’।
‘শিখা’ পত্রিকার তৃতীয় সংস্করণে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নিয়ে চমৎকার একটি লেখনি ছিলো অধ্যাপক মোহিতলাল মজুমদারের। দার্শনিক ইবনে রুশদ, স্যার সৈয়দ আহমদ এবং আরবী কাব্য নিয়ে লেখনি ছিলো। এছাড়াও এই সংখ্যার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লেখনি হলো খান সাহেব আবদুর রহমান খাঁর ‘ইউরোপে শিক্ষার আদর্শের ক্রমবিকাশ’, মৌলভী নাজিরুল ইসলামের ‘মানব প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধি’, মৌলভী শামসুল হুদার ‘কুসংস্কারের একটা দিক’ এবং মৌলভী আবুল ফজলের ‘তরুণ আন্দোলনের গতি’।
চতুর্থ সংস্করণে লেখার সংখ্যা অনেকটাই কমে আসে। তবে এবার মুসলমান লেখকদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের লেখকদের লেখাও প্রকাশিত হয়। যেমন- অধ্যাপক শ্রী উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনে জগৎ ও জীবন’, করুণাকণা গুপ্তার ‘বর্তমান বাংলার মহিলা ঔপন্যাসিক’ এবং প্রিন্সিপাল শ্রী সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের ‘সাহিত্যে শুচিতা’। এছাড়াও জ্ঞানের ধারা অব্যাহত রাখতে এখানে ছিলো অধ্যাপক কাজী আবদুল ওদুদের ‘গ্যেটে’, ফাতেমা খানমের ‘তরুণের দ্বায়িত্ব’ এবং নাজির উদ্দিন আহমদের ‘মুসলিম জাগরণ’।
পঞ্চম সংস্করণে বেশ উঁচু স্তরেই ছিলো ‘শিখা’ পত্রিকার উপাদানগুলো। ধীরে ধীরে জ্ঞানের প্রতিটি সিড়ি পার হচ্ছিলেন পাঠকরা। কিন্তু এরপর আর প্রকাশিত হয়নি এই পত্রিকাটি। এই সংখ্যার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি লেখনি ছিলো আবুল হুসেনের ‘আমাদের রাজনীতি’, কামাল উদ্দীনের ‘সভ্যতার উত্তরাধিকার’, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের ‘নাস্তিকের ধর্ম্ম’, মোহাম্মদ আবদুল ওদুদের ‘আলবেরুনী’ এবং মোহাম্মদ আবদুর রশীদের ‘হিন্দু মুসলমানের কথা’।
‘শিখা’ পত্রিকার লেখাগুলো মূলত তৎকালীন সমাজের কথা বলেছে। মুসলমানদের জাগরণের কথা বলেছে। সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তায় গুরুত্বারোপ করেছে। তাদের প্রতিটি সংখ্যায় কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা থাকতো। লেখা থাকতো ইতিহাসের চমৎকার কয়েকটি অধ্যায় নিয়ে। আর ধর্মের চমৎকার কিছু ব্যাপার থাকতো প্রতিটি সংখ্যায়। সেখানে আমাদের সমাজের কিছু কুসংস্কারের বিষয়ে সজাগ করে দেয়া হতো। নারীদের নিয়েও তাদের ইতিবাচক মনোভাব ছিলো। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নারীদের পিছিয়ে রাখার পক্ষে তারা ছিলেন না।
বাংলার মুসলিম মুক্তচিন্তার আন্দোলন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ যখন মুখ থুবড়ে পড়লো, তখনই থমকে গেলো বুদ্ধিচর্চার পত্রিকাটি। সেখানে থমকে না থেকে মহাসমারোহে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারলো হয়তো এই বাংলার ইতিহাসটা অন্যরকম হতো। এখানকার মুসলমানরাও কাউকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করে নিজেদের চিন্তায় চালিত হতেন। হয়তো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অন্যান্যদের মতো তারাও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। হয়তো ১৯৪৭ সালের দেশভাগে এমনভাবে আমাদের মধ্যে অনৈতিকভাবে ভাগাভাগি করে দেয়া সম্ভব হতো না। বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো না এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীজ বপন করার নীল নকশাটিও।
কিন্তু তা আজ শুধু হাহাকার জন্ম দেয়। জন্ম দেয় একরাশ কান্নাভেজা চোখের। যেখানে অশ্রু জমতে জমতে শুকিয়ে গেছে। কেননা আজকেও আনন্দিত হবার মতো সংবাদ নেই। আজকেও মুক্তচিন্তা থমকে আছে। থামিয়ে দেয়া হচ্ছে ধর্ম এবং আইনের বেড়াজালে।