ইংরেজি সাহিত্য জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র অস্কার ওয়াইল্ড ( ১৮৫৪- ১৯০০)। ঊনবিংশ শতাব্দীর আইরিশ এ সাহিত্যিকের বিচরণ ছিল সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায়- তা হোক ছোট গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদিতে। কিন্তু ৪৬ বছরের জীবনে ওয়াইল্ড কেবল একটি মাত্র উপন্যাস রচনা করেছিলেন। কিন্তু সেই উপন্যাসই পরবর্তী সময়ে সাহিত্য জগতের অন্যতম ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত হয়।
দ্য পিকচার অফ ডরিয়ান গ্রে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালে।
প্রকাশনার সময় তুমুল বিতর্কিত হয় গথিক ঘরানার এই উপন্যাসটি। এতটাই যে সমালোচনার রোষানল থেকে বাঁচতে ওয়াইল্ডকে কিছু না জানিয়েই উপন্যাসের প্রায় ৫০০ শব্দ ছেঁটে পুনরায় প্রকাশ করেন ওয়াইল্ডের সম্পাদক।
কী কারণে বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত এই সাহিত্যকর্মকে তার জন্মলগ্নে এতটা বিতর্কের শিকার হতে হয়েছিল?- এই প্রশ্নের জবাব দেবার আগে প্রথমে উপন্যাসের কাহিনীটি জানা জরুরি।
দ্য পিকচার অফ ডরিয়ান গ্রে-এর শুরুটা হয় উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে, গ্রীষ্মের এক সুন্দর দিনে, লর্ড হেনরি উওটনকে দিয়ে। ব্রিটিশ এ লর্ড এসেছেন তার বন্ধু ব্যাসিল হলওয়ার্ডের বাড়িতে। ব্যাসিল হলওয়ার্ড একজন চিত্রশিল্পী, অল্পভাষী মৃদু স্বভাবের এই ব্যক্তি বছর কয়েক আগে হুট করে উধাও হয়ে বেশ আলোচনার কেন্দ্রে এসেছিল। যদিও ব্যাসিল নিজে সেগুলোকে কানে নেয় না। লর্ড হেনরি এসময়ে ব্যাসিলকে দেখেন এক অনিন্দ্যসুন্দর তরুণের ছবি আঁকতে। নীল নয়নের এই স্বর্ণকেশী হলো ডরিয়ান গ্রে, ব্যাসিলের মডেল। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ব্যাসিল চাইছিল না তার চিত্রকর্মটি কোথাও প্রদর্শন করতে। এর কারণ হিসেবে সে হেনরিকে বলে, “নিজেকে একটু বেশি ঢেলে দেয়া হয়েছে”।
আবার ডরিয়ানের সাথে হেনরির পরিচয় হোক, এ-ও সে চাইতো না। ব্যাসিল মনে করতো, হেনরির অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গী ডরিয়ানের উপর একটা খারাপ প্রভাব ফেলবে।
তারপরও একসময় হেনরির সাথে পরিচয় হয় ডরিয়ানের, ব্যাসিলের চিত্রের মতোই সুন্দর এই তরুণ। হেনরি ডরিয়ানকে বলে যে যৌবনের মতো মূল্যবান এ জগতে আর কিছু নেই। আবার তারুণ্যের মতো ক্ষণস্থায়ীও আর কিছু নেই। হেনরি ডরিয়ানকে উপদেশ দেয় তার সৌন্দর্য ও তারুণ্যকে কাজে লাগাতে। নিজের সকল কামনা-বাসনা, তা যতই প্রশ্নবোধক হোক না কেন, পূরণ করতে।
প্রথমবারের মতো নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে উপলব্ধি হওয়ায় হেনরির কথাগুলো ডরিয়ানকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। এ সময়ে ডরিয়ানের পোর্ট্রেটটি শেষ করে ব্যাসিল। নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ডরিয়ান ভাবতে থাকে যে, একসময়ে সে বুড়িয়ে গেলেও এই ছবিটির কোনো পরিবর্তন হবে না। ব্যাসিলের কাছে ছবিটা চায় ডরিয়ান।
অত্যন্ত ভগ্নহৃদয়ের সাথে সে বলে বসে,
“আহা, কী চমৎকারই না হতো, যদি এই ছবিটা বুড়িয়ে যেতো আর আমি যেমন আছি, তেমনই থাকতাম! এর জন্য আমি আমার আত্মা বিক্রি করে দিতেও রাজি।”
এরপর হেনরির উপদেশ অনুযায়ী নিজের তারুণ্যকে উপভোগ করতে শুরু হয় ডরিয়ানের দ্বৈত জীবন। একদিকে যেমন সে ব্রিটিশ অভিজাত শ্রেণির পার্টি জমিয়ে রাখতো, অন্যদিকে সে বেরিয়ে পড়তো লন্ডনের অলিতে গলিতে। এরকমই এক রাতে, এক নিম্নমানের ভাঙাচোরা থিয়েটারে তার সাথে পরিচয় হয় সিবিল ভেইনের। সিবিল থিয়েটারের সবচেয়ে দক্ষ অভিনেত্রী, তার কাজ দেখে মুগ্ধ হয় ডরিয়ান। প্রেমে পড়ে যায় সে, সিবিলকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তও নিয়ে নেয়। সিবিলের অভিনয় শৈলী দেখাতে ব্যাসিল এবং হেনরিকে নিয়ে আসে সে।
কিন্তু এদিকে ডরিয়ানের প্রেমে পরা সিবিল ডরিয়ানকে দেখে অভিনয়ের উপর মনোযোগ হারিয়ে ফেলে।
সিবিলের এই অবস্থা দেখে ক্ষিপ্ত হয় ডরিয়ান, তার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে সে। পরদিন সকালে সে খবর পায়, সিবিল আত্মহত্যা করেছে। এসময় ডরিয়ান দেখে, ব্যাসিলের আঁকা সেই পোর্ট্রেট একটু বদলে গেছে।
ছবির আগের সেই প্রাঞ্জল হাসিটা কেমন যেন কুটিল হয়ে গিয়েছে।
ডরিয়ান বুঝতে পারে যে ব্যাসিলের আঁকা সেই ছবিটি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তার করা অন্যায়ের সাক্ষ্য রেখে যাচ্ছে। অন্যায়, যত অনৈতিক কাজ ডরিয়ান করবে, ততই বিকৃত হবে সেই ছবিটি। শুধু তা-ই নয়, যত সময়ই যাক না কেন, তার কোনো প্রভাব পড়বে না ডরিয়ানের উপর। ডরিয়ান সেই তরুণই থাকবে, আর তার স্থলে বয়স বাড়তে থাকবে সেই ছবির ডরিয়ানের।
ডরিয়ানের আত্মার এক নগ্ন প্রতিবিম্বে পরিণত হয় সেই পোর্ট্রেটটি।
প্রথমে ছবিটা দেখে ভয় এবং অনুশোচনা বোধ করলেও খুব দ্রুত সেটা কাটিয়ে ওঠে সে।
সে এখন চির তরুণ! কিছুই তো তাকে আর আটকে রাখতে পারবে না!
ধীরে ধীরে নিজের কামনা-বাসনার কাছে আরো নিজেকে সঁপে দেয় ডরিয়ান। আফিমের আখড়া, নিষিদ্ধ পল্লী থেকে লন্ডনের অভিজাত রুচিশীল সমাজ- ডরিয়ানের বিচরণ হয় আরো বিচিত্র ও বিস্তৃত।
সেইসাথে সে বিপথে পরিচালিত করে অন্য তরুণদেরও।
বিকৃত হতে থাকে পর্দার পেছনে থাকা ডরিয়ানের ছবি।
এভাবেই কেটে যায় প্রায় ১৮টি বছর।
তারপর?
এরপর ডরিয়ান এবং সেই ছবির কী পরিণতি হয়, তা জানতে আপনাকে পড়তে হবে এই রোমাঞ্চকর উপন্যাসটি।
উপন্যাসের নামচরিত্র ডরিয়ান গ্রে আদতে একজন অত্যন্ত স্বার্থপর ব্যক্তি। নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে অবগত হবার পর থেকে সে যেমন স্বেচ্ছাচারী জীবন কাটায়, তেমনই নিজের কোনো কাজের জন্য দায় স্বীকার করতে রাজি না সে। নিজেকে বাঁচাতে হেন কোনো কাজ নেই, যা সে করবে না। উপন্যাসের অন্যতম চমৎকার বিষয় ছিল ডরিয়ানের সবধরনের ভাবনাকে সোজাসুজি উপস্থাপন।
যত গর্হিত কাজই করা হোক না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডরিয়ান তার কাজের পেছনে অন্যদেরকেই দায়ী করেছে এবং সে নিজে কতটা ‘দুর্ভাগা’, তা ব্যক্ত করেছে।
উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র লর্ড হেনরি একজন রহস্যময় ব্যক্তি। সে বিশ্বাস করে, জীবনের মর্ম হলো নিজেকে জানা আর তা কেবল সম্ভব নিজের সবটুকু- ভালো এবং কদর্য সত্ত্বায় বিচরণ করা, জানা। নীতি-নৈতিকতা, বিবেকবোধ তার কাছে শেকলের মতো।
ব্যাসিলকে এক পর্যায়ে সে বলে,
“বিবেক আর কাপুরুষতা একই জিনিস, ব্যাসিল। বিবেক তো প্রতিষ্ঠানের ট্রেডমার্ক মাত্র।”
মানুষকে দেখতে, মানুষকে প্রভাবিত করতে ভালোবাসে হেনরি। ডরিয়ানের মাথায় ভোগবাদের বীজ বপন করতে পেরে বেশ খুশি হয়েছিল এই লর্ড। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, হেনরি নিজে কখনোই স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করেনি।
ব্যাসিল একসময় বলেই বসে,
“হেনরি, তোমার মুখ দিয়ে কখনোই ন্যায়ের কথা বের না হলেও তুমি নিজে একটা অনৈতিক কাজ করোনি। নৈতিকতা নিয়ে সবসময় সমালোচনা করলেও নীতির বিরুদ্ধে যাওনি।”
হেনরির রহস্যের পাশাপাশি রয়েছে সেই ছবির স্রষ্টা ব্যাসিল। ব্যাসিল একজন অল্পভাষী নীতিবান মানুষ। ডরিয়ানের সৌন্দর্যকে সে রীতিমতো পূজা করতো। ব্যাসিলের চোখে ডরিয়ানের পবিত্রতা ছিল শাশ্বত। ডরিয়ানের প্রতি ব্যাসিলের আকর্ষণ একজন শিল্পীর তার আদর্শের প্রতি টান হিসেবে দাবি করা হলেও তাকে প্রেম বললেও ঠিক ভুল বলা হবে না।
উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে আছে সিবিল ভেইন, জেমস ভেইন, অ্যালান ক্যাম্পবেল প্রমুখ, তবে মূলত উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চলক এই তিনজনই।
‘দ্য পিকচার অফ ডরিয়ান গ্রে’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালের জুলাই মাসের লিপিনকটস মান্থলি ম্যাগাজিনে (Lippincott’s Monthly Magazine)। প্রকাশনার পরই তুমুল বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয় এটি৷
উপন্যাসে গোটা সমাজব্যবস্থা, আদর্শ, নারী, বিবাহ সহ বহু বিষয়ের তুমুল সমালোচনা করা হয়েছে।
সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ এবং নান্দনিকতার উপর গুরুত্ব দেয়া হলেও উপন্যাসটিতে একইসাথে এর পঙ্কিল দিকটিও প্রকাশ পায়- ডরিয়ানের দ্বৈত চরিত্রের মতো। উপন্যাসের বিতর্কিত বক্তব্য, সেইসাথে তার হোমোএরোটিক উপস্থাপন- সবকিছু মিলিয়ে সমালোচনার শিকার হয় উপন্যাসটি।
১৮৯১ সালে এর সেন্সরকৃত সংস্করণ বের হয়। এর বহু বছর পর বইটির সেন্সরবিহীন সংস্করণ বের হয়।
উপন্যাস আকারে বের হওয়া পরিমার্জিত সংস্করণের ভূমিকায় ওয়াইল্ড তার আত্মপক্ষ সমর্থনে কলম ধরেন।
অসাধারণ সাহিত্যগুণ সম্পন্ন এই প্রারম্ভিকায় ওয়াইল্ড বলেন,
“নৈতিক বা অনৈতিক বই বলতে কিছু নেই। আছে শুধু ভালো এবং খারাপ লেখনীর বই… এবং শিল্প কেবল শিল্পের স্বার্থেই।”
বিতর্কিত এই গথিক সাহিত্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে বহু গান, চলচ্চিত্র এবং নাটক। তবে এর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত মনে করা হয় অ্যালবার্ট লিউইন পরিচালিত একই নামের ১৯৪৫ সালের চলচ্চিত্রটি। সাদাকালো চলচ্চিত্রটিতে একমাত্র রঙিন বস্তু ছিল ডরিয়ানের পোর্ট্রেটটি। তখনকার সময়ে এর অভিনব সিনেমাটোগ্রাফির জন্য এটি ১৯৪৬ সালে অস্কার লাভ করে।
অপূর্ব সুন্দর ডরিয়ান গ্রে একইসাথে তার গল্পের নাটক এবং খলনায়ক। মানুষের ভেতর ভালো-মন্দের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং পতনের এক বড় স্পষ্ট বর্ণনা দেয় অস্কার ওয়াইল্ডের একমাত্র উপন্যাসটি। ভয়ংকর সুন্দর ডরিয়ান এবং তার পাপের স্বাক্ষী সেই ছবির পরিণতি জানতে রোমাঞ্চকর বইটি পড়তে ভুলবেন না।