পূর্ববর্তী পর্ব (ঈনিয়াসের ভ্রমণকাহিনী: ট্রয় থেকে ক্রিটে) পড়ুন এখানে।
ট্রোজানরা যখন জানতে পারলো যে অ্যাপোলোর দৈববাণী তাদেরকে ক্রিটের কথা বোঝায়নি, তখন সানন্দে বেরিয়ে পড়ল নতুন বাসস্থান খুঁজতে। বেচারা তখনো জানত না যে ভেনাস তাদেরকে কোন পথে পরিচালিত করছেন। ট্রোজানরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে দেব-দেবীরা যেমন তাদের ভ্রমণের উপর নজর রাখবেন, তেমনই তা প্রভাবিত করার চেষ্টাও করবেন। সবচেয়ে বড় কথা- তাদের কারণে মারাত্মক হয়রানীর শিকার হতে হবে বেচারাদের।
জুনো তখন পর্যন্ত ট্রোজানদের উপর রেগে ছিলেন, কারণ প্যারিস সবচেয়ে সুন্দর দেবী হিসেবে আপেল তুলে দিয়েছিল ভেনাসের হাতে। ট্রোজান মাঝিরা ক্রিট ত্যাগের পরেই জুনো আর ভেনাসের ফন্দিবাজী শুরু হয়। ট্রোজানরা কার্থেজ পৌঁছানো পর্যন্ত তা চলতে থাকে।
কার্থেজে ট্রোজানদের দেখা হয় সুন্দরী রানী ডিডোর সঙ্গে। তারপর? শুরু করতে হবে একদম প্রথম থেকে।
ঈনিয়াসের সাথে ডিডোর সাক্ষাৎ
ট্রোজানরা ক্রিট ছেড়ে আসার সময়, নানা অসুস্থতা এবং দৈহিক দুর্বলতা সত্ত্বেও মানসিক উদ্যম ছিল তুঙ্গে। শীঘ্রই আসল নিবাস খুঁজে পাবে- এই বিশ্বাস ছিল তাদের মাঝে প্রবল। অ্যাপোলোর ‘হেসপেরিয়া’ তখনও তাদের থেকে অনেক দূরে। সমুদ্রে নামার পর কয়েক মাইল গেছে কী যায়নি, এক বিকট ঝড় ট্রোজানদের নিয়ে ফেলে এক দ্বীপে। সেই দ্বীপে বাস করতো হার্পিরা, কুৎসিত পাখাওয়ালা নারীর চেহারা বিশিষ্ট একদল জীব। ঈনিয়াসরা দ্বীপ ছেড়ে পালানোর আগেই, হার্পিরা আক্রমণ করে ট্রোজানদের খাবার চুরি করে নিল।
এই হার্পিদের মধ্যে একজন হচ্ছে কেলেনো, দেবতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতা ছিল তার। সে ট্রোজানদের জানালো, অ্যাপোলো ভবিষ্যত দেখেছেন, তিনি জানাচ্ছেন- হেসপেরিয়ায় পা রাখায় ক্ষুধার জ্বালায় ট্রোজানদের টেবিল চিবোতে হবে।
কুৎসিত পাখি-মানবীদের দেখে বিতৃষ্ণ এবং একইসাথে অ্যাপোলোর দৈববাণীতে বিভ্রান্ত হয়ে ট্রোজানরা দ্রুত সব গুছিয়ে নিয়ে দ্বীপ থেকে বেরিয়ে পড়ল। এরপর তারা গ্রিসের পশ্চিম উপকূলীয় দ্বীপ, অ্যাক্টিয়ামে বেশ কয়েক মাস আরামেই কাটিয়ে দিল। তাদের পরবর্তী বিশ্রামস্থল ছিল বাটথ্রোটাম, এখানেই ঈনিয়াসের সঙ্গে দেখা হয় হেলেনাসের সঙ্গে।
হেলেনাস আসলে ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম এবং রাণী হেকুবার সন্তান। যুদ্ধের পর এই রাজপুত্র প্রতিষ্ঠা করেন বাটথ্রোটাম শহর। হেলেনাস ট্রোজানদের জানান, গ্রিকরা যে ভূমিকে হেসপেরিয়া নামে ডাকে সেটা আরও বহুদূরে। তিনি তাদেরকে আরও সতর্ক করলেন এই বলে যে, তাদের ইতালি এবং সিসিলির একেবারে মাঝ বরাবর যাওয়া ঠিক হবে না। বরং সিলা ও চ্যারিবডিস, দুই ভয়ানক দানবকে এড়িয়ে সিসিলিকে ঘুরে যাওয়া উচিত।
প্রকাণ্ড এই দানবরা এলাকা দুটোর ঠিক মাঝখানে ওঁৎ পেতে থাকে। সিলার মাথার সংখ্যা ছয়টি, যা দিয়ে সে ইতালির তীরের কাছাকাছি আসা জাহাজগুলো থেকে মানুষ ছিনিয়ে নেয়। আর চ্যারিবডিস ঘূর্ণিপাক তৈরি করে, যা সিলার থেকে পালিয়ে যাওয়া জাহাজকে ভিতরে গিলে নেয়।
সতর্কবার্তা মনে রেখে, ট্রোজান মাঝিরা ইতালিয়ান উপদ্বীপ ধরে সিসিলি ঘুরে এগিয়ে গেল। নিরাপদেই স্থলপথে পা রাখতে সক্ষম হলো তারা। কিন্তু বিপদ এলো অন্যদিক থেকে। অকস্মাৎ কোন দিক থেকে যেন বেরিয়ে এলো বিশাল একচোখা জন্তু। ট্রোজানদেরকে তাড়া করে পাহাড়ের উপর থেকে নিচে নামতে লাগল সে। সাইক্লোপস সম্বন্ধে আগেই নানারকম ভয়ংকর কাহিনী শোনা থাকায়, ট্রোজানরা সবাই জাহাজের দিকে ছুটতে লাগল। সদ্যই কানা হওয়া এক সাইক্লোপস পানির ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে গিয়ে পলায়নরত জাহাজের সাথে ধাক্কা খেল। ভয়ানক এই জন্তুকে দেখে আরো বেড়ে গেল ট্রোজানদের ভয়। তারা দ্রুত নোঙর উঠিয়ে, পাল তুলে শুরু করল সমুদ্রের দিকে দাঁড় বাওয়া।
সাইক্লোপসের কাছ থেকে পালিয়ে ট্রোজানরা বিশ্রামের জন্য সিসিলির উত্তর-পশ্চিমের দ্বীপ ড্রেপানামে থামল। এখানে এসে মারা গেলেন এনকাইসিস, অথচ কোনো দৈববাণীতে এই মর্মান্তিক ঘটনার পূর্বাভাস দেওয়া হয়নি। ঈনিয়াস তার প্রিয় পিতাকে হারিয়ে নির্জীব এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। অনেক বিলাপের পর, সামলে নিলেন নিজেকে। জাহাজকে টারেনিয়ান সাগরের উত্তর দিয়ে এগিয়ে নেবার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আফসোস, ট্রোজানদের নৌ-বাহিনী আচমকা জুনোর প্রতারণার মুখে পতিত হলো।
জুনো বুঝতে পেরেছিলেন- ট্রোজানরা ইতালির পথ খুঁজে পেতে যাচ্ছে। ট্রোজানদের নিরস্ত করতে জুনো ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। বাতাসের দেবতা, এওলাসকে দিয়ে তিনি সাগরে এক বিশাল ঝড় তৈরি করলেন। এওলাস এত বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি করলেন যে সেই ঢেউ জাহাজগুলোকে এপাশ থেকে ওপাশে আছড়ে ফেলতে লাগল। ঢেউয়ের কারণে সবকিছুর জাহাজ থেকে পানিতে পড়া দেখে নারী আর শিশুরা আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল। কাণ্ডারিরা হাল ধরে রাখতে পারছিল না। ঈনিয়াস ট্রয় ছেড়ে আসার পর এই প্রথম ভয় পেলেন।
একপর্যায়ে যখন মনে হলো টিকে থাকা যখন সম্ভব নয়, ট্রোজানরাও প্রস্তুত হয়ে গেল সাগরে মরার জন্য তখন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন সাগরের দেবতা এবং ট্রোজানদের বন্ধু, নেপচুন। অনুমতি ছাড়াই সমুদ্রে ঝড় তোলার জন্য প্রচণ্ড তিরস্কার করলেন এওলাসকে। এরপর নেপচুন আফ্রিকার উত্তর উপকূলে, শান্ত একটা পোতাশ্রয়ে ভিড়িয়ে দিলেন ট্রোজানদের জাহাজ।
তীরে পৌঁছে নোঙর ফেলা হলো। ঈনিয়াস নারী ও শিশুদের নামতে সাহায্য করলেন। তারা ভয়ে কাপছিলেন। তাদেরকে শুকনো বস্তা দিয়ে মুড়িয়ে আশ্বাস দিলেন- যে উপায়েই হোক, পূর্বপুরুষদের আবাসস্থলে ওদেরকে নিয়ে যাবেন তিনি। তাই যেন তারা আশা না হারায়।
ট্রোজানরা যখন এই দুর্ভাগ্যকে সামলে উঠার চেষ্টা করছে, তখন ভেনাস সুযোগ বুঝে দেখা করতে এলেন জুনোর স্বামী এবং দেবতাদের প্রধান, জুপিটারের সঙ্গে। ভেনাস দেবরাজকে মনে করিয়ে দিলেন যে তিনি ঈনিয়াসকে ইতালিতে নিয়ে যাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। জুপিটার আশ্বাস দিলেন যে তিনি প্রতিজ্ঞা ভুলেননি।
ইতালিতে যুদ্ধে লড়বে ঈনিয়াস,
হারবে ওর হাতে হিংস্র এক যুদ্ধ-জাত।
উঠবে গড়ে নতুন এক নগর,
থাকবে ওতে ট্রোজানরা বাকি জীবনভর।
ভেনাস এবং জুপিটার যখন কথোপকথনে ব্যস্ত, ঈনিয়াস তখন অন্তরঙ্গ বন্ধু, অ্যাকেটিসকে সঙ্গে নিয়ে উত্তর আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চল ঘোরে দেখায় ব্যস্ত। পথিমধ্যে তরুণী এক শিকারির ছদ্মবেশে তাদেরকে দেখা দিলেন ঈনিয়াসের অমর মাতা, ভেনাস।
ভয় পেয়ে গেলেন ভেনাস, ভাবলেন যে কার্থেজিনিয়ানরা হয়তো তার ছেলে ও ছেলের বন্ধুর ক্ষতি করবে। তাই বিদায় জানানোর আগে ছেলেদের তিনি অদৃশ্য মেঘে মুড়িয়ে দিলেন। শীঘ্রই ঈনিয়াস আর অ্যাকেটিস কার্থেজ শহরে পৌঁছলেন। প্রথমেই দেখতে পেলেন জলপাইয়ের ঘন বনের মধ্যে থাকা জুনোর মন্দির।
ঠিক সেই সময় মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন রানী ডিডো। তিনজন মানুষকে উদ্দেশ্য করে নানা উপদেশ এবং পরামর্শ দিচ্ছিলেন তিনি। দেখামাত্র ওই তিন ব্যক্তিকে চিনতে পারলেন ঈনিয়াস। খুশিতে ভরে উঠল তার বুক- কেননা ঝড়ের সময় এই তিনজন পানিতে পড়ে গিয়েছিল বলেই ধারণা ছিল তার।
লোকগুলো ট্রয় থেকে পালানোর পর তাদের বিপদসংকুল ভ্রমণের কাহিনী বলছিল, কিন্তু তাদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ডিডো বাধা দিচ্ছিলেন এবং তাদের দলনেতার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছিলেন। ঈনিয়াস এবং অ্যাকেটিস অদৃশ্য মেঘের ভেতরে থেকে আর সময় নষ্ট করলেন না। ঈনিয়াস সামনে এগিয়ে এলেন এবং নিজেকে ট্রোজানদের দলনেতা বলে পরিচয় দিলেন। পরিচয় শুনে উষ্ণ হাসি হাসলেন রাণী, গল্পের বাকি অংশটা শুনতে চাইলেন রাতের ভোজসভায়। সানন্দে রাজি হলেন ঈনিয়াস, সেই সঙ্গে ছেলে ইস্কানিয়াসকে সঙ্গে আনার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। গল্প শোনার আগ্রহে রাণী আর আপত্তি করলেন না।
এখানে রাণী ডিডোর ব্যাপারে কিছু কথা না বললেই নয়। প্রকৃতপক্ষে তার নাম ছিল এলিসা, তিনি ছিলেন টায়ারের রাজকন্যা। আপন চাচা, সিকেয়াসের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। পিগম্যালিয়ন নামে এক ভাই ছিল এলিসার। তার আশা ছিল- পিতার পর টায়ার নগরীর অধিপতি হবে সে নিজেই। কিন্তু এলিসাকে বিয়ে করার পর, সিকেয়াসের দাবি বেশি পোক্ত হয় বুঝতে পেরে, তাকে খুন করে এলিসার ভাই।
সিকেয়াস মরে গিয়েও প্রতিশোধ নিতে ছাড়ল না। আত্মা হয়ে সে ফিরে এসে সব জানিয়ে দিল এলিসাকে। সেই সঙ্গে পিগম্যালিয়ন মূলত যে সম্পদের লোভে এই কাজ করেছিল সেই সম্পদের খোজঁও জানিয়ে দিল। সেই সম্পদ এবং অনুসারীদেরকে সঙ্গে নিয়ে পালাবার অনুরোধ জানাল সে স্ত্রীকে।
তা-ই করলেন ডিডো, সাইপ্রাসে কিছু সময় কাটাবার পর চলে এলেন আফ্রিকার উত্তরে। ওখানকার অধিবাসীদের কাছে বিশ্রামের অনুমতি চাইলেন তারা। জবাবে উপহাসের সুরে তারা জানালো যে দেওয়া হবে জায়গা। তবে কেবল ততটুকুই, যতটুকু একটা ষাঁড়ের চামড়া ঢাকতে পারে। এদিকে বুদ্ধির খেলায় কম যান না ডিডোও। তিনি একটা ষাঁড়ের চামড়া টুকরো টুকরো করে, অর্ধ-চন্দ্রাকৃতিতে বিছালেন। বিশাল এক এলাকা পেয়ে গেলেন ‘বিশ্রাম’ নেবার জন্য। জায়গা হিসেবে সিসিলির ঠিক উলটো দিকের এলাকা বেছে নিয়েছিলেন ডিডো, যাতে করে টায়ার থেকে আসা বণিকরা প্রথমেই তাদের দেখা পায়। ষাঁড়ের চামড়া দিয়ে ঢাকা এই এলাকায় পরবর্তীতে পরিচিত হয় কার্থেজ নামে।
মূল গল্পে ফিরে আসা যাক। প্রাসাদের সান্ধ্য ভোজে ভেনাস পাঠালেন তার অমর সন্তন, প্রেমের দেবতা কিউপিডকে। ইস্কানিয়াসের ছদ্মবেশে এলেন কিউপিড। ভেনাসের বিশ্বাস ছিল, ডিডো যদি প্রেমে পড়েন, তাহলে তিনি ঈনিয়াসের কোনো ক্ষতি করবেন না। তাই মায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কিউপিড ডিডোর কোলে বসলেন এবং মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন। যখন ঈনিয়াস রানী ডিডোর অতিথিদেরকে ট্রোজানদের কার্থেজ ভ্রমণের বিশাল কাহিনী শুনিয়ে প্রমোদ দিচ্ছিলেন, ততক্ষণে ডিডো কিউপিডের মন্ত্রে তরুণ ট্রোজানের প্রতি গভীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন।
সেই রাতে ডিডো তার বোন এনাকে জানালেন- তিনি ঈনিয়াসকে ভালোবেসে ফেলেছেন। এখন পড়েছেন উভয়সঙ্কটে। মৃত স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার যে প্রতিজ্ঞা ডিডো করেছেন, তা আর রাখতে পারছেন না। এনা ডিডোকে মনে করিয়ে দিলেন- তার স্বামী মারা গিয়েছেন বহুদিন হলো। তাছাড়া কার্থেজে ট্রোজানদের উপস্থিতি, শহরের জন্যই বেশ উপকারী হবে। বিশেষত যুদ্ধপ্রিয় বিদেশীদের আক্রমণ প্রতিহত করতে, যোদ্ধা এই জাতি কাজে আসবে অনেক।
কিউপিডের মন্ত্র এবং ঈনিয়াসের প্রতি ভালোবাসা ডিডোকে গ্রাস করে নিল। ঈনিয়াসকে তিনি কিছুতেই মনের আড়াল করতে পারছিলেন না, দ্রুতই তিনি শহরের রক্ষণাবেক্ষণ উপেক্ষা করতে শুরু করলেন। এদিকে ঈনিয়াসও ডিডোর রূপ ও গুণে বন্দি হয়ে গেলেন। প্রতি সন্ধ্যায় তারা দেখা করতেন, একসাথে কার্থেজের সরু অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতেন এবং প্রায়শই পোতাশ্রয়ে চলে যেতেন।
একপর্যায়ে তারা এত বেশি সময় একত্রে কাটাতে শুরু করলেন যে রাজকার্য ফেলে ঈনিয়াসকে নিয়েই পড়ে থাকতে লাগলেন ডিডো। জুনো ভাবলেন, যদি ডিডোর সাথে ঈনিয়াসের বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে রাণী হয়তো তার শহর শাসন ও তৈরির কাজে আরো বেশি মনোনিবেশ করতে পারবেন। সেই সাথে ঈনিয়াসও কার্থেজে থেকে যাবেন। তাই একদিন ডিডো এবং ঈনিয়াস যখন বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, জুনো এক প্রবল বজ্র-ঝড় তৈরি করলেন। আবহাওয়া এতটাই প্রচণ্ড আর ঝড়ো ছিল যে দুজন বাধ্য হয়ে একটা ছোট গুহায় আশ্রয় নিলেন। আবহাওয়া পরিষ্কার হতেই তারা গুহা ছেড়ে চলে এলেন। এদিকে জুনো একটুও সময় নষ্ট না করে রটনা রটাতে শুরু করলেন যে তাদের মধ্যে গোপন অভিসার চলছে।
শহরে এবং দেবতাদের মধ্যে অতি দ্রুত গুজবটি ছড়িয়ে গেল। এই খবর শোনামাত্র জুপিটার শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি তাড়াতাড়ি দেবদূত এবং দেবতা, মার্কারিকে ডেকে পাঠিয়ে, প্রেম-পাগল ট্রোজান নেতার কাছে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ঈনিয়াসকে যেন মনে করিয়ে দেওয়া হয়- ট্রোজানদের জন্য নতুন আবাস খুঁজে দেবার প্রতিজ্ঞা তিনি দেবতা এবং তার অনুসারী, উভয়ের কাছেই করেছেন। সেই সঙ্গে মার্কারি ঈনিয়াসকে এটাও মনে করিয়ে দিলেন- ট্রোজানরা কার্থেজে থেকে গেলে তার ছেলে, ইস্কানিয়াস, কখনোই রাজা হতে পারবেন না।
পরিশেষে ঈনিয়াস তার কর্তব্য বুঝতে পারলেন। তিনিও মার্কারির সাথে একমত যে ট্রোজানদের অবশ্যই কার্থেজ ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু ভালোবাসার পাত্রীকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তার হৃদয় ভেঙে দিলো। তবু ঈনিয়াস তার লোকদের পরের দিন সকালে পাল তোলার প্রস্তুতি নিতে বললেন। ডিডোকে এই খবর দেওয়ার সাহস না থাকায় গোপনে চলতে লাগল প্রস্তুতি। রানী সত্য জানার সাথে সাথে ছুটে এলেন তার ভালোবাসার মুখোমুখি হতে-
তুমি আমায় রাখতে চেয়েছ অন্ধকারে,
এ কেমন অত্যাচার, হে দু’মুখো মানব!
কেন যাচ্ছ চলে চুপি চুপি?
আমাদের ভালোবাসা পারল না কী তোমায় ঠেকাতে?
ধরে রাখতে পারল না সেই প্রতিশ্রুতি যা আমরা করেছিলাম,
এখন কি মরবে না ডিডো, নিদারুণ ব্যথা-যন্ত্রণায়?
ঈনিয়াস সুন্দরী রানীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, কার্থেজ ত্যাগের সিদ্ধান্ত তার নিজের না, বরং তা দেবতাদের। ডিডোকে যে তিনিও বড় ভালবাসেন। কিন্তু দেবতা জুপিটার, ট্রোজান জনগণ, মৃত পিতার স্মৃতি এবং ছেলের ভবিষ্যতের প্রতি তার কর্তব্য যে এই ভালবাসার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ঈনিয়াসের পরিত্যাগের সংকল্প আর এই ব্যাখ্যা ডিডোকে বরং আরো বেশি রাগিয়ে তুলল। তিনি তাকে সতর্ক করলেন যে ঈনিয়াস যদি চলে যান, তবে সারা জীবন তিনি প্রেমিকের কল্পনায় হানা দিয়ে যাবেন।
সেই রাতে ঈনিয়াস ঘুমের মধ্যে শুধু এপাশ-ওপাশ করলেন। ভোরে মার্কারি এসে তাকে জাগালেন এবং এই বলে সতর্ক করলেন যে রানী ট্রোজানদের সব নৌযান পুড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা করেছেন! দেবতা ঈনিয়াসকে পরামর্শ দিলেন- তখনই, অন্ধকার থাকতে থাকতেই কার্থেজ ত্যাগ করতে হবে। ঈনিয়াস সবসময়ই মার্কারির উপদেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাই তিনি তার লোকদেরকে জাগালেন এবং অবিলম্বে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিলেন। মাঝিরা সেই অন্ধকারেই পাল তুলে পোতাশ্রয় থেকে বেরিয়ে পড়ল।
সকালে উঠে ডিডো জানালায় দাঁড়িয়ে ট্রোজান জাহাজগুলিকে চলে যেতে দেখলেন। নৌযানগুলো পোড়ানোর সুযোগ নেই আর, কারণ সেগুলো এরই মধ্যে এত দূরে চলে গেছে যে কার্থেজের জাহাজ পিছু করে ধরতে পারবে না। হতাশ, ব্যথতুর হৃদয়ে ডিডো যারপরনাই রাগান্বিত হয়ে দেবতাদের শাপশাপান্ত করতে লাগলেন।
ঈনিয়াস কার্থেজ ছেড়ে যাওয়ার পর, সুন্দরী ডিডো হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। একে তো ঈনিয়াসকে ভালোবেসে তিনি স্বামীকে দেয়া অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন, তার ওপর প্রেমিকের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় হারিয়ে ফেলেছেন আত্মসম্মানবোধও।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন ডিডো। এনাকে পাশে ডেকে বললেন, একটা অগ্নি-চিতা তৈরি করতে। ঈনিয়াসের ফেলে যাওয়া সবকিছু রাণী পুড়িয়ে ফেলবেন। বাদ যাবে না তাদের ভালোবাসাও।
চুপি চুপি জানালায় দাঁড়িয়ে ডিডো অগ্নি-চিতা তৈরি করা দেখলেন। কাজ শেষ হতেই তিনি প্রাসাদ প্রাঙ্গণে ছুটে এসে চিতার বেদিতে উঠলেন। তার হাতে ছিল ঈনিয়াসের উপহার দেওয়া বিশাল চকচকে তলোয়ার। বোন কিংবা সভাসদ, কাউকে থামানোর সুযোগ না দিয়ে রানী ডিডো নিজের বুকে তলোয়ার বসিয়ে দিলেন। এনা যখন বোনের পাশে পৌঁছলেন, ডিডোর দেহ থেকে জীবন-বায়ু ততক্ষণে নিঃশেষের পথে। রাণী অতিকষ্টে এক হাতে ভর দিয়ে নিজেকে তুললেন। এনা মৃত্যু-পথযাত্রী রানীকে কোলে তুলে নিয়ে অসহায়ভাবে ফোঁপাতে থাকলেন।
এদিকে দেবী জুনোও দেখতে পেয়েছেন মৃতপ্রায় রানীকে। তীব্র অনুশোচনায় ভুগছে তার মন। তার কারণেই এত বেশি খেসারত দিতে হলো ডিডোকে- এতটা তিনিও চাননি।