পুরাণে যতজন মুনি-ঋষিদের কথা উল্লেখ আছে তন্মধ্যে মহর্ষি দুর্বাসা সবচেয়ে কোপনস্বভাব মুনি। অবয়বে শ্রীহীন হলেও তপস্যা আর অভিশাপের বলে দেব-দানব-মানব-অসুরকে এক ঘাটে জল খাওয়াতেন তিনি। সবাই দুর্বাসার ক্রোধকে ভয় করত। তাকে বলা হতো ‘ক্ষ্যাপা দুর্বাসা’। সবাই তাকে সমীহ করে চলত। একবার দুর্বাসা মুনি বনদেবীর স্তুতি করলে বনদেবী খুশি হয়ে তাকে একটি অদ্ভুত মাল্য বা মালা উপহার দেন। মালাটিতে বনের সকল সৌন্দর্যের নির্যাস নিহিত ছিল। মালাটি হাতে নিয়ে ফেরার পথে দুর্বাসা ঋষির দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে দেখা হয়। ঋষিবর ইন্দ্রকে মাল্যটি উপহার দেন। ইন্দ্র অহংকারের বশে মালাটি তার বাহন ঐরাবতের শুঁড়ে ঝুলিয়ে দিলে ঐরাবত মালাটি পা দিয়ে পিষে ফেলে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কাহিনী প্রচলিত। কেউ কেউ বলেন, মালা নয়, দুর্বাসা বিষ্ণুর কাছ থেকে একটি পারিজাত ফুল নিয়ে এসেছিলেন। সে ভব্য ফুলটি ছিল চির সজীব। সেটির আরেকটি গুণ ছিল, যার কাছে সেটি থাকবে, তিনিই হবেন প্রথমপূজ্য। অর্থাৎ, সবধরনের পুজোর আগে তাকে পুজো দিতে হবে। ইন্দ্রকে পুষ্পটি দেওয়ার পরে ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত পা দিয়ে সেটি পিষে ফেললে মহর্ষি ক্রোধে ফেটে পড়েন। তিনি পুরো দেবকুলকে অভিশাপ দেন,
“ইন্দ্র, অহংকারে অন্ধ হয়ে গেছিস তুই আর তোর দেবকুল। আমার প্রসাদকে তোর বাহন পা দিয়ে পিষে ফেলেছে। পুরো দেবকুলকে আমি অভিশাপ দিলাম– তোরা সৌভাগ্যহীন, বলহীন ও শ্রীহীন হ। এতেই তোরা শিক্ষা পাবি।”
ইন্দ্র অনেক অনুনয়-বিনয় করলেও ঋষির মন টলে না। ঋষির কথা শেষ হওয়ার পরপরই দেবতাদের বল হারিয়ে যায়, গায়ের অলংকার খসে পড়ে, দেবলোকের সকল ঐশ্বর্য বাতাসে মিলিয়ে যায়। সকল দেবতা মহাবিপাকে পতিত হন। ত্রিভুবনে এ খবর ছড়াতে বেশি দেরি লাগে না।
অসুরেরা এ সংবাদ শোনামাত্র আনন্দে উদ্বেলিত হয়। অসুররাজ মহাবলি সকল অসুরকে একত্র করে দেবলোক আক্রমণ করে দেবতাদের পরাজিত করেন। অসুরেরা পাতাল, মর্ত্য ও স্বর্গে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। স্বর্গ থেকে নিষ্ক্রান্ত হন দেবতারা।
সকল দেবতা গিয়ে বৈকুণ্ঠধামে নারায়ণের শরণাগত হন। নারায়ণ তাদের সান্ত্বনা দিয়ে কীভাবে হারানো শ্রী ফিরিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন। তিনি বলেন,
“সৌভাগ্যের দেবী লক্ষ্মী দুর্বাসার শাপের প্রভাবে তোমাদের ত্যাগ করে সমুদ্রের তলায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তোমাদের হারানো শ্রী ফিরিয়ে আনার একটাই উপায়– সমুদ্রকে মন্থন করে লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনা।”
নারায়ণ বা বিষ্ণু দেবতাদের সমুদ্রমন্থন করার উপদেশ দেন। সমুদ্র মানে সাগর, আর মন্থন মানে মথিত করা বা নাড়ানো। দুধ থেকে মাখন বা ঘি বের করতে দুধকে যেভাবে নাড়ানি দড়ি দিয়ে বেঁধে নাড়ানো হয়, তাকেই বলে মথিত করা বা মন্থন করা। বিশাল ক্ষীরোদসমুদ্রকে মন্থন করা বলহীন দেবতাদের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তারা অসুরদের সাহায্য প্রার্থনা করে। সন্ধি হয় যে, অমৃতের অর্ধেক পাবে দেবতারা, আর বাকি অর্ধেক অসুরদের দেওয়া হবে। অসুরেরা রাজি হলে নির্দিষ্ট দিনে সকল দেবতা ও অসুর ক্ষীরসাগরের পাড়ে গিয়ে হাজির হয়। মন্থনে সমুদ্রের ক্ষতি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তাই সমুদ্রকেও অমৃতের কিছুটা ভাগ দেওয়ার কথা হয়।
মন্থনদণ্ড বা মথিত করার নাড়ানি হিসেবে মন্দার পর্বতকে হাজির করা হয়। বারো যোজন উচ্চতার এত বড় পর্বতকে সাগরের মাঝখানে নিয়ে বসানো কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন মহাদেব শিবের গলায় থাকা বাসুকি নাগ নামক সাপটি বিশাল আকৃতি ধারণ করে মন্দরকে পেঁচিয়ে তুলে নিয়ে মাঝসাগরে রেখে আসার দায়িত্ব নেয়। বাসুকি মহামুনি কাশ্যপের ঔরসে কদ্রুর গর্ভে জন্মানো এক নাগ। সে ছিল নাগদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তার আরেকনাম অনন্ত নাগ। সর্পদেবী মনসা ছিল এরই বোন। বাসুকি নাগ মন্দারকে নিয়ে মাঝসমুদ্রে গেলে দেবতা ও অসুর সবাই মিলে তাকে মন্থনরজ্জু বা মন্থনের রশি হতে অনুরোধ করলে বাসুকি রাজি হয়।
এবার মন্থন শুরু হওয়ার পালা। কিন্তু রজ্জুর কোন মুখ কে ধরবে, তা নিয়ে শুরু হয় আরেক দ্বন্দ্ব। প্রথমে দেবতারা সাপের মুখের দিকের অংশ ধরার দাবি করলে অসুরেরা বাকবিতণ্ডা শুরু করে। যেকোনো প্রাণীর নিম্নাংশকে শাস্ত্রে নিকৃষ্ট অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই দু’পক্ষই বাসুকির মুখের দিকটা ধরার জোরালো দাবি করে। যুদ্ধ শুরুর উপক্রম হলে ভগবান বিষ্ণু এসে মধ্যস্থ হন। পুরো মন্থনে তিনি দেবতাদের পক্ষাবলম্বন করেন। তিনি দেবতাদের পরামর্শ দেন, বাসুকির লেজের দিকটা ধরতে কারণ বাসুকিকে ধরে টানাটানি করলে একসময় সে তার মুখ দিয়ে বিষ উগরে দেওয়া শুরু করবে। আর মাথার দিকে যারা থাকবে, তারা বুঝবে বিষের জ্বালা। বিষ্ণুর চতুরতায় দেবতারা বাসুকির বিষের প্রকোপ থেকে রক্ষা পান।
অসুরেরা এই ভেবে খুশি হয় যে, তাদের নিকৃষ্ট অংশ ধরতে হচ্ছে না। প্রবল উল্লাসে মন্থন শুরু হয়। একবার অসুরেরা বাসুকিকে ধরে টানে, তারপর দেবতারা। সমুদ্রে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। সুউচ্চ মন্দার পর্বতও পানির গর্ভে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাওয়া শুরু করে। মন্দারকে পানির তলা থেকে ধরে রাখতে ভগবান বিষ্ণু একটি কচ্ছপের রূপে কূর্ম অবতার ধারণ করে পর্বতকে তার খোলসের উপর ধারণ করেন। মন্দার যাতে কূর্মের খোলসে সুচারুভাবে বসতে পারে, সেজন্য ইন্দ্র তার বজ্র দিয়ে মন্দারের তলা সমানভাবে কেটে দেন।
আবার মন্থনকার্য শুরু হয়। অনেককাল মন্থনের পরে সমুদ্রের তলা থেকে বিভিন্ন রত্ন, মাণিক্য, ভেষজ, দেব-দেবীর উত্থান হয়। মন্থনে প্রাপ্ত দ্রব্যাদি দেবতা ও অসুরেরা নিজেদের ভেতর ভাগ করে নেন। ভগবান বিষ্ণু ও শিবকেও রত্ন-মণি-মাণিক্য উপহার দেওয়া হয়। পুরাণমতে, সমুদ্রমন্থনের ফলে মোট চৌদ্দ প্রকার রত্নের উদ্ভব হয়। তিনজন দেবী, একজন দেব ও তিনটি দিব্য পশুরও উত্থান হয়।
দেবীদের মধ্যে রয়েছেন লক্ষ্মীদেবী, সুরাদেবী ও বারুণী দেবী। লক্ষ্মী সৌভাগ্যের দেবী। তিনি সমুদ্রের ভেতর থেকে ওঠার সাথে সাথে দেবতারা তাদের হারানো বল-বীর্য ফিরে পান। লক্ষ্মী উঠে সবাইকে আশীর্বাদ করেন এবং পতি বা স্বামী হিসেবে ভগবান বিষ্ণুকে বরণ করে নেন। লক্ষ্মীর সাথে তার বড় বোন অলক্ষ্মীও উঠে এসেছিলেন। অলক্ষ্মী দুর্ভাগ্যের দেবী। তাকে কেউ গ্রহণ করে না। তখন তিনি বলে, “যেখান থেকে লক্ষ্মী বিদায় নেবে, আমি সেখানে গিয়েই বাসা বাঁধব”। আরেকজন দেবী হলেন সুরাদেবী। তিনি মদ বা সুরার অধিকর্ত্রী দেবী। তাকে অসুরেরা গ্রহণ করে।
তৃতীয়জন হলেন দেবী বারুণী। সমুদ্রের দেবী। তিনি বরুণদেবকে পতি হিসেবে গ্রহণ করেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে অসুরদের ভাগে প্রদান করা হয়। দেবীগণের ন্যায় আরেকপ্রকার নারীর উদ্ভব হয়েছিল অমৃতমন্থনে। অপ্সরা। অপরূপ ও মনোহর রূপের অধিকারিণী এবং নৃত্যকলায় পারদর্শী অপ্সরাদের দেবতারা গ্রহণ করেন। ইন্দ্রসভায় স্থান দেওয়া হয় তাদের। অপ্সরাদের মধ্য প্রসিদ্ধ তিনজন– রম্ভা, মেনকা, উর্বশী।
চন্দ্রদেবেরও উদ্ভব হয় অমৃতমন্থনে। তাকে ভগবান শিব নিজের জটায় স্থাপন করেন। মন্থনে যে তিনটি দিব্য পশুর উদ্ভব হয়েছিল, সেগুলো হলো– কামধেনু, ঐরাবত ও উচ্চৈঃশ্রবা। কামধেনুর আরেকনাম সুরভি গাই। এটির এমন গুণ যে এর বাটে কোনোদিনও দুধের ঘাটতি হবে না। মহাপবিত্র এ গাইটি ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের দান করেন। কারণ যাগযজ্ঞের দ্বারা তারা সর্বদা ঈশ্বরের আরাধনায় ব্যস্ত থাকেন। যজ্ঞের আহুতি, প্রসাদ ইত্যাদিতে দুধ-ঘৃত-মাখন সর্বদা প্রয়োজন হয়।
ঐরাবতকে ইন্দ্র নিজের বাহন হিসেবে নির্বাচিত করলে উচ্চৈঃশ্রবা নামীয় দিব্য ঘোটকটিকে অসুররাজ মহাবলি নিজের বাহন হিসেবে নির্বাচিত করেন। দুই প্রকার ভেষজ বৃক্ষের উদ্ভব হয় । কল্পতরু ও পারিজাত। পারিজাত গাছের ফুল ও পাতা চিরসজীব। দিব্য এ বৃক্ষটিকে দেবতারা স্বর্গোদ্যানে নিয়ে বপন করেন। আরেকটি গাছ- কল্পতরুও দেবতাদের ভাগ্যে পড়ে। কেউ কেউ পারিজাত ও কল্পতরুকে একই বৃক্ষ মনে করেন। কল্পতরুর গুণটি হলো, এর সামনে দাড়িয়ে যেকোন মনোবাঞ্ছা ব্যক্ত করলে তা পূরণ হয়।
জগতের সবচেয়ে মূল্যবান মনি কৌস্তুভ মনির আবির্ভাব হলে দেবতারা এটি অসুরদের প্রদান করেন। রাজা মহাবলি এ মনিটি ভগবান বিষ্ণুকে উপহার দেন। ভগবান বিষ্ণু মন্থনে প্রাপ্ত শার্ঙ্গ নামক একটি দিব্য ধনুকেরও অধিকারী হয়েছিলেন। মন্থনে উত্থিত অলংকারাদির মধ্যে রয়েছে শঙ্খ, ছত্র ও কর্ণকুণ্ডল। পাঞ্চজন্য নামীয় শঙ্খটি ভগবান বিষ্ণু তার এক হাতে ধারণ করেন। ছত্র পান বরুণদেব। কর্ণকুণ্ডল দেবরাজ ইন্দ্র তার মা অদিতির জন্য সংরক্ষণ করেন।
অমৃতের আশায় করা সে মন্থনে অমৃতের আগে উঠেছিল বিষ। ভয়ংকর সে বিষের নাম কালকূট বা হলাহল। সমুদ্রগর্ভ থেকে বিষ ওঠা শুরু হলে সবাই ভয় পেয়ে পালানো শুরু করে। কারো মতে, সমুদ্রের গর্ভ থেকে নয়, বাসুকির মুখ থেকেই হলাহল নির্গত হয়েছিল। দেবাসুরেরা সবাই মিলে দেবাধিদেব মহাদেবের স্তব করা শুরু করে। মহাদেব এসে সে বিষ তুলে পান করেন। বিষ পেটে গেলে যন্ত্রণায় ফেটে পড়বেন, তাই দেবী পার্বতী এসে দিব্যবলে বিষটি মহাদেবের গলাতেই আটকে দেন। বিষের প্রভাবে মহাদেবের গলা নীল হয়ে যায়। তখন থেকে তার নাম হয় ‘নীলকণ্ঠ’।
সবার শেষে ধন্বন্তরী অমৃতের কলস হাতে উঠে আসেন। ধন্বন্তরী দেবতাদের চিকিৎসক। অমৃতের কলস দেখার সাথে সাথে অসুরেরা চিৎকার করতে থাকে, “এ অমৃত আমাদের, এ অমৃত আমাদের” বলে। আবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার উপক্রম হয়। হঠাৎ বিষ্ণুর বাহন গরুড়পাখি এসে অমৃতের কলস নিয়ে উড়ে যায়। ভগবান বিষ্ণু ‘মোহিনী’ রূপ ধারণ করে অসুরদের মন ভুলিয়ে অমৃত থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নেন। মোহিনীরূপী বিষ্ণুর হাতে অমৃতের কলস দিয়ে গরুড় বিদায় হয়।
পূর্বের কথা মতো, অমৃতবণ্টন শুরু হয় দেবতাদের অমৃত পান করিয়ে। মোহিনী কলস থেকে পাত্রে ঢেলে ঢেলে দেবতাদের অমৃত খাওয়ানো শুরু করলে রাহু নামক এক অসুর দেবতার রূপ ধরে দেবতাদের দলে গিয়ে ভেড়ে। সূর্য আর চন্দ্র তাকে চিনতে পেরে সবাইকে চিৎকার করে তার আসল রূপের কথা জানিয়ে দেন। ইতোমধ্যে সে অমৃত মুখে দিলে গলাধঃকরণের আগেই বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে তার ধড় ও মুণ্ড আলাদা করে ফেলেন।
রাহুর মাথার নাম রাহু থাকলেও জীবন্ত ধড়ের নাম হয় কেতু। আকাশে গ্রহরূপে স্থাপিত হয় তারা। সূর্য ও চন্দ্রের উপর ক্রোধ থাকার দরুণ মাঝে মাঝে রাহু ছুটে গিয়ে তাদের গিলে ফেলে। পরক্ষণেই তারা রাহুর কাটা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে। পুরাণমতে, এটাই সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কারণ। অনেক পরিশ্রম করে অমৃতমন্থন করলেও অমৃত পেয়েছিলেন শুধু দেবতারাই। অসুরদের বঞ্চিত করা হয়েছিল।
পুরাণে এর কারণ হিসেবে অসুরদের ধৈর্যহীনতা ও অহংকারকে দায়ী করা হয়েছে। অমৃত পান করে দেবতারা অমর হলেও পুরাণে এমন কয়েকজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা অমৃত পান না করেও অমর। এদের বলা হয় ‘চিরঞ্জীব’। পরের পর্বটি সাজানো হয়েছে চিরঞ্জীবদের গল্প দিয়ে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিভিন্ন পুরাণভেদে এসব কাহিনীতে মতান্তর রয়েছে, তাই অমিল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এই লেখাতে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।