ভারতীয় উপমহাদেশের রয়েছে সমৃদ্ধ মিথোলজি। সময়ের পরিক্রমায় এখানে উত্থান-পতন ঘটেছে নানা সভ্যতার। তারা সবাই নিজস্ব গল্প-কাহিনী দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে একে। বিভিন্ন সভ্যতার মিথোলজির মধ্যে মিথস্ক্রিয়াও খুব সাধারণ ব্যাপার।
ভারতের দক্ষিণাঞ্চল, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ডেকান (সংস্কৃত daksina/’south’) মালভূমিও এমন নানা গল্পের উৎস। নর্মদা নদীর দক্ষিণে এর অবস্থান। পূর্ব-পশ্চিমে পাহাড়শ্রেণী ঘেরা ডেকান মালভূমি নিয়ে মৌর্য, গুপ্তসহ নানা শাসনামলে বহু লড়াই হয়েছে। স্থানীয় শাসকেরা এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজস্ব রাজ্য। এই সভ্যতার অন্যতম এক মিথোলজি গড়ে উঠেছে রাম-লক্ষণ নামে দুই বন্ধুকে কেন্দ্র করে। তবে তারা রামায়ণের রাম-লক্ষণ নন, বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই চরিত্র।
রাজা এবং উজির
বহু বহু বছর আগে ডেকান শাসন করতেন চন্দ্ররাজ। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং উজির বুট্টি। দুজনে মিলে কায়েম করেছিলেন সুশাসন। প্রজারা তাদের অধীনে সুখে-শান্তিতেই দিন গুজরান করত।
তবে রাজা আর উজির দুজনেই ছিলেন নিঃসন্তান। ফলে তাদের মনে ছিল হাহাকার। কাকতালীয়ভাবে একসময় তাদের দুজনের স্ত্রী-ই গর্ভবতী হয়ে পড়লেন, কাছাকাছি সময়ে জন্ম দিলেন পুত্রসন্তানের। রাজপুত্রের নাম রাখা হলো রাম, এর উজিরপুত্রের লক্ষণ। সন্তান জন্মের খুশিতে রাজ্যে উৎসবের হুকুম দিলেন চন্দ্ররাজ।
মানিকজোড়
রাম আর লক্ষণ বেড়ে উঠছিলেন একসাথে। রাজপুত্র রগচটা হলেও লক্ষণ ধীরস্থির। তারা ছিলেন দুই পিঠাপিঠি ভাইয়ের মতো, খেলতেন একত্রে, খাবার খেতেন একই পাতে। একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারতেন না একমুহূর্তও।
রাজপুত্র বড় হতে থাকলে রানী একটু শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তার মনে হলো, যত যা-ই হোক, মর্যাদায় উজিরপুত্র রামের থেকে নিচুতে, কাজেই ছেলের এমন কারো সাথে চলাফেরা করা উচিত যে কিনা মর্যাদায় তাদের সমতুল্য। রামের বয়স যখন পনের, তখন তিনি রাজার কাছে আবেদন করলেন উজিরপুত্রের সাথে ছেলের সখ্য রাজা যাতে নিষেধ করে দেন। কিন্তু চন্দ্ররাজ রাজি হলেন না।
রানী নিরাশ না হয়ে চারদিকে লোক পাঠালেন। তারা জাদুকর, ডাইনী, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা এমন অনেক লোকের সাথে দেখা করল। সকলেই জানিয়ে দিল- দুই বন্ধুর বন্ধন ছিন্ন করা সম্ভব নয়। কেবল এক বৃদ্ধা মহিলা রানীকে জানালেন, তিনি এ কাজ করতে সক্ষম, তবে বহু অর্থ দিতে হবে তাকে।
রানী আগাম হিসেবে বৃদ্ধাকে থলেভর্তি স্বর্ণমুদ্রা দিলেন। সেই অর্থ দিয়ে মহিলা মূল্যবান পরিচ্ছদ কিনে সোজা চলে গেলেন রাজকীয় বাগানবাড়িতে। সেখানে রাম আর লক্ষণ তখন খেলায় ব্যস্ত। মহিলা এরপর বাগানের এককোণায় কুয়োর সামনে দাঁড়িয়ে নিচে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলেন।
রাজপুত্রের মনে স্বভাবতই কৌতূহল জেগে উঠল। তিনি লক্ষণকে পাঠালেন বৃত্তান্ত জেনে আসতে। লক্ষণ মহিলাকে প্রশ্ন করলে তিনি কিছু না বলেই চলে গেলেন সেখান থেকে। এরপর রানীর কাছে গিয়ে বললেন ‘কেল্লা ফতে’। রানীও তাকে প্রতিশ্রুত অর্থ দিয়ে বিদায় করলেন।
ওদিকে বাগানবাড়িতে রাজপুত্র আর উজিরপুত্রের মধ্যে বচসা লেগে গেছে। লক্ষণ যতই বলেন যে মহিলা কিছুই বলেননি, ততই রামের সন্দেহ বাড়তে থাকে। তিনি মনে করলেন, লক্ষণ তাকে ঘটনা খোলাসা করে বলছেন না। ফলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে রাজপ্রাসাদে চলে এলেন রাজপুত্র, ঘোষণা করলেন, লক্ষণকে হত্যা করে তার চোখ থালায় সাজিয়ে পেশ না করা অবধি অন্নগ্রহণ করবেন না।
চন্দ্ররাজ পড়লেন মহাবিপদে। ছেলেকে তিনি ভালো করেই চেনেন। হ্যাঁ, একসময় তার রাগ পড়বে, অনুশোচনাও হবে। কিন্তু তার আগপর্যন্ত গোঁয়ার রাজপুত্র আসলেই খাদ্যপানি মুখে তুলবেন না। যদি তার জীবনসংশয় হয়?
রাজা ভেবেচিন্তে এক বুদ্ধি বের করলেন। উজিরকে পরামর্শ দিলেন ছেলেকে লুকিয়ে ফেলতে। এরপর তন্নতন্ন করে খুঁজে এমন এক হরিণ বের করলেন যার চোখের সাথে মিল রয়েছে লক্ষণের। এরপর সেই হরিণ শিকার করে তার চোখ হাজির করা হলো রামের সামনে। খুশিমনে রাজপুত্র এবার ভোজ করতে বসলেন।
রাজপুত্রের স্বপ্ন
কিছুদিন যেতে না যেতেই রাম তার প্রিয় সাথীর অভাব অনুভব করতে লাগলেন। লক্ষণ তাকে মজার মজার গল্প শোনাতেন, জবাব দিতেন তার নানা প্রশ্নের। তাকে ছাড়া তো আর ভালো লাগে না।
এর মধ্যে দেখা দিল নতুন সমস্যা। রাজপুত্র পর পর চার রাত স্বপ্নে দেখলেন- গাছপালায় ঘেরা এক ফুলের বাগানে প্রবেশ করেছেন তিনি, সেখানে মালির স্ত্রী তাকে দিয়েছেন ফুলের মালা। এরপর বাগানের মাঝে এক নদীর ধারে গিয়ে রাম দেখতে পেলেন ছোট্ট এক দ্বীপ। সেখানে এক কাচের প্রাসাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে পরমাসুন্দরী এক রাজকন্যা।
স্বপ্নেই রাম প্রেমে পড়ে গেলেন রাজকন্যার। কিন্তু রাজ্যের কেউই এর স্বপ্নের কোনো অর্থ তাকে করে দিতে পারলো না। রাম দুঃখে মুষড়ে পড়লেন। তার মনে হতে লাগলো- লক্ষণ থাকলে তাকে নিয়ে দুই বন্ধু আলাপ করে নিশ্চয় একটা সমাধান বের করতে পারতেন। অনুতাপে পুড়তে পুড়তে তিনি বাবাকে বললেন লক্ষণের সমাধি দেখিয়ে দিতে, মৃত বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাইতে চাইতেই তিনি প্রাণত্যাগ করতে চান।
চন্দ্ররাজ বুঝলেন ছেলের সুমতি ফিরেছে। তিনি প্রথমে তাকে তার হঠকারী আচরণের জন্য তিরস্কার করলেন, এরপর জীবিত লক্ষণকে নিয়ে এলেন রামের সামনে। দুই বন্ধু দ্রতই তাদের ঝগড়া মিটিয়ে ফেললো।
রাম বন্ধুকে নিজের স্বপ্ন খুলে বললেন। লক্ষণ তাকে বললেন বহু দূর এক রাজ্যের কথা। সেই রাজ্যের রাজকন্যা বার্গুটি এমনই এক দ্বীপে কাচের প্রাসাদে বাস করেন। তার বাগানের চারদিক সুপারি, পেয়ারা আর নারকেল গাছের প্রাচীর। চব্বিশ বছর বয়স্কা রাজকন্যার বিয়ের জন্য রাজা অনেক আগে থেকেই চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রাজকন্যার সাফ কথা, যে ছেলে একলাফে নদী পার হয়ে দ্বীপে পা রাখতে পারবে তাকেই কেবল বিয়ে করবেন তিনি। এ কাজ করতে গিয়ে মারা গেছে কত শত যুবক, কেউ নদীতে ডুবে, কেউ বা ঘাড় ভেঙে।
রাম-লক্ষণের অভিযান
রাজপুত্র বাবার কাছে এসে জানালেন- তিনি দেশভ্রমণে যাবেন। রাজা সাথে অনেক পাইক পেয়াদা দিতে চাইলেও রাম কেবল একটি জিনিসই চাইলেন, চন্দ্ররাজের বহু যুদ্ধের পোড় খাওয়া বৃদ্ধ ঘোড়া। এই নিয়েই লক্ষণ আর তিনি বেরিয়ে পড়লেন রাজকন্যাকে খুঁজতে।
চলতে চলতে একদিন দুই বন্ধু ঠিকই চলে এলেন সেই বাগানে। সেখানে প্রবেশ করতেই মালির স্ত্রী তাদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। এখানে নদীর মাঝে কাচের প্রাসাদও দেখতে পেলেন তারা।
তবে দুই বন্ধুর জানা ছিল না যে নদীর তীরে ঘোরাফেরা নিষিদ্ধ করেছেন রাজা। এজন্য যে তার মেয়ের পাণিপ্রার্থনা করতে এসে বহু যুবক মারা পড়েছে সেখানে। তিনি তাই আইন করে দিয়েছিলেন তার অনুমতি ব্যতিরেকে কেউ রাজকন্যার জন্য প্রস্তাব করা তো দূরে থাক, নদীর ধারে পর্যন্ত যেতে পারবে না। কেউ এ কাজ করার চেষ্টা করলে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। কাজেই রক্ষীরা যখন দেখলো দুই অচেনা তরুণ নদীর পারে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের গ্রেফতার করল তারা।
লক্ষণ পালানোর জন্য এক ফন্দি করলেন। তিনি কিছু পয়সা দিয়ে এক রক্ষীকে পাঠালেন বাগানে, তাকে বললেন মালির পালা গরুটা ছুটে গেছে, রক্ষী যেন বাগানে গিয়ে উচ্চস্বরে গরুর নাম ডেকে একটু খোঁজাখুঁজি করেন।
রক্ষী অর্থের লোভে ঠিক তা-ই করলো। তার হাঁকডাক শুনে মালির স্ত্রী চিন্তিত হয়ে পড়লেন, বাগানের মাঝে রক্ষী কেন? তাহলে কি কিছুক্ষণ আগে যে দুই যুবককে দেখলেন তিনি, তাদের কিছু হয়েছে? দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে সব বুঝে নিলেন তিনি।
মালির স্ত্রী দুজন ভিখারীকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত কারাগারের দিকে রওনা দিলেন। কারাগারের মধ্যে ছিল এক মন্দির, যেখানে লোকজন পুজো দিতে আসতো। ফলে নিরাপদেই কারাভ্যন্তরে প্রবেশ করেন তারা। এরপর কৌশলে রাম-লক্ষণকে মুক্ত করে তাদের পোশাক পরিয়ে সেখানে দুই ভিখারীকে রেখে এলেন তিনি।
মালির স্ত্রী দুই যুবককে রাজ্যের আইন বুঝিয়ে দিলেন, পরামর্শ দেন যাতে পরদিনই তারা রাজার কাছে গিয়ে অনুমতি প্রার্থনা করেন। ওদিকে রক্ষীরা যখন বন্দীদের রাজার সামনে হাজির করল, তখন তিনি তো ভিখারীদের দেখে হেসেই খুন। কোথায় সেই রাজপুত্র? রক্ষীরা বোকা বনে গেল, রাজা তাদের ভর্ৎসনা করে ভিখারীদের মুক্ত করে দেন।
রামের সফলতা
সকালে যখন রাজার সাথে দেখা করলেন রাম-লক্ষণ, তখন রাজা তাদের আবেদন শুনে আঁতকে উঠলেন। “পৃথিবীতে আরো অনেক রাজকন্যা আছে বাপু, আমার মেয়েই কেন? জেনেশুনে প্রাণটা খোয়াতে চাও নাকি?“
তবে রাম অটল। ফলে রাজা বাধ্য হলেন অনুমতি দিতে। ঢেঁড়া পিটিয়ে রাজ্যে জানিয়ে দেয়া হলো আরেক দুর্ভাগা আত্মহত্যা করতে চলেছে! রাজা সবাইকে বলে দিলেন রামের জন্য প্রার্থনা করতে।
রাজপুত্র মূল্যবান পরিচ্ছদ পরিধান করে বাবার সেই বুড়ো ঘোড়ায় উঠে বসলেন। তিনি নির্দেশ দিতেই ঘোড়া ছুটে গেল নদীর দিকে, এক লাফে পার হয়ে গেলো বিশাল দূরত্ব। রাজপুত্র নিরাপদেই অবতরণ করলেন দ্বীপে। তিন তিনবার এ কাজ করে দেখালেন তিনি। রাজা তো খুশিতে আত্মহারা। ছুটে এসে রামকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। মহা ধুমধামে হয়ে গেল বিয়ে।
দেশের পথে
রাম ও তার নবপরিণীতা স্ত্রী অনেকদিন কাটিয়ে দিলেন সেই রাজ্যেই। লক্ষণ তাদের ছায়ার মতো আগলে রেখেছিলেন। একদিন রাম শ্বশুরের থেকে নিজ রাজ্যে ফিরে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। শ্বশুরের কোনো ছেলে ছিল না, ফলে রামই ছিলেন তার উত্তরাধিকারী। ফলে একটু দুঃখই পেলেন তিনি। তবে রাম প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি মাঝে মাঝেই আসবেন এখানে।
বিশাল কাফেলা আর মূল্যবান মালামাল নিয়ে যাত্রা শুরু করলো রাজদম্পতি, বরাবরের মতোই তাদের প্রধান সঙ্গী লক্ষণ। রওনা হবার আগে মালির স্ত্রীকে প্রচুর পুরষ্কার দিয়ে এলেন রাম।
জ্ঞানী পেঁচা
প্রথমদিন সন্ধ্যায় এক বনের ধারে যাত্রাবিরতি করলেন রাম। তিনি ও তার স্ত্রী যখন তাঁবুতে ঘুমাচ্ছেন, তখন বাইরে এক গাছের নিচে পাহারা দিচ্ছেন লক্ষণ। এমন সময় দুটো পেঁচা গাছের ডালে এসে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলো।
লক্ষণ তাদের কথা বুঝতে পারলেন। এরা স্বামী-স্ত্রী। স্ত্রী স্বামীকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলো একটা গল্প বলার জন্য। গল্প শুনবে? স্বামী পেঁচা বললো, তবে শোনো, এই যে একদল লোক এখানে শিবির করেছে তাদের গল্প!
লক্ষণ কৌতূহলী হয়ে নিজের লেখার ফলকগুলো নিয়ে বসলেন। ওদিকে স্বামী পেঁচা গড়গড় করে তাদের বন্ধুত্ব, ঝগড়া, রাজকন্যাকে জয় করা সবকিছু বলে যেতে লাগলো।
স্ত্রী পেঁচা প্রশ্ন করলো, সবই বুঝলাম। কিন্তু উজিরপুত্র, তার কী হবে? ভাগ্য তার জন্য কী লিখে রেখেছে?
লক্ষণ মনোযোগ দিয়ে স্বামী পেঁচার উত্তর শুনলেন। তার সারমর্ম হলো- চন্দ্ররাজের রাজ্যের কাছাকাছি পৌঁছলে বিশাল এক বটগাছের নিচ দিয়ে যেতে হবে তাদের। সেখানে কয়েকটি ডাল ভেঙে পড়ি পড়ি করতে থাকলে লক্ষণ দ্রুত বন্ধু ও বন্ধুপত্নিকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে বাঁচাবেন। এরপর ভেঙে পড়বে সেসব ডাল। এরপর যখন রাজপ্রাসাদের বিশাল দরজার নিচ দিয়ে যেতে থাকবেন তারা, তখন উজিরপুত্র দেখতে পাবেন দরজার উপরের অংশ খুলে বন্ধুর মাথায় পড়তে যাচ্ছে। এবারেও তাদের বাঁচাবেন তিনি।
সবশেষে যে ঘটনা বর্ণনা করলো স্বামী পেঁচা, তাতে শিউরে উঠলেন লক্ষণ। রাতের বেলা যখন নিজ ঘরে ঘুমোবেন রাম ও তার স্ত্রী, তখন সেখানে প্রবেশ করবে এক বিষধর সাপ। লক্ষণ সাপটি হত্যা করবেন বটে, তবে সাপের একফোঁটা বিষ গড়িয়ে পড়বে বন্ধুপত্নির কপালে। লক্ষণ যখন তা মুছে দিতে যাবেন, তখনই জেগে উঠবেন রাম। বন্ধুকে ভুল বুঝে অনেক কিছু বলবেন তিনি, সাথে সাথেই উজিরপুত্র পরিণত হবেন পাথরে।
স্ত্রী পেঁচা জানতে চাইলো, লক্ষণের কাহিনী কি এরপর শেষ? স্বামী জানালেন, তা নয়। আট বছর তাকে মূর্তি হয়ে থাকতে হবে। এরপর রামের এক সন্তান হবে, সেই সন্তানের হাতের স্পর্শে পুনরায় মানুষে পরিণত হবেন লক্ষণ।
সত্যি হলো ভবিষ্যদ্বাণী
লক্ষণ প্রথমে পেঁচার কথা বিশ্বাস করতে চাইলেন না। কিন্তু এক বটগাছের নিচ দিয়ে যেতে যেতে তিনি লক্ষ্য করলেন বিশাল এক ডাল ভেঙে পড়তে যাচ্ছে। তড়িৎ তিনি রাম ও তার স্ত্রীকে সরিয়ে নিলেন, এরপরই সশব্দে ভেঙে পড়লো সেই ডাল।
চন্দ্ররাজের প্রাসাদে ঢোকার সময়েও পেঁচার বলা ঘটনা হুবহু ঘটে গেলো। লক্ষণ বুঝতে পারলেন নিয়তির লিখন খণ্ডানোর উপায় নেই। রাত্রিবেলা তাই ঘুমন্ত বন্ধু ও তার স্ত্রীকে পাহারা দিতে লাগলেন তিনি।
হঠাৎই লক্ষণ দেখতে পেলেন দেয়াল বেয়ে নেমে এসেছে এক সাপ, উদ্যত হয়েছে ছোবল দিতে। এক কোপে সাপের মাথা আলাদা করে দিলেন তিনি, তবে একফোঁটা বিষ গড়িয়ে পড়লো রাজকন্যার কপালে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেঁচার গল্প লিখে রাখা ফলকগুলো বের করলেন লক্ষণ। রামের পাশে সেসব রেখে বিষের ফোঁটা মুছে দিলেন। ঠিক তখনই জেগে উঠলেন রাম, বন্ধুকে নিয়ে ভুল ধারণা জন্মালো তার মনে। নানারকম কথা শুনিয়ে দিলেন তিনি লক্ষণকে, ফলে নিমিষেই লক্ষণ পরিণত হলেন পাথরের মূর্তিতে।
রাম তো হতভম্ব। এমন সময় তার চোখে পড়লো সেই ফলক, সেখানে বিবৃত কাহিনী পড়ে তিনি বুঝতে পারলেন, আবারও বিশাল এক ভুল করে বসেছেন তিনি। তার চিৎকারে ছুটে এলেন বাবা-মা। সব শুনে ছেলেকে তার হঠকারিতার জন্য বকাবকি করতে থাকলেন রাজা।
অতঃপর তারা সুখে-শান্তিতে…
লক্ষণ পাথরে পরিণত হবার পর কেটে গেছে আট বছর। প্রতিদিন তার সামনে বসে কান্নাকাটি করেন রাম ও তার স্ত্রী, কিন্তু পাথরে তো আর জীবন ফেরে না। এমন সময় তাদের কোল আলো করে জন্ম নিল এক পুত্র।
পেঁচার বলা কথা মাথায় রেখে পুত্রকে প্রতিদিন বন্ধুর মূর্তির সামনে বসিয়ে দিতেন রাম, মনে আশা- তার স্পর্শে হয়তো ফিরে আসবে লক্ষণ। কিন্তু এক বছর কেটে গেলেও সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। একদিন ছোট্ট রাজপুত্র টলমল পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিলো। এমন সময় পড়ে যেতে যেতে সে আঁকড়ে ধরলো মূর্তির পা। সাথে সাথেই প্রাণ সঞ্চারিত হলো পাথরের বুকে। ঝুঁকে পড়ে ছোট্ট বালককে কোলে তুলে নিলেন লক্ষণ।
রাম ও তার স্ত্রী তখন আনন্দে আত্মহারা। রাজা বিশাল এক উৎসবের আয়োজন করলেন। উজিরকে বললেন লক্ষণের জন্য উপযুক্ত স্ত্রী খুঁজে আনতে, তিনি নিজে তার বিয়ে দেবেন। অনেক জাঁকজমকের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো লক্ষণের। এরপর সুখে শান্তিতে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন দুই বন্ধুতে মিলে।