বিখ্যাত রোমান কবি ভার্জিলের লিখিত ‘দ্য ঈনিয়াড’ থেকে ঈনিয়াস নামক যুবক ট্রোজানের কিংবদন্তি ভ্রমণকাহিনীর কথা জানা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ১২৫০ সালে গ্রিকদের হাতে প্রাচীন নগরী ট্রয় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তারপর সেই নগরীর অবশিষ্ট অধিবাসীদেরকে সঙ্গে নিয়ে নতুন এক মাতৃভূমির খোঁজে বেরিয়ে পড়েন ঈনিয়াস। রোমানদের জন্য ট্রয়ের সঙ্গে নিজেদের একটা সংযোগ স্থাপন করা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে তারা বনে যায় বিখ্যাত প্রেমের দেবী, ভেনাসের বংশধর। প্রসঙ্গত- ঈনিয়াস ছিলেন ভেনাসের পুত্র।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে রোমানরা যখন ভার্জিলের মহাকাব্য পড়তে শুরু করল, ততদিনে তারা রোমান দেব-দেবীদের এট্রুসকান ও গ্রিক প্রতিরূপ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। এমনকি যেসব দেব-দেবী মানুষের মাঝে এসে, মানুষের সঙ্গে প্রেম করতো- তাদেরকে তারা গ্রহণ করেছিল স্বাভাবিকভাবে। তাই ঈনিয়াসের এই ভ্রমণ-গাথা এবং তাতে দেব-দেবীদের হস্তক্ষেপ রোমান ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে আছে।
ক্রিটে ঈনিয়াসের আগমন
তরুণ ট্রোজান সৈনিক ঈনিয়াস, যুদ্ধের মাঝেই তার বড় হওয়া। তিনি কখনো ভাবতেও পারেননি যে প্রিয় শহর ট্রয় গ্রিকদের কাছে হেরে যাবে। কিন্তু এক রাতে ট্রোজান বীর, মৃত হেক্টরের আত্মা ঈনিয়াসের ঘুমের মাঝে এসে হাজির হলো। হেক্টরের আত্মা ঈনিয়াসকে এই বলে সতর্ক করে দিল যে পরের দিন ট্রয় ধ্বংস হবে আর গ্রিক সেনারা লুটপাট চালাবে তাদের শহরে। সে ঈনিয়াসকে আরও বলল, গৃহস্থালির দেবতা লারস এবং পেনাটসকে জড়ো করতে; আর জনগণকে এই নগরী থেকে সরিয়ে নিতে।
অদ্ভুত ও নৃশংস এই সতর্কবাণী শুনে ঈনিয়াস জেগে উঠলেন, বর্ম গায়ে গলিয়েই দ্রুত পা বাড়ালেন শহরের দিকে। গ্রিক সৈন্যরা এরই মধ্যে ট্রয়ে লুটপাট শুরু করে দিয়েছে।
ঈনিয়াস অন্যান্য ট্রোজান সৈন্যদের সাথে যোগ দিয়ে রাজা প্রিয়ামের প্রাসাদের সামনে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাজা প্রিয়াম বা ট্রোজান রাজ পরিবারের কাউকে তারা বাঁচাতে পারলেন না। রাজপ্রাসাদের বাইরে ঈনিয়াস আর তার সঙ্গীরা শুনতে পেলেন- গ্রিক সৈন্যদের হাতে রাজা এবং রাজকুমার পোলিটেস নিহত হয়েছেন।
ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। একই অবস্থা তার নিজ পরিবারেরও যেন না হয়- এই সম্ভাবনা রোধে তিনি প্রাসাদ ছেড়ে বাড়ির পথ ধরলেন। তবে ঈনিয়াসের ভয়ের কিছু ছিল না। কেননা তার অজ্ঞাতসারে তারই মা, দেবী ভেনাস সবকিছু দেখছিলেন এবং ছেলের পরিবারকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করছিলেন।
ঈনিয়াস বাড়িতে ঢুকে দেখলেন তার পিতা (এনকাইসিস), ছেলে (ইস্কানিয়াস) এবং স্ত্রী (ক্রিউজা) একটা ছোট কাঠের টেবিল ঘিরে বসে মধু দেওয়া রুটি আর গরম দুধ খাচ্ছে। শহরে কী হচ্ছে, তা তারা কিছু টেরই পায়নি। ঈনিয়াস তাদের বোঝালেন, গ্রিক সৈন্যরা শহর আক্রমণ করেছে, তাদেরকে এখনই শহর ত্যাগ করতে হবে।
পঙ্গু এনকাইসিস যেতে অস্বীকৃতি জানালেন। ঈনিয়াস পিতাকে তাদের সাথে যেতে মিনতি করলেন বারংবার। বলতে লাগলেন- তাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবেন না ।
এনকাইসিস বিমূঢ়, বিভ্রান্ত হয়ে, উচ্চস্বরে জুপিটারের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। জুপিটার প্রার্থনার জবাব হিসেবে পাঠালেন, বিজলি। তীব্র বজ্রধ্বনির সাথে বিজলি। জুপিটারের এই ইশারা দেখে এনকাইসিস মনে করলেন- তাকে ঈনিয়াস এবং তার পরিবারের সাথে ট্রয় ত্যাগ করতে হবে। যেহেতু এনকাইসিস যাওয়ার জন্য তৈরিই ছিলেন, সেহেতু তিনি পেনাটস এবং লারস দেবতাদের সাথে নেওয়ার জন্য জড়ো করলেন।
ঈনিয়াস পিতার কাঁধ ধরে, তাকে আলতোভাবে উঁচু করলেন এবং ছোট্ট ইস্কানিয়াসের হাত ধরলেন। তিনি ক্রিউজার গালে চুমু এঁকে দিলেন এবং বললেন- কাছাকাছি থেকেই যেন তাকে অনুসরণ করে।
ঈনিয়াস সপরিবারে বেরিয়ে পড়লেন এতদিনের নিরাপদ আশ্রয় থেকে। অন্ধকার অলিগলি পার হতে হলো অনেক। সর্বদা গ্রিক সৈন্যদের ব্যাপারে চোখ-কান খোলা রাখলেন। দীর্ঘ এই পথচলা স্ত্রী-পুত্রের জন্য ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়াল। অচিরেই ক্লান্ত হয়ে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো তারা। তবে পিতার টানে ইস্কানিয়াস এগিয়েই চলল।
অবশেষে দলটা শহরের দরজার বাইরে এসে পৌঁছালে, ঈনিয়াস পিতাকে মাটিতে বসিয়ে ছেলের হাত ছেড়ে দিলেন। আচমকা উপলব্ধি করতে পারনে- ক্রিউজা তাদের সাথে নেই। স্ত্রী তাকে অনুসরণ করছে কিনা, সেটা চলার পথে ব্যস্ততায় একবারও দেখেননি। গ্রিক সৈন্যরা হয়তো ক্রিউজাকে নাগালে পেয়ে মেরে ফেলেছে, এই আশঙ্কাকে সঙ্গী করে তিনি জ্বলন্ত শহরে আবার ঢুকে পড়লেন। স্ত্রীকে ফেলে ঈনিয়াস যাবেন না।
ইতোমধ্যে, সৈন্যরা ঈনিয়াসের বাড়িসহ আশেপাশের অনেক ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ঈনিয়াস স্থির দৃষ্টিতে ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খেয়াল করলেন কিছু একটা নড়ছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে ওটা ক্রিউজাই, তাই দৌড়ে গেলেন সেদিকে। কিন্তু প্রিয়তমা স্ত্রীকে কোনভাবেই বাহুডোরে নিতে পারলেন না। তাকে ছুঁতে গিয়ে দেখতে পেলেন, ওটা আসলে ক্রিউজার আত্মার ধোঁয়াশা-পূর্ণ বাতাস।
এদিকে ক্রিউজাও বীরের স্ত্রী। স্বামীর অবস্থা দেখে সে বারবার সান্ত্বনা দিয়ে বলছিল- মহান দেবতা জুপিটারের ইচ্ছে ছিল বলেই সে স্বামীকে অনুসরণ করতে পারেনি। সাবধান করে দেয় সে ঈনিয়াসকে। বলে, ট্রোজানদের সামনে রয়েছে এক ভয়ানক এবং দীর্ঘ যাত্রা।
ঈনিয়াস বারংবার চাইলেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে আলিঙ্গন করতে। কিন্তু আত্মাকে যে ছোঁয়া যায় না। বিফল মনরথে তাই তিনি ফিরে গেলেন পিতা-পুত্রের কাছে। সেখানে আরো কয়েকজন ট্রোজান ইতিমধ্যে জড়ো হয়েছে। ঈনিয়াসের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই, নেতৃত্বের আশায়।
সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ঈনিয়াস মাসখানেক নিরলস পরিশ্রমের পর কাঠের কিছু জাহাজ তৈরি করতে সক্ষম হলেন, যেন এতে করে নতুন আবাসস্থলের খোঁজে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া যায়। জাহাজগুলোর নিচের পাটাতন ছিল যাত্রীদের জন্য, মাঝেরটা মাঝিদের জন্য; লম্বা-লম্বা বৈঠা ব্যবহার করতো তারা। সেগুলো জাহাজের পাশের ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে পানি স্পর্শ করতে পারত। আর একেবারে উপরের পাটাতনের ঠিক মাঝখানে ছিল বিশাল-বিশাল সব পাল।
যখন সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে খোরাক বোঝাই করা হলো, তখন নৌবহর উত্তরে, থ্রেস-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। থ্রেস বরাবরই ছিল ট্রোজানদের মিত্র। ঈনিয়াসের ইচ্ছে ছিল, ওখানে গিয়ে তিনি পলিডোরাসের সাথে দেখা করবেন। পলিডোরাস, রাজা প্রিয়ামের সর্বকনিষ্ঠ ছেলে, যাকে নিরাপত্তার খাতিরে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঈনিয়াস এবং তার দলবল নিরাপদে থ্রেসের উপকূলে পৌঁছেই দেব-দেবীদের সম্মানে প্রথাগত পূজাবেদি তৈরি করলেন।
কিন্তু বিপদ হলো এর পরেই। বেদি সাজানোর জন্য ঈনিয়াস কিছু মেদি-গাছ উপড়ে তুলতেই ওগুলোর পাতা থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করল। মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল চাপা ফোঁপানি। ওই কান্নার আওয়াজ আসলে তরুণ পলিডোরাসের, থ্রেসিয়ানদের হাতে খুন হয়েছিল বেচারা। কারণ থ্রেসিয়ানরা ট্রোজানদের পক্ষ ছেড়ে গ্রিকদের সাথে বন্ধুত্ব করেছিল।
রাজপরিবারের আরো এক সদস্যকে হারিয়ে ঈনিয়াস অত্যন্ত দুঃখ পেলেন। থ্রেস ছাড়ার পূর্বে তিনি লোকদেরকে নিয়ে, যথাযোগ্য মর্যাদায় পলিডোসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। ট্রোজান মহিলারা তাদের চুল কাটল, তরুণ রাজপুত্রের আত্মার শান্তি কামনায় শোকাকুল উপাসনা করতে লাগল।
এবার কোথায় যাওয়া যায় তা ভেবে না পেয়ে ঈনিয়াস মাঝিদেরকে ডেলোসের দিকে এগোবার নির্দেশ দিলেন। ডেলোস ছোট্ট একটা গ্রিক দ্বীপ, এজিয়ান সাগরে যার অবস্থান। এই দ্বীপেই জন্ম নেন দেবতা অ্যাপোলো। ডেলোসের অ্যাপোলো মন্দিরের নিচে বাস করত বিখ্যাত ওরাকল। দ্বৈববাণীর আশায় তার সঙ্গেই দেখা করতে চাচ্ছিলেন ঈনিয়ান।
সফল হলেন, ওরাকলকে খুঁজে বের করে জানতে চাইলেন,
করব কার অনুসরণ মোরা?
কোন সমুদ্রে ভাসাব ভেলা?
কোন স্থানে করব বসতি স্থাপন?
হে পিত! নির্দেশনা দিন, করুন মনোভঞ্জন।
ওরাকল মুখ খুলল। যেখান থেকে এসেছে, সেখানেই আবার ফিরে যেতে বলা হলো ওদের। দৈববাণীতে প্রকৃতপক্ষে কী বলা হয়েছে, তা ঈনিয়াস বুঝতে পারেননি। তাই তিনি পিতার কাছে পরামর্শ চাইলেন। এনকাইসিস একটা কিংবদন্তী জানতেন- সে অনুসারে ট্রয়ের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন ক্রিট থেকে, ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে অবস্থিত একটা দ্বীপ ওটা। বৃদ্ধ তার পুত্রকে বুঝালেন- অ্যাপোলোর দৈববাণী অনুযায়ী তাদের ক্রিটে উপনিবেশ স্থাপন করা উচিত।
দৈববাণী রহস্য সমাধান হয়ে যাওয়ায়, ঈনিয়াস ট্রোজানদেরকে নির্দেশ দিলেন তারা যেন অ্যাপোলোকে ধন্যবাদ জানায়। অতঃপর পাল তুলে যাত্রা শুরু করলেন তারা।
ক্রিটের অবস্থান এশিয়া মাইনর এবং গ্রিক মূল ভূখণ্ডের ঠিক মাঝামাঝি হওয়ায়, ট্রোজানদের জন্য জায়গাটা একদম উপযুক্ত ছিল। নোঙর ফেলার পর, ট্রোজানরা তাদের নতুন বাসভূমি খুঁজে পাওয়ার আনন্দ উদযাপন করল। প্রচণ্ড উৎসাহ এবং উদ্দীপনা নিয়ে, নতুন জীবনের আশায় প্রত্যেকে কঠোর পরিশ্রম করতে লাগল। পুরুষ-মহিলারা দ্বীপের উর্বর মাঠগুলোতে নিড়ানি দিয়ে রোপণ করল ভুট্টা আর যব। দ্বীপে যত্র-তত্র জন্মে থাকা নানা ধরনের ফল আর জলপাই গাছের পরিচর্যাও করল। ঈনিয়াস তার লোকদের আশ্বাস দিলেন প্রত্যেককে আলাদা-আলাদা জমি দেওয়া হবে এবং তাদের পরিচালনার জন্য আইনও প্রণয়ন করা হবে। গড়ে উঠল নতুন এক শহর- পারজেমাম।
কিন্তু এত সুখ কি আর চির অভাগাদের সয়? এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দ্বীপ বিধ্বংসী মহামারীতে আক্রান্ত হলো। গাছপালা, পশুপাখি এমনকি বহু মানুষ মারা পড়ল রোগে। ট্রোজানরা বুঝতে পারল না, কেন প্রভু তাদের উপর এত রেগে আছেন।
এরপর এক রাতে, পেনাটস আর লারস (ট্রোজানদের গৃহ-দেবতা যারা ট্রয় ছাড়ার পর থেকে ঈনিয়াসের সাথেই ছিলেন) আবির্ভূত হলেন। তারা কোরাস করতে লাগলেন,
চালিয়ে যাও তোমাদের কঠোর পরিশ্রম,
তবে পাল্টে নাও বসবাসের ভূম।
ডেলোসের অ্যাপোলোর নির্দেশিত জমি এটা নয়,
ক্রিটে বাসে সিদ্ধান্তও যে ভুল প্রতিপন্ন হয়।
সামনে আছে এক দেশ, নাম যার- হেসপেরিয়া,
উর্বর, সমৃদ্ধ ভূমি দেখে যাবে দুঃখ ভুলিয়া।
পরের দিন সকালে, ঈনিয়াস লোকদেরকে তার পরিকল্পনা জানালেন এবং তাদেরকে আশাবাদী থাকতে উৎসাহিত করলেন। এমন ইতিবাচক নেতৃত্ব পেয়ে, ট্রোজানরা খুশি মনে গোছগাছ করে দ্বীপ ছেড়ে হেসপেরিয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।
গ্রিকদের কাছে এটি পরিচিত ছিল ইতালি নামে।