অ্যানান্সির নাম হয়তো আপনি শুনে থাকবেন না, কিন্তু এটুকু নিশ্চিতভাবে বলতে পারি- ভার্চুয়াল জগতে অ্যানান্সির সাথে আপনার পরিচয় ঘটেছে অনেক অনেক আগে, বলতে পারেন একদম শৈশবে। স্কুলের সাধারণ পড়াশোনা থেকে আমেরিকার পপ কালচার ঘানার এই ‘স্পাইডার গড’ এর বিস্তৃতি আছে পুরো বিশ্ব জুড়েই। দক্ষিণ আমেরিকাতে ঘানার পুরাণের এই ঈশ্বরের আদলেই তৈরি হয়েছে বিখ্যাত চরিত্র ‘ব্রের র্যাবিট’। কিংবা যদি একদম পরিচিত উদাহরণ খুঁজতে চান, তাহলেও সমস্যা নেই। শৈশবে ফিরে গিয়ে মনে করতে পারেন মার্ভেলের স্পাইডার ম্যানকেই।
অ্যানান্সি কে?
কুয়াকু অ্যানান্সির গল্পের উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিমে, ঘানাতে। ঘানার প্রচলিত ভাষা ‘আকান’ অনুসারে অ্যানান্সি শব্দের অর্থ মাকড়সা। তবে প্রচলিত কথায় এই ‘অ্যানান্সি’ শব্দটির আরো বেশ কয়েকটি উচ্চারণ আছে। কোথাও কোথাও একে বলা হয় ‘অ্যানান্সে’, কোথাও বলা হয় ‘কুয়াকু আনান্সে’, আবার কেউ কেউ ‘কুয়েকু আনানসি’ও বলে থাকেন। তবে যেটাই বলুন না কেন,সবচেয়ে বেশি প্রচলিত নামের উচ্চারণ হল ‘অ্যানান্সি’।
অ্যানান্সি দেখতে কেমন? এই প্রশ্নেও ঘানার মানুষ কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। তবে ঘানাতে অ্যানান্সির সবচেয়ে প্রচলিত যে ছবিটা চালু আছে সেখানে অ্যানান্সিকে আঁকা হয়েছে আট পা-ওয়ালা এক ঈশ্বর হিসেবেই। পশ্চিম আফ্রিকার এই মাকড়সা সদৃশ ঈশ্বরের একটা পরিবারও আছে, পরিবারের সব সদস্যই দেখতে এই অ্যানান্সির মতোই। অ্যানান্সির মায়ের নাম ‘অ্যাসাসি ইয়া’। ঘানার মানুষের কাছে এই ‘অ্যাসাসি ইয়া’ হলেন পৃথিবীর দেবী। অ্যানান্সির পরিবারে এই মা ছাড়াও আছে একজন স্ত্রী আর তিনজন সন্তান। তার স্ত্রীর নাম ‘ওকোনোরে ইয়া’ আর তিন সন্তানের নাম যথাক্রমে- ‘তিকুমা’, ‘তিকেলেনকিলেন’ আর ‘ন্যানকোনওয়া’। এর মধ্যে তিকুমা নিজের বাবাকে প্রচন্ড ভয় পায় বলে পশ্চিম আফ্রিকার পুরাণে উল্লেখ আছে।
কুয়াকু অ্যানান্সির স্বভাব বলতে গিয়ে ঘানার পুরাণে বলা হয়েছে, অ্যানান্সি ভীষণরকম ধূর্ত। নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তিনি শক্ত সব প্রতিপক্ষকেও হারিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখেন বলে বিশ্বাস করে পশ্চিম আফ্রিকার মানুষেরা। এমনকি অ্যানান্সির বুদ্ধিমত্তাকে ঘানার মানুষেরা এতটাই পূজনীয় মনে করে যে ঘানার ‘আকান’ ভাষাতে অ্যানান্সির নামে একটা আস্ত শব্দই আছে- ‘অ্যানান্সিসিম’। ইংরেজিতে রূপান্তর করলে শব্দটার অর্থ করলে দাঁড়ায়- a story too incredible to believe.
অর্থাৎ এমন কোনো গল্প যেখানে এতটাই বুদ্ধিমত্তার নজির আছে যা বিশ্বাস করাই কষ্টকর- এমন সব ঘটনা ব্যাখ্যা করতে ‘আকান’ ভাষাতে আপনার একটা শব্দই যথেষ্ট- ‘অ্যানান্সিসিম’।
স্পাইডার-গড অ্যানান্সি ও ট্রান্সআটলান্টিক দাস প্রথা
ট্রান্সআটলান্টিক দাস প্রথার জন্যে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে লোকেরা ধীরে ধীরে বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। এই ছড়িয়ে পড়ার অবশ্য দুটো পরিণতি হতে পারত। প্রথমত, আফ্রিকার যে নিজস্ব লোককথা ও পুরাণ আছে সেসব বিলুপ্ত কিংবা বিকৃত হতে পারত। দ্বিতীয়ত, আফ্রিকান পুরাণের গল্পগুলো আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে পারত বিশ্বের নানা প্রান্তে। প্রথম সম্ভাবনা যে একেবারেই ঘটেনি তা কিন্তু নয়, তবে দ্বিতীয় সম্ভাব্যতাও নিজের মতো করেই জানান দিয়েছে। আফ্রিকান পুরাণের গল্প ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। এই যেমন অ্যানান্সির গল্প জ্যামাইকাতে ভীষণ জনপ্রিয়। কারণ হিসেবে মনে করা হয় ১৮০০ সালের দিকে ‘জ্যামাইকা মেরুন’ নামক জাহাজ যখন সিয়েরা লিওনে নোঙর ফেলেছিল, ফিরে যাওয়ার সময় আফ্রিকান কিছু দাসের সাথে অ্যানান্সির গল্পকেও নিয়ে গিয়েছিল। অ্যানান্সির এই গল্প তখন থেকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপগুলোতে আস্তে আস্তে ডালপালা মেলে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছিল। অবশ্য, জ্যামাইকাতে এই অ্যানান্সির গল্পের গোড়াপত্তন হয়েছিল আফ্রিকান দাসদের হাত ধরেই।
কুয়াকু অ্যানান্সির কিংবদন্তী আফ্রিকায় জন্ম নিয়ে সর্বপ্রথম ছড়িয়ে পড়ে জ্যামাইকাতে, একটা দাসবাহী জাহাজের ওপর ভর করে। তবে জ্যামাইকা থেকেও এটি আমেরিকা সহ নেদারল্যান্ড শাসিত বিভিন্ন দ্বীপে কীভাবে পৌঁছে গেল সে প্রশ্নের উত্তরে অনেকে মনে করেন, এখানেও আছে দাসবাহী জাহাজের অবদান। সিয়েরা লিওন থেকে জ্যামাইকাতে যাওয়ার পথে জাহাজটি নোঙর করেছিল দক্ষিণ আমেরিকা, অরুবা, বোনাইর আর কুরাকাওতে। মনে করা হয়, এখান থেকেই এসব দেশে অ্যানান্সির গল্পের গোড়াপত্তন শুরু।
তবে ট্রান্সআটলান্টিক দাসপ্রথার মাধ্যমে অ্যানান্সির গল্পের ছড়িয়ে পড়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ‘নীল গাইম্যান’ এর লেখা বই ‘আমেরিকান গডস’। এসবের বাইরে আমেরিকার জনমানুষের কাছে অ্যানান্সি প্রথমবারের মতো সবচেয়ে বড় পরিসরে পরিচিত হয়েছিল অরল্যান্ডো জোন্সের টেলিভিশন সিরিজের মাধ্যমে। সেখানে অবশ্য আট পা-ওয়ালা চরিত্রটিকে অ্যানান্সির বদলে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মিস্টার ন্যান্সি’ বলে।
অ্যানান্সির দেবত্ব লাভ
অ্যানান্সি শুরুতেই কিন্তু দেবতা ছিলেন না। পশ্চিম আফ্রিকার পুরাণ অনুসারে তার দেবত্ব লাভের একটা মজার গল্প আছে। সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখন পৃথিবীতে বলার মতো কোনো গল্প ছিল না। পৃথিবীর সবকিছু ছিল আকাশের দেবতা ‘নিয়াম’-এর অধীনে। অ্যানান্সি একদিন এই আকাশের দেবতার কাছে গেলেন, গিয়ে জিজ্ঞেস করে বসলেন- এই পৃথিবীর কিছু অংশের বিনিময়ে তাকে কী দিতে হবে? নিয়াম অ্যানান্সিকে তখন অদ্ভুত এক শর্ত দিলেন। তিনি বললেন, অ্যানান্সিকে পৃথিবী থেকে তিনটি জিনিস এনে নিয়ামকে দিতে হবে। এক, অনিনি নামের পাইথন। দুই,ওসেবো নামের চিতাবাঘ। তিন, এমব্রো নামের ভিমরুলের দল।
অ্যানান্সি তখন নিয়ামের কথায় অভিযানে বেরিয়ে পড়ল। প্রথমেই সে গেল পাইথনের কাছে। পাইথনের বাসার বাইরে গিয়ে সে জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগল। বলতে লাগল, পাইথনটি মোটেই পাম গাছের চাইতে বেশি লম্বা নয়। অ্যানান্সির এই শ্লেষ গায়ে লাগল পাইথনের। সে তাকে বলল, পারলে পরীক্ষা করুক সে। অ্যানান্সি তাতে সম্মতি দিলে নতুন সমস্যায় পড়ে গেল পাইথনটি। দেখা গেল, দৈর্ঘ্য পরীক্ষার জন্যে পাইথনটি ঠিকমত দাঁড়াতেই পারছে না। এতে করে কে আসলে বেশি লম্বা সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। ধূর্ত অ্যানান্সি তখন নিজের মোক্ষম চালটি দিল। সে পাইথনকে পরামর্শ দিল, পাইথনটি যদি গাছের গোড়ার সাথে নিজেকে বেঁধে ফেলে তাহলে সে সোজা হতে পারবে আর এতে করে বোঝাও যাবে যে পাইথনটিই আসলে বেশি লম্বা। বোকা পাইথন অ্যানান্সির এই টোপ গিলে নিল। সে সত্যি সত্যি গাছের গোড়ার সাথে নিজেকে বেঁধে ফেলল। আর তখনই অ্যানান্সি গাছসুদ্ধ তুলে পাইথনটিকে নিয়ে যায় নিয়ামের কাছে। পাইথনটি শেষ অব্দি আর বাঁধন ছাড়াতে পারেননি।
পাইথনকে ধরার পর অ্যানান্সি বেরিয়ে পড়ে চিতাবাঘটিকে ধরতে। চিতাবাঘটিকে ধরার জন্যে সে চিতাবাঘের রাস্তায় একটি বড় গর্ত খুঁড়ে ফেলে। চিতাবাঘটি একসময় ঐ গর্তে পড়ে গেলে অ্যানান্সি তখন চিতাবাঘটিকে সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। সে চিতাবাঘটিকে বলে, সে যদি অ্যানান্সির জাল ধরে উপরে উঠে আসে তাহলে এই গর্তের ফাঁদ থেকে সে মুক্ত হতে পারবে। ওসেবো নামের চিতাবাঘটি তখন অ্যানান্সিকে সরল মনে বিশ্বাস করল আর এখানেই সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলে। যেই না জাল ধরে উপরে উঠে এসেছে, তখনই দেখা যায় অ্যানান্সি নিজের জাল দিয়ে চিতাবাঘের সমস্ত দেহ দ্রুত আবৃত করে ফেলেছে। চিতাবাঘটি আর সে জাল থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারেনি। শেষ অব্দি এই বদ্ধ চিতাবাঘটিকে নিয়ে অ্যানান্সি রওনা দেয় দেবতা নিয়ামের কাছে।
ভিমরুলকে ধরার জন্যে অ্যনান্সি ব্যাবহার করলে একটি লাউ। সে লাউয়ের অর্ধেক কেটে একটি ফাঁপা গর্ত করে সেটা পানি দিয়ে পূর্ণ করে। এরপর সে তার নিজের ওপর, নিজের বাসার ওপর আর কলাপাতার ওপর পানি ছিটিয়ে ভিমরুলকে বলে- বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। ভিমরুল যদি এই লাউয়ের ভেতর ফাঁপা স্থানে আশ্রয় নেয় তাহলে সে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারবে। চিতাবাঘ আর পাইথনের মত ভিমরুলও অ্যানান্সিকে বিশ্বাস করে ফেলে, সে লাউয়ের ভেতরের ফাঁপা স্থানে ঢুকে যায়। আর তখনই অ্যানান্সি লাউয়ের বাকি অর্ধেল দিয়ে ওটাকে আটকে দেয় আর নিয়ে যায় নিয়ামের কাছে।
নিয়াম অ্যানান্সির কাজে ভীষণ খুশি হয়। সে অ্যানান্সিকে এই পৃথিবীর দেবত্ব দেয়।
‘ব্রের র্যাবিট’ ও অ্যানান্সি
‘ব্রের র্যাবিট’ মূলত ১৯৪৬ সালে উন্মোচিত ডিজনি ফিল্ম ‘সং অফ দা সাউথ’ -এর একটি চরিত্র। সে লোককথার একটি চরিত্র যার উৎপত্তি ধরা হয় আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চলে যেখানে দাস প্রথার হার ছিল সবচেয়ে বেশি। কুয়াকু অ্যানান্সির মতো ব্রের র্যাবিটও নিজের ধূর্ততার সর্বোচ্চ ব্যাবহার করতে চাইত। এমনকি আফ্রিকা থেকে আগত যেসব দাস আমেরিকায় কাজ করত, তাদের মধ্যে অ্যানান্সিকে নিয়ে যে গল্প হতো সেই গল্পের বৈশিষ্ট্যের সাথে ব্রের র্যাবিটের সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মিলে যায়। এই অদ্ভুত মিল কি কাকতালীয়?
এটি ব্যাখ্যা করেছেন পোস্টকলোনিয়াল সাহিত্যের গবেষক এমিলি জোবেল মার্শাল। তিনি নিজের বই ‘আমেরিকান ট্রিকস্টার’-এ এটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
“ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোর প্রচলিত গল্প অনুসারে অ্যানান্সির যে বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, ব্রের র্যাবিটের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই দেখা যায়। আসলে দুটোই প্রচন্ড ধূর্ত এবং সহনশীল চরিত্র। দুটো চরিত্রই দাস প্রথার ব্যাপক বিস্তৃতির অঞ্চলে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। দুটো চরিত্রের মধ্যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সিদ্ধহস্ত মনোভাব দেখা যায়। যদিও উনিশ শতকের পরে ব্রের র্যাবিট চরিত্রটি আরো বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে।”
অ্যানান্সি ও স্পাইডার ম্যান
কুয়াকু অ্যানান্সির যে গল্প আর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য আর মার্ভেলের স্পাইডারম্যানের ক্ষেত্রেও যে গড়ন আর বৈশিষ্ট্য- এতে করে এই দুইয়ের মিল না খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
কিন্তু মার্ভেল কমিকসের বেশিরভাগ ভক্তের কাছে পশ্চিম আফ্রিকার এই দেবতার সাথে স্পাইডারম্যানের মিল সবসময়ই চোখ এড়িয়ে গেছে। কিন্তু, ২০০৩ সালেই কিন্তু ‘দ্যা অ্যামাজিং স্পাইডার ম্যান সিরিজ’ ঘোষণা করেছিল, তাদের কাছে প্রথম স্পাইডারম্যানের ধারণা আসে এই কুয়াকু অ্যানান্সিকে দেখেই। তাদের ভাষ্যমতে,
“Kwaku Anansi was, in fact, the very first Spider-Man”
তবে মার্ভেল কমিক্স এই উক্তিটি বলেছিল তাদেরই একটি চরিত্রের মাধ্যমে। চরিত্রটি ছিল এজকিয়েল।
অ্যানান্সির বই
টিভি সিনেমার পাতা ছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকান পুরাণের এই ঈশ্বরকে নিয়ে কিন্তু বইও লেখা হয়েছে। বইটি লিখেছেন মার্থা ওয়ারেন বেকউইথ। তিনি মূলত নানা ধরনের লোককথা নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয় তার বই ‘জ্যামাইকান অ্যানান্সি স্টোরিস’। বইটিতে তিনি জ্যামাকাইতে অ্যানান্সিকে নিয়ে ছড়িয়ে থাকা লোককথাগুলোকে দুই মলাটে স্থান দিয়েছেন। অ্যানান্সিকে নিয়ে এটিই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বই বলে মনে করা হয়।