কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ: ভীষ্ম পর্বের সারসংক্ষেপ || পর্ব–২

[১ম পর্ব পড়ুন]

যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন: ভীমের বীরত্ব, অর্জুনের রণকুশলতা এবং পাণ্ডবদের বিজয়

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে অর্জুন পাণ্ডব সৈন্যদেরকে নিয়ে ‘ক্রৌঞ্চব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ পাণ্ডব বাহিনীকে একটি সুবৃহৎ বকের আকারে সজ্জিত করেন। একে প্রতিহত করার জন্য ভীষ্ম কৌরব সৈন্যদেরকে নিয়ে একটি পাল্টা ব্যূহ গঠন করেন।

যুদ্ধের শুরুতেই ভীষ্মের তীরবর্ষণের ফলে পাণ্ডব বাহিনীর বহুসংখ্যক রথী ও অশ্বারোহী সৈন্য নিহত হয় এবং আতঙ্কিত পাণ্ডব সৈন্যরা পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। এমতাবস্থায় অর্জুন ভীষ্মকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তার দিকে অগ্রসর হন। অর্জুন ভীষ্মের নিকটবর্তী হলে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, দুর্যোধন, অশ্বত্থামা, শল্য, জয়দ্রথ ও বিকর্ণ একযোগে অর্জুনের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, এবং অর্জুন তাদের সকলের ওপর পাল্টা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। ইতোমধ্যে সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, অভিমন্যু, বিরাট ও দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে অর্জুনকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন এবং কৌরব যোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন।

এ সময় অর্জুনের তীরবৃষ্টির ফলে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। ক্ষিপ্ত দুর্যোধন ভীষ্মের কাছে গিয়ে অনুযোগ করেন যে, ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য জীবিত থাকা সত্ত্বেও অর্জুন তার সৈন্যবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করতে পারছে। দুর্যোধন যোগ করেন যে, কেবল ভীষ্মের কারণেই তার পরম শুভানুধ্যায়ী কর্ণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে না, সুতরাং ভীষ্মের উচিত অর্জুনকে হত্যা করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দুর্যোধনের বক্তব্য ভীষ্মের কাছে পছন্দনীয় ছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়েই তিনি অর্জুনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং অর্জুনের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। ভীষ্ম ও অর্জুন পরস্পরের বিরুদ্ধে এক প্রলম্বিত দ্বৈরথ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, কিন্তু উভয়েই সমান রণনৈপুণ্যের পরিচয় দেন এবং কেউই একে অপরের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হননি।

একই সময়ে দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। প্রাথমিকভাবে উভয়েই সমান রণনৈপুণ্যের পরিচয় দেন, কিন্তু শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুক কাটা পড়ে। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যকে লক্ষ্য করে একটি ভারী গদা নিক্ষেপ করেন, কিন্তু দ্রোণাচার্য তীর নিক্ষেপ করে সেটি প্রতিহত করেন। এরপর ধৃষ্টদ্যুম্ন আবার একটি ধনুক তুলে নিয়ে দ্রোণাচার্যের ওপর তীর নিক্ষেপ করতে থাকেন, কিন্তু শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে তার ধনুক কাটা পড়ে এবং তার রথের সারথি ও রথের সঙ্গে সংযুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। ধৃষ্টদ্যুম্ন তার অকেজো রথ থেকে একটি গদা হাতে নেমে পড়েন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে গদাটি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়ে। এরপর ধৃষ্টদ্যুম্ন একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার হাতে নেন, কিন্তু দ্রোণাচার্যের তীরবৃষ্টির কারণে তিনি এক পা-ও অগ্রসর হতে পারছিলেন না এবং কোনোক্রমে ঢাল–তলোয়ারের সাহায্যে উক্ত তীরবৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করছিলেন। এমতাবস্থায় ভীম ধৃষ্টদ্যুম্নকে সাহায্য করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন এবং দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন। তার সহায়তায় ধৃষ্টদ্যুম্ন একটি নতুন রথে আরোহণ করেন। অর্থাৎ, দ্রোণাচার্যের নিকট ধৃষ্টদ্যুম্ন পরাজিত হন।

চিত্রকর্মে পাণ্ডব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন; Source: Wikimedia Commons

এসময় দুর্যোধন ভীমকে আক্রমণ করার জন্য কলিঙ্গের রাজা শ্রুতায়ুর নেতৃত্বাধীনে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন এবং ভীম পাণ্ডব বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত চেদি রাজ্যের একদল সৈন্য নিয়ে তাদের মোকাবিলা করতে অগ্রসর হন। এই পরিস্থিতিতে দ্রোণাচার্য দ্রুপদ ও বিরাটের সম্মুখীন হন এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন যুধিষ্ঠিরকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন। ভীমের নেতৃত্বাধীন চেদি রাজ্যের সৈন্যরা রাজা শ্রুতায়ুর নেতৃত্বাধীন কলিঙ্গ রাজ্যের সৈন্য এবং রাজপুত্র কেতুমাৎ–এর নেতৃত্বাধীন নিষাদ রাজ্যের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তীব্র যুদ্ধের পর চেদির সৈন্যরা পশ্চাৎপসরণ করে, কিন্তু ভীম একাকী শত্রুসৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন।

শ্রুতায়ু ও তার ছেলে শক্রদেব ভীমের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শুরু করেন এবং শক্রদেবের তীরের আঘাতে ভীমের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। ক্ষিপ্ত ভীম শক্রদেবকে লক্ষ্য করে একটি গদা নিক্ষেপ করেন এবং উক্ত গদার আঘাতে শক্রদেব নিহত হন। ভীম একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে তার অকেজো রথ থেকে নেমে পড়েন এবং উক্ত তলোয়ারের সাহায্যে তার দিকে নিক্ষিপ্ত শ্রুতায়ুর তীরগুলোকে কেটে ফেলতে থাকেন। এরপর ভীম কলিঙ্গের আরেক রাজপুত্র ভানুমাৎকে দেখতে পান এবং তার দিকে ছুটে যান। ভানুমাৎ একটি হাতির পিঠ থেকে ভীমের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলেন। ভীম হাতিটির ওপরে লাফিয়ে উঠে তলোয়ারের সাহায্যে ভানুমাৎকে দুই টুকরো করে কেটে ফেলেন এবং এরপর তার হাতিটিকেও হত্যা করেন।

এরপর ভীমের তলোয়ারের আঘাতে কলিঙ্গের বহুসংখ্যক রথী, অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য এবং হাতি নিহত হয়। এরপর ভীম শ্রুতায়ুকে দেখতে পেয়ে তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন, কিন্তু শ্রুতায়ু তার ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এসময় ভীমের সারথি তার জন্য একটি নতুন রথ এনে দেয় এবং ক্ষিপ্রগতিতে সেটিতে আরোহণ করে তিনি শ্রুতায়ুর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। শীঘ্রই ভীমের তীরের আঘাতে শ্রুতায়ু ও তার দুই পার্শ্বনী নিহত হন, এবং এরপর সত্যদেব ও সত্য নামক কলিঙ্গের দুই রথী ও নিষাদের রাজপুত্র কেতুমাৎ ভীমের তীরে নিহত হন।

এরপর কলিঙ্গের সৈন্যরা ক্রোধান্বিত হয়ে ভীমকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। ভীম একটি গদা হাতে নিয়ে দ্রুত তার রথ থেকে নেমে পড়েন এবং উক্ত সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তার গদার আঘাতে কলিঙ্গের বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয়, কিন্তু ভীমের একার পক্ষে এত বিপুল সংখ্যক সৈন্যের মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। এমতাবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকির নেতৃত্বাধীনে পাণ্ডব সৈন্যরা ভীমকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হয় এবং তাদের হাতে কলিঙ্গের বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত হয়।

ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে অবস্থিত ভীমের ভাস্কর্য; Source: CEphoto, Uwe Aranas/Wikimedia Commons

এমতাবস্থায় ভীষ্ম সেদিকে অগ্রসর হন এবং ভীম, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রুতগতিতে নিজেদের রথে চড়ে ভীষ্মের দিকে অগ্রসর হয়ে তাকে আক্রমণ করেন। ভীষ্মের তীরের আঘাতে ভীমের রথের সাথে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ভীম ভীষ্মকে লক্ষ্য করে একটি তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীষ্ম তীরের সাহায্যে সেটিকে কেটে ফেলেন। এরপর ভীম একটি গদা হাতে নিয়ে তার অকেজো রথ থেকে লাফিয়ে পড়েন এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন তাকে নিজের রথে তুলে নিয়ে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। এরপর সাত্যকির তীরের আঘাতে ভীষ্মের রথের সারথি নিহত হয় এবং রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে ভীষ্মকে সেখান থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।

সেদিন দুপুরে যুদ্ধক্ষেত্রের আরেক প্রান্তে ধৃষ্টদ্যুম্ন অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য ও শল্যের ওপর আক্রমণ চালান এবং তার তীরের আঘাতে অশ্বত্থামার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। অশ্বত্থামা দ্রুত তার অকেজো রথ থেকে নেমে পড়ে শল্যের রথে আরোহণ করেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ অব্যাহত রাখেন। এমতাবস্থায় অভিমন্যু সেদিকে অগ্রসর হয়ে অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য ও শল্যের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তারাও অভিমন্যুর ওপর পাল্টা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।

এমতাবস্থায় দুর্যোধনের ছেলে লক্ষ্মণ অভিমন্যুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিছুক্ষণের মধ্যেই লক্ষ্মণের তীরে আঘাতে অভিমন্যুর ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু অভিমন্যু আরেকটি ধনুক উঠিয়ে লক্ষ্মণের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন। এসময় দুর্যোধন তার ছেলেকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন এবং তার নেতৃত্বে কৌরব রথীরা অভিমন্যুকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন। এটি দেখে অর্জুন খুবই ক্ষিপ্ত হন এবং তার ছেলেকে রক্ষা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন। ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্যের নেতৃত্বাধীনে কৌরব যোদ্ধারা তাকে প্রতিহত করার জন্য অগ্রসর হন, কিন্তু অর্জুনের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর তার ব্যাপক তীরবৃষ্টির কারণে তারা আর অগ্রসর হতে পারেননি।

এ সময় অর্জুন কৌরব বাহিনীর ওপর ব্যাপক হারে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং তার তীরের আঘাতে কাতারে কাতারে কৌরব সৈন্য নিহত হয়। শেষ পর্যন্ত কৌরব সৈন্যরা অর্জুনের তীরবৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। কৌরব সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণের পর অর্জুন ও কৃষ্ণ শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে নিজেদের বিজয়ের ঘোষণা করেন। সেসময় সূর্যাস্ত ঘনিয়ে আসছিল এবং ভীষ্ম মনে করছিলেন যে, মনোবলহীন কৌরব সৈন্যদের সেদিন আর নতুন করে যুদ্ধে লিপ্ত করা সম্ভব হবে না। এজন্য তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করেন। এভাবে কৌরবদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনের অবসান ঘটে।

যুদ্ধের তৃতীয় দিন: ভীষ্মের রুদ্রমূর্তি, কৃষ্ণের ক্রোধ, অর্জুনের রণনৈপুণ্য এবং পাণ্ডবদের বিজয়

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তৃতীয় দিনে ভীষ্ম কৌরব সৈন্যদেরকে নিয়ে ‘গরুড়ব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ কৌরব বাহিনীকে একটি গরুড়ের আকারে সজ্জিত করেন। এটিকে প্রতিহত করার জন্য অর্জুন ও ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডব সৈন্যদেরকে নিয়ে ‘অর্ধচন্দ্রব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ পাণ্ডব বাহিনীকে অর্ধচন্দ্রের আকারে সজ্জিত করেন।

ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে অবস্থিত অর্জুন ও কৃষ্ণের ভাস্কর্য; Source: Wikimedia Commons

যুদ্ধের শুরুতেই অর্জুনের তীরবৃষ্টির ফলে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়, কিন্তু তারা পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং উভয় পক্ষেরই ব্যূহের স্থানে স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। উভয় পক্ষের শীর্ষ যোদ্ধারা প্রতিপক্ষের সৈন্যদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালাতে থাকেন। অর্জুনের রণনৈপুণ্য দেখে কৌরব বাহিনীর বহুসংখ্যক রাজা অর্জুনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন এবং তার ওপর বিভিন্ন ধরনের বিপুল সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করেন। কিন্তু অর্জুন বিশেষ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়ে তাদের সকল অস্ত্রশস্ত্র প্রতিহত করেন।

এদিকে শকুনির নেতৃত্বে গান্ধারের সৈন্যরা সাত্যকি ও অভিমন্যুকে ঘিরে ফেলে এবং গান্ধারের সৈন্যরা নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে সাত্যকির রথটিকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে। এরপর সাত্যকি তার ধ্বংসপ্রাপ্ত রথ থেকে নেমে অভিমন্যুর রথে আরোহণ করেন এবং তাদের দুইজনের তীরের আঘাতে গান্ধারের বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে, ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরের অধীনস্থ সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালান এবং তাদের তীরবৃষ্টির ফলে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। প্রত্যুত্তরে যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব দ্রোণাচার্যের অধীনস্থ সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালান এবং তাদের তীরবর্ষণের ফলে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়।

ভীম ও ঘটোৎকচ অনুরূপভাবে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্যকে হত্যা করেন এবং তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য দুর্যোধন তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর ভীমের তীরের আঘাতে দুর্যোধন সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন এবং দুর্যোধনের রথের সারথি দুর্যোধনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যায়। দুর্যোধনের পরাজয়ের পর তার অধীনস্থ সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে এবং ভীম তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য কৌরব সৈন্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন করে তাদেরকে পুনরায় যুদ্ধে লিপ্ত করার প্রচেষ্টা করেন, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এদিকে সাত্যকি ও অভিমন্যুর তীরের আঘাতে গান্ধারের সৈন্যদলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অর্জুন তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কৌরব বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন।

ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য তখনো কৌরব সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণ থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা সফল হচ্ছিল না। এমতাবস্থায় দুর্যোধন কৌরব সৈন্যদের উদ্দেশ্যে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা প্রদান করেন এবং তাদের পশ্চাৎপসরণ রোধ করেন। পশ্চাৎপসরণরত কৌরব সৈন্যদের মধ্যে যারা দুর্যোধনকে দেখতে পেয়েছিল, তারা তৎক্ষণাৎ থেমে যায় এবং তাদের দেখাদেখি বাকি কৌরব সৈন্যরাও থেমে পড়ে। দুর্যোধন পুনরায় তার সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। এই ঘটনা থেকে দুর্যোধনের নেতৃত্বসূচক গুণের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কৌরব সৈন্যদের ওপর দুর্যোধনের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত প্রভাব ছিল, কারণ ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্যের মতো অতি সম্মানিত রণনায়করা যেখানে পলায়নরত সৈন্যদেরকে থামাতে পারেননি, সেখানে দুর্যোধন তাদের থামিয়ে পুনরায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে সক্ষম হন।

চিত্রকর্মে দুর্যোধন (ডানে) এবং তার সৈন্যবাহিনী; Source: B. K. Mitra/Wikimedia Commons

কৌরব সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণ রোধ করার পর দুর্যোধন ভীষ্মের কাছে যান এবং মন্তব্য করেন যে, ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যের মতো যোদ্ধাদের উপস্থিতিতে কৌরব সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণ মোটেই শোভনীয় নয়। তিনি ভীষ্মকে পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের দায়ে অভিযুক্ত করেন এবং যোগ করেন যে, যুদ্ধের আগেই যদি ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য তাকে তাদের প্রকৃত মনোভাব জানিয়ে দিতেন, সেক্ষেত্রে তিনি কর্ণকে সঙ্গে নিয়ে পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করতেন। দুর্যোধন অনুরোধ করেন যে, ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্যের যদি তাকে পরিত্যাগ করার ইচ্ছা না থাকে, সেক্ষেত্রে তারা যেন তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ভীষ্ম মন্তব্য করেন যে, পঞ্চপাণ্ডবকে পরাজিত করা সম্ভব নয়, কিন্তু তিনি তার সামর্থ্য অনুযায়ী পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন।

এরপর ভীষ্মের নেতৃত্বে কৌরব সৈন্যরা আবার পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং উভয় পক্ষের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ভীষ্মের ব্যাপক তীরবৃষ্টির ফলে অসংখ্য পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয় এবং ভীষ্ম পাণ্ডব রথীদের নাম ধরে ডেকে ডেকে তাদেরকে হত্যা করতে শুরু করেন। পাণ্ডব সৈন্যরা ভীষ্মকে প্রতিহত করার জন্য জোরালো প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু তাতে কেবল তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে পাণ্ডব সৈন্যদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু পাণ্ডব সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। পরিস্থিতি দেখে কৃষ্ণ অর্জুনকে ভীষ্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন।

কৃষ্ণের উৎসাহে অর্জুন ভীষ্মের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। অর্জুনকে ভীষ্মের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে দেখে পাণ্ডব সৈন্যদের মধ্যে মনোবলের সঞ্চার হয় এবং তারা পশ্চাৎপসরণ বন্ধ করে পুনরায় যুদ্ধে লিপ্ত হতে শুরু করে। ভীষ্ম ও অর্জুনের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভীষ্মের তীরবৃষ্টির ফলে অর্জুন, কৃষ্ণ ও অর্জুনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ক্ষতবিক্ষত হয়, কিন্তু কৃষ্ণ দক্ষতার সঙ্গে অর্জুনের রথ পরিচালনা করতে থাকেন। এরপর অর্জুনের তীরের আঘাতে ভীষ্মের পরপর দুইটি ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু ভীষ্ম তৃতীয় একটি ধনুক উঠিয়ে অর্জুনের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কৃষ্ণ অত্যন্ত সুনিপুণভাবে অর্জুনের রথটিকে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে ভীষ্মের তীরবৃষ্টি থেকে অর্জুনকে রক্ষা করেন। এরপর ভীষ্ম আবার অর্জুনকে লক্ষ্য করে ব্যাপক তীরবর্ষণ করেন এবং তার তীরের আঘাতে অর্জুন ও কৃষ্ণ উভয়েই ক্ষতবিক্ষত হন।

এমতাবস্থায় কৌরব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা অর্জুনকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং অর্জুনকে সহায়তা করার জন্য সাত্যকির নেতৃত্বাধীনে পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারাও সেদিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু ভীষ্মের রুদ্রমূর্তিতে ভীত হয়ে পাণ্ডব সৈন্যরা আবার পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। সাত্যকি তাদের থামানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু এই পর্যায়ে কৃষ্ণ সাংঘাতিক ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, কারণ তিনি মনে করছিলেন যে, অর্জুন তার পূর্ণ শক্তিসামর্থ্য দিয়ে ভীষ্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন না। তিনি সাত্যকির উদ্দেশ্যে বলেন যে, যারা পশ্চাৎপসরণ করছে, তাদেরকে পশ্চাৎপসরণ করতে দেয়া হোক এবং যারা পশ্চাৎপসরণ করছে না, তাদেরকেও চলে যেতে দেয়া হোক, কারণ তিনি এখন নিজেই ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য ও তাদের অনুসারীদের হত্যা করতে যাচ্ছেন।

চিত্রকর্মে ভীষ্মকে হত্যা করা থেকে কৃষ্ণকে নিরস্ত করার জন্য অর্জুনের প্রচেষ্টার দৃশ্য; Source: Mahavir Prasad Mishra/ Wikimedia Commons

এই মন্তব্য করে কৃষ্ণ অর্জুনের রথ থেকে নেমে পড়েন এবং তার সুদর্শন চক্র হাতে ভীষ্মের দিকে ছুটে যান। কৃষ্ণকে চক্র হাতে ছুটে আসতে দেখে ভীষ্ম তার উদ্দেশ্যে মস্তক অবনত করেন এবং বলেন যে, কৃষ্ণের হাতে তার মৃত্যু হলে সেটি হবে তার জন্য মর্যাদার বিষয়। এই পরিস্থিতিতে অর্জুন রথ থেকে নেমে বহু কষ্টে কৃষ্ণকে নিরস্ত করতে সক্ষম হন এবং এরপর তিনি কৃষ্ণকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন যে, তিনি তার পূর্ণ শক্তিসামর্থ্য দিয়ে কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। এরপরই কেবল কৃষ্ণ অস্ত্র ছেড়ে পুনরায় অর্জুনের রথের সারথির আসনে বসেন এবং অর্জুন রথে চড়ে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করেন।

এরপর অর্জুনের অনন্যসাধারণ রণনৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। অর্জুনের তীরবৃষ্টির ফলে অসংখ্য কৌরব সৈন্য নিহত হয় এবং তাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে ভীষ্ম, ভুরিশ্রবা, শল্য ও দুর্যোধন একযোগে তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ভীষ্ম, ভুরিশ্রবা, শল্য ও দুর্যোধন যথাক্রমে অর্জুনকে লক্ষ্য করে একটি বিশেষ ধরনের তীর, ৭টি বল্লম, একটি গদা ও একটি বর্শা নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অর্জুন তীরের সাহায্যে তার উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত সবগুলো অস্ত্রকেই প্রতিহত করেন। এরপর অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে কৌরবদের বিরুদ্ধে মহেন্দ্রাস্ত্র প্রয়োগ করেন। এই দিব্যাস্ত্র প্রয়োগের ফলে হাজার হাজার তীর কৌরব বাহিনীর ওপর পতিত হতে থাকে এবং বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য এর ফলে নিহত হয়। এই অস্ত্র প্রয়োগের ফলে সৃষ্ট তীরবৃষ্টির আঘাতে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, দুর্যোধন, বাহ্লিক এবং অন্যান্য শীর্ষ কৌরব যোদ্ধারাও ক্ষতবিক্ষত হন।

মহাভারতে প্রদত্ত বিবরণ অনুযায়ী, অর্জুনের ব্যবহৃত মহেন্দ্রাস্ত্রের আঘাতে কৌরব বাহিনীর অন্তত ১০,০০০ রথী ও ৭০০টি হাতি নিহত হয়। এসময় সূর্যাস্ত হওয়ার উপক্রম হতে দেখে এবং বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে কৌরব সেনানায়করা যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করেন। এভাবে কৌরবদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তৃতীয় দিনের অবসান ঘটে।

Related Articles

Exit mobile version