ভূত চতুর্দশী: বাংলার হ্যালোউইন

নির্জন সন্ধ্যা, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া নেই কোনো শব্দ। কুপি বাতির আলোতে বাড়ির দাওয়ায় বসে একমনে মাছ ভাজছেন গৃহবধূ। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে মাছ উল্টানোর সময় তিনি খেয়াল করলেন না, কখন যেন বন্ধ হয়ে গেল ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, নেমে এলো নিস্তব্ধতা। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ নাকি স্বরে বলে উঠলো, ‘এঁকঁটাঁ মাঁছঁ দিঁবিঁ?’

নিশুতি রাতে হানা দেয় অশরীরীরা, Source: YouTube

শীতের অন্ধকার রাতে সব ভাইবোন মিলে দাদুর কাছে এমন সব ভূতের গল্প শোনার সৌভাগ্য এখনকার শিশুদের হয় না। এই গল্পের সঙ্গে হয়তো আজকালকার প্রজন্মের পরিচয়ই নেই। চার দেয়ালে ঘেরা শহুরে জীবনে সারাক্ষণই আমাদের চারপাশে নানা শব্দ, নীরব হয়ে ভূতের গল্প শোনার সময়ই বা কোথায়! এরই ফাঁকে কখন যেন আমাদের ভয় পাওয়ার উৎস হয়ে উঠেছে হ্যালোউইন নামের এক উৎসব। আমাদের শহরের শিশুদের শৈশবে হ্যালোউইন ছিল শুধু তিন গোয়েন্দার বইতেই সীমাবদ্ধ। দিনকে দিন মজার এই উৎসব জায়গা করে নিচ্ছে শহুরে বাঙালির ঘরে। ভ্যাম্পায়ার, ওয়্যারউলফ কিংবা ডাইনি ভূত সেজে অক্টোবরের শেষ রাতে পালন করা হচ্ছে এই উৎসব।

কিন্তু আপনি জানেন কি, মাত্র কদিন আগেই হয়ে গেল বাঙালি হ্যালোউইন? হ্যাঁ পাঠক, পশ্চিমাদের অনুকরণ করতে করতে নিজেদের ঘরের খবর রাখার সময় নেই আমাদের। এই ফাঁক দিয়েই হয়তো বাড়ি বাড়ি এসে নিরাশ হয়ে ফিরে গেলেন আমাদের নিজস্ব ভূতেরা!

কথা হচ্ছে তাদের নিয়ে, সন্ধ্যাবেলায় নাকি যাদের নাম মুখে নিতে নেই। যুগ পাল্টেছে, সূর্য ডোবার পর চুল খুলে মেয়েদের বাইরে যেতে আজ আর মানা করেন না মায়েরা। নগর জীবনে সবকিছু যান্ত্রিক হয়ে গেলেও, রাত বাড়ার সাথে সাথে যখন নীরব হয়ে যায় চারিদিক, তখন অশরীরী কারো আনাগোনা কি উড়িয়ে দেওয়া যায় এত সহজে?

ভূতদের দিন ভূত চতুর্দশী

ক’দিন আগেই হয়ে গেল দীপাবলি। অমাবস্যার রাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে আঁধার দূর করে মা কালীর পূজা দিলেন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীরা। দীপাবলি বা দিওয়ালির কথা আমাদের সবারই কমবেশি জানা আছে, কিন্তু অনেকেই জানেন না, দীপাবলির আগের দিনটিকে বলা হয় ‘ভূত চতুর্দশী’। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, এদিন রাতে পাতাল থেকে উঠে আসে ভূত-প্রেত ও অশরীরী আত্মারা!

কালীপুজোর আগের রাতে পালিত হয় ভূত চতুর্দশী, Source: Reuters

পশ্চিমে মিষ্টি কুমড়োর লন্ঠন, পূবে চৌদ্দ পিদিম

হ্যালোউইনের রাতে যেমন মিষ্টি কুমড়ো কেটে ভূতের মুখ বানিয়ে তাতে আলো জ্বালান পশ্চিমারা, তেমনই ভূত চতুর্দশীতে বাড়ির আনাচে-কানাচে জ্বালানো হয় প্রদীপ। হিন্দু পুরাণে আছে, এই দিন সন্ধ্যা নামার পরপরই বের হয় ভূত ও অশরীরী প্রেতাত্মারা। আর তাদের হাত থেকে বাঁচতে গৃহস্থের বাড়িতে জ্বালানো হয় চৌদ্দটি করে প্রদীপ।বলা হয়, কার্তিক মাসের চতুর্দশ তিথিতে দিনটি পালন করা হয় বলেই চৌদ্দটি পিদিম জ্বালানো হয়। বাড়ির প্রতিটি দরজার সামনে ও অন্ধকার কোণাগুলোতে রাখা হয় এই পিদিম।

ঘরে জ্বালানো হয় চৌদ্দটি করে প্রদীপ, Source: Reuters

কৃষ্ণপক্ষের রাতে প্রদীপগুলো জ্বালানো হয় পরলোকগত আত্মীয়স্বজন ও দেবতাদের উৎসর্গ করে, পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিত ‘প্রেত’ অতিথিদের তাড়ানোও থাকে অন্যতম উদ্দেশ্য। চৌদ্দ পিদিম নিয়ে নানা ধরনের গল্প আছে। কেউ কেউ বলেন, ভূত চতুর্দশীর রাতে নিজ বাড়িতে সফর করতে আসেন পরলোকগত চৌদ্দ পুরুষ। তাদের আসা আর যাওয়ার পথ আলো করে রাখতেই জ্বালানো হয় এই প্রদীপ। আবার এমনও শোনা যায়, এই দিনে ‘চামুণ্ডা’ রূপে চৌদ্দ ভূত দিয়ে ভক্তদের বাড়ি থেকে অশুভ শক্তি দূর করতে নেমে আসেন মা কালী। মাকে স্বাগত জানাতেই নাকি প্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা।

হিন্দু পুরাণে ভূত চতুর্দশী

ভূত চতুর্দশী নিয়ে পুরাণে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। তবে এর গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। ভূত চতুর্দশী নিয়ে পুরাণের গল্পটা এমন- দানবরাজ বলি যখন স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে নিলেন, তখন নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল। তার আক্রোশ থেকে পার পেলেন না দেবতারাও, মানুষ কী ছাই! বলির তাণ্ডব ঠেকাতে দেবগুরু বৃহস্পতি ভগবান বিষ্ণুকে একটি উপায় বাতলে দিলেন। বামনের ছদ্মবেশে তখন নেমে এলেন বিষ্ণু, তিন পা সমান জমি ভিক্ষা চাইলেন রাজা বলির কাছে।

দানবরাজ কিন্তু শুরুতেই বুঝেছিলেন এই বামন আর কেউ নন, স্বয়ং বিষ্ণু। কিন্তু এরপরও না বোঝার ভান করে বামনের পাল্লায় পড়ে ঠিকই রাজি হলেন চুক্তিতে। দুই পা দিয়ে স্বর্গ ও মর্ত্য দখল করে ফেললেন বিষ্ণু। এরপর নাভি থেকে বের হয়ে এলো আরেক পা, যা রাখলেন বলি রাজার মাথার উপর। সঙ্গে সঙ্গেই পাতালে নেমে গেলেন দানবরাজ বলি। সেই থেকে পাতালই হলো তার আবাস।

বিষ্ণুর আনুগত্য স্বীকার করছেন দানবরাজ বলি, Source: Wikimedia Commons

তবে জেনেশুনে জমি দান করায়, আর ভগবানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করায় বলির জন্য একটি বিশেষ সুবিধা রেখে দিলেন বিষ্ণু। প্রতি বছর মর্ত্যে, অর্থাৎ পৃথিবীতে তাকে পূজা দিবে মানুষ। সেই থেকে কালীপূজার আগের রাতে বলি রাজা পাতাল থেকে উঠে আসেন পূজা নিতে, তার সহচর হিসেবে থাকে শত সহস্র ভূত, প্রেতাত্মা এবং অশরীরী!

‘ট্রিক অর ট্রিট’ বাঙালি স্টাইল

‘ক্যান্ডি দাও নাহলে ভয় দেখাবো!’- হ্যালোউইনের ‘ট্রিক অর ট্রিট’ খেলার প্রচলন হয়েছে এভাবেই। আর ভোজনরসিক বাঙালির উৎসবে খাবার থাকবে না, তা কি হয়? এই দিনটি উপলক্ষে বিশেষ খাবার হিসেবে রান্না হয় চৌদ্দ শাক ভাজা। বলা হয়, কারও দেহে যেন এই প্রেতাত্মারা ভর করতে না পারে তাই চৌদ্দ রকমের শাক খেয়ে নিজেকে নিরাপদে রাখেন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীরা।

ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা ও শুষণী- এই চৌদ্দ রকমের শাক একসঙ্গে রান্না হয় সেদিন। চৌদ্দ শাক ধোয়ার জন্য যে পানি ব্যবহার করা হয়, সেই পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয় বাড়ির অন্ধকার কোণগুলোতে। আগেকার দিনে নাকি কালীপূজার আগের এই রাতে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে তান্ত্রিক সাধকরা ছোট ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে যেত মা কালীর উদ্দেশ্যে বলি দেওয়ার জন্য। সে কথা যাদের মনে আছে তারা আজও ভূত চতুর্দশীর রাতে সূর্য ডুবলে ছোটদের বাড়ি থেকে বের হতে বারণ করেন।

চৌদ্দ শাক ভাজা, Source: foodcooking-inspiration.in

দুপুরে চৌদ্দ শাক ভাজা খেয়ে, সন্ধ্যায় চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে, দরজায় চৌদ্দ ফোঁটা দেওয়ার এই রেওয়াজ বহুদিনের। যদিও আধুনিক যুগে এই রীতিতে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেন অনেকেই। হিন্দু পুরাণে থাকলেও ভূত চতুর্দশী একান্তই বাঙালির উৎসব বলা চলে। কারণ বাঙালি ছাড়া অন্য অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে ভূত চতুর্দশী উদযাপন করার প্রচলন তেমন নেই। দানবরাজ বলির পৃথিবী সফরকে কেন্দ্র করে উৎসব চলে ভারতের কেরালাতেও। তবে এই উৎসবে ভয়ের বদলে থাকে আনন্দ।

ওনাম উৎসব উপলক্ষ্যে চলছে নাচ-গান, Source: Reuters

ওনাম উৎসব উপলক্ষ্যে দশ দিন ব্যাপী কেরালাতে চলে নাচ-গান, ঘর সাজানো আর খাওয়াদাওয়া। কেরালাবাসী বিশ্বাস করে, বছরের একটি দিন পাতাল থেকে মহারাজ বলি আসেন তার প্রজাদের দেখতে, যাদের তিনি একসময় শাসন করতেন। তাই রাজার সফর উপলক্ষ্যে বিশাল আয়োজন করেন তারা। তবে অক্টোবরে নয়, ওনাম উৎসব হয় আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে।

হ্যালোইনের সঙ্গে ভূত চতুর্দশীর অনেক অমিল রয়েছে। যার মধ্যে একটি বড় অমিল হলো তারিখ। প্রতি বছর ঠিক ৩১ অক্টোবরই উদযাপন করা হয় হ্যালোউইন, অপরদিকে তারিখ নয় বরং তিথির হিসাব মেনে কালীপূজার ঠিক আগের দিন পড়ে ভূত চতুর্দশী। নানা ধরনের ভূত সেজে ভয় দেখানো এবং ভয় পাওয়ার জন্যই এত জনপ্রিয় হ্যালোউইন, এই রীতি নেই ভূত চতুর্দশীতে।

চৌদ্দ শাক ভাজা আর চৌদ্দ পিদিম জ্বালানোর পেছনে কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। বলা হয়, হেমন্ত কালের শুরুতে পোকার উপদ্রব দূর করে বাড়িতে জ্বালানো হয় চৌদ্দ পিদিম। আবার ঋতুর পরিবর্তনের কারণে এই সময়টা অসুখবিসুখ হয় বেশি, তাই চৌদ্দ রকমের শাক খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে বহুগুণ। গুণীজনদের বলা সেই বিশেষ চৌদ্দ রকমের শাক এখন আর পাওয়া না গেলেও, শত বছরের পুরনো রীতি আজও ধরে রাখার চেষ্টা চলে কোনো কোনো ঘরে, যদিও এর নজির একেবারেই হাতেগোনা।

ফিচার ইমেজ- Debasrita Sarkar/ Flickr

Related Articles

Exit mobile version