চলছে গ্রিস ও ট্রয়ের মধ্যকার রক্তক্ষয়ী তুমুল সংঘর্ষ। গ্রিকরা ট্রয় দখলের নেশায় ট্রয়ের মাটিতে আস্তানা গাড়ার পর পেরিয়ে গেছে পুরো নয়টি বছর। প্রয়াণ ঘটেছে গ্রিস ও ট্রয়ের দুই বীর যোদ্ধা অ্যাকিলিস ও হেক্টরের। দেবতাদের মধ্যকার কলহ ক্রমশ মোড় নিচ্ছে ভয়ংকর এক ধ্বংসযজ্ঞের দিকে।
জ্যোতিষ ক্যালচাস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, গ্রিস ও ট্রয়ের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটবে দশ বছর টানা যুদ্ধের পর। কিন্তু যুদ্ধ থামার কোনো নাম-গন্ধ নেই। দেবতাদের ইশারায় সে যুদ্ধে একদিন ট্রয় এগিয়ে থাকলে, পরের দিন এগিয়ে থাকে গ্রিস। যেন চলছে আলো-আঁধারির মধ্যকার লুকোচুরি খেলা। না গ্রিকরা তখন বিজয়মাল্য পরতে পেরেছে, না ট্রয়ীরা নিজ দেশ থেকে সরাতে পেরেছে বহিরাগতদের। যুদ্ধ যেন এক অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে, যেখানে যুদ্ধের গতিপথ কারো পক্ষে স্থায়ীভাবে অটল হবে না কখনো। রক্ত-রাঙা বিজয় সূর্য কার আকাশে উদিত হবে, সেটা দেবতারা ছাড়া কেউ জানে না।
গ্রিকদের কানে তখন নতুন এক ভবিষ্যদ্বাণীর হাওয়া ভেসে আসে, যেটা করেছে মহারাজ প্রিয়ামের পুত্র হেলেনাস। উল্লেখ্য যে, এই হেলেনাস যুদ্ধে গ্রিক যোদ্ধা অডিসিউস আর ডায়ামিডিসের হাতে বন্দি হয়েছিল। ভবিষ্যদ্বাণী খণ্ডায়ন করলে এ রকম অর্থ পাওয়া যায়, হেরাক্লিসের (হারকিউলিস) তীর-ধনুক ছাড়া ট্রয় বিজয় করা অসম্ভব। সেই অমোঘ অস্ত্র বর্তমানে রয়েছে ফিলোকটিটিসের কাছে, যাকে গ্রিক যোদ্ধারা নয় বছর আগে নির্লজ্জভাবে পাথুরে দ্বীপ লেমনসে পরিত্যাগ করে এসেছে।
কারণ, ট্রয় অভিযানে খাবার জল সংগ্রহ করার জন্য তারা লেমনস দ্বীপে নোঙর করলে, এক বিষাক্ত সাপ কামড়ায় ফিলোকটিটিসকে। সেই ক্ষত পচে একসময় সেখান থেকে বিকট দুর্গন্ধ সৃষ্টি হলে, বিবেকহীনতার পরিচয় দিয়ে তাকে সেখানে ফেলে চলে আসে তারা। পচা ঘা নিয়ে অবিরত যন্ত্রণায় নির্জন দ্বীপে নয়টি বছর পার করে ফিলোকটিটিস। অবিরত ক্রোধ ক্রমে দানা বেধে পরিণত হয় উন্মাদনায়।
ওদিকে নিজ দলের যোদ্ধার প্রতি এমন নির্দয় আচরণের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় আফসোস করতে লাগল সবাই। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, অডিসিউস আর নিওপটলেমাস লেমনস দ্বীপে উদ্ধার অভিযানে রওয়ানা দেবে। দ্বীপে পদার্পণের পর তারা ফিলোকটিটিসের কাছে গিয়ে দেখল, সে অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার কাছে সবিনয়ে সাহায্য চাইলো দুজন। কিন্তু দীর্ঘদিন বুকের মধ্যে গুমরে থাকা অসন্তোষের ফলে গ্রিকদের সহযোগিতা করতে মোটেও রাজি হয়নি সে। তখনই ঘটে গেল এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা, ফিলোকটিটিসের দিব্যদৃষ্টিতে প্রতিফলিত হলো স্বয়ং হেরাক্লিসের অবয়ব। তিনি আদেশ দিলেন, “শত্রুদের ক্ষমা করে দাও। এক মুহূর্ত দেরি না করে ট্রয়ের উদ্দেশ্যে তরী ভেরাও। সেখানে গ্রিক বৈদ্য ম্যাকাওনের চিকিৎসায় তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠবে।”
তাই, সাত-পাঁচ আর কিছু না ভেবে ট্রয় অভিমুখে রওনা হলো তিনজন। গ্রিক শিবিরে পৌঁছানোর পর আগামেমনন সহ অন্যান্য নেতারা তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনার পাশাপাশি যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত লুটের মালামাল বুঝিয়ে দিল। ধীরে ধীরে বৈদ্য ম্যাকাওনের সুচিকিৎসায় সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল। দৈববাণী অনুযায়ী, হেরাক্লিসের তীর-ধনুক নিয়ে যুদ্ধ-ময়দানে পা রাখল ফিলোকটিটিস। একে একে ধরাশায়ী করলো বহু ট্রয় যোদ্ধাকে। এমনকি যে প্যারিসকে কেন্দ্র করে এই ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে, সেও ভূপাতিত হলো ফিলোকটিটিসের শরাঘাতে। যদিও প্যারিস তখন মারা যায়নি, কিন্তু সে এমন গুরুতরভাবে জখম হলো, কোনো চিকিৎসাতেই তাকে সুস্থ করে তোলা গেল না।
উপায়ান্তর না দেখে, করুণার পাত্র হয়ে প্যারিস তার সাবেক পত্নী, আইডা পর্বতের পরী ইনোনির শরণাপন্ন হয়। কারণ, অসুখবিসুখ সারানোর সব রকম গাছ-গাছড়া চিনত সেই পরী। কিন্তু জিউস-কন্যা হেলেনের লোভে পড়ে, ইনোনিকে ত্যাগ করার পর থেকেই প্যারিসের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মায় ইনোনির। তাই প্যারিসের দূতেরা তার বর্তমান দুর্দশার কথা ব্যাখ্যা করলেও প্যারিসকে সে কিছুতেই সাহায্য করতে রাজি হয়নি।
এ কথা শোনার পর প্রচণ্ড বিমর্ষতা আচ্ছন্ন করে ফেলে প্যারিসকে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়, বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটাও যেহেতু সে হারিয়েছে, তাই শেষ নিঃশ্বাসটাও সে ট্রয়েই ত্যাগ করবে। ট্রয়ে নিজ প্রাসাদে ফিরে দুর্বলতার করাল গ্রাসে পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ল রাজকুমার প্যারিস। স্বাস্থ্য ক্রমশ ভেঙে পড়তে লাগল তার। এভাবেই বাঁচা-মরার সাথে লড়াই করতে করতে, একসময় পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় সে।
ওদিকে মনে ক্ষোভ পোষে রাখলেও, নিখাদ ভালোবাসার দরুন প্যারিসকে ফিরিয়ে দিয়ে গভীর অনুতাপে পুড়তে লাগলো ইনোনির অন্তর। তাই সে রওনা হলো ট্রয়ের প্রাসাদে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে এসে দেখে প্যারিসের নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে আছে ধবধবে পাথরে বাধাই করা রাজপ্রাসাদে। সে দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে, অব্যক্ত এক কান্না বুকে চেপে ছুরি দিয়ে নিজের প্রাণ জলাঞ্জলি দেয় পরী ইনোনি।
যার জন্য এত যুদ্ধ-বিগ্রহের সূচনা ঘটেছিল, সেই প্যারিসই আজ অতীত। অতীত হয়েছে অ্যাকিলিস, হেক্টরের মতো বীর যোদ্ধারাও। এবার হয়তো কিছুটা শান্তি আশা করেছিল সবাই। কিন্তু উন্মাদ গ্রিকরা টানা দশ বছর যুদ্ধ করার পর, এখন ট্রয়কে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুতেই তৃপ্ত হবে না। কিন্তু যুদ্ধে তারা কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। দেবতাদের তৈরি ট্রয়ের প্রাচীর ভেদ করে কোনো শত্রু ট্রয়ের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করতে পারবে না- হাজার বছর ধরে ভেসে চলা এই কিংবদন্তি মাথা নত এক করলো অডিসিউসের এক ধূর্ত কৌশলের সামনে। যার ফলে এক রাতেই পতন ঘটেছিল ট্রয় নগরীর, নির্বংশ হয়েছিল মহারাজ প্রিয়ামের বংশ।
কৌশলটির নীলনকশা এঁকেছিল গ্রিক বীর অডিসিউস। তার নির্দেশে গ্রিকরা নিখুঁতভাবে বিশাল এক কাঠের ঘোড়া নির্মাণ করে, যেটা পরবর্তীতে ইতিহাসে ‘ট্রোজান হর্স’ হিসেবে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নেয়। সেই ঘোড়ার শরীর ছিল ফাঁপা, এবং জনা-বিশেক লোক সেখানে লুকিয়ে থাকার মতো জায়গা বরাদ্দ ছিল। তখন নিওপটলেমাস, অডিসিউস, ডায়োমিডিস-সহ গ্রিসের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন বীরযোদ্ধা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেই ঘোড়ার ভিতর ঢুকে গা ঢাকা দিলো। পুরোটাই ছিল সাজানো এক সুকৌশল, যার ফলে হয় তারা মরবে, না হয় ট্রয় দখল করবে।
নাটকের অংশ হিসেবে, আগামেমনন সমস্ত গ্রিক বাহিনী নিয়ে ট্রয় ত্যাগ করল। অর্থাৎ তারা বুঝাতে চাইল, যুদ্ধ করতে করতে তারা খুব ক্লান্ত, ট্রয়বাসীদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আর কোনো ইচ্ছা নেই তাদের। কিন্তু আদতে তারা ট্রয় থেকে বারো মাইল দূরে টেনেডোস দ্বীপে আশ্রয় নিল। সকালবেলা উঠে ট্রয়বাসীরা যখন দেখল, গ্রিকরা তাদের রাজ্য ছেড়ে চলে গেছে, তখন তারা সে ভাবনাই ভাবল, যেটা গ্রিকরা তাদের ভাবাতে চেয়েছিল।
দীর্ঘ দশ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের খোলস থেকে বের হতে পারার আনন্দে পুরো ট্রয় তখন আনন্দের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। সবাই আনন্দ-উল্লাসের পাশাপাশি দেবতাদের প্রতি নিজ শ্রদ্ধা-ভক্তি একেবারে উজাড় করে দিতে থাকল। কিন্তু হঠাৎ তাদের সে আনন্দে বাগড়া দিল গ্রিকদের তৈরি বিশাল কাঠের ঘোড়াখানা। মনে নানারকম জল্পনা কল্পনা সৃষ্টি হবার পাশাপাশি, এটা নিয়ে বেশ কৌতূহল জন্মাল। অনেকে বলতে লাগলো, ঘোড়াটাকে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হোক নয়তো জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে ফেলা হোক। আবার কেউ কেউ মতামত দিলো, বিজয়-স্মারক হিসেবে এটাকে নগরীতে রেখে দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ঘোড়াটাকে নগরীতে নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা যারা করেছিল, তাদের মধ্যে অ্যাপোলো মন্দিরের পুরোহিত লাওকুন ছিল অন্যতম। সে বলল, “হে ট্রয়বাসীগণ, তোমাদের মস্তিষ্ক কি ভোঁতা হয়ে গেছে? টানা দশ বছর ধরে যারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেল, তারা এত সহজে চলে যাবে সেটা কীভাবে তোমরা বিশ্বাস করো? অডিসিউস আর ডায়োমিডিস কি এতই বোকা নাকি? আমার মনে হয়, এই ঘোড়া নির্মাণ করা হয়েছে প্রবঞ্চনার উদ্দেশ্যে। তারা হয়তো এটা একটা টোপ হিসেবে রেখে গেছে, যে ফাঁদে পা দিলেই ভয়াবহ বিপদ ঘটতে পারে। তাই, এটাকে পুড়িয়ে ফেললেই ভালো হবে।“
কিন্তু পুরোহিতের কথায় কর্ণপাত করল না কেউ। তখন ভীর ঠেলে বেরিয়ে এলো সাইনন নামে অতি সাধারণ এক লোক। এই সাইননকে গ্রিকরা লোভ দেখিয়ে বলেছিল, সে যদি ট্রয়ীদের কাছে একটা গল্প বানিয়ে বলতে পারে, তাকে অঢেল পুরষ্কার দেয়া হবে- যা তার চৌদ্দপুরুষ পর্যন্ত বসে বসে খেতে পারবে। পুরষ্কারের লোভে ট্রয়ি শান্ত্রীদের কাছে আত্মসমর্পণ করল সাইনন। গ্রিকদের শেখানো বুলি আওড়াতে শুরু করল সে। বলল, “গ্রিক বীর অডিসিউসের সাথে আমার চরম দ্বন্দ্ব থাকায়, অডিসিউস আমাকে নির্বিচারে হত্যার ফন্দি এঁটেছিল। তাই, প্রাণ বাঁচাতে গ্রিকদের হাতে থেকে পালিয়ে আপনাদের কাছে এসে ধরা দিতে হলো। এই ঘোড়াটা বানানো হয়েছিল দেবী আথেনিকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। আপনারা যদি এই ঘোড়াকে রক্ষা করেন, তবে আথেনি রক্ষা করবেন আপনাদেরকে। এবং আথেনির আশীর্বাদের আপনারা একদিন গ্রিস জয় করতে পারবেন।“
কাঁদো-কাঁদো চেহারা ও মিনতি ঝরা কণ্ঠে রস মিশিয়ে সে এমনভাবে কাহিনীটা উপস্থাপন করল, সকলের হৃদয় তাতে বরফের মতো গলে গেল। সবাই বেদবাক্যের মতো বিশ্বাস করল তার কথা। কিন্তু ট্রয় নগরীর পতন তো লেখা হয়ে গেছে অনেক আগেই, তাই দেবরাজ জিউসও তার প্রিয় ট্রয় নগরীকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন না। উল্টো দেব-দেবীদের দিয়ে দিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা। যারা ট্রয় নগরী ও প্রিয়ামকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করতেন, তারা ধ্বংসলীলায় শামিল করলেন নিজেকে। ট্রয়কে যেসকল দেব-দেবী ক্রূর দৃষ্টিতে দেখতেন, তাদের মধ্যে সমুদ্র-দেবতা পসেইডন ছিল অন্যতম। তিনি সমুদ্র থেকে দেও-দানব পাঠাতে লাগলেন যাতে লাওকুনের নিষেধাজ্ঞায় সবাই সন্দেহ পোষণ করে।
পুরোহিত লাওকুন তখন দুই ছেলেকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে অঞ্জলি দিতে ব্যস্ত। এমন সময় পসেইডনের নির্দেশে রক্ত-লাল ফণা তুলে সমুদ্রের বুক চিড়ে কূলের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল বিশাল বড় দুটো সাপ। তারপর পেঁচিয়ে ধরে মেরে ফেলল পুরোহিতের দুই ছেলেকে। নিজ সন্তানদের বাঁচাতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন পিতা নিজেও। সাপ দুটো পুরোহিতকে মারার পর ট্রয় নগরীর ভেতরে দেবী আথেনির মন্দিরে আশ্রয় নিল।
সকলেই হকচকিয়ে গেলো। ভাবল, দেবীকে উৎসর্গীকৃত নৈবেদ্যকে অপমানের চরম শাস্তি পেতে হয়েছে পুরোহিতকে। তাই, সকলেই হাত লাগিয়ে ঘোড়াটাকে টেনে ভেতরে আনার জন্য উদ্বুদ্ধ হলো। ঘোড়ার গলায় বাঁধা হলো ইয়া মোটা রশি, শুরু হলো টানা। অথচ তারা একটুও জানত না, এই নির্বুদ্ধিতা তাদের ধ্বংস ডেকে আনতে যাচ্ছে। এভাবেই গ্রিসের শ্রেষ্ঠ-যোদ্ধারা কৌশলের আশ্রয়ে নিরেট পাথরে নির্মিত দুর্ভেদ্য সেই দেয়াল ভেদ করতে সক্ষম হয়।
ঘোড়াটা এতই বিশাল ছিল যে, সেটা বার বার প্রাচীরের দরজায় ঠেকে যাচ্ছিল। তাই তারা প্রাচীরের খানিকটা অংশ ভেঙে বড় করে ফেলল প্রধান ফটক। নগরী ধ্বংসের সর্বশেষ ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে ক্যাসান্ড্রা অবহিত করেছিল সবাইকে। প্রিয়াম কন্যা ক্যাসান্ড্রাকে ভবিষ্যৎ গণনার বর দান করেছিলেন দেবতা অ্যাপোলো। কিন্তু ক্যাসান্ড্রা একসময় দেবতার সঙ্গে প্রতারণা করে বসলে, কঠোর আক্রোশে ফেটে পড়েন তিনি। বর একবার দান করলে তা আর ফিরিয়ে নেয়া যায় না, তাই তিনি সে বরকে অকেজো করে দিলেন। ক্যাসান্ড্রা যাদেরকে ভবিষ্যদ্বাণী শোনাত, দেবতা অ্যাপোলো তাদের মনে বুনে দিতেন অবিশ্বাসের বীজ। ফলে তার ভবিষ্যদ্বাণী আর কেউ বিশ্বাস করত না। কাজেই, ক্যাসান্ড্রা যখন শেষবারের মতো ট্রয়ের পতন সম্পর্কে অবহিত করল, কেউ তা তোয়াক্কাই করল না।
সোল্লাসে ট্রয় প্রাচীরের ভেতরে নিয়ে রাখা হলো ঘোড়াটিকে। দেবীর আশীর্বাদে সবার জীবনে নেমে আসবে অফুরন্ত আনন্দ ঢল, এই ভেবে অনেক রাত পর্যন্ত পান-ভোজন ও উল্লাসধ্বনি চলল। যেখানে দেবী নিজে তাদেরকে সুরক্ষা দিচ্ছেন, সেখানে মরণশীল মানুষ তাদেরকে কিছু করতে পারবে না; এই ভেবে প্রাচীরের কাছে বা উপকূলে কোনো সান্ত্রী মোতায়েন করা হলো না। ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলল প্রহর। সারাদিনের উল্লাস পরিশ্রমে চোখ মুদে এলো সহসা, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সবাই।
নিস্তব্ধ ট্রয় নগরী তখন তাদের চিরশত্রু গ্রিকদের একেবারে হাতের মুঠোয়। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। মাঝেমধ্যে কারও নাক ডাকার ঘোঁতঘোঁত শব্দ ভেসে আসছে। ধূর্ত সাইনন তখন ধীর কদমে কাঠের ঘোড়াটার কাছে গিয়ে সুকৌশলে বসানো পেরেক খুলে কাঠগুলো আলগা করে নিল। গ্রিকদের গায়ে চাঁদের ফুটন্ত আলো পড়তেই একে একে ঘোড়া থেকে বেরিয়ে এলো সবাই।
ওদিকে আগামেমননও তার নৌবহর নিয়ে পৌঁছে গেল সুপরিচিত ট্রয় নগরীর উপকূলে। গুটি গুটি পায়ে, চোখ-কান খোলা রেখে নিঃশব্দে সমতলভূমির উপর দিয়ে এগিয়ে চলল তারা। প্রধান ফটকের কাছে এসে অপেক্ষা করতে লাগল সকলে। অডিসিউস, ডায়োমিডিসরা নগর-প্রাচীরের দরজা খুলে দিলে নগরীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল গ্রিক সৈন্যরা। শুরু করে দিল হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ। ট্রয়ীরা কিছু বুঝার আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হলো তাদের। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কেউই রক্ষা পেল না তাদের জ্বলতে থাকা ক্রোধের হাত থেকে। বিশাল বিশাল অট্টালিকায় লাগা আগুন গিয়ে ঠেকল আসমানের চুড়ায়। দাও দাও করে জ্বলতে থাকা আকাশচুম্বী আগুনের লেলিহান শিখা যেন দেবতাদের আরশ ভেদ করে চলে যাবে।
পুরো ট্রয়ের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল পতনের জ্বলন্ত দাবানল, একপাশ থেকে অন্যপাশে ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তের মধ্যেই। সুদীর্ঘকাল ধরে চলা এই যুদ্ধ গ্রিকদের মনে এতটাই ঘৃণা, তিক্ততা, নিষ্ঠুরতা ও বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছিল যে, ট্রয়ের ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র মানুষদেরও জবাই করা হলো। প্রহরীদের খণ্ডিত মাথায় লুটিয়ে গেল ধুলোয়। তাদের টকটকে লাল চোখে জ্বল জ্বল করছিল প্রতিহিংসার অনল।
দেবতাদের ছলাকলা, কূটবুদ্ধি, হিংসা ও ট্রয়বাসীদের মূর্খতার দরুন এক রাতেই পতন ঘটল হাজার বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ বিখ্যাত ট্রয় নগরীর।