হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড তার ‘ক্লিওপেট্রা’ বইতে ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন এভাবে,
ক্লিওপেট্রার মুখটা না গোলাকার, না লম্বাটে, বরং দুটোর মাঝামাঝি। ঠোঁট দুটো গোলাপের পাঁপড়ির মতো- টকটকে লালও নয়, আবার কিছু কমও নয়। নাকটা সরু, লম্বা; ঠিক যতটুকু হলে অপূর্ব সুন্দর চেহারার সাথে মানানসই হয়। কপালটা ঢালু, চওড়া। ধনুকের মতো বাঁকানো ভ্রু, লম্বা, বাঁকা পাঁপড়িগুলো মায়াময় চোখগুলোকে পাহারা দিচ্ছে সুদক্ষ প্রহরীর মতো। এত নীল সে দু-চোখের মণি, মনে হয় যেন আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল এক হয়েও হারাতে পারবে না সেই গাঢ়ত্বকে।
শুধু স্যার হেনরি রাইডারই নয়, শেক্সপিয়ার থেকে শুরু করে অনেক লেখক ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যকে বর্ণনা করেছেন অতুলনীয় রূপে।
সেই প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত যত রূপসী নারীর কথা ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে মিশরের সৌন্দর্যের রানী ক্লিওপেট্রার নাম সগৌরবে জ্বলজ্বল করছে। শুধু সৌন্দর্য নয়, বুদ্ধিমত্তায়ও তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
তাহলে কে এই ক্লিওপেট্রা, যার জন্য রচিত হয়েছে এত শত কাহিনী? চলুন জেনে নেওয়া যাক তার জীবন সম্পর্কে।
ক্লিওপেট্রা সপ্তম থিয়া ফিলোফেটর ছিলেন মিশরের একজন রানী এবং প্রাচীন মিশরের শেষ ফারাও। তার জন্মের আগেও ছয়জন ক্লিওপেট্রা ছিলেন, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তার মতো জায়গা করে নিতে পারেননি কেউই। গ্রীক শব্দ kleos এবং pater থেকেই ক্লিওপেট্রা নামের জন্ম, যার অর্থ হলো ‘গ্লোরি অফ দ্য ফাদার’। খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষ প্রথম টলেমি ছিলেন আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের অন্যতম সেনাপতি, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালে আলেক্সান্ডার মারা গেলে টলেমি বংশের প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
রানী সপ্তম ক্লিওপেট্রা যেমন ছিলেন সৌন্দর্যে অতুলনীয়, তেমনি তার জীবন ছিল নাটকীয়তায় ভরপুর। তার পিতা, রাজা দ্বাদশ টলেমি মারা যাওয়ার পর তার দুই সন্তান ত্রয়োদশ টলেমি এবং সপ্তম ক্লিওপেট্রার মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেন। তৎকালীন নিয়মানুসারে, ক্লিওপেট্রা তার ভাই ত্রয়োদশ টলেমিকে বিয়ে করেন এবং একসাথে মিশর শাসন করতে থাকেন।
বিয়ের পর ক্লিওপেট্রা ও তার ভাইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক সুখকর ছিল না। তাছাড়া তখনকার মিশরের অবস্থা ছিল বিশৃঙ্খল। টলেমি ষড়যন্ত্র করে ক্লিওপেট্রাকে মিশর থেকে বিতাড়িত করে একাই রাজ্য শাসন করতে থাকেন। ধারণা করা হয়, ক্লিওপেট্রা তখন তৎকালীন সিরিয়ায় পালিয়ে যান নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য। তিনি সিরিয়ায় গিয়ে সৈন্য যোগাড় করতে থাকেন, যাতে হারানো সিংহাসন পুনরুদ্ধার করা যায়।
ক্লিওপেট্রা ও জুলিয়াস সিজার
খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ সাল; রোমান সাম্রাজ্য গৃহযুদ্ধে লিপ্ত রাজা জুলিয়াস সিজার এবং বিদ্রোহী সেনাপতি পম্পেইয়ের সাথে। বিদ্রোহী সেনাপতি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেল তৎকালীন মিশরের রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়ায়। মিশরের শাসক হিসেবে তখন সিংহাসনে ছিলেন ক্লিওপেট্রার ভাই ত্রয়োদশ টলেমি। তার হুকুমেই ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় পরাজিত সৈনিক পম্পেইকে।
এর কিছুদিন পরেই জুলিয়াস সিজার তার বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে রওনা হন মিশর দখলের জন্য। মিশরের সম্রাট টলেমি সিজারকে বাধা দিলেও জিততে পারলেন না। ক্লিওপেট্রা পুরো ঘটনার ওপর নজর রাখছিলেন। তিনি যখন দেখলেন, রাজা জুলিয়াস সিজার মিশর দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তিনি বুঝতে পারলেন, এটি তার জন্য বিশাল একটি সুযোগ। ক্লিওপেট্রা বুঝে গিয়েছিলেন, জুলিয়াস সিজারের দরকার মিশরের ধন-সম্পদ, আর তার দরকার ছিল মিশরের সিংহাসনের ক্ষমতা।
তাছাড়া জুলিয়াস সিজার ছিলেন রোমান সাম্রাজ্যর একক অধিপতি। ক্লিওপেট্রা যদি তাকে পাশে রাখতে পারেন, তাহলে তার সৈন্য বাহিনীর সাহায্যে সহজেই ভবিষ্যতে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন। রানী ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য এবং বুদ্ধিমত্তায় জুলিয়াস সিজার অভিভূত হয়ে তাকে পূর্ণ সমর্থন দেন এবং ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেন। সিজার রানীর প্রেমিক হিসেবেই প্রতীয়মান হন এবং মিশরের নিয়মনীতি এবং পুরোহিতদের প্রতি সম্মানার্থে ক্লিওপেট্রা তার ভাই চতুর্দশ টলেমিকে বিয়ে করেন। এই বিয়ে স্থায়ী হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৪-৪৭ পর্যন্ত।
সেই সময়ে ক্লিওপেট্রা তার প্রেমিক জুলিয়াস সিজারের এক ছেলের জন্ম দেন, যদিও জুলিয়াস সিজার প্রকাশ্যে কখনোই তাকে ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজারের আমন্ত্রণে ক্লিওপেট্রা তার ছেলে ও স্বামীসহ রোম ভ্রমণে যান। এ সময় ক্লিওপেট্রার প্রতি সিজারের মুগ্ধতা রোমান রাজনীতিকদের পছন্দ হয়নি। তারা সিজারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালে রোমে অবস্থানকালেই সিজারকে হত্যা করা হয়। এই হত্যায় ক্লিওপেট্রা চিন্তিত হয়ে পড়েন, কারণ সিজার ছিলেন তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার একটি অস্ত্র। তাছাড়া জুনিয়র সিজার ভবিষ্যতে রোমের রাজা হবে, এমন স্বপ্নই দেখতেন রানী।
রাজা অ্যান্টনির আগমন
জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পরও থেমে থাকেনি রানী ক্লিওপেট্রার ক্ষমতার মোহ। সৌন্দর্য দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়াসে আর সিংহাসনে নিজের আসন পাকাপোক্ত করার জন্য তিনি এবার কাজে লাগাতে চাইলেন আরেক রোমান শাসক অ্যান্টনিকে। অ্যান্টনি ছিলেন রাজা জুলিয়াস সিজারের পরবর্তী রোমান শাসক। জুলিয়াসের মৃত্যুর পর রোমান সাম্রাজ্য তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যেহেতু রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতা চলে যায় তিনজন শক্তিশালী ব্যক্তির হাতে, যারা প্রত্যেকেই জুলিয়াস সিজারের জায়গা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে পড়েন। এই তিনজনের মধ্যে একজন ছিলেন অক্টোভিয়ান, যিনি ছিলেন সিজারের ভাইপো, আরেকজন ছিলেন মার্ক অ্যান্টনি এবং মার্কাস লেপিডাস। ত্রিধাবিভক্ত এই সাম্রাজ্যের একভাগ ছিল পূর্ব মেডিটেরিয়ান অঞ্চল, যার মধ্যে মিশরও ছিল।
যদিও মার্ক অ্যান্টনির ক্ষমতার মধ্যেই ছিলেন মিশরে, তবুও মিশর শাসনের জন্য ক্লিওপেট্রার সম্মতি দরকার ছিল তার। অ্যান্টনির ধারণা ছিল, যদি তিনি জোর করে মিশর দখল করতে চান, তাহলে ক্লিওপেট্রা হয়তো তার শত্রুদের সাহায্য করতে পারে। অপরদিকে মিশরের ধন-সম্পদ দরকার ছিল, তাই তিনি ক্লিওপেট্রার সাথে সমঝোতায় আসার একটি উপায় খুঁজছিলেন। অ্যান্টনির পক্ষ থেকে রাজদূত ক্লিওপেট্রার জন্য চিঠি নিয়ে গেলেও তিনি কোনো জবাব দেননি। কারণ তিনি ভালো করেই জানতেন, অ্যান্টনি তখন মুখিয়ে আছেন তার সাথে দেখা করার জন্য। তিনি অপেক্ষায় ছিলেন নিজের দাবি-দাওয়া পেশ করার একটা সুযোগের।
ক্লিওপেট্রার প্রয়োজন ছিল আরেকজন রোমান শাসকের, যিনি তাকে সাহায্য করবেন তার শত্রুদের ঘায়েল করতে। এত কিছুর পরেও যখন ক্লিওপেট্রা কোনো উত্তর দিলেন না, মার্ক অ্যান্টনি তখন আদেশ করলেন, ক্লিওপেট্রাকে তার প্রাসাদে দেখা করার জন্য। ক্লিওপেট্রা এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনিও আদেশ দিলেন সফরের জন্য নৌকা প্রস্তুতের।
বিশেষ সেই নৌকা প্রস্তুত হলো। নৌকাটি যেন কোনো ভাসমান প্রাসাদ ছিল। স্বর্ণনির্মিত, মুক্তাখচিত নৌকায় সিডনাস নদী পাড়ি দিয়ে রোমে যাচ্ছিলেন ক্লিওপেট্রা। নৌকার পালগুলো ছিল মূল্যবান সিল্কে বোনা। নৌকা যখন বাওয়া হচ্ছিল, তখন সুমধুর শব্দে চারদিক ভরে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কোনো বংশীবাদক তার সুরেলা বাদ্য বাজাচ্ছে। ক্লিওপেট্রা নিজে পরেছিলেন গ্রীকদের প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির মতো মোহনীয় পোশাক, যার প্রতি ভাঁজে ভাঁজে ছিল প্রেম কিংবা কামের লেলিহান শিখা। রাজা অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রাকে তার প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানালেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং দূত মারফত অ্যান্টনিকে তার ভাসমান রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানায়। ক্লিওপেট্রা চাইছিলেন সাক্ষাতের সময়টা যথাসম্ভব মোহময় করে তুলতে।
রাজা অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যের কীর্তন আগেই শুনেছিলেন লোকমুখে। কিন্তু তিনি যখন তার সামনে এসে দাঁড়ালেন, মনে হলো যেন খোদ প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি তার সামনে। সোনার পোশাকে মোড়া যেন কোনো স্বপ্নপুরী থেকে আগত মানবী, যিনি তার মনের মধ্যে প্রেমের জোয়ার এনে দিলেন। ধারণা করা হয়, ক্লিওপেট্রা ও রাজা অ্যান্টনি একে অপরকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলেন। ক্লিওপেট্রার এই কৌশলটিও কাজে লেগেছিল, অ্যান্টনি তার প্রেমে পাগল হয়ে তার সাথে আলেক্সান্দ্রিয়ায় বেশ অনেকটা সময় কাটালেন।
এ সময় অ্যান্টনি তার শত্রুদের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছলেন। এদিকে রোমানদের পছন্দ ছিল না ক্লিওপেট্রা এবং রাজা অ্যান্টনির এই সম্পর্ক। তারা অ্যান্টনির শত্রুদের সাথে মিলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঘোষণা দেয়। যদিও অ্যান্টনি চাচ্ছিলেন এই যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে, কিন্তু ৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইতিহাসখ্যাত সেই অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধ লেগেই যায় রাজা অ্যান্টনি আর রোমান সামাজ্যের অন্যান্য শাসকের মধ্যে।
এই যুদ্ধের মধ্যেই একটি গুজব ছড়ানো হয় যে, ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেছেন। প্রেয়সীর মৃত্যুর খবর শুনে রাজা অ্যান্টনি ভেঙে পড়েন, এবং তলোয়ারের আঘাতে নিজের জীবন শেষ করে দেন। তাছাড়া তখন যুদ্ধের অবস্থাও বেশ নাজুক ছিল। রাজা অ্যান্টনির পরাজয় ছিল নিশ্চিত। রাজার মৃত্যুর পর যুদ্ধে বিজয়ী হন রোমান সাম্রাজ্যের আরেক অধিপতি অক্টাভিয়ান।
অক্টাভিয়ান মিশর দখল করে নেন। এদিকে ক্লিওপেট্রা শোকে পাথর হয়ে ছিলেন, একে তো অ্যান্টনির মৃত্যু, আরেকদিকে পরাজয়ের লজ্জা। তখন তিনি বিভিন্ন উপায়ে আত্মহত্যা করতে চাইলেও পারেননি, কারণ অক্টাভিয়ানের সৈন্যরা তাকে পাহারায় রেখেছিল।
কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সাল; বন্দী ক্লিওপেট্রা বিষাক্ত মিশরীয় গোখরা সাপের (অ্যাম্প নামক এই সাপ লম্বায় কয়েক ইঞ্চি হলেও খুবই বিষাক্ত। কথিত আছে- এই সাপ তার কাছে ডুমুরের ঝুড়িতে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়) কামড়ে আত্মহত্যা করেন। অনেকের মতে, ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেননি, বরং খুন হয়েছিলেন। ইতিহাসবিদদের মতামত ভিন্ন হলেও একসময়ের ক্ষমতাধর রানীর যে করুণ পরিণতি হয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।