যুগে যুগে নানা জাতি নানাভাবে তাদের ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবী ও মানুষ সৃষ্টির বিভিন্ন গল্পের অবতারণা করেছে। চমকপ্রদ এমন কয়েকটি কাহিনী নিয়ে পাঁচ পর্বের এই সিরিজের অবতারণা। আর কথা না বাড়িয়ে চলুন জেনে আসা যাক জানা-অজানা সেসব সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েই।
জরথুস্ত্রবাদ
বলা হয়, চার হাজার বছর আগে পার্সিয়াতে আবির্ভাব ঘটে এ ধর্মবিশ্বাসের। মুসলমানদের হতে সাসানিদ সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত পার্সিয়ার মূল ধর্ম ছিল জরথুস্ত্রবাদ। জরোস্টার নামের এক ব্যক্তি এর প্রবর্তন করেন। তার কথামালা নিয়ে সাজানো হয়েছে ‘আভেস্তা’, যা প্রাচীন এই ধর্মাবলম্বীদের মূল গ্রন্থ।
জরোস্টারের সময়ের বিষয়টি নিয়ে প্রচুর মতভেদ আছে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, তিনি বিখ্যাত পার্সিয়ান সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেটের সমসাময়িক, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে রাজত্ব করেছিলেন। তবে অন্য এক দল মনে করেন, জরোস্টার তার থেকে অনেক আগের, সম্ভবত ১৫০০-১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। পার্সিয়ান সৃষ্টিগাথা তার জবানিতেই বর্ণনা করে হয়েছে।
আহুরা মাজদা ও আংগ্রা মাইনু
মহাবিশ্বে বিরাজমান দুই বিপরীত অস্তিত্ব। একদিকে অনন্ত আলো, যা পরিপূর্ণ শুদ্ধতা আর মঙ্গলের প্রতীক। এর মধ্যেই বাস করেন আহুরা মাজদা (জ্ঞানী প্রভু)। তিনি হরমুজাদ নামেও পরিচিত। তার পরিচ্ছদ তারকাখচিত আলখাল্লা। স্বর্গের সর্বোচ্চ শিখরে তার সিংহাসন। কোনোকিছুই তার জ্ঞানের বাইরে নয়। চাঁদ, সূর্য, তারা- সবই তার ইচ্ছাধীন। অপরদিকে নিঃসীম অন্ধকারে রাজত্ব করছেন আংগ্রা মাইনু, তবে ‘আহরিমান’ নামেই তিনি সুপরিচিত। ধ্বংস আর বিশৃঙ্খলাই তার প্রধান কাজ। আহরিমান আহুরা মাজদার কথা না জানলেও, আহুরা মাজদা কিন্তু আহরিমানের কথা জানতেন।
বহুকাল পরে এক সময় কী মনে করে আহরিমান অন্ধকার থেকে উঁকি দিলেন। তিনি দেখতে পেলেন আলোর ছটা, দেখতে পেলেন গ্রহ-নক্ষত্র। আহুরা মাজদার অস্তিত্ব জানতে পেরে আহরিমান তার চরিত্র অনুযায়ী চাইলেন তাকে ধ্বংস করতে। তিনি আহুরা মাজদাকে লড়াইয়ের ডাক দিলেন। আহুরা মাজদা তাকে শান্ত করতে চাইলেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হলো। আহরিমান মনে করল আহুরা মাজদা দুর্বল, তাই তিনি আরো বেশি করে যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠলেন।
শেষ পর্যন্ত আহুরা মাজদা আহরিমানের সাথে এক নির্দিষ্ট সময় ধরে লড়াইয়ের ফয়সালা করলেন। আহুরা মাজদা এ পর্যায়ে সসীম সময়ের সৃষ্টি করেন। ১২ হাজার বছরের পরিসর নির্ধারিত হলো শুভ আর অশুভের সংঘাতের জন্য। বলা হয়, এর প্রথম তিন হাজার বছর আহুরা মাজদা বিভিন্ন সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন, দ্বিতীয় তিন হাজার বছর তার অধীনে সবকিছু সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে থাকে। তৃতীয় তিন হাজার বছর জুড়ে চলছিল আহরিমানের তাণ্ডব, আর শেষ তিন হাজার বছর আহরিমানের পরাজয়।
যা-ই হোক, আহুরা মাজদা প্রস্তুতি নিলেন। যুদ্ধের পূর্বে তিনি জরথ্রুষ্টবাদের পবিত্র প্রার্থনা আহুনা ভার পাঠ করলেন। এদিকে তার প্রার্থনা শুনে আহরিমানের ভুল ভাঙল। তিনি বুঝতে পারলেন, আহুরা মাজদা তার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। ফলে, আহরিমান পালিয়ে গেলেন তার রাজ্যে, সেখানে তিনি তিন হাজার বছর অচেতন হয়ে পড়ে থাকেন।
আহুরা মাজদার সৃষ্টি
আহুরা মাজদা জানতেন, আহরিমানের সাথে সংঘর্ষ একসময় হবেই। তিনি কাজে হাত দিলেন। ইচ্ছার শক্তিতে তিনি সৃষ্টি করলেন ছয় অবিনশ্বর সত্ত্বা। এরা হলেন ভহু মানাহ (সুচিন্তা), আশা ভাহিস্তা (নীতিপরায়ণ), স্পেন্টা আরমাইতি (ভক্তি), খাস্থ্রা ভারিয়া (উদার ক্ষমতা), হরভাটাট (নির্মলতা) এবং আমেরাটাট (অমরত্ব)। আহুর মাজদা আর তার ছয় অবিনশ্বর- এই সাতজনকে বলা হয় ‘আমেশা স্পেন্টা’। জরথুস্ত্রবাদের মূল ভিত্তি এদেরকে ঘিরেই। এদের পর আহুরা মাজদা বানালেন ইয়াজাটাদের। এরা সংখ্যায় বহু, এবং তাদের পদমর্যাদা ঠিক ছয় অবিনশ্বরের পরেই।
পৃথিবী ও মানব
আহুরা মাজদা স্বর্গ থেকে দৃষ্টিপাত করলেন। তিনি প্রথমে সৃষ্টি করলেন আকাশ। পার্সিয়ানদের বিশ্বাস ছিল, ধাতব পদার্থের তৈরি আকাশ আমাদের পৃথিবীকে খোলসের মতো ঢেকে রেখেছে। আহুরা মাজদা আকাশ বানিয়েছিলেন আহরিমান আর মানুষের জগতের মাঝে প্রাচীর হিসেবে। এরপর তৈরি হলো পানি। তার তৃতীয় সৃষ্টি পৃথিবী। চতুর্থ পর্যায়ে এল গাছপালা, যা কাঁটা আর ছাল থেকে মুক্ত। পঞ্চম সৃষ্টি আদি প্রাণী, গ্যাভিওভোডাটা, যা ছিল বিশালকায় আর চাঁদের মতো উজ্জ্বল এক গাভি, যা থেকে এলো সুপেয় দুধ। ষষ্ঠ স্থানে এলো প্রথম মানব, গায়োমার্ড- লম্বা আর সুদর্শন।
বলা হয়, আহুরা মাজদা তাকে দিয়েছিলেন সূর্যের মতো উজ্জ্বলতা। জ্ঞানী প্রভুর সর্বশেষ উপহার ছিল আগুন, জরথুস্ত্রবাদে যা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সৃষ্টির শুরুতে সবই ছিল এক পরিপূর্ণভাবে নিখুঁত। ছিল না কোনো রোগবালাই বা দুঃখকষ্ট। পৃথিবী ছিল সম্পূর্ণ সমতল, কোনো পাহাড়পর্বত তখন মাথা তুলে দাঁড়ায়নি।
মর্ত্যে মন্দ
এদিকে অসীম অন্ধকারে আহরিমান ছিলেন ঘুমিয়ে। তার চেলা-চামুন্ডারা বহু চেষ্টা করেও তাকে জাগাতে ব্যর্থ হল। এবার এগিয়ে এল জাহি, যাকে বর্ণনা করা হয়েছে নারীরূপী নিকৃষ্ট এক শয়তান হিসেবে। চিৎকার করে সে ঘোষণা করল, আহুরা মাজদার সৃষ্টিকে সে খান খান করে দেবে। গ্যাভিওভোডাটা আর গায়োমার্ডের উপর এমন বিপদ আনবে, যে তারা বেঁচে থাকতেই চাইবে না। পানি, মাটি, আগুন আর গাছ সবকিছুই জাহি ধ্বংস করবার শপথ করল। দীর্ঘ আলস্য ভেঙে আহরিমান জেগে উঠলেন। আহুরা মাজদার কীর্তির কথা শুনে ক্রোধে আত্মহারা হয়ে গেলেন। জাহি চাইল, মানবজাতি তাকে কামনা করবে; আহরিমান তার ইচ্ছা কবুল করলেন। সৈন্য-সামন্ত নিয়ে প্রস্তুত হলেন সৃষ্টির উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে।
আহরিমানের ভয়ে আকাশ এমন কুঁকড়ে গেল, যেমন করে নেকড়ের ভয়ে ভেড়া পালিয়ে যায়। নিজের সব শক্তি নিয়ে চারদিক চূর্ণ-বিচূর্ণ করে আহরিমান অবতরণ করলেন পৃথিবীতে। চারিদিক ঢেকে গেল নিকষ কালো আঁধারে। আহরিমানের সঙ্গীরা নিষ্কলুষ সৃষ্টির প্রতিটি অংশকেই কলুষিত করে তুলল। গাছ মরে গেল, মাটির উপর মাথা তুলল পাহাড় পর্বত। আহরিমান সাথে করে এনেছিলেন মৃত্যু, সে তার কালো ছায়া দিয়ে ঘিরে ধরল সৃষ্টিকে।
আহরিমান এবার নজর দিলেন প্রাণিকূলের দিকে। গ্যাভিওভোডাটা আর গায়োমার্ডের উপর নামিয়ে আনলেন রোগবালাই, ক্ষুধা, পাপ, লোভ, চাহিদা আর ক্লান্তি। গ্যাভিওভোডাটা নির্জীব হয়ে পড়তে লাগল। তার কষ্ট আহুরা মাজদা লাঘব করলেন, কিন্তু একসময় তার দুধ ফুরিয়ে গেল। নিষ্প্রাণ গ্যাভিওভোডাটা মাটিতে মিশে যায়। হাজার হাজার শয়তান এরপর আক্রমণ করল গায়োমার্ডকে। তিরিশ বছর টিকে থাকার পর প্রথম মানবের মৃত্যু হলো। মনের আনন্দে আহরিমান গর্জন করে উঠলেন। পেরেছেন তিনি, আহুরা মাজদার প্রিয় সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। বিজয়ী বাহিনী নিয়ে আহরিমান নিজ রাজ্যে ফেরত যাবার পথ ধরলেন।
নব প্রাণের জাগরন
আকাশের দিকে তাকিয়ে তো আহরিমানের চক্ষু চড়কগাছ! তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্গীয় সেনাবাহিনী। অবিনশ্বর ইয়াজাটা আর আকাশের সাথে যোগ দিয়েছে ফ্রাভাশি বাহিনী। ফ্রাভাশিরা মর্ত্যমানবের স্বর্গীয় প্রতিচ্ছবি।
জমির দিকে তাকিয়ে আহরিমান দেখলেন, আকাশ থেকে নেমে অবারিত বর্ষণে তৈরি হয়েছে নদী-নালা। পানির তীব্র স্রোত টেনে নিতে থাকল তার সাঙ্গোপাঙ্গকে। গ্যাভিওভোডাটার শরীর থেকে তৈরি হলো পঞ্চান্ন রকমের শস্য, ১২ রকমের ওষধি গাছ আর নানা জাতির পশুপাখি। গায়োমার্ডের দেহ থেকে পৃথিবীর বুকে সঞ্চারিত হলো নানা বৈশিষ্ট্যের ধাতব পদার্থ। তার হাড়গোড় থেকে জন্ম নিল এক গাছ, সেখান থেকে উৎপত্তি হলো মানব মাশায়ি আর মানবী মাশায়েনের।
আদি পাপ
মাশায়ি আর মাশায়েন অবিচ্ছিন্ন সত্ত্বা হিসেবে গাছের আকারে বেড়ে ওঠে চল্লিশ বছর। এ গাছের ফল থেকেই মানবজাতির দশটি ধারার সৃষ্টি হয়। সময়ের হিসাবে চল্লিশ বছর পর মাশায়ি আর মাশায়েন পরিপূর্ণ মানুষরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
আহুরা মাজদা তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু আহরিমান এত সহজে হার মানবেন কেন! তিনি তাদের চিন্তা-চেতনায় প্রভাব বিস্তার করলেন। তার প্ররোচনাতে মানব-মানবী আহুরা মাজদাকে ভুলে আহরিমানকে মেনে নিল তাদের প্রভু হিসেবে। তারা আহুরা মাজদার দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ল। তারা দুধ পান করল, জমিতে কুয়ো খুঁড়ল আর কাজ করার যন্ত্রপাতি বানাতে লাগল। জরথুস্ত্রবাদ অনুযায়ী, এসবই পবিত্র কাজ। কিন্তু তাদের হৃদয় তখন আহরিমানে আচ্ছন্ন; ফলে, তাদের কাজের ফল হতে লাগল মন্দ। শান্তি আর সৌহার্দ্যের বদলে হিংসা আর হানাহানি গ্রাস করল পৃথিবীকে। আহরিমান মানব-মানবীর জৈবিক চাহিদা পঞ্চাশ বছরের জন্য সরিয়ে নিলেন। অপরদিকে জ্ঞানী প্রভু চাইছিলেন, তাদের মিলনে পৃথিবীকে মানবসন্তানে পরিপূর্ণ করে তুলতে।
আহরিমানের পরাজয়
শেষপর্যন্ত মাশায়ি আর মাশায়েন আহরিমানের কবল থেকে বেরিয়ে এসে সন্তান জন্মদান করে। পৃথিবী ভরে উঠল মানব কোলাহলে। স্বর্গীয় সেনাবাহিনীর সাথে মিলে তারা তাড়িয়ে দিল আহরিমানকে। তিনি ফিরে গেলেন তার অন্ধকার রাজ্যে। মৃত্যুর থেকে জন্ম নিল নতুন প্রাণ, অন্ধকার ভেদ করে ফুটে উঠল আলোর রেখা। শুভ আর অশুভের লড়াইতে বিজয়ী হলেন আহুরা মাজদা, বিজয়ী হলো মানবজাতি।