গ্রীক দেবতা বললে সবার আগে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে উত্তপ্ত বজ্র হাতে পরাক্রমশালী দেবরাজ জিউসের ছবি। কিন্তু জিউস কীভাবে দেবরাজ হলেন এবং জিউসের আগমনের পূর্বে এই পৃথিবীতেই বা কী ছিল?
ধর্মানুভূতি চিরকাল মানুষের চিন্তাভাবনার দিককে প্রভাবিত করেছে। গ্রিক সভ্যতা প্রাচীন যেকোনো সভ্যতার চেয়ে ছিল বেশি মানবীয়। এমন একটি সময়ে গ্রিকদের উত্থান হলো যখন মানুষের মনে দেবতারা শুধু ভয়ই উদ্রেক করতে পারতেন। তাদের চোখে দেবতারা ছিলেন অন্য যেকোনো পার্থিব প্রাণীর চেয়ে আলাদা। যেমন- মিশরের চলৎশক্তিহীন বিড়ালের মাথাযুক্ত একটি অর্ধমানবী। কিন্তু গ্রিকরাই সর্বপ্রথম এই দেবতাদেরকে দিলেন মানুষের আকৃতি এবং জীবন।
তারা দেবতাদেরকে দৈত্য বা ভয় উদ্রেককারী কোনো রাক্ষস হিসেবে দেখলেন না, দেখলেন বন্ধু হিসেবে। একজন মরণশীল মানুষের যত দুর্বলতা আছে তার প্রায় সবই একজন অমর দেবতারও বৈশিষ্ট্য হয়ে গেল। দেবতারা আর মন্দিরে বসে থাকলেন না, বরং তারা ভূতলের মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেলেন। অনেক সময় মরণশীল মানুষরাও দেবতাদের জীবনে প্রভাব ফেলার সুযোগ পেলেন।
পৃথিবীর শুরুতে কী ছিল?
প্রতিটি ধর্মেই পৃথিবীর শুরু নিয়ে কিছু কাহিনী বা উপাখ্যান প্রচলিত আছে। কথায় বা ব্যাখ্যায় আলাদা হলেও মজার বিষয় যে, দিনশেষে সবগুলো প্রায় একই রকম। আজ কথা বলবো শুধু গ্রিক পুরাণের দৃষ্টিকোণ থেকে। গ্রিক কবি হোমারের সমসাময়িক হেসিওড ছিলেন সর্বপ্রথম গ্রিক কবি যিনি তাঁর থিওগনি নামক কবিতার মাধ্যমে সৃষ্টি রহস্যের ব্যাখ্যা দেন। গ্রিকরা এটি বিশ্বাস করতেন না যে সব কিছুই শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তারা বিশ্বাস করতেন, সবকিছুই ক্যাওস থেকে সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এই ক্যাওস অনেকটা শূন্যের মতোই ছিল, যার ছিলো না কোনো অবয়ব; এটি সৃষ্টি ও শূন্যতার মাঝে একটি দ্বিধা ছিল।
খুবই আকস্মিকভাবে ক্যাওস একাই জন্ম দিলেন ৫টি শক্তিকে- গায়া (ধরিত্রী মাতা), টারটারাস (পাতাল), এরিবাস (পাতালপুরীর অন্ধকার, যেখানে বাস করে মৃত্যু) ও নিক্স বা রাত (যা ধরিত্রী মাতাকে আচ্ছন্ন করে রাখে অন্ধকারে)। এরিবাস ও রাত মিলনে আবদ্ধ হয় এবং এর থেকে জন্ম নেয় এরস (ভালোবাসা)। ভালোবাসা তার উজ্জ্বলতা দিয়ে নির্মূল করলো অন্ধকার। ভালোবাসা জন্ম দিল ‘আলো’ ও ‘দিনকে’। এবং হেসিওডের মতে, এর পরেই জেগে উঠলেন ধরিত্রী মাতা এবং ‘স্বর্গ’ পিতা, যারা আবার মিলনে আবদ্ধ হলেন (স্বর্গ বা ইউরেনাস ছিলেন গায়ারই সন্তান এবং পরবর্তীতে স্বামী)। অর্থাৎ, পৃথিবী বা ধরিত্রী ও আকাশ বা স্বর্গকে গ্রিক পুরাণে মানুষের মতোই দেখানো হয়েছে, যারা বৈবাহিক সূত্রে (যদি বিবাহ বলে তখন কিছু থেকে থাকে) আবদ্ধ হতেন এবং অনেক অনেক সন্তান জন্ম দিলেন। আগেই বলা হয়েছে, গ্রিকরা সবকিছুর ব্যক্তিত্বায়ন করতেন। যেহেতু আকাশ ও মাটি সময়ের সাথে সাথে রূপ পরিবর্তন করতো, তাই তাদেরও মানুষের মতোই আচরণ করা সঙ্গত মনে হলো সেসব পণ্ডিতদের।
যা-ই হোক, এরিবাস ও রাত্রির মিলনে শুধু ভালোবাসাই জন্ম নিল না। এর সাথে জন্ম নিল মৃত্যু, জরা, ধোঁকা ও বিদ্বেষ। অর্থাৎ পৃথিবী ভালোবাসায় আলোকোজ্জ্বল থাকলেও এতে বিরাজমান ছিল হতাশা, মৃত্যু ও পাপাচার।
ইউরেনাস ও গায়ার মিলনে যারা জন্ম নিলেন তারাই প্রথম বা আদি দেবতা। দেবতাদের প্রথম বংশধর। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গায়া ও ইউরেনাসের সব সন্তানই দেবতার খেতাব পায়নি। প্রথমেই তাঁদের ঘর আলো করে জন্ম নিল কয়েক শ্রেণীর বীভৎস দানব, যাদের ছিল পঞ্চাশটি মাথা ও একশটি হাত। এদের মধ্যে তিনজনের ছিল মাথা বরাবর একটি বিশালাকারের চোখ। এদের নাম দেয়া হলো সাইক্লপস। কারণ এদের ঐ চোখ সাইকেলের চাকার মতো ঘোরে। পৃথিবী সৃষ্টির প্রাক্কালের এক ভয়াবহ যুদ্ধে এ দানবেরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও সাইক্লপসদের প্রতি দয়াপরাবশ হয়ে দেবরাজ জিউস তাদেরকে তাঁর বজ্র তৈরির কাজ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি অনেক পরের কথা।
দানব এবং সাইক্লপসদের পরে ইউরেনাস ও গায়ার জীবনে দানবের অভিশাপ কাটল। তাঁরা জন্ম দিলেন কয়েকজন মানবসদৃশ দেবতা টাইটানদের। তারা দানব ও সাইক্লপসদের চেয়ে বুদ্ধিমান ছিলেন। তাদের অনেকেই যুদ্ধপ্রিয় ছিলেন কিন্তু কিছু কিছু টাইটান আবার জনগণের কল্যাণের জন্যও কাজ করতেন। কয়েকজন উল্লেখযোগ্য টাইটান হলেন সমুদ্র দেবতা ওসেনিয়াস এবং তাঁর স্ত্রী থেটিস, সূর্যদেবতা হাইপারিয়ন ও তাঁর স্ত্রী থেইয়া, ধরিত্রী দেবী রিয়া ও থেমিস, স্মৃতিশক্তির দেবী নেমসিন এবং সবচেয়ে চালাক এবং বীর টাইটান ক্রনাস।
ধরিত্রীকে সবসময়ই মেয়ে হিসেবে দেখা হয়েছে। আর মেয়ে হিসেবে দেখার কারণেই তাকে চিত্রায়ন করা হয়েছে অসহায় স্ত্রী-রূপে, যে তাঁর স্বামী ইউরেনাসের অপকর্মে বাধা দিতে অক্ষম। কোনো অজানা কারণে ইউরেনাসকে দেখানো হয়েছে পুরুষরূপে, তথাপি পাপিষ্ঠ এবং ক্রুর পিতা হিসেবে, যে তার সন্তানদেরকে টারটারাসে বন্দী করে রাখতো।
টাইটান ও সাইক্লপসরা তাদের অত্যাচারী পিতার বশ্যতা মানেনি, সেটিই স্বাভাবিক। নিরুপায় ধরিত্রী মা গায়া তাঁর বাকি সন্তানদের বাঁচানোর জন্য সাহায্য চায় সাইক্লপস এবং টাইটানদের। উন্নত হলেও সাইক্লপস এবং টাইটানরা এতটা তেজী ছিলেন না যে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবেন। তথাপি একজন টাইটান, ক্রনাস, যিনি ছিলেন টাইটান-শ্রেষ্ঠ, তিনি এগিয়ে এলেন।
গায়া ক্রনাসকে একটি কাস্তে তৈরি করে দিলেন এবং তাকে লুকিয়ে ফেললেন পাতালের গর্তে। সেই রাতে যখন ইউরেনাস গায়ার সাথে মিলনাবদ্ধ হতে এলেন, তখন মায়ের গহ্বরে লুকিয়ে থাকা ক্রনাস সেই কাস্তে দিয়ে ইউরেনাসের যৌনাঙ্গ কেটে ফেললেন। এটি নিক্ষেপ করলেন ওস্যান সমুদ্রে, যা পৃথিবীকে ঘিরে ছিল।
ইউরেনাসের রক্ত থেকে জন্ম নিল দানবদের চতুর্থ প্রজন্ম- জায়ান্টগণ এবং এরিনিজ (বা ফিউরি)। ইউরেনাসের সন্তানদের মধ্যে এরিনিজগণই একমাত্র, যারা এখনও স্বর্গে রয়ে গেছেন। তাদের মূর্তিটি বীভৎস, চুল যেন পেঁচানো সাপ। তাদের কাজ পাপীদের বিচার করা। যতদিন পৃথিবীতে পাপ থাকবে ততদিন তাদের প্রয়োজন থাকবে।
কথিত আছে, ইউরেনাসের কর্তিত লিঙ্গ সমুদ্রে ফেলার পর সেখান থেকে ফেনা নির্গত হয়ে জন্ম নেন ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি।
ক্রনাসের শাসন ও জিউসের জন্ম
জুলুমবাজ পিতা ইউরেনাসের মৃত্যুর পর ক্রনাসের আর কোনো শত্রু রইল না। তিনি একাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাসক হয়ে গেলেন। বিয়ে করলেন নিজের বোন, ধরিত্রীর দেবী রিয়াকে। মানুষের সাথে গ্রিক দেবতাদের আরেকটি বড় মিল হলো তারা উভয়ই নিয়তিতে বিশ্বাস করতেন। যেহেতু ক্রনাস তার পিতা ইউরেনাসের হন্তারক ছিলেন, সেহেতু নিয়তি তাকেও ছেড়ে দেয়নি। ইউরেনাস ক্রনাসকে অভিশাপ দিলেন যে, ক্রনাসেরই আপন ঔরসজাত সন্তান তাকে হত্যা করে তার স্থান দখল করবে। তিনি পিতার চেয়ে ভিন্ন কিছু করলেন না। ক্রনাস তার জন্মানো প্রতিটি সন্তানকে একে একে গিলে ফেলতে লাগলেন।
এভাবে পাঁচটি সন্তান গিলে ফেললেন ক্রনাস। রিয়া মা হয়ে এত বড় নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তিনি ফন্দি আঁটলেন। তিনি সাহায্য চাইলেন তার পিতা-মাতার। রিয়া ও ক্রনাসের ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন জিউস। পিতার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য রিয়া তার পুত্র জিউসকে ক্রিট নামক একটি দ্বীপে পাঠিয়ে দেন।
এদিকে ক্রনাসকে বোকা বানানোর জন্য রিয়া কাপড়ে মোড়ানো একটি পাথর খণ্ডকে জিউস বলে চালিয়ে দেন এবং টাইটানশ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান ক্রনাস হঠাৎ বোকা বনে গেলেন; পাথরকে বাচ্চা ভেবে গিলে ফেললেন।
ক্রিট দ্বীপে প্রকৃতির দেবী নিম্ফ জিউসের দেখাশোনা করলেন। আমালথিয়া নামক এক ছাগল জিউসকে দুগ্ধ দিল। কিউরেটাস নামক কিছু গৌণ দেবতাদের উপর জিউসকে রক্ষা করার ভার ছিল। যখনই জিউস কান্না করতেন তখন কিউরেটাসরা তাদের তলোয়ার সজোরে আঘাত করতেন, যাতে ক্রনাস জিউসের কান্নার শব্দ শুনতে না পান।
টাইটানদের পরাজয় এবং অলিম্পীয় দেবতাদের আগমন
ভাগ্যে যেহেতু আছে, তাহলে অবশ্যই ক্রনাস তার পুত্র দ্বারাই ক্ষমতাচ্যুত হবেন। জিউস যখন প্রাপ্তবয়স্ক হলেন তখন তিনি ক্রনাসের উপর প্রতিশোধ নিতে এলেন। সাহায্য পেলেন তার মাতামহী গায়া, তার ভাইবোন এবং টাইটানদের একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবতা প্রমিথিউসের।
গায়ার সহায়তায় জিউস ক্রনাসকে তার গিলে ফেলা সকল সন্তানকে উগড়ে ফেলতে বাধ্য করলেন। যে পাঁচজন সন্তানকে ক্রনাস গিলেছিল, তারা প্রত্যেকে পরবর্তীতে অলিম্পাসে দেবতা হয়ে বিরাজ করেছেন। ক্রনাসের পেট থেকে যারা নির্গত হলেন তারা সকলেই ছিলেন জীবিত এবং একেকজন পূর্ণাঙ্গ দেবতারূপেই বের হয়ে এলেন। তারা হলেন বিয়ের দেবী হেরা, পাতালের রাজা হেডিস, সমুদ্রের রাজা পোসাইডন, উনুনের দেবী হেস্টিয়া এবং শস্য ও ফলনের দেবী দিমিতির।
টাইটানোমাকি
প্রমিথিউস এবং সদ্য উগরানো ভাই-বোনদের নিয়ে জিউস তার পিতা ক্রনাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ক্রনাসের সাথে ছিলেন অন্য টাইটানরা। জিউস যাদের নিয়ে যুদ্ধ করেন তাদের অলিম্পীয় দেবতা বলা হয়, কারণ মাউন্ট অলিম্পাসকে গ্রিসের সবচেয়ে বড় ও পবিত্র পর্বত মনে হয়, যেটি আকাশের সর্বোচ্চ স্থান এবং সেই দেবতাদের আবাস্থল।
টাইটান ও অলিম্পীয়দের এই যুদ্ধকে টাইটানোমেকি, টাইটান যুদ্ধ বা দেবতাদের যুদ্ধ বলা হয়। এটি ছিল ১০ বছরব্যাপী একটি ভয়াবহ যুদ্ধ, যার ফলে পূর্বের সকল সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যায়। জিউস শুধু তার ভাই-বোন এবং একজন টাইটানের সাহায্যই পেলেন না। বরং তিনি পাতাল থেকে জাগিয়ে তুললেন একচোখা সাইক্লপস এবং হেকাটনকিরস নামক শতহস্ত বিশিষ্ট দানবদের, যাদের ক্রনাস টারটারাসে বন্দী করে রেখেছিল। হেকটানকিরসরা টাইটানদের দিকে বড় বড় পাথর নিক্ষেপ করতো আর সাইক্লপসরা জিউসের জন্য বজ্র বানাতো। জিউসের পক্ষ হয়ে প্রমিথিউস এবং ক্রনাসের পক্ষ হয়ে অ্যাটলাস চরম যুদ্ধ করলেন। আদতে তারা সকলেই ছিলেন ভাই-বোন। শুধু ক্ষমতার লড়াই তাদেরকে একে অপর থেকে দূরে সরিয়ে দিল।
দীর্ঘ ১০ বছরের এই যুদ্ধের শেষে অলিম্পীয়রা জয়ী হলেন এবং অলিম্পাস হয়ে গেল দেবতাদের নতুন আবাস্থল। ক্রনাসকে পরাজিত করার পর তিন ভাই তাদের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে নিলেন- পোসাইডনকে করা হলো সমুদ্র দেবতা, হেডিস পেলেন পাতালপুরের রাজত্ব। সবচেয়ে কনিষ্ঠ যিনি ছিলেন, সেই জিউস হলেন আকাশ ও বায়ুর নিয়ন্তা, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের একাধিপতি। তিনি বিয়ে করলেন বিয়ের দেবী হেরাকে।