বিশ্বের যেকোনো সভ্যতার পৌরাণিক কাহিনীগুলো সেসব এলাকায় মানুষের মাঝে যুগের পর যুগ টিকে থাকে। বংশপরম্পরায় মানুষ তা পরের প্রজন্মকে বলে যায়। আর এভাবেই এই কাহিনীগুলো মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের বজ্রদেবতা থরের নর্স পুরাণ বলি বা ভারতীয় উপমহাদেশের পৌরাণিক কাহিনী, এসব কিছুই যুগের পর যুগ ধরে মুখে মুখে টিকে আছে আর পরবর্বতীতে বই আকারে লিখিত হয়েছে। প্রাচীন আরবেও এরূপ কিছু বৈচিত্র্যময় এবং অবিশ্বাস্য পৌরাণিক কাহিনী, গল্প আর কিংবদন্তি রয়েছে। আর এসব গল্প হাজার হাজার বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মৌখিকভাবে রক্ষিত হয়েছে।
আরবের প্রাচীন সভ্যতাগুলোর জনগণের মধ্যে বিশ্বের কিছু বিশুদ্ধ পৌরাণিক কাহিনী ও রূপকথা প্রচলিত আছে। এসব কাহিনীতে যেমন রয়েছে মানুষের বীরত্বের কথা, তেমনি রয়েছে দৈত্য দানবের ক্ষমতা ও রাজত্বের কথা। বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার যেমন নিজস্ব কাহিনী তাদের সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, আরবেও তেমনটা ঘটেছে। যখন আমরা প্রাচীন আরবের পুরাণ সম্পর্কে বলি তখন আমরা বেশিরভাগই মধ্যযুগীয় উৎসগুলোর উপর নির্ভর করি, কারণ এর আগে লিখিত আকারে এসব লিপিবদ্ধ ছিল না। বলে রাখা ভালো, এখানে ধর্ম, লোককাহিনী ও উপকথার মিশেল ঘটেছে। এসব কাহিনীর অনেক কিছুই পরবর্তীতে আরবের বিভিন্ন ধর্মের সাথে মিশে গিয়েছে আর সেগুলোর অংশ হয়ে যায়। আজকের লেখায় এমনি কিছু পৌরাণিক কাহিনী ও রূপকথার বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
বাহামুত, এক পৌরাণিক প্রাণী
বিশ্বাস করা হয়, এটি গভীর সমুদ্রে থাকা একটি দৈত্যাকার এবং দানবীয় মাছ। প্রাচীন আরবের লোকেরা বিশ্বাস করত যে এই পৌরাণিক প্রাণী পৃথিবীকে ধরে রেখেছে। পৌরাণিক কাহিনী মতে, দৈত্যাকার এই মাছটি তার পিঠে একটি দৈত্যাকার ষাঁড়কে বহন করে আছে এবং এর উপর একটি রত্নপাথর আছে, যাতে একটি দেবদূত পৃথিবী এবং সমুদ্রের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে।
দানব নাসনাস
এটি আরবের পৌরাণিক কাহিনীর একটি ভয়ঙ্কর দানব। নাসনাসকে রাক্ষস এবং মানুষের সম্মিলিত সন্তান বলে মনে করা হতো। কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা আর কেবল স্পর্শ করেই তাদেরকে শুকিয়ে বা মেরে ফেলা বা তাদের শরীর থেকে মাংস নিয়ে ফেলা ছিল এর ক্ষমতার উদাহরণ। এটি বিশ্বাস করা হতো যে নাসনাসের শুধুমাত্র অর্ধেক মাথা, এবং শরীরের প্রতিটি অংশ অর্ধেক আছে। শুধুমাত্র একটি পা দিয়েই বিশাল লাফ দিতে পারত এই দানব, যার মাধ্যমে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে মানুষকে ধরত আর হত্যা করত।
পৌরাণিক প্রাণী শাদ’হাওয়ার
মধ্যযুগীয় আরবের একটি পৌরাণিক প্রাণী শাদ’হাওয়ার। মনে করা হতো, এটি ইউনিকর্নের মতো একটি প্রাণী, যার একটি বিশাল শিং আছে। এই শিং থেকে ৪২টি শাখা ছড়িয়ে থাকে। কিংবদন্তি অনুযায়ী, এর জাদুকরী শিং থেকে বাতাসের সাথে শক্তিশালী সঙ্গীত বাজত, যা এর শাখাগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো। এই প্রাণীর শিং রাজাদের উপহার দেওয়া হতো, যা বাঁশির মতো বাজানো হতো। এর একদিকে বাজানো হলে তা একটি মনোমুগ্ধকর সুর উৎপন্ন করে, এবং যখন অন্যদিকে বাজানো হয়, সুরটি এতই দুঃখের হয় যে এটি মানুষকে কাঁদায়।
পৌরাণিক প্রাণী রক
প্রাচীন আরবদের একটি জনপ্রিয় পৌরাণিক প্রাণী রক হলো একটি বিশাল কিংবদন্তি শিকারি পাখি। বিভিন্ন নাবিক, জেলে এবং অনুসন্ধানকারীরা এর সম্পর্কে লিখে গেছেন। তারা শপথ করেছিলেন যে, তাদের অভিযানে থাকাকালীন এই জাদুকরী প্রাণীকে দেখেছিলেন। এর কথা এসেছে বিখ্যাত অভিযাত্রী ইবনে বতুতা ও মার্কো পোলোর লেখায়। এছাড়া আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাত ও সিনবাদের গল্পেও এর কথা এসেছে। রককে প্রায়ই পশ্চিমা পৌরাণিক প্রাণী, যেমন- ফিনিক্স বা থান্ডারবার্ডের সাথে তুলনা করা হয়েছে। রকের শরীর এত বৃহৎ ও এর শক্তি এত বেশি যে এটি তার পা দিয়ে অনায়াসে একটি বড় হাতিকেও তুলে নিতে পারে।
আনকা আল-মুগরিব
আনকা বা আনকা মুগরিব বা আনকা আল-মুগরিব আরবীয় পৌরাণিক কাহিনীর একটি রহস্যময় কল্পিত বৃহৎ স্ত্রী পাখি। বলা হয়ে থাকে, এটি অনেক দূর পর্যন্ত উড়ে যায়, এবং জীবদ্দশায় মাত্র একবারই দেখা দেয়। এটাও বলা হয় যে, একে ‘সূর্য অস্ত যাওয়ার জায়গায়’ দেখতে পাওয়া যায়। আনকা শব্দটি আনাক এর স্ত্রীলিঙ্গ, যার অর্থ ‘লম্বা ঘাড়’। এটি দিয়ে সম্ভবত বোঝায় যে পাখিটি একটি সারস বা অন্যান্য লম্বা গলার পাখির মতো বা কেবল একটি ঈগলের মতো একটি বড় শক্ত ঘাড় রয়েছে, যার মাধ্যমে একে চিহ্নিত করা যায়। মুগরিব শব্দের বেশ কিছু অর্থ রয়েছে: অদ্ভুত, বিদেশী, দূরবর্তী, পশ্চিম, সূর্যাস্ত, বিচ্ছিন্ন, অজানা, সাদা, ভোর ইত্যাদি।
আনকা নামটি ‘দুর্ভাগ্য বা কঠিন ব্যাপার’ এর সাথেও সম্পর্কযুক্ত এবং আনকা মুগরিব নামটি দিয়ে বিপর্যয়কে বোঝানো হতো। এটি হয়েছিল কারণ পাখিটিকে মূলত বেশ নিখুঁতভাবে সাথে সৃষ্ট বলা হয়েছিল, কিন্তু এটি প্লেগে পরিণত হয়েছিল, এবং তাই একে হত্যা করা হয়েছিল। জাকারিয়া আল-কাজউইনির মহাজাগতিক বই ‘দ্য ওয়ান্ডার্স অব ক্রিয়েশন’-এ আনকা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “পাখিদের আত্মীয় যারা কাফ পর্বতে একা বাস করত“, এবং “অনেক যুগে অর্জিত অভিজ্ঞতাসহ একটি জ্ঞানী পাখি যা নৈতিক উপদেশ দেয়।” কাজউইনি আরও বলেছেন, পাখিটি ১,৭০০ বছর বেঁচে থাকে, ৫০০ বছর বয়সে মিলন করে, ডিম ভাঙার পর ছানা ভেতরে থাকে, এবং ১২৫ বছর পরে বের হয়ে আসে। এদের কখনও কখনও আধুনিক সময়ে ফিনিক্সের মতো প্রাণী হিসেবে চিত্রিত করা হয়। এদের ৪টি ডানা থাকে। কথিত আছে যে আনকা হাতি এবং বড় মাছ ছাড়া কিছুই খায় না। আর্মেনিয়ান ও বাইজেন্টাইন ঈগল এবং তুর্কি কোনরুল ও পারস্য পুরাণের সিমুর্গের সাথে আনকাকে প্রায়শই সাদৃশ্য মনে করা হয়।
ঘুল
ঘুল বা ঘুওল হলো একটি দানব-সদৃশ সত্তা বা পৌরাণিক দানবীয় প্রাণী। ঘুলের ধারণা প্রাক-ইসলামিক আরবের ধর্মগুলোতে তৈরি হয়েছিল, যে প্রাণীকে কবরস্থানে দেখা যায়, এবং বিশ্বাস করা হতো- এটি মানুষের মাংস খায়। ঘুল একটি আরবি শব্দ, যা এসেছে ঘালা থেকে, এর অর্থ ‘জব্দ করা’। আরবি লোককাহিনী মতে, কবরস্থান এবং অন্যান্য জনবসতিহীন স্থান ঘুলের বসবাসের জায়গা হিসেবে। পুরুষদের ঘুল বলা হয়, আর মহিলাদের ঘুলা বলা হয়। একে অনেক গল্পে দেখানো হয়েছে, যে অসহায় মানুষদের প্রলুব্ধ করে, সাধারণত পুরুষদের, আর যাতে করে এটি তার বাড়িতে গিয়ে তাদের সবাইকে খেতে পারে।
কেউ কেউ বলে যে, ঘুল হলো মরুভূমিতে বসবাসকারী দানব, যা আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে, বিশেষ করে হায়েনার ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। এটি অসতর্ক লোকদেরকে মরুভূমির বর্জ্য বা পরিত্যক্ত জায়গায় হত্যা করে খাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। প্রাণীটি ছোট বাচ্চাদেরও শিকার করে, তাদের রক্ত পান করে, মুদ্রা চুরি করে এবং মৃতকে খায়। তারপরে যে ব্যক্তিকে এটি খায় তার রূপ ধারণ করে।
ওয়্যারহায়েনা
ওয়্যারহায়েনা নামের এই পৌরাণিক প্রাণী একটি নিওলজিজম যা হায়েনাদের সাথে জড়িত, যা ওয়্যারউলফের ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। আরব উপদ্বীপ, উত্তর আফ্রিকা, হর্ন অফ আফ্রিকা এবং নিকট প্রাচ্যের পাশাপাশি কিছু সংলগ্ন অঞ্চলের সাধারণ লোককাহিনীতে এর দেখা মেলে। ওয়্যারউলফের মতো, যেগুলো সাধারণত মানুষের বিবর্তনের ফলে হয় বলে বিশ্বাস করা হয়, ওয়্যারহায়েনার কাহিনীগুলোও বলে যে তারা কীভাবে মানুষের ছদ্মবেশে হায়েনা হতে পারে।
সোমালিয়ায় ঐতিহ্যগতভাবে এটি বিশ্বাস করা হয় যে, কোরি ইসমারিস এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি রাতের বেলা নিজেকে একটি একটি জাদুর লাঠি দিয়ে ঘষে হায়েনা-মানবে রূপান্তরিত করতে পারতেন এবং ভোরের আগে মানব অবস্থায় ফিরে যেতেন। ইথিওপিয়াতে ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বাস করা হয় যে প্রতিটি কামার, যাদের ব্যবসা বংশগত, তারা সবাই একেকজন জাদুকর বা ডাইনি আর তারা তাদের ক্ষমতা হায়েনায় পরিণত হয়। এই কামার ওয়্যারহায়েনারা মধ্যরাতে কবর লুট করে বলে বিশ্বাস করা হয়, তাদের বওদা বলা হয়ে থাকে। অধিকাংশ দেশবাসী তাদের সন্দেহের চোখে দেখে। এই বিশ্বাস বর্তমানে সুদান এবং তানজানিয়ার পাশাপাশি মরক্কোতেও রয়েছে। অনেক ইথিওপিয়ান খ্রিস্টান সেখানকার ইহুদিদের বওদা হিসেবে চিহ্নিত করে, তাদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের মৃতদেহ খুঁজে বের করার এবং সেগুলো খাওয়ায় অভিযোগ তোলে।
পশ্চিম সুদানের জনগণের লোককাহিনী অনুযায়ী একটি হাইব্রিড প্রাণী রয়েছে, যে একজন মানুষ, আর রাতে একটি নরখাদক দানবে রূপান্তরিত হয়। এটি মানুষদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। প্রাণীটিকে প্রায়শই একটি শক্তিশালী জাদুকর বা নিরাময়কারী, কামার, বা কাঠুরে হিসেবে তার মানব আকারে চিত্রিত করা হয়, যার একটি লোমশ শরীর, লাল এবং জ্বলজ্বল চোখ থাকে।
আল-মিরাজ
আল-মিরাজ হলো একটি পৌরাণিক প্রাণী, যা মধ্যযুগীয় আরবি সাহিত্যে উল্লিখিত এক শিংওয়ালা খরগোশ বা খরগোশের মতো। এই নামটি ইস্কান্দারের কিংবদন্তির একটি সংস্করণে লেখা হয়েছে, যিনি ভারত মহাসাগরের ড্রাগন দ্বীপের ড্রাগনকে পরাজিত করার পরে বাসিন্দাদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে প্রাণীটি পেয়েছিলেন। প্রাণীটির দিকে দৃষ্টি পড়লে অন্যান্য সব প্রাণীও পালাতে বাধ্য হয়।
কাজউইনির মারভেলস অব থিংস ক্রিয়েটেড এবং মিরাকুলাস অ্যাসপেক্টস অব থিংস এক্সিস্টিং (দ্য ওয়ান্ডার্স অব ক্রিয়েশন) অনুসারে, আল-মিরাজ হলো ভারত মহাসাগরের জাজিরাত আল-তিনিন যা সি-সার্পেন্ট আইল্যান্ড বা ড্রাগন আইল্যান্ড নামে পরিচিত একটি দ্বীপে বসবাস করা কথিত একটি জন্তু। এর রয়েছে একটি কালো শিং। এর গায়ের রং হলুদ, আর এটি দেখতে খরগোশের মতো। এটি দেখে সমস্ত বন্য জানোয়ারও পালিয়ে যায়। দ্বীপবাসীরা ইস্কান্দারকে (আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট) একটি ড্রাগন (বা বড় সাপ) হত্যা করতে সাহায্য করার পরে একে উপহার দিয়েছিল, যেটি গবাদি পশু খেয়েছিল।
দানব কুতরুব
আরবীয় লোককাহিনীর জনপ্রিয় প্রাণী কুতরুব, ওয়্যারউলফের মতো এই দানব একধরনের রাক্ষস। কুতরুবকে প্রায়শই পশ্চিমা সংস্কৃতির পিশাচের সাথে তুলনা করা হয়। সেখানে একে কবরস্থানের বাসিন্দা বলা হয়েছে, যা মৃতদেহ ভক্ষণ করে।
ফালাক
আরবের পৌরাণিক কাহিনী মতে, ফালাক হলো এক বিশালাকার পৌরাণিক সাপ। এটি বাহামুত নামে পরিচিত একটি মাছের নিচে বাস করে। ‘ওয়ান থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস’ বা ‘আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাত’-এ একে বিপজ্জনক দানব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি বলা হয়ে থাকে যে, এই সাপ কেবল সৃষ্টিকর্তার শক্তিকেই ভয় করে যা একে জগতের সমস্ত সৃষ্টিকে গ্রাস করতে বাধা দেয়। ফালাক খুব বিপজ্জনক প্রাণী। তবে এরা সাধারণত পৃথিবীতে খনন করা সুড়ঙ্গে থাকে। এদের দেহ অতিবৃহৎ নয়, তবুও পর্যাপ্ত খাবার এবং পানি পেলে এদের দেহ বিশাল আকারে বৃদ্ধি পেতে পারে।
ফালাক খুব ঘনিষ্ঠভাবে নর্স জর্মুনগান্ডারের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ফালাককে অত্যন্ত শক্তিশালী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পৌরাণিক বিশ্বাসমতে, এটি পৃথিবী, স্বর্গ এবং তার উপরে থাকা ছয়টি নরককে গ্রাস করতে পারে। এদের অগ্নি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে তাপ সহ্য করার সক্ষমতা।
‘ওয়ান থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস’ অনুযায়ী একটি বিশাল ফালাক পৃথিবী পৃষ্ঠের নীচে বাস করে, তবে এটি সৃষ্টিকর্তার ভয়ে এর নীচে থাকা সবকিছু গ্রাস করা থেকে এড়িয়ে থাকে। যদিও এই পৌরাণিক কাহিনীকে প্রায় আমেরিকান এবং ইউরোপীয় ম্যাজিজুওলজিস্টরা অস্বীকৃতি জানান, তবে তারা আজকের ম্যাগমা পাইথনের বিবর্তনীয় প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
আলাদিনের বিস্ময়কর প্রদীপের কিংবদন্তি
আরবের সবচেয়ে বিখ্যাত লোককাহিনীগুলোর মধ্যে একটি হলো কিংবদন্তি আলাদিনের জাদুর প্রদীপের গল্প। সারা বিশ্বের শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের কাছে এই গল্পটি পরিচিত ও বহুল প্রচলিত। এটি আজও মানুষের কল্পনা ও আবেগকে ধারণ করে রেখেছে। মূলত এই গল্পটি ‘আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাত’-এর একটি অংশ। গল্পে এক যুবক ছেলে আলাদিনের কথা বলা হয়েছে যে ছিল দরিদ্র। সে একটি দুষ্ট জাদুকরের দ্বারা প্রতারিত হয়। পরে সে একটি জাদুকরী প্রদীপের মালিক হয়ে যায়। প্রদীপের মধ্যে থাকা একটি জিনি বা জ্বিনের মাধ্যমে একের পর এক দুঃসাহসিক কাজ শুরু করে। এভাবে সে জিনির সাহায্যে রাজকন্যার মন জয়ে সক্ষম হয়।
আলীবাবা এবং চল্লিশ চোরের গল্প
কিংবদন্তি ‘আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাত’-এর আরেকটি বিখ্যাত গল্প এটি। এই গল্পে আলীবাবা নামে এক দরিদ্র কাঠুরির কথা উঠে এসেছে। বনে একটি দুঃসাহসিক অভিযানের সময় তিনি চোরের লুকানো আস্তানা আবিষ্কার করেন, আর জাদুকরী শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে সেই গুহার দরজা খুলতে সক্ষম হন। আলীবাবা অবশেষে দুষ্ট চোরদের হাত থেকে রক্ষা পান এবং তাদের বিশাল ধনভান্ডারের মালিক হয়ে যান।
জারকা’ আল-ইয়ামামার কিংবদন্তি
আরব্য পৌরাণিক কাহিনী মতে, জারকা’ আল-ইয়ামামা ছিল অবিশ্বাস্য শক্তি, এবং জাদুবিদ্যার অধিকারী একজন শক্তিশালী মহিলা। কিংবদন্তি মতে, তার উজ্জ্বল নীল চোখ তাকে ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিতে এবং ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করতে সাহায্য করত। কিন্তু তার ঈর্ষান্বিত উপজাতি শত্রুরা শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করে। তার চোখ উপড়ে নেয়, এবং তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে।
কিংবদন্তি নাবিক সিন্দবাদ
আরেকটি বিখ্যাত কিংবদন্তি গল্প, যা বর্তমান ইরাক থেকে আরম্ভ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এই কিংবদন্তি অনুসারে সিন্দবাদ ছিল একজন বিখ্যাত নাবিক ও অভিযাত্রী। তার দুঃসাহসিক অভিযাত্রা আর কাজের অসংখ্য গল্প রয়েছে। সিন্দবাদের সাতটি দুঃসাহসিক অভিযানের গল্পের কথা পাওয়া যায়। এসব গল্পের বেশিরভাগই যাদুকরী প্রাণী আর শক্তিশালী দানবদের নিয়ে তৈরি, যাদের মুখোমুখি হয়েছিল সিন্দবাদ। আর তাদের সাথে মোকাবিলা করে বিজয় লাভ করেছিল।
হারিয়ে যাওয়া শহর মরুভূমির আটলান্টিস
হারিয়ে যাওয়া শহর মরুভূমির আটলান্টিস, যা এখন আরবের একটি পৌরাণিক কাহিনী এবং কিংবদন্তি। পৌরাণিক কাহিনী মতে এটি ছিল আরবের একটি প্রাচীন শহর, যা সৃষ্টিকর্তা একটি বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটিয়ে ধ্বংস করে দেয়। ফলে এই শহরটি বালির নিচে চাপা পড়েছিল। শহরটিকে ওয়াবার, ইরাম, উবার এবং পিলার অব ইরামসহ অনেক নামে উল্লেখ করা হয়। এই স্থানটি সত্যিই কি পৌরাণিক কাহিনী নাকি বাস্তবে এর অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়ে পণ্ডিত, ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক এবং অনুসন্ধানকারীদের মধ্যে বেশ বিতর্ক রয়েছে। যদিও এটি দাবি করা হয়েছিল যে শহরটি ১৯৯২ সালে ওমানে আবিষ্কৃত হয়েছিল, তবে খুব কম লোকই বিশ্বাস করে যে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি উবারই ছিল। অনেক অভিযাত্রী এই গল্পের উপর এখনো বিশ্বাস করে চলেছেন এবং হারিয়ে যাওয়া শহরটির অনুসন্ধান করছেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে এটি আধুনিক সৌদি আরবের দক্ষিণ মরুভূমির কোথাও অবস্থিত।
পৌরাণিক কাহিনী, রূপকথা, লোককাহিনী, উপকথা বা দৈত্য দানো যা-ই বলি না কেন, এসব তৈরি হয়েছিল মানুষের কল্পনা, বা কল্পকাহিনীর উপর ভিত্তি করে। যদিও এসব কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাক বা না যাক, তারপরও মানুষের মনোব্যাঞ্জনা, আকাঙ্ক্ষা আর আনন্দের জন্য প্রাচীন আরবে এসবের বেশ গুরুত্ব ছিল তা বলাই যায়।