Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পুরাণ সবিশেষ ৩: কালনেমির লঙ্কাভাগ

বাংলাভাষায় ‘কালনেমির লঙ্কাভাগ’ একটি বহুল প্রচলিত বাগধারা। এর অর্থ, কর্ম না করেই ফলের ব্যাপারে অলীক কল্পনায় ডুবে থাকা। অনেকটা ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’- এর মতো। বাগধারাটির উৎস বিখ্যাত মহাকাব্য রামায়ণ। রামায়ণের একটি বিখ্যাত কাহিনীর উপর আধারিত এ বাগধারাটি।

পুরাণ ঘাঁটলে মূলত দুজন কালনেমিকে পাওয়া যাবে। প্রথমজন দৈত্য কালনেমি। দ্বিতীয়জন রাক্ষস কালনেমি। বর্তমানে দৈত্য আর রাক্ষসের প্রচলিত অর্থ এক হলেও পুরাণে এদের অর্থ ভিন্ন। দৈত্য শব্দটি এসেছে ‘দিতি’ থেকে। মহামুনি কাশ্যপ প্রজাপতি দক্ষের তেরোজন কন্যাকে বিয়ে করেন, যাদের থেকে একেকটি প্রজাতির জন্ম হয়। দেবতা, অসুর, দানব ইত্যাদি। দিতি কাশ্যপেরই একজন পত্নী। দিতি গর্ভে কাশ্যপের দুটি পুত্র হয় হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু। দুজনই ভগবান বিষ্ণুর দুই অবতারের হাতে নিহত হন।

দিতি থেকে জাত বলে এদের বলা হয় দৈত্য। তেমনি কাশ্যপের আরেক পত্নী দনুর সন্তানদের বলা হয় দানব। দেবতাদের মা হলেন অদিতি। আদতে, অসুর-দেবতা, দৈত্য-দানব সম্পর্কে বৈমাত্রেয় ভাই। হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু- এই দুই ভাই থেকে দৈত্যকুলের বিস্তার হয়। হিরণ্যাক্ষের দুই পুত্র। কালনেমি ও অন্ধক। কালনেমিকে ভগবান বিষ্ণু, আর অন্ধককে ভগবান শিব বধ করেন।

দৈত্য কালনেমি ভগবান বিষ্ণু কর্তৃক নিহত হয়; Image Source: 4 KRSNA

আরেকজন কালনেমি ছিল রাক্ষস মারীচের পুত্র। এ সেই মারীচ, যে সোনার হরিণ সেজে সীতার মন হরণ করে রামকে সীতার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। যার ফলস্বরূপ, রাবণ কর্তৃক সীতা অপহৃত হন। মারীচ রামের হাতে নিহত হলে তার পুত্র কালনেমিকে রাবণ তার অমাত্য নিযুক্ত করেন। উল্লেখ্য, মারীচের মা তাড়কা রাক্ষসীকেও রাম বধ করেছিলেন মহর্ষি বিশ্বামিত্রের আদেশে।

রাক্ষস মারীচ স্বর্ণমৃগের বেশে সীতার মন হরণ করে; Image Source : Talking Myths

আবার কোনো কোনো রামায়ণের সংস্করণে কালনেমিকে রাবণের মামা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। মহারাজ সুমালীর পুত্র এবং কৈকেসীর ভ্রাতা। বাংলা ভাষায় প্রচলিত রামায়ণগুলোতে কালনেমিকে রাবণের মামা হিসেবেই উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কালনেমিকে কিছুটা হাস্যকর হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন কৃত্তিবাসসহ অন্যান্য বাঙালি লেখক ও অনুবাদকগণ। বয়স্ক একজন রাক্ষস, যে মায়াবী হওয়া সত্ত্বেও অলীক কল্পনায় মেতে থাকতে ভালোবাসে। ঘোড়ারোগগ্রস্ত।

বাংলা ভাষায় সবচেয়ে প্রচারিত রামায়ণের দুটো সংস্করণ; Image Source : sanatangyaan.com

ঘটনার সূত্রপাত হয় রাবণপুত্র মেঘনাদ রামানুজ লক্ষ্মণকে শক্তিশেলের আঘাতে আহত এবং মূর্ছিত করলে। মূর্ছিত লক্ষ্মণকে মেঘনাদ উঠিয়ে লঙ্কাপুরীতে নিয়ে যেতে আসলে হনুমান তাকে গদার আঘাতে ধরাশায়ী করে এবং লক্ষ্মণকে ফেলে রেখেই লঙ্কায় ফিরে যেতে বাধ্য হয় মেঘনাদ। মূর্ছিত লক্ষ্মণকে কোলে নিয়ে রামচন্দ্র শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লে পুরো বানর বাহিনীতে ভীতি ও হতাশার সৃষ্টি হয়। বিভীষণের পরামর্শে হনুমান গিয়ে লঙ্কা থেকে রাক্ষস বৈদ্য সুষেণকে তুলে নিয়ে আসে। সুষেণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্মণকে পরীক্ষার পরে বলেন যে,

“এ আমার কম্ম নয়। শক্তিশেলের বিষ কাটাতে পারে একমাত্র সঞ্জীবনী বটিকা। সূর্যোদয়ের আগে গন্ধমাদন পর্বত থেকে বিশল্যকরণী, সুবর্ণকরণী, মৃতসঞ্জীবনী ও সন্ধানী এ চার প্রকার ভেষজ এনে লক্ষ্মণকে খাওয়াতে পারলে তবেই লক্ষ্মণ শক্তিশেলের প্রভাব কাটিয়ে সুস্থ হতে পারবে।”

শক্তিশেলের আঘাতে আহত লক্ষ্মণ; Image Source: ritsin.com

সুদূর গন্ধমাদন পর্বত (কেউ কেউ আরো নির্দিষ্ট করে আরেকটি টিলার নাম বলেন) থেকে এত অল্পসময়ের ভেতর সঞ্জীবনী বটিকা আনার ক্ষমতা ছিল একমাত্র হনুমানের। হনুমান ‘জয় শ্রী রাম’ বলে রওনা দেন। এদিকে রাবণের গুপ্তচরেরা তাকে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বললে রাবণ হনুমানকে আটকানোর নানা ফন্দিফিকির করতে থাকেন। একপর্যায়ে তার মাথায় কালনেমির নাম আসে। কারণ কালনেমি ছিলেন রূপ বদল করে ধোঁকা দিতে সিদ্ধহস্ত। রাবণ গিয়ে কালনেমিকে বলেন,

“মামাশ্রী, এ যাত্রায় আপনাকেই উদ্ধার করতে হবে। আপনি গন্ধমাদনে গিয়ে যেকোনোভাবে হনুমানকে হত্যা করুন যাতে সঞ্জীবনী রাম শিবিরে পৌঁছতে না পারে।”

রাবণের অনুরোধে ঢোঁক গিলে কালনেমি বলেন,

“হনুমান মহাশক্তিধর ও মহাজ্ঞানী। তাকে হত্যা করা আমার কম্ম নয়। তুমি অন্য পথ দেখো।”

রাবণ এতে মারাত্মক ক্ষেপে যান। অনুরোধে কাজ না হওয়ায় কালনেমিকে হত্যার হুমকি দেন। হত্যার ভয়ে কালনেমির পিলে চমকে যায়। বয়স্ক মামার চোখে-মুখে ভীতি দেখে রাবণ খানিকটা মিষ্ট সুরে কথা বলেন এবারে। শেষে রাবণ কালনেমির দুর্বলতা, তার ঘোড়ারোগকে উস্কে দেন এই বলে যে, আচ্ছা, ঠিক আছে। হনুমানকে বধ করতে হবে না। ওকে সূর্যোদয় পর্যন্ত আটকে রাখুন, যাতে ও বটিকা নিয়ে যথাসময়ে পৌঁছতে না পারে। আর তা যদি পারেন, তবে কথা দিচ্ছি আমার এ স্বর্ণলঙ্কার অর্ধেক আমি আপনাকে দিয়ে দেব।

পটচিত্রে হনুমানের গন্ধমাদন তুলে আনার দৃশ্য; Image Source: 4 KRSNA

এবার জায়গামতো ওষুধ পড়ে। কালনেমির দু’চোখ চকচক করে ওঠে। লঙ্কার কোনদিককার ভাগ নিলে তার লাভ হবে, কোন পাশের প্রজারা বেশি স্বচ্ছল এবং তাকে বেশি খাজনা দেবে, তার নতুন সভায় তিনি কাকে কাকে অমাত্য-মন্ত্রী নিযুক্ত করবেন- এসব ভাবনা ভাবতে শুরু করেন কালনেমি।

মায়াবলে চোখের পলকে গন্ধমাদনে পৌঁছে যান তিনি। মায়ার শক্তিতে সেখানে অপূর্ব এক তপোবন সৃষ্টি করে ঋষির বেশ ধরে সাধনার আসনে বসে ‘রাম রাম’ জপ করা শুরু করেন। খানিকক্ষণ বাদেই হনুমান গন্ধমাদনে এসে হাজির হন। গন্ধমাদনে রামনাম শুনে হনুমান চকিত হন এক মুহূর্ত। খুঁজতে খুঁজতে হনুমান সেই মায়াবী তপোবনে ঋষি বেশধারী কালনেমির সামনে এসে উপস্থিত হন তারপর। কালনেমিকে প্রণাম করে তার পরিচয় জানতে চাইলে কালনেমি বলেন,

“তোমাকে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে, পুত্র। আগে স্নান করে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নাও। তারপর কথা বলব।”

হনুমান বিশ্রাম নিতে অস্বীকৃতি জানান। সঞ্জীবনী বটিকার ব্যাপারে ঋষিকে বারবার তাগাদা দিতে থাকে। ঋষিরূপী কালনেমি বলেন,

“তোমার যখন এতই তাড়া, তবে বিশ্রাম নিতে হবে না। ঐ পুষ্করিণীতে গিয়ে একটি ডুব দিয়ে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়াও। আমি একটি মন্ত্র দিচ্ছি তোমাকে। সেটি পাঠ করলে কোনো ক্লান্তি, জড়া তোমায় আর স্পর্শ করতে পারবে না।”

হনুমান খুশিমনে সে পুষ্করিণীতে নামে। কালনেমি তাকে সেখানে নামতে আদেশ দেয় কারণ সেখানে বাস করত একটি বিরাট ভয়ানক কুমির। কালনেমি আশা করেছিলেন, এদিকে হনুমান কুমিরের পেটে যাবে, আর ওদিকে তিনি অর্ধলঙ্কেশ্বর হবেন। তার মনে শুধু ঐ একটি বিষয়ই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। হনুমান পুষ্করিণীতে নেমে অবগাহন আরম্ভের কিছুক্ষণের ভেতর কুমিরটি তাকে আক্রমণ করে।

কুমিরের সাথে যুদ্ধ করে তাকে বধ করার পরে কুমির চিরে বেরিয়ে আসে এক ফুটফুটে সুন্দরী কন্যা। এ পর্যন্ত বাংলা ও সংস্কৃত রামায়ণ এক কথা বলে। এখান থেকে সংস্কৃত রামায়ণ কিছুটা ভিন্ন পথে প্রবাহিত হয়েছে। সংস্কৃত রামায়ণানুসারে, মেয়েটি হনুমানকে বলেন,

“অহো ভাগ্য আমার হে পবনপুত্র! আমি একজন গন্ধর্বী। আপনি যাকে ঋষি ভেবে ভুল করেছেন, সেও আগের জন্মে একজন গন্ধর্ব ছিল। মহর্ষি দুর্বাসার কুরূপ দেখে আমরা দুজনই হেসে ফেলেছিলাম। দুর্বাসার শাপে আমাদের এ দশা হয়েছে। অনেক অনুরোধের পর ঋষির মনে গলে। তিনি আমাদের বলেন যে, ত্রেতাযুগের শেষভাগে বায়ুপুত্র হনুমান এসে তোদের দুজনকেই দুই জড় দেহ থেকে মুক্তি দেবে। আপনি আমাকে মুক্তি দিয়েছেন। এবার আমার সঙ্গীকেও দিন।”

কুমিরকে চিরে গন্ধর্বীকে মুক্তি দেয় হনুমান; Image Source: Stone Stories

গন্ধর্বীর কথায় হনুমানের মন গললে তিনি এসে কালনেমিকে বধ করে তাকেও মুক্তি দেন। গন্ধর্ব আর গন্ধর্বী হনুমানকে প্রণাম করে স্বর্গলোকে ফিরে যায়। এখানে কালনেমির কল্পনাবিলাসিতার বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব রাখে না। হনুমান পর্বতের ঠিক কোন পাশে বটিকাগুলো পাওয়া যাবে, তা তিনি জানতেন না। গাছগুলোও ছিল তার অচেনা। খুঁজতে গেলে সময় নষ্ট হবে। তাই, দক্ষিণহস্তে অর্থাৎ, ডানহাতে পুরো গন্ধমাদনই তুলে আনেন হনুমান। আকাশে পর্বত হাতে উড়ন্ত হনুমানকে দেখে দুই শিবিরেই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তারপর বৈদ্য সুষেণ পর্বতে চড়ে বটিকাগুলো সংগ্রহ করে এনে লক্ষ্মণকে সেবন করালে তার কিছুক্ষণ পর লক্ষ্মণের জ্ঞান ফেরে এবং তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।

গন্ধমাদন নিয়ে হনুমান সূর্যোদয়ের আগেই ফিরে আসে; Image Source : dolls of india

বাংলা রামায়ণ বলছে একটু ভিন্নকথা। হনুমান কুমিরকে মেরে গন্ধর্বীকে মুক্তি দিলেও কালনেমিকে বধ করে তার মুক্তির পথ প্রশস্ত করে না। গন্ধর্বী হনুমানকে রাক্ষস কালনেমির ব্যাপারে সচেতন করলে হনুমান স্নান সেরে প্রস্তুত হয়ে তার সামনে গিয়ে হাজির হন। তারপর বলেন,

“ঋষিবর, আপনার কাছ থেকে মন্ত্র নেওয়ার আগে আপনাকে গুরুদক্ষিণা দিতে চাই।”

কালনেমি বলেন,

“সে কী কথা! আগে মন্ত্র নাও, পরে সুবিধামতো গুরুদক্ষিণা দেবে ক্ষণ।”

হনুমান বলে,

“না ঋষিবর, আমাদের ওখানে এরকমই নিয়ম। আগে দক্ষিণা পরে শিক্ষা।”

কালনেমি বলে,

“ঠিক আছে। তোমারই জিত। দাও, কী দক্ষিণা দেবে, দাও।”

কালনেমির সাথে লড়াইরত হনুমান (রামানন্দ সাগরের ‘সম্পূর্ণ রামায়ণ’ টিভি সিরিজ থেকে); Image Source : DNA India

তখন হনুমান তার গদার এক আঘাতে কালনেমিকে শূন্যে উড়িয়ে দিলে বেচারা কালনেমি সোজা গিয়ে পড়েন রাবণের সভায়, তার সিংহাসনের সামনে। সেখানেই প্রাণত্যাগ করেন কালনেমি। সেই থেকে বাংলাভাষায় ‘কালনেমির লঙ্কাভাগ’ একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিভিন্ন পুরাণভেদে এসব কাহিনীতে মতান্তর রয়েছে, তাই অমিল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এই লেখাতে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

This article is in Bangla. It describes the background story of the idiom in the same name as the title. It's a story from the epic 'Ramayan'.

Most of the necessary references have been hyperlinked inside the article and here are some reference books:

  1. বৃহৎ, সটীক ও সচিত্র সপ্তকাণ্ড কৃত্তিবাসী রামায়ণ (মূল রামায়ণ থেকে কৃত্তিবাস পণ্ডিত কর্তৃক পয়ার ত্রিপদী ছন্দে অনুবাদিত). সম্পাদনা : শ্রী বেনীমাধব শীল, প্রকাশক : অক্ষয় লাইব্রেরি (কলকাতা).
  2. সচিত্র কিশোর পুরাণ সমগ্র (২০১৫). দীন ভক্তদাস বিরচিত. প্রকাশক : অক্ষয় লাইব্রেরি (কলকাতা).
  3. পুরাণের গল্প. লেখক : উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী. মূল বই : উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র (২০০৪). প্রকাশক : দে'জ পাবলিকেশন্স (কলকাতা, ৭০০ ০৭৩)
  4. বাংলা শব্দের পৌরাণিক উৎস (২০১৫). লেখক : ড. মোহাম্মদ আমীন. প্রকাশক : পুথিনিলয় প্রকাশনী (ঢাকা – ১১০০).

Featured Image: Daily Hunt

Related Articles