পুরাণগুলো রচিত হয়েছিল আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে। সে যুগে সাহিত্যের মুখ্যধারা বলতে যা ছিল, তা এই পুরাণই। তাই, তখনকার সভ্যতা-সংস্কৃতির ব্যাপারে জানতে হলে পুরাণে মুখ গুঁজতেই হবে। পুরাণ রচয়িতাগণ ঠিক যে পুরাণ রচনা করেছিলেন, আজকের পুরাণগুলো একদম সে অবস্থায় নেই। যুগান্তরে সেগুলো পরিবর্তিত, পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত হয়ে আজকের রূপ পরিগ্রহ করেছে। অনুবাদের খাতিরেও পুরাণের বিভিন্ন সংস্করণ ভূ তথা ভারতের একেক অঞ্চলে একেক ভাষায় প্রচারিত হয়েছে। সেজন্যে একই প্রসঙ্গে একাধিক পৌরাণিক ঘটনা বা প্রেক্ষাপট বা চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। যারা প্রকৃত রসবোদ্ধা, তারা এ বিষয়গুলো মেনে নিয়েই পুরাণ থেকে রসাহরণ করেন।
দেবতা হয়েও ঋষি স্বভাবের দরুন নারদকে বলা হয় দেবর্ষি। নারদ কিন্তু যেনতেন ঋষি নন। স্বয়ং ব্রহ্মার মানসপুত্র তিনি। সৃষ্টির আদিলগ্নে ব্রহ্মার মন থেকে জাত হওয়া কয়েকজনের ভেতর নারদ একজন। নারদের জন্মের পরে ব্রহ্মা তাকে সংসারধর্ম পালন করে সৃষ্টিকে এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলে নারদ বেঁকে বসলেন। তিনি বললেন, “হে পিতা, আমি সৃষ্টির জটিল প্রক্রিয়ায় নিজেকে জড়াতে চাই না। ঈশ্বরের নামগান, গুণকীর্তন করেই জীবন নির্বাহ করতে চাই।” পুত্রের কথায় ব্রহ্মদেব রেগে গিয়ে তাকে শাপিত করলেন, “তবে আর দেবতা হয়ে কি করবে? তুমি বরং গন্ধর্বযোনিতে জন্ম নাও। আর সংসারের প্রবাহকে তুমি বিড়ম্বনা ভাবলে। তাই, সংসারের সকল ঝঞ্ঝাটের মূলে থাকবে তুমি।”
ব্রহ্মদেবের শাপে নারদ গন্ধর্ব হয়ে জন্মালেন। তার নাম হল উপবর্হণ। উপবর্হণের সাথে গন্ধর্বশ্রেষ্ঠ চিত্ররথের অর্ধশত কন্যার বিবাহ হল। গন্ধর্ব হওয়ায় নারদ সঙ্গীতকে জীবনের একমাত্র অবলম্বন করেন। স্বর্গসভায় গীত পরিবেশন করে দেবতাদের মনোরঞ্জনই ছিল তার ধর্ম। একদিন ইন্দ্রসভায় অপ্সরা রম্ভার নৃত্য দেখে উপবর্হণের অসংযমী আচরণের জন্য তাকে স্বর্গচ্যুত করে মানবযোনিতে পাঠানো হয়।
এবার নারদের জন্ম হয় গোপদের রাজা দ্রুমিলের বন্ধ্যা পত্নী কলাবতীর গর্ভে। মানবজন্মে নারদের পিতা ঠিক দ্রুমিল ছিলেন না। তার পিতা ছিলেন কাশ্যপ মুনি। নারদ ও তার মা কলাবতীকে দ্রুমিল ত্যাগ করেন। কলাবতী ঋষিগণের পদসেবা করে দিনযাপন করতেন। নারদও মায়ের সাথে আশ্রমে আশ্রমে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন কলাবতীও নারদকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান। অনাথ নারদকে ঋষিগণ প্রতিপালন করেন। ঋষিদের পরিধেয় পড়ে, ঋষিদের এঁটোকাঁটা খেয়ে নারদ জীবনযাপন করতে থাকেন। ঋষিদের উচ্ছিষ্ট ছিল মূলত বিষ্ণুর প্রসাদের অবশিষ্টাংশ। নিয়মিত সেগুলো সেবনের ফলে নারদের দেহমনে গভীর বিষ্ণুভক্তির সঞ্চার হয়।
ঋষিরা নারদের পূর্বজন্মের কথা জানতে পেরে তাকে জ্ঞান এবং শিক্ষা-দীক্ষা প্রদান করেন। দাসবৃত্তি ছেড়ে নারদ ঋষিদের সাথে তপ শুরু করেন। ধীরে ধীরে নারদ পূর্বজন্মের কথা জানতে পারেন এবং দিব্যজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় দেবর্ষির আসনে অধিষ্ঠিত হন।
নারদের ব্যাপারে সবচেয়ে প্রচলিত চিহ্নটি হলো মুখে সর্বদা ‘নারায়ণ নারায়ণ’ জপ। সম্ভাষণে নারায়ণ, সম্মতিতে নারায়ণ, বিদায়বেলাতেও নারায়ণ। নারদ বিষ্ণুভক্তির শক্তিমান পরাকাষ্ঠা। নারদের ভক্তির ব্যাপারে একটি গল্প প্রচলিত আছে। একদিন বৈকুণ্ঠধামে বিষ্ণুর সাথে কথা বলতে বলতে নারদ বিষ্ণুকে প্রশ্ন করলেন, “প্রভু, এ সংসারে আপনার সবচেয়ে বড় ভক্ত কে?” নারদ আশা করেছিলেন, বিষ্ণু তার নাম নেবেন। কিন্তু বিষ্ণু মুচকি হেসে এক দরিদ্র কৃষকের নাম নিলে নারদ চকিত ও আহত হন। তিনি বলেন,
“এ সংসারে একমাত্র আমিই আপনার নামগান ত্রিলোকে প্রচার করি। সদা-সর্বদা বিষ্ণুচিন্তায় নিজেকে মগ্ন রাখি। আর আপনার সবচেয়ে বড় ভক্ত ঐ দরিদ্র কৃষক!”
নারদ তখনই বৈকুণ্ঠ ত্যাগ করে সেই কৃষকের বাড়িতে গিয়ে হাজির হন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাকে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। দেখলেন কৃষক সকালে উঠে ভক্তিভরে বিষ্ণুকে স্মরণ করে সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলায়। আবার, রাতে সব কাজ সেরে ভক্তিভরে বিষ্ণুকে স্মরণ করে ঘুমোতে যায়। নারদ বৈকুণ্ঠে ফিরে বিষ্ণুকে বলেন,
“এ আপনার কেমন বিচার, প্রভু? কৃষক দিনে মাত্র দু’বার আপনাকে মনে করেই সবচেয়ে বড় ভক্ত হয়ে গেল!”
তখন বিষ্ণু নারদকে একটি তেলভর্তি ভাঁড় দিয়ে বলেন, “এই ভাঁড় হাতে করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে এসো। দেখো, এক ফোটা তেলও যেন না পড়ে।” বিষ্ণুর নাম নিয়ে নারদ ভাঁড় নিয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে পুনরায় বিষ্ণুর সামনে এসে হাজির হলে বিষ্ণু তাকে বলেন, “প্রদক্ষিণরত অবস্থায় কয়বার আমাকে স্মরণ করেছ?” নারদ বলে,
“প্রভু, পুরো মনোযোগ তেলে ছিল। তাই, আপনাকে স্মরণ করতে পারিনি। তবে শুরু করেছিলাম আপনার নাম নিয়েই।”
বিষ্ণু তখন হেসে নারদকে বলেন,
“ঐ দরিদ্র কৃষক সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে রাতে শুতে যাওয়ার আগে আমাকে স্মরণ করে। আবার ঘুম থেকে উঠেও আমার কথা চিন্তা করেই তার দিন শুরু হয়। সে জীবনের সবচেয়ে করুণ সময়েও আমাকে একদিনের জন্যও ভোলেনি। এবার বুঝলে তো, কৃষক কেন আমার সবচেয়ে বড় ভক্ত?”
নারায়ণের উত্তরে নারদ আনন্দিত হন।
নারদের সঙ্গীতে পারদর্শিতার কথা ত্রিভুবন বিদিত। বীণা ও করতাল নিয়ে সর্বদা ভক্তিমূলক গীতে লীন থাকতেন নারদ। নারদ চৌষট্টি কলায় পারদর্শী ছিলেন। সর্বপ্রকার বিজ্ঞানে পণ্ডিত ছিলেন। ব্রহ্মার কণ্ঠ থেকে আবির্ভাবের দরুণ নারদ জন্ম থেকেই সঙ্গীতপ্রিয় এবং সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। গন্ধর্ব ও মানব থাকাকালীন তিনি গানবাজনায় তালিম নিয়েছিলেন জগতশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতগুরুদের কাছে। শ্রীকৃষ্ণও তাদের একজন। তবে, নারদের গানে বা রাগে কোথাও না কোথাও একটু ত্রুটি থাকত। এটি তিনি সহজাতভাবেই করতেন। নারদ ভুল রাগ গেয়েও গর্ব করতেন।
একবার রাগ-রাগিনীরা বিকলাঙ্গ নর-নারীর রূপ ধরে নারদের পথে এসে দাঁড়ান। নারদকে তাদের এ দশার জন্য দায়ী করেন। নারদ এতে মর্মাহত হন এবং তাদের সুস্থ করার উপায় জানতে চান। তারা বলে যে, একমাত্র দেবাধিদেব মহাদেব সূক্ষ্মভাবে তাদের গাইতে পারবেন। তিনি যদি সঙ্গীত পরিবেশন করেন, তবে তাদের বিকলাঙ্গতা দূর হয়। নারদ মহাদেবকে গিয়ে ধরলে মহাদেব বলেন,
“প্রকৃষ্ট শ্রোতা না পেলে প্রকৃষ্ট গীত কীভাবে বের হবে? আগে শ্রোতা যোগাড় করো।”
নারদ শ্রোতা হিসেবে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে নিয়ে আসেন। ব্রহ্মা শিবের গানের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেন না। বিষ্ণু সে গান শুনে গলে যাওয়া শুরু করেন। তখন ব্রহ্মা সে গলিত অংশ তার কমণ্ডলুতে সংরক্ষণ করেন, যেটি পরবর্তীতে গঙ্গা নামে স্খলিত হয়।
পিতার অভিশাপে নারদ সকল কলহের মূলে থাকতেন। নারদকে বলা হয় ‘কলহপ্রিয়’। পরিস্থিতির বিপরীতে নারদের মুখ দিয়ে অকস্মাৎ এমন একটি কথা বেরিয়ে যেত, যেটি পরিস্থিতি আরো জটিল করত। শেষে অবশ্য মঙ্গলই হতো। ত্রিলোকের সবখানে ছিল নারদের অবাধ বিচরণ। কোনো জায়গায় যেতে তিনি নিমন্ত্রণের তোয়াক্কা করতেন না। আবার তিনি যেকোনো স্থানে দণ্ডকালের বেশির থাকতে পারতেন না। এটিও এক অভিশাপের ফল।
ব্রহ্মার আরেক মানসপুত্র দক্ষের পুত্রদের নারদ ভক্তিরসে সিক্ত করে সংসারী থেকে যোগী করেছিলেন। তারা সবাই গৃহত্যাগ করেছিল। এতে দক্ষ ক্রুদ্ধ হয়ে নারদকে অভিশাপ দেন যে,
“তোমার জন্য আমার পুত্রেরা গৃহ ছেড়েছে। তুমিও দণ্ডকালের বেশি কোথাও থাকতে পারবে না।”
নারদের বাহন ঢেঁকি। ঢেঁকিতে চড়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতেন বা পরিবেশন করতেন। নারদকে দেখে সবাই ভক্তিও করত আবার ভয়ও পেত। নারদ অনেকবার দেবতা ও অসুরদের যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। কোনো দেব-দানব-মানবের মনে সন্দেহ উৎপন্ন করার কাজে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। নারদকে তাই কেউ খুব একটা বিশ্বাস করত না। একজনের কথা আরেকজনকে বলে তিনি কলহ সৃষ্টি করে মজা পেতেন। অসুরেরা স্বর্গ দখল করলে তিনি অসুরদের কাছে গিয়ে এমন ভাব দেখাতেন যে, তিনি এতদিন ধরে অসুরদের স্বর্গ দখলের অপেক্ষাতেই ছিলেন।
এমনকি নারদ অসুরদের বলে দিতেন, কীভাবে দেবতাদের শক্তি নষ্ট হবে। আবার অসুরদের দুর্বলতার খবর গিয়ে দেবপক্ষকে বলে দিতেন তিনি। নারদের ঢেঁকি থেকেই ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলও ধান ভানে’ প্রবাদটির উদ্ভব হয়েছে। তার ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও কলহসংগঠকের ভূমিকাই পালন করবে। তাই, প্রবাদটি দিয়ে সব মহলে কারো স্বভাবসিদ্ধ আচরণকে বোঝানো হয়। নারদ নামটির সাথে ঢেঁকির একটি সূক্ষ্ম সম্পর্ক আছে। নারদ সবসময় জলতর্পণ করে পূজা সারতেন বলে তার নাম হয় নারদ। আর, জল থেকে কৃষি। কৃষির সাথে ঢেঁকি।
নারদের ব্যাপারে পুরাণ, মহাভারত, রামায়ণে অনেক ঘটনা উল্লেখ আছে। রামায়ণের লেখক বাল্মিকীকে দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মিকীতে পরিণত করতে নারদ ভূমিকা রেখেছিলেন। মহাভারতে দ্রৌপদীর সঙ্গকে পাঁচ স্বামীর ভেতর সমানভাবে বণ্টিত করেছিলেন নারদ। হিরণ্যকশিপুর গর্ভবতী পত্নী কয়াধুকে ইন্দ্র হরণ করতে এলে নারদ তাকে রক্ষা করে নিজের আশ্রমে নিয়ে আসেন। মাতৃগর্ভে শিশু প্রহ্লাদ নারদের হরিগুণ-কীর্তন শুনে বিষ্ণুভক্ত হয়ে ওঠেন। জন্মের পরেও কিছুকাল প্রহ্লাদ নারদের নিকট শিক্ষালাভ করেছিলেন।
নারদ হর-পার্বতীর বিয়েতে ঘটকালি করেছিলেন। হিমালয়ের কাছে শিবের গুণ-কীর্তন করে হিমালয়ের মনে শিবের প্রতি ভক্তির উদ্রেক করেন তিনি। তিনি শিশু ধ্রুবকেও দীক্ষিত করেন। নারদ বিন্ধ্যের কাছে সুমেরুর প্রশংসা করে বিন্ধ্যের মনে মোহ উৎপন্ন করে বিপর্যয় তৈরি করেন। কংসের কাছে কৃষ্ণের জন্মের কথা বলে দেবকী ও বাসুদেবকে অন্তরীণ করতে নারদের ভূমিকা ছিল। কৈলাসে দিব্য আম নিয়ে গিয়ে গণেশ ও কার্তিকের ভেতর দ্বন্দ্বমূলক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেন তিনি।
এভাবে, নারদ নানা লোকে নানা ঘটন-অঘটন ঘটাতে ভূমিকা রাখেন। নারদের ব্যাপারে আরেকটি গল্প প্রচলিত আছে, যেটিতে তিনি তার উপাস্য নারায়ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। তার অভিশাপের ফলে বিষ্ণু রাম অবতারে স্ত্রীবিয়োগের পীড়া লাভ করেছিলেন। সে গল্প আরেক লেখায় বলা যাবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট, ঘটনাক্রম, চরিত্র, প্রতিবেশ প্রভৃতি বিষয়ে অল্পবিস্তর মতভেদ থাকতে পারে। তবে, গল্প বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীটিই অনুসরণ করা হয়েছে। কোনো ধর্ম, বর্ণ এবং মতবাদকে কোনোরূপ কটূক্তি বা কটাক্ষ বা অপমান করার অভিপ্রায়ে এ লেখাটি রচিত হয়নি।