খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের আগে অব্দি ভাইকিং জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ছিল। গোটা মধ্যযুগ জুড়ে অজস্র গল্পেরা তাদের জীবন ও জগতের অর্থবাচকতা দিয়ে এসেছে। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সেই সব বিশ্বাস ও চর্চাকে বলা হয় নর্স পুরাণ। অবশ্য যারা এই পুরাণ এবং ধর্মকে পালন করে গেছেন; তাদের কাছে এর কোনো নাম ছিল না। পালন করা হতো প্রথা হিসেবে। খ্রিষ্টধর্মের আগমনের পরেও যারা স্থানীয় নর্স সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসকে লালন করতো; তাদের বলা হতো ‘হিদেন’ বা প্রাচীনপন্থী।
নর্স পুরাণের চরিত্রগুলো অন্যান্য উপকথা থেকে অনেক বেশি বিশেষত্বপূর্ণ। দেবতারা এখানে অনেক দিক থেকেই মানুষের মতো। তবে প্রাচীন ধর্মের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনুসারে একমাত্রিক। উদাহরণস্বরূপ, উর্বরতার দেবতা, যুদ্ধের দেবতা, সৌন্দর্যের দেবতা, জ্ঞানের দেবতা প্রভৃতি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে পৃথকভাবে ব্যক্তিত্ব আরোপ। যদিও দেব-দেবী ছাড়াও তাদের বিশ্বাসে আরো অতিমানবীয় চরিত্রের সাক্ষাৎ মেলে। দেবতাদের মতো শক্তিশালী না হলেও নর্স বিশ্ববীক্ষায় তাদের অবদান কম ছিল না। তাদের কেউ কেউ ভয়ংকর, কেউ উপকারী কিংবা কেউ ধ্বংসাত্মক।
পৃথক পৃথিবী
দুইটা প্রধান শিবিরে বিভক্ত নর্স দেবতারা- এসির এবং ভানির। প্রাচীন নর্স ‘এসির’ শব্দটি বহুবচন; একবচনে ‘অস’। একে ইন্দো-ইউরোপীয় ঐতিহ্যের সাথে মিলিয়ে পড়া যেতে পারে। আনসুজ অর্থ জীবনীশক্তি। হিট্টাইট ‘হাসু’ অর্থ রাজা। আবেস্তাতে আহুর বলা হয় দেবতাকে; বৈদিক ভারতে অসুর নির্দেশ করে দানবকেই। সমস্ত বিশৃঙ্খলা এবং দানবদের হটিয়ে দিয়ে বিশ্বজগতকে ধরে আছে এসির দেবতারা। তারাই যেন প্রাণ। নর্স পুরাণের বিখ্যাত সব দেবতারাই মূলত এসির শিবিরের। থর, ফ্রিগ, টিয়র, লোকি, বালদর, হেইমদ্যাল- প্রত্যেকেই একজন ‘অস’; আর তাদের প্রধান ওদিন। এসিরের আবাসভূমির নাম আসগার্দ; যা নর্স সৃষ্টিতত্ত্বের মহাবৃক্ষ ইগদ্রিসিলের সবথেকে উঁচু এবং রৌদ্রোজ্জ্বল শাখায় অবস্থিত।
অন্যদিকে বহুবচনে ভানির বলতে প্রাকৃতিক শক্তি ও জাদুবিদ্যার সাথে জড়িত দেবতাদের বুঝানো হয়। ফ্রেয়া, ফ্রেয়র, নিয়র্দর, স্কাদি- প্রত্যেকেই ‘ভানর’। তাদের বসবাস ভানাহেইমার অবস্থিত ইগদ্রিসিলের শাখাতেই। তবে স্নোরি স্টারলাসন `’সাগা অব ইংলিংস’-এ দাবি করেন, ভানিররাজ্য ভানাহেইমার অবস্থিত ভানাকভিসল নদীর তীরে। ভানাকভিসল্ শব্দটি এসেছে টানাকভিসল্ থেকে আর টানাকভিসল্ শব্দেরই গ্রীক উচ্চারণ টানাইস। একথা অজানা নয়, রাশিয়ার ডন নদীকে গ্রীসে টানাইস বলা হতো। ডন ছিল এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যবর্তী সীমারেখা। সেই চোখে তাকালে, আসগার্দ বা এসিররাজ্য বলতে তৎকালীন এশিয়াকেই নির্দেশ করে। আর ভানির হলো সীমানার বাইরের জাতিগোষ্ঠী। বৈদিক ভারতে আর্য বনাম অনার্যের সংঘর্ষে ভাগিরথী নদী যেমন সীমারেখা হয়ে ছিল; ঠিক যেন সেই গল্পেরই একটু ভিন্ন সংস্করণ।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
ভাইকিংরা পৃথিবীকে কারাগার মনে করে তা থেকে মুক্তি খুঁজেনি। তাদের কাছে দুনিয়াটা ছিল পবিত্র। প্রাকৃতিক নিয়ম ও বিধিবিধানকে মেনে নিয়ে সেই অনুপাতে নিজেকে সংশোধন করাটা মুখ্য ছিল। প্রাচীন চীনের তাওবাদ কিংবা বৈদিক যুগের হিন্দুধর্মের মতো। নর্স পুরাণ মতে, দেবতাদের সত্য প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম এবং নিজেদের ত্যাগকে অনুসরণ করাটাই সুন্দর জীবন। এজন্য দিনশেষে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতো ভিন্ন ভিন্ন দেবতা। উদাহরণস্বরূপ, যোদ্ধারা যুদ্ধের মাঠে প্রার্থনা করতো তারা যেন মৃত্যুর পর দেবরাজ ওদিনের বিশেষ বাহিনীতে যুক্ত হন।
দেবরাজ ওদিন
নর্স পুরাণের সবথেকে প্রভাবশালী ও জটিল চরিত্র দেবতাদের প্রধান ওদিন। প্রাচীন ইংরেজিতে Woden শব্দটি প্রাচীন স্যাক্সনে Woutan এবং প্রাচীন জার্মানে ভোতান। ইংরেজিতে Wednesday শব্দটি এসেছে Woden’s day থেকে। ওদিন বুদ্ধিমান এবং প্রাজ্ঞ। ভবিষ্যৎ দেখা, মৃতদের সাথে কথা বলা, জাদু এবং মানুষকে মোহিত করে কাজ করিয়ে নেয়াটা তার স্বাভাবিক ক্ষমতা।
একসময় যোদ্ধা, জাদুকর এবং ভ্রমণকারীরা ওদিনকে স্মরণ করতো কর্মে দৃঢ়তা এবং মনোযোগের জন্য। নর্স মিথের বহু কাজ থেকে জ্ঞানের প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ প্রমাণিত হয়। ওদিনের ঘোড়া স্লেইপনিরের পা আটটা; যা তাকে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে দ্রুতগামী করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ওদিনের সাথে থাকে গেরি এবং ফ্রেকি নামের দুটি নেকড়ে। সৃষ্টিজগতের সমগ্র খবর তার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য আছে দুইটা কাক- হুগিন এবং মুনিন। নানা রকম কৌশলে যেকোনো পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে ঘুরিয়ে দেয় ওদিন।
বজ্রদেবতা থর
প্রাচীন নর্স শব্দ হিসাবে থর- এর অর্থ বজ্র। ঝড় ও বজ্রের দেবতা থর মূলত দেবরাজ ওদিনের পুত্র। দানব, এলফ্, বামন এমনকি খোদ দেবতাদের মধ্যেও তার মতো শক্তিশালী কেউ ছিল না। থরের প্রিয় অস্ত্র মিওলনির নামের হাতুড়ি। সেই হাতুড়ির আঘাতে আগুন জ্বলে উঠে আকাশে। বজ্র টানা আর শত্রুকে আঘাত করা ছাড়াও বিশেষ ক্ষেত্রে পুনরুত্থিত করতে পারে মৃতকেও। Thor’s day থেকেই আধুনিক Thursday নামের উৎপত্তি।
থরের হাতে পরা থাকে লোহার দস্তানা- ইয়ার্নগ্রেইপর। বেল্ট মেগিনগিয়র্দ শক্ত করে বাঁধলে তার শক্তি আগের চেয়ে দ্বিগুন হয়ে ওঠে। আসগার্দে যাবার সেতুর নাম বাইফ্রস্ট। দেবতারা সেখান দিয়েই দেবসভায় যায়। কেবল থর যায় অন্যপথ ঘুরে। কারণ বাইফ্রস্ট দিয়ে তার যাতায়াতে তা ধসে পড়তে পারে। থরের রথের চালক হিসেবে থাকে টানগ্রিসনির এবং টাননিয়স্তির নামের দুই ছাগল। অন্যান্য দেবতারা যে কাজে বুদ্ধি ও কৌশল ব্যবহার করতে চায়; থর সেখানে মিওলনির নিয়ে সশরীরে হাজির। মাঝে মাঝে তো এমন সব ধ্বংসাত্মক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে; যা আর নিয়ন্ত্রণে থাকে না।
চিরকৌশলী লোকি
প্রাচীন নর্স শব্দ ‘লোগি’ অর্থ আগুন; আর জার্মান শব্দ ‘লোকি’ অর্থ গিঁট। উভয় ক্ষেত্রেই লোকির পরিচয় প্রকাশ পায়। কখনো সে অনিশ্চয়তা ডেকে আনে; কখনো বিপাকে ফেলে দেবতাদের। দানব ফারবাউতি এবং লাউফির সন্তান লোকি নিজের সুবিধা মতো আকৃতি বদল করতে সক্ষম। প্রধান অস্ত্র বলতে আছে চাতুর্য আর ছলনা। র্যাগনারকের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, লোকি এবং তার তিন সন্তান হেল, ইয়োরমুঙ্গানদর এবং ফেনরির সরাসরি দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে।
আসলে লোকিকে দেবতাদের পক্ষ বা বিপক্ষের শক্তি বলে হঠাৎ রায় দেওয়া যায় না। নিয়ম কিংবা সীমানাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লোকি কাজ করে নিজের ইচ্ছা অনুসারে। তাতে কখনো দেবতাদের উপকার হয়; কখনো পড়ে বেকায়দায়। ভালো আর খারাপের মধ্যকার ব্যবধান অনেক বেশি সূক্ষ্ম; লোকি বোধ হয় সেটাই প্রমাণ করতে চায় তার কাজের মধ্য দিয়ে।
ভানিররাজ নিয়র্দর
দেবতাদের ভানির শিবিরের প্রধান নিয়র্দর। বাতাস আর সমুদ্রের দেবতা হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। ভাইকিংস সমাজের মাঝি এবং জেলেরা তাকে স্মরণ করতো। সম্পদের সাথেও নিয়র্দরের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ। এজন্যই তৎকালে কাউকে সম্পদশালী বুঝাতে বলা হতো, নিয়র্দরের মতো সম্পদশালী। প্রলয়ংকর এসির বনাম ভানির যুদ্ধের শান্তিচুক্তি অনুযায়ী নিয়র্দরকে জিম্মি হিসেবে পাঠানো হয় এসিরের দরবারে।
তবে তারচেয়েও নিয়র্দর বিখ্যাত তার জমজ সন্তান ফ্রেয়র এবং ফ্রেয়ার কারণে। দানবী স্কাদির সাথে তার বিয়ে নিয়ে একটা আখ্যান খুব জনপ্রিয়তা পায়। দানবী স্কাদি তার পিতার মৃত্যুর কারণে দেবতাদের কাছে ক্ষতিপূরণ চায়। দেবতারা প্রস্তাব দেয়, সে চাইলে যেকোনো দেবতার স্ত্রী হতে পারবে। স্কাদি এই প্রস্তাবে বালদর ভেবে নিয়র্দরকে বেছে নেয় পতি হিসাবে। দিনশেষে বিয়েটা স্থায়িত্ব পায়নি।
এসির রাণী ফ্রিগ
ওদিনের স্ত্রী এবং এসির শিবিরে দেবতাদের রাণী হিসেবেই পরিচিত ফ্রিগ। বিয়ে, গার্হস্থ বিষয়াদি, প্রেম এবং প্রজ্ঞার সাথে তার নাম জড়িত। ফ্রিগ শব্দটি প্রোটো জার্মান শব্দ ফ্রিয়াজ থেকে এসেছে; যার অর্থ প্রিয়। আর আধুনিক Friday শব্দটি এসেছে Frigg’s day থেকে। অনেকেই তাকে ভানির দেবী ফ্রেয়ার সাথে মিলিয়ে ফেলতে চান নানা বৈশিষ্টের কারণে। তারপরেও ফ্রেয়া যেখানে যৌনতার ব্যাপারে অবাধ এবং স্বেচ্ছচারী; ফ্রিগ সেখানে রক্ষণশীল এবং মূল্যবোধ সম্পন্ন।
ফ্রিগ বসবাস করে পানির রাজ্য ফেনসালিরতে। পুরাণে তার বাজপাখির পালক বিখ্যাত। লোকি তার কাছ থেকেই পালক ধার নিয়েই বাজপাখি সেজে থরের হাতুড়ি খুঁজতে যায়। ফ্রিগ শ্বেতদেবতা বালদর এবং অন্ধ হোদরের মা। বালদরকে মৃত্যু থেকে বাঁচানোর জন্য সব রকম চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু নিয়তি বদলাতে পারেনি।
ভানির দেবী ফ্রেয়া
প্রোটো-জার্মানিক ঐতিহ্যে উচ্চবংশীয় পরিণত নারীকে শ্রদ্ধার্থে বলা হতো ফ্রাউইয়োন। ফ্রেয়া নামটা সেখান থেকেই উৎসারিত। ভানির শিবিরের প্রধান নিয়র্দরের মেয়ে এবং ফ্রেয়রের জমজ বোন। উর্বরতা এবং ভালোবাসার দেবী ফ্রেয়া আবাসভূমি ফোকভাঙ্গরে। যুদ্ধের সময় মৃতদের অর্ধেক চলে যায় ওদিনের ভালহালাতে আর বাকি অর্ধেক ফোকভাঙ্গর।
নর্স পুরাণের সবচেয়ে সংগঠিত জাদু সেইদরের চর্চা করে ফ্রেয়া। সেইদর নিয়তি অব্দি পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। এসির এবং ভানিরের যুদ্ধে তার স্পষ্ট নজির দেখা যায়। ফ্রেয়ার নেকলেস বেশ পরিচিত।
প্রহরী হেইমদ্যাল
আসগার্দের প্রহরী হেইমদ্যাল। নর্স পুরাণের নয়টি জগতের অভিভাবক এবং দেবতাদের সুরক্ষাদাতা। হেইমদ্যাল শব্দের অর্থ ‘যিনি জগতকে আলোকিত করেন’। ওদিন এবং নয় জন জলদানবীর সমন্বিত পুত্র সে। নয়জন মা বলতে নয় জগতকেই নির্দেশ করা হয়। হেইমদ্যাল সকল দেবতার চেয়ে প্রখর দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন। পাখির চেয়েও কম ঘুমিয়ে পাহারা দিতে পারেন। শ্রবণশক্তি এতটাই তীক্ষ্ণ যে, দুনিয়ার জমিনে কোনো ঘাস গজানো কিংবা ভেড়ার চুল খসে পড়ার শব্দও তার কান এড়ায় না। তার দাত স্বর্ণের। যেকোনো আখ্যানে হেইমদ্যালের আগমন সংশ্লিষ্ট থেকেছে সমুদ্র, স্বর্ণ এবং শরাবের সাথে।
গালারহর্ন নামের একটা শিঙ্গা বহন করে হেইমদ্যাল। যখন র্যাগনারক বা মহাপ্রলয়ের লক্ষণ দৃশ্যমান হবে; তখনই সে ফুঁকে দেবে শিঙ্গা। সাথে সাথে নয় জগৎ জেনে যাবে প্রতিশ্রুত সময় আসন্ন। সমস্ত দেবতারা একত্রিত হবে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য।
শ্বেত বালদর
ইন্দো-ইউরোপীয় ভেল শব্দের অর্থ সাদা। বাস্তবিক অর্থেই নর্স পুরাণে তাকে বর্ণনা করা হয়েছে এসির দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন এবং প্রিয় হিসেবে। শরীর দিয়ে যেন আলো বিচ্ছুরিত বালদরের। তবুও সাদা বলে কেবল রঙ না; প্রজ্ঞা, মেধা, স্বচ্ছতাকেও বুঝানো হয়েছে। দেবতা আর মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন বালদর। পিতা সর্বপিতা ওদিন এবং মা জ্ঞানের দেবী ফ্রিগ। দেবী নানা কে বিয়ে করার পর ফরেস্তি নামে তার একটা ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। শান্তি ও ন্যায়ের দেবতা হিসেবে বেড়ে উঠা ফরেস্তি পরবর্তীতে বিশৃঙ্খলার মীমাংসা এবং ক্রোধ প্রশমনে কাজ করে।
কূটকৌশলী লোকি অন্ধ হোদরকে প্ররোচিত করে বালদরের দিকে বর্শা ছুড়ে মারতে। কিছু না জেনে, না বুঝে হোদর তাই করে বসে। আর সাথে সাথে অপমৃত্যু ঘটে বালদরের। তার মৃত্যুতে দেবতা ও মানবজাতি শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। লোকিকে করা হয় বন্দী। র্যাগনারকের পর পুনরায় পৃথিবী যাত্রা শুরু করলে বালদর পুনরুত্থিত হবে।
সার্বজনীন টিয়র
এসির শিবিরের অন্যতম সদস্য টিয়র যুদ্ধ আর শৃঙ্খলার দেবতা বলে গৃহীত। একইসাথে যুদ্ধ আর শৃঙ্খলাকে প্যারাডক্স মনে হতে পারে। টিয়র শব্দের অর্থ ঈশ্বর। ইন্দো ইউরোপীয় শব্দ ডিউস এর প্রোটো জার্মানিক উচ্চারণ টিউয়াজ; যার অর্থ ঈশ্বর। শব্দটা মূলত আকাশ দেবতাকে ইঙ্গিত করে। প্রাচীন ভারতের আকাশ দেবতা দ্যৌস পিতৃ, গ্রীসের জিউস পাতের এবং রোমান জুপিটার শব্দগুলো পরিভাষাগত এবং ভাবগতভাবে এর সমান্তরাল। অন্যান্য সংস্কৃতির শীর্ষদেবতা নর্স পুরাণে তলিয়ে গেল কেন- তা গবেষণার বিষয় হতে পারে। আধুনিক Tuesday শব্দটি এসেছে মূলত Tyr’s day থেকে।
সর্বপিতা ওদিনের সন্তান টিয়রের হাত হারানোর ঘটনা বেশ প্রচলিত। লোকি এবং দানবী আঙ্গরবদার তৃতীয় সন্তান নেকড়ে ফেনরির। হিংস্রতা এবং ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে ভীত দেবতারা চোখের সামনে থেকে সরাতে চায়নি ফেনরিরকে। টিয়র তার ডান হাত হারায় নেকড়ের মুখে; তার কারণেই অন্যান্য দেবতারা ফেনরিরকে শিকলে বাঁধতে সক্ষম হয়।
প্রিয় ফ্রেয়র
ভানিররাজ নিয়র্দরের পুত্র এবং ফ্রেয়ার জমজ ভাই ফ্রেয়র। জীবনীশক্তি, আবহাওয়া, ফসল এবং সমৃদ্ধির দেবতা হিসেবে ফ্রেয়র স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে পূজিত হতো। প্রোটো-জার্মানিক ফ্রাওয়ান শব্দের ব্যবহৃত হতো পরিণত সম্ভ্রান্ত পুরুষকে বুঝাতে। এখান থেকেই ফ্রেয়র শব্দের আগমন। বাস্তবিক দিক থেকে ফ্রেয়ার পুরুষবাচক অর্থে ফ্রেয়রের আগমন নর্স পুরাণে। ফ্রেয়রের ছিল সোয়ারতালফেইম থেকে বানিয়ে আনা জাহাজ স্কেদব্লাদনির। জাহাজটির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব, ভাঁজ করে পকেটে উঠিয়ে রাখা যায়। এছাড়াও আছে স্বর্ণশূকর গুলিনবুরস্তি এবং নিজে নিজে যুদ্ধ করা একটা তরবারি। ফ্রেয়রই মানুষের কোরবানি গ্রহণ করে।
ফ্রেয়র থাকে এলফদের রাজ্য আলফেইমারতে। এসির বনাম ভানির যুদ্ধের শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ভানির পক্ষ থেকে এসিরদের কাছে জিম্মি হিসাবে আসে। বালদরের পাশাপাশি, নর্স দেবতাদের মধ্যে ফ্রেয়র ছিলো অনেক বেশি প্রিয়। র্যাগনারকের দিন মুসপেলহেইমের আগুনদেবতা সুর্তর এবং ফ্রেয়রের যুদ্ধ হবে। পরস্পরের হাতে মৃত্যু হবে পরস্পরের।
চিরযৌবনা ইদুন
প্রাচীন নর্স শব্দ ইদুন অর্থ ‘তরুণ জন’। বাস্তবিক অর্থে ইদুন ছিল যৌবন এবং তারুণ্যের দেবী। নর্স পুরাণে তার প্রধান ভূমিকাই ছিল অলৌকিক আপেল দেয়া; যা খেলে বয়স কমে যায়। এস্কি নামে আপেল ভর্তি বাক্স নিয়ে ঘোরাঘুরি করে ইদুন। তার বিয়ে হয় এসির সভাকবি এবং গায়ক ব্রাগির সাথে।
যখনই নর্স দেবতারা নিজেদের বয়সের ভার উপলব্ধি করতে পারতো; তখনই ইদুন আসতো তার আপেল নিয়ে। পুনরায় যৌবনে ফিরিয়ে আনতো তাদের। পুরাণ অনুসারে ইদুন একবার দানব দ্বারা অপহৃত হয় আপেলের কারণে।
সবিশেষ
দেবতাদের বাইরেও নর্স পুরাণের রয়েছে বিশাল অংশ। সোয়ারতালফেইমের বামনরা নির্মাণের জন্য বিখ্যাত। এলফহেইমে থাকে শান্তিকামী এলফরা। মুসপেলহেইমে বসবাস করে আগুনদানবের দল এবং মিদগার্দে মানুষ। এইসব প্রজাতির বাইরে বিশেষ কিছু সৃষ্টিও আধিপত্য করেছে। লোকির সন্তান ইয়োরমুঙ্গানদর পৃথিবীকে পেঁচিয়ে রাখা বিশালাকার সাপ এবং ফেনরির হলো দানবীয় নেকড়ে। আট পা ওয়ালা ওদিনের ঘোড়া স্লেইপনির, থরের রথ টানা ছাগল, পাতালের নেকড়ে গার্মর এবং ফ্রেয়রের স্বর্ণশূকরের রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবস্থান। আছে নারীদের নিয়ে তৈরি যোদ্ধাবাহিনী ভ্যালকারি। পূর্বপুরুষের আত্মাদেরও একটা স্থান ছিলো ভাইকিং চিন্তা চেতনায়।
প্রকৃতির হোমোজেনিটি থেকে কোনো একটা কিছুতে হেটারোজেনাস বৈশিষ্ট্য দেখার মাধ্যমে ‘পবিত্র’ কিংবা ‘অপবিত্র’ তকমা পায়। ব্যক্তি মানুষের ধর্মানুভূতি জাগরণের ইতিহাসটা এখানেই। ভাইকিংরাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি তাদের চোখে হাজির হয়েছে ঐশী সত্তা হিসাবে। তারা নিজেদের গঠন করেছে সেই চেতনায়, উদারতায় এবং বীরত্বে। তৈরি হয়েছে মূল্যবোধের সীমারেখা, সামাজিক আচার এবং আইন। সবচেয়ে বড় কথা, সেই বিশ্বাসগুলো সংঘবদ্ধ করে রেখেছে মানুষের পূর্বপুরুষদের। যাদের বুকে ভর দিয়েই আধুনিকতার উত্থান।