মিশরীয় পুরাণের সূর্যদেবতা এবং সৃষ্টিকর্তা রা। রাজবংশের পরিবর্তন ঘটেছে। এক সংস্কৃতিকে প্রতিস্থাপন করেছে অন্য সংস্কৃতি। তারপরেও রা ছিল চিরতরুণ। রাষ্ট্রধর্মের সাথে সবসময় যুক্ত থেকেছে রা এর উপাসনা। মিশরীয় দেবতাদের অধিকাংশই পুরাণ মতে রা এর বংশধর। অনেক রাজাও নিজেদের রা-এর সন্তান দাবি করে তদানুযায়ী শাসন পরিচালনা করতেন। রা-এর উদ্ভব ইয়ুনু শহরে। গ্রিকরা নাম দিয়েছিল হেলিয়োপলিস বা সূর্যদেবতার শহর। বর্তমানে তা উত্তর কায়রোতে অবস্থিত।
প্রাচীন মিশরীয় উপকথা নিয়ে ঘাটাঘাটি করাকে বলা হয়, ‘একটা পাজল সমাধান করার চেষ্টা; যেখানে একত্রিত করতে চাওয়া টুকরোগুলোর অধিকাংশই হারিয়ে গেছে; আর বাক্সটা দূরে ফেলে এসেছে কেউ।’ মিশরীয় ধর্ম টিকে ছিল প্রায় ৩০০০ বছর। এত দীর্ঘ সময়ে অনেক কিছুরই উত্থান পতন ঘটেছে। অনেক উপকথা বিলুপ্ত হয়েছে; অনেকগুলোর হয়েছে সংস্কার; অনেকগুলো প্রতিস্থাপিত। তাই ধর্ম আর উপকথা নিয়ে সামগ্রিক ধারণা পাওয়া বেশ দুরূহ।
রা
প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় রা শব্দের সাদামাটা অর্থ সূর্য। বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যানে দেবতাদের অনেক নামই বিধৃত হয়েছে। রা এরও অনেক নাম- রা, আটুম-রা, খেপরি, রা-হোরাখতি এবং আটুম। নামগুলো রা এর অস্তিত্বের বিভিন্ন অবস্থাকে নির্দেশ করেছে বিভিন্ন সময়ে। যুক্ত করা হয়েছে অন্য কোনো উপাস্যের সাথে। স্রষ্টার রূপে পরিচিত হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে তার উপস্থিতি স্বীকার করে নেয়া হতো। বিশেষ করে শৃঙ্খলা, শান্তি এবং রাজত্বের অধিকর্তা হিসেবে।
রা-কে চিত্রিত করা হতো মানুষের দেহে বাজপাখির মাথাকে কল্পনা করে। থাকতো মাথার উপরে সৌর-চাকতি; হাতে রাজদণ্ড আর আংখ্। কখনো কখনো রা কে বিশেষ ধরনের গুবরে পোকা হিসাবেও দেখানো হয়েছে। প্রতি ভোরে পোকাটা যেন গোবরের বল বালির উপর দিয়ে গড়িয়ে নিয়ে পুঁতে ফেলে। পরের দিন আবার নতুন গুবরে পোকা আসে একই কাজ নিয়ে। পুরো আখ্যানটা আকাশে সূর্যের প্রতিদিনকার উদয়-অস্তের ঘটনাকেই প্রতিফলিত করে। রা কে মনে করা হতো সৌর নৌকা আতেত-এ চড়ে আকাশে ভ্রমণ করছে।
অনেকটা পার্থেনোজেনেসিসের মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় রা-এর সন্তান শু এবং তেফনুত। অন্যদিকে মাতকে মনে করা হতো তার সবচেয়ে প্রিয় কন্যা। ন্যায়, প্রাকৃতিক আইন এবং ভারসম্যের দেবী মাত। মিশরের শাসকেরা নিজেদের মাতের পক্ষের বীর বলে গণ্য করতো। দুনিয়াবি জীবনে কে কতটুকু মাতকে সহযোগিতা করেছে; মৃত্যুর পরে তারই বিচার হবে।
কোনো উপকথায় রা নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে; কোথাও সৃষ্টি করেছে আমোন কিংবা পতাহ। নেইথ নামে তার মায়ের হদিস পাওয়া যায়। নেইথ শব্দর অর্থ ‘ভয়ানক একজন’। আদিম বিশৃঙ্খলার দিকেই ইঙ্গিত এর।
জন্ম কথা
আদিতে মহাবিশ্ব বলতে কিছু ছিল না; ছিল কেবল অসীম পানি। মিশরীয় পুরাণে তাকে নু বলে আখ্যা দেয়া হয়। নু নির্দেশ করে অচেতন, নিষ্ক্রিয়তা, স্থবির এবং চিরন্তন বিশৃঙ্খলা। এই অসীম শূন্যতার মধ্যে অস্তিত্বশীল হলেন রা। বিষয়টাকে বুঝতে হলে ঘটনার পরম্পরার কথা মনে রাখা উচিৎ। জীবন বলতে সময়ের দিকে আঙুল তোলা হয়; আর সময় বলতে কতিপয় ঘটনার সমাবেশকে। সেই অর্থে সৃষ্টিপূর্ব অবস্থা বলতে ঘটনাহীন অবস্থা। সৃষ্টির শুরু বলতে ঘটনা ও পরিবর্তনময়তার শুরু। কাহিনীর অন্য সংস্করণে কিছুটা ভিন্নতা পাওয়া যায়। আদিম শূন্যতা বা পানি থেকে প্রথমে আমুন নিজেকে সৃষ্টি করে। একটা ডিম তৈরি করে আমুন; যা ভাসতে থাকে নু-এর উপরে। সময়ের ব্যবধানে সেই ডিম থেকে জন্ম নেয় রা।
মিশরীয় সৃষ্টিতত্ত্বে দেবতাদের উদ্ভব অনেকটা বিভাজন প্রক্রিয়ার মতো। একটা সাধারণ অবস্থা থেকে বিশ্বজগৎ বিভাজিত হয়ে গেছে ব্যক্তিতে। সেই সব ব্যক্তি দেবতারাও পরবর্তীতে বয়ে চলেছে বিভাজনের সিলসিলা।
চন্দ্র, সূর্য এবং মানবজাতি
শু হলো বাতাসের দেবতা আর তেফনুত আর্দ্রতার দেবী। পিতা রা এর ব্যস্ততার সময় তারা আদিম জল নু-এর রহস্য উদঘাটনে নামে। কিন্তু অনন্ত স্থবিরতায় হারিয়ে যেতেও দেরি হলো না। সন্তানদের অনুপস্থিতিতে রা এর তো পাগলপ্রায় অবস্থা। শেষমেশ একটা বিহিত হলো। সন্তানদের খুঁজে বের করে নিজের চোখ তুলে ছেড়ে দিলেন রা। কন্যা আর পুত্রকে খুঁজে পাওয়া গেলো। কিন্তু চোখটা ফিরে এসে দেখলো তার অবর্তমানে নতুন একটা চোখ লাগিয়েছে রা। পুরাতন চোখটা হিংসায় জ্বলে গেলো অবস্থা দেখে। অনেকটা তাকে শান্ত করতেই দ্বিতীয়টার চাইতে শক্তি বাড়িয়ে দেয়া হয়। এভাবেই প্রথম চোখ পরিণত হলো সূর্য এবং দ্বিতীয় চোখ পরিণত হলো চন্দ্রে।
অন্যান্য দেবতা এবং গ্রহ-নক্ষত্রকে সৃষ্টি করার পরে রা কাঁদলো। তার সেই চোখের জল থেকে সৃষ্টি হলো মানবজাতির। অন্য আখ্যানে, রা এর প্রথম চোখ যখন শু আর তেফনুতকে খুঁজতে যায়; তখনই কাঁদছিল। তাই প্রথম চোখের পানি থেকেই মানবজাতির জন্ম। কান্নাটা ঠিক কী কারণে; তার ব্যাখ্যা স্পষ্ট না। নিঃসঙ্গতা কিংবা দ্বিতীয় চোখের দ্বারা প্রথম চোখের প্রতিস্থাপন- উভয়ই হতে পারে। আরো একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। জন্মের পর রা কেঁদেছিল নিজের জন্মদাত্রীকে দেখতে না পেয়ে।
প্রতিটি ব্যাখ্যায় মানবজাতির উৎস দেখানো হয়েছে দেবতার দুঃখ কিংবা ক্রোধ হিসাবে। মানুষ যেন বিধাতার অসচেতন আবেগের ফসল।
নুত এবং মিশরীয় ক্যালেন্ডার
শু এবং তেফনুতের ঘরে জন্ম নেয় দুই সন্তান গেব আর নুত। দেবতা গেব ছিল পৃথিবীর শাসক আর দেবী নুত আকাশের। রা চেয়েছিল নুতকে স্ত্রী হিসেবে পেতে। কিন্তু নুত তাকে অগ্রাহ্য করে প্রেমে পড়লো গেবের। ক্রোধে অভিশাপ দিলেন রা। নুত কোনো মাস কিংবা বছরেই সন্তান জন্মদান করতে পারবে না। প্রবল উৎকণ্ঠা আর হতাশা নিয়ে নুত সাহায্য প্রার্থনা করলো জ্ঞানের দেবতা থতের। একটা রাস্তাও বের করা হলো।
চাঁদ তখন সূর্যের সমানই আলো দেয়। থত জুয়া খেলতে রাজি করালো চাঁদকে। নানা কৌশলের পরেও জুয়ায় হেরে গেলো চাঁদ। বাজির পরিমাণ নেহায়েত কম ছিল না। যতবার থত জিতেছে; ততবার সে চাঁদের থেকে আলো নিয়ে নিয়েছে। এভাবে বাহাত্তর ভাগের এক ভাগ আলোই চলে এলো থতের হাতে। থত সেই আলোতে তৈরি করে দিলেন অতিরিক্ত ৫ দিন।
মিশরীয় ক্যালেন্ডার ৩৬০ দিনের। অতিরিক্ত ৫ দিন যোগ করা হতো বছরের শেষে। এই ভিত্তিতেই সৌর ক্যালেন্ডারের সাথে মিশরীয় ক্যালেন্ডার ভারসম্যে পৌঁছায়। আবার, অতিরিক্ত এই ৫ দিন রা এর অভিশাপের বেষ্টনী থেকে বাইরে। নুতও সন্তান জন্মদানের সুযোগ খুঁজে পেল। তার গর্ভেই জন্ম নেয় মিশরীয় পুরাণের অন্যতম মুখ অসিরিস, হোরাস, সেথ, আইসিস এবং নেপথিস।
রা-এর গোপন নাম
নামেই শক্তি। তাই, শক্তির নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রায়ই ছদ্মনামে আসতেন ঈশ্বরেরা। অনেকটা এ কারণেই আইসিস রা এর গোপন নাম আবিষ্কারের অভিযানে বের হয়েছিল। সময়ের ব্যবধানে রা তখন নিজেই বৃদ্ধ এবং শারীরিকভাবে দুর্বল। সিংহাসনে বসে ঘুমিয়ে গেলে মুখ দিয়ে লালা পড়ে। আইসিস খুব যত্ন নিয়ে সংগ্রহ করল সেই লালা। নিজের যাদুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে রূপ দিলো এক ভয়ঙ্কর সাপের।
বহু রকম অভ্যাস ছিলো রা-এর। নিজের সৃষ্টির দেখাশুনা করার জন্য তার যাতায়াত প্রায়শ একই পথ ধরে। সুতরাং পথে ওৎ পেতে থেকে তার সাথে সাক্ষাৎ করা কঠিন কিছু না। আইসিস সেই সুযোগটা কাজে লাগালো। পথে রেখে দিলো সেই সাপটা। সময় মতো রা আসলে তাকে আঘাত করলো সাপটা। অন্য যেকোনো আঘাত হজম করতে সক্ষম দেবতা এবার বেকায়দায় পড়লো। সাপটা যে তার নিজের সত্তা থেকেই উৎসারিত; প্রচণ্ড ব্যথায় ককিয়ে উঠলো রা।
আরোগ্যের কোনো লক্ষণ নেই। বাধ্য হয়েই ঘোষাণা দিলো, আরোগ্য দানকারীর যেকোনো ইচ্ছা পূরণ করে দেওয়া হবে। ঠিক এই সময়ের অপেক্ষাতেই ছিল আইসিস। একে একে সবাই ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলে গিয়ে দাঁড়ালো রোগীর সামনে। রা কে সুস্থ করে দিতে পারবে; তবে মূল্য হবে সেই গোপন নাম। কৌশলের গন্ধ পেয়ে মুখ খুললো রা-
‘আমি আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা,
পর্বতগুলোর প্রতিষ্ঠাকারী,
পানিকেও সৃষ্টি করেছি আমিই,
আমি উভয় প্রান্তে গোপনীয়তার অধিকারী।
আমি আলো; আমি অন্ধকার
সময়ের স্রষ্টা, দিনের স্রষ্টা;
আমার হাতে সকল উৎসবের উদ্বোধন;
আমি দুর্নিবার ঢেউয়ের স্রষ্টা।
আমি সে-ই; যে বানিয়েছে জীবন্ত আগুন,
আমি সকালে খেপরি, দুপুরে রা, সন্ধ্যায় আটুম।’
ভণিতায় বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হ নি আইসিস। গো ধরে থাকলো রা এর গোপন নাম জানার জন্য। নাহলে সুস্থ করার কোনো চেষ্টাই দেখাবে না। ব্যথায় ভঙ্গুর রা নিজের সত্যিকার নাম প্রকাশ করে দেয়। আর যাদুমন্ত্র পাঠের মধ্য দিয়ে বিষও নামিয়ে আনে আইসিস। নিজের অনাগত সন্তান হোরাসের জন্য রা-এর কাছে চোখ চন্দ্র আর সূর্যকে প্রার্থনা করে। পরবর্তীতে হোরাস পরিণত হলে রা এর আসনে সূর্যদেবতা হিসাবে অধিষ্ঠিত হয়।
আখ্যানটা প্রাচীন মিশরের আনুমানিক ১২০০-১০৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের প্যাপিরাস লিপিতে প্রাপ্ত। সেই সমাজে সাপের কামড়ের চিকিৎসা হিসেবে যাজকেরা এভাবেই চিকিৎসা করতো। আইসিসের যে মন্ত্রে রা সুস্থতা পেয়েছে; একই মন্ত্রে মানুষের থেকেও বিষ নামানো সম্ভব।
বিবর্তন বহুরূপে
মিশরীয় ধর্ম বিস্ময়কর লম্বা জীবন পেয়েছিল। হাজার বছরের ব্যবধানে অনেক গোষ্ঠীর আগমন-প্রস্থান ঘটেছে। কখনো উঁচুভূমি নিম্নভূমির উপর রাজত্ব করেছে; কখনো নিম্নভূমি অধিকার খাটিয়েছে উঁচুভূমির উপর। কিন্তু রা কখনোই গুরুত্ব হারায়নি। বারবার অভিযোজিত হয়ে ধরে রেখেছে কেন্দ্রিকতা ও জনপ্রিয়তা। নয়া সংস্কৃতির সংস্পর্শে নয়া দেবতাদের সাথে সংযুক্ত হওয়ার নজির তাই খুব সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়।
সংস্কৃতিতে এই প্রবণতার দরুণ মৌলিক রা কিন্তু অপ্রচলিত হয়ে পড়ে। তার বদলে কখনো আটুম, কখনো হোরাসের সাথে মিলে জানান দেয় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
রা-হোরাখতি
মিশরীয় ধর্মের অগ্রগতির সাথে সাথে রা এবং হোরাসের ধারণা মিলিত হয়। হোরাস আইসিস এবং অসিরিসের সন্তান এবং অন্যতম প্রভাবশালী দেবতা হিসেবে প্রতীয়মান। রা-হোরাখতির অর্থ রা-হোরাস দুই দিকের অধীশ্বর। সূর্যের যাত্রায় রাতের শত্রুদের পরাজিত করে পরবর্তীতে উঠার রাস্তা পরিষ্কার করাকেই ইঙ্গিত করে।
হোরাস বস্তুত জটিল দেবতা। কমপক্ষে ১৫টি আকৃতি পাওয়া যায় তার প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতিতে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে স্থায়ী বাজপাখির আকৃতি। রা-হোরাখতিকে তাই বাজপাখির মাথার উপর সৌর চাকতি দিয়ে উপস্থাপন করা হতো।
আমুন-রা
খ্রিষ্টপূর্ব ২০২০ অব্দে থিবিসের রাজা দ্বিতীয় মেনতুহোতেপ উচ্ছেদ করেন হেরাক্লিওপোলিটান রাজবংশকে। মিশরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে একত্রিত করেন। ঐতিহাসিকরা একে মিডল কিংডম (২০৬৬-১৭৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)-এর সূচনা বলে গণ্য করেন।
আমুন ছিল থিবিসের প্রধান দেবতা। মধ্য সাম্রাজ্যের উত্থানে এই আঞ্চলিকতা ও স্থানীকতা থেকে মুক্ত হতে থাকে প্রভাব। অষ্টাদশ রাজবংশের সময় (১৫৫০-১২৯২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) আমুন জাতীয়ভাবে রা এর সাথে একীভূত হয়ে যায়। সাথে সাথে রা সংশ্লিষ্ট আখ্যানগুলোও আমুন-রা নামে প্রচলিত হতে থাকে।
আটুম-রা
আমুনের মতোই আটুম প্রভাবশালী দেবতা। আসলে আটুম আর আমুন নিয়ে যতগুলো উপকথা প্রচলিত; তা প্রায়ই মিলেমিশে একাকার। খুব সম্ভবত, তারা দুজনেই একটা বিশেষ চেতনাকেই উপস্থাপিত করতো। রা-এর মতো আটুম সৌরদেবতা হলেও আরো বেশি বিশেষায়িত। আটুমকে চিত্রিত করা হতো ডুবন্ত সর্যের দেবতা হিসেবে। এজন্য তাকে প্রায়ই স্থাপন করা হতো সূর্যোদয়ের দেবতা খেপরির পাশাপাশি।
আটুম-রাকে মিশরীয় নিম্নাঞ্চলের উপাস্য হিসাবে গণ্য করা হতো। উচুঁভূমির জন্য ছিল অন্য দেবতা মন্তু-রা। হেলিয়োপলিসের উপকথাগুলোতে রা বলতে সাধারণ আটুম-রাকেই বুঝানো হয়।
খেপরি
খেপরিও সূর্যদেবতা। বিশেষ করে সকালের উদীয়মান সূর্যকে চিহ্নিত করা হয় এই নামে। পুরাণ অনুসারে, খেপরি বলতে রা নিজের সকালের অবস্থাকেই দাবি করেছে। মিশরীয়রা আকাশে একটা শক্তিকে অনুভব করতো; যা সূর্যকে গতি দেয়। খেপরির ধারণার পেছনেও এই বিশ্বাস নিহিত।
খেপরিকে আঁকা হতো একটা গুবরে পোকার সাদৃশ্যে। মানুষের শরীর; কিন্তু মাথাটায় গুবরে পোকা। সাথে অবশ্য কিছু অলঙ্কার এবং সিলমোহরও থাকতো। এক সময় খেপরি যুক্ত ছিল আটুমের সাথে। আটুম আর খেপরির সংযুক্ত অবস্থায় প্রতীকায়িত করতো ব্যক্তিক রূপান্তর। শৈশব থেকে যৌবন এবং জীবন থেকে মৃত্যু। এই রূপান্তরকে বলা হয় খেপেরু।
আটেন-রা
সম্রাট চতুর্থ আমেনহোটেপ ক্ষমতায় আসেন ১৩৫১ কিংবা ১৩৫৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। আমুন তখন মিশরীয় জনজীবনের কেন্দ্রীয় দেবতা। আমেনহোটেপ নামের অর্থই আমুন যার উপর সন্তুষ্ট। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছরের মাথায় আমেনহোটেপ নিজের নাম বদলে রাখেন এখনাটন। নতুন নামের অর্থ ‘এটনের স্থলাভিষিক্ত’। তার কর্মকাণ্ডেও আমুনের চেয়ে এটনের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এখনাটনের উত্থানের আগেই এটন পূজিত ছিল। তাকে চিত্রিত করা হতো সৌর চাকতির সাথে। এখনাটনের আগমনে এটন রা হোরাখতির সাথে মিলিত হলো। পাশাপাশি নিষিদ্ধ হলো আমুন এবং অন্যান্য দেবতার উপাসনা। এই হঠাৎ পরিবর্তন জনগণ ঠিক ভালোভাবে নেয়নি। ফলে তার মৃত্যুর সাথে সাথে পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করে। এটন সূর্যদেবতার স্থানে চলে যায়। দেবতাদের প্রধান এবং জাতীয় ধর্ম হিসেবে সামনে আসেন আমুন।
খনুম
মিশরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছে নীলনদকে কেন্দ্র করে। আর বন্যা ছিল নীলনদের নিয়মিত ঘটনা। নীলের পানি আর বন্যায় বয়ে আনা পলিতেই অস্তিত্ত্বের সমস্ত উপাদান। দেবতা খনুম সংশ্লিষ্ট ছিল নীলনদের বন্যার সাথে। তার অন্য নাম স্বর্গীয় কুমার। বিশ্বাস ছিল, খনুমই পলিমাটি দিয়ে শিশু তৈরি করে তা মায়ের গর্ভে স্থাপন করে দেয়। মাটির পাত্র এবং চাকার সাথে সম্পর্কিত করে উপাসনা করা হতো সে সময়।
খনুমের উৎস স্পষ্ট না। তাকে চিত্রিত করা হয়েছে মানব শরীরে ছাগলের মাথা সংযুক্ত হিসেবে। সাথে আছে মানবদেহ তৈরির ছাঁচ এবং বন্যা দেয়ার জন্য একটা মগ। মিশরীয় ইতিহাসের শেষের দিকে তার পরিচিতি পাওয়া যায়। খ্রিষ্ট পরবর্তী দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শতকেও তার প্রভাব বিদ্যমান ছিল। রা-এর সাথে যুক্ত হবার দরুণ তার প্রতিপত্তি আরো বৃদ্ধি পায়।
মন্তু-রা এবং রায়েত-তায়ী
থিবিসের অন্যতম দেবতা মন্তুকে যুক্ত করা হয় রা-এর সাথে। বাজপাখির মাথা নিয়ে এক তারকাদেবতা। খুব সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব বিশ শতকের আগে থেকেই মিশরীয় উঁচুভূমিতে প্রধান দেবতার আসন করে নেয়। মূলত মন্তু একজন যুদ্ধদেবতা। মাত বা মহাজাগতিক নিয়ম-শৃঙ্খলাকে যারা লঙ্ঘন করে; তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। গ্রীকরাও তাকে এপোলো এবং এরেস-এর সাথে সাদৃশ্য দেখিয়ে পাঠ করতো।
রায়েত-তায়ী আসলে রা এর নারীমূর্তি। নামের অর্থ দুই ভূমির (উঁচু ও নিম্নভূমি) রায়েত। পঞ্চম রাজবংশের আগে তার তেমন উপস্থিতি পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে তাকে উদ্বৃত করা হয়েছে আকাশদেবী অভিধায়। কখনো তাকে দেবতা মন্তুর স্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হতো।
সবিশেষ
সভ্যতার ইতিহাসে মিশরের অবদান জ্ঞানচর্চার সকল ক্ষেত্রেই অনন্য। চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে জ্যামিতি, প্রকৌশলবিদ্যা থেকে বর্ণমালা। প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিকদের অনেকেই জ্ঞানচর্চায় মিশরের কাছে সরাসরি ঋণ স্বীকার করেছেন। ধর্মের ইতিহাস অনুসন্ধানে তাই প্রাচীন মিশরের ধর্মচর্চা ও বিশ্বাস একটা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। গ্রীক, রোমান কিংবা নর্স উপকথায় দেবতারা অবিকল মানুষের আকৃতি পাওয়া। কিন্তু মিশরীয় পুরাণে মিলিত হয়েছে মানুষ এবং অন্য কোনো প্রাণীর সমষ্টি। এই বিশেষত্বের পেছনের মনস্তত্ত্ব গবেষণার বিষয়।
১৯৮১ সালের ইন্ডিয়ানা জোনস্ সিরিজের সিনেমা ‘রেইডার্স অভ দ্য লস্ট আর্ক’ রা-এর বিষয়াদি ব্যবহার করেছে। ১৯৯৪ সালের সিনেমা ‘স্টারগেইট’-এ রা হিসেবে অভিনয় করেছেন জেভ ডেভিডসন; অবশ্য কোথাও রা তার সঠিক অবস্থান পায়নি। সত্যিকার রা কে আবিষ্কার ও পঠনের মধ্য দিয়ে সেই সময়কার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে উপলব্ধি করা সম্ভব। বিশেষত রা এর ক্রমবিবর্তন রাজনৈতিক উত্থান পতনের যে মানচিত্র তুলে ধরে; তা যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত।