গ্রিক উপাখ্যানে বর্ণিত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হলো ট্রোজান যুদ্ধ। এই যুদ্ধ গ্রিক পুরাণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কথিত আছে, দেবরাজ জিউস নাকি মনে করতেন পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত বেড়ে গেছে, তাই তা কমানোর দরকার। সেই সঙ্গে কমানো প্রয়োজন মর্ত্যের নারীদের গর্ভে জন্ম নেওয়া উপদেবতার সংখ্যা। এজন্য তিনি তার কূটকৌশলের মাধ্যমে একটি যুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা করেন যাতে মানুষের সংখ্যা কমে যায়। এই যুদ্ধ গ্রিক ও ট্রোজানদের মধ্যে সংঘটিত হলেও এর পটভূমি শুরু হয় গ্রিক মিথোলজির দেব-দেবীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে।
উপকথা অনুযায়ী, দেবরাজ জিউস ও সমুদ্র দেবতা পসাইডন উভয়ে থেটিস নামক এক সুন্দরী জলপরীর প্রেমে পড়েন। জিউস ও পসাইডন দুজনেই থেটিসকে নিজের স্ত্রী রুপে পেতে চেষ্টা করতে থাকেন, কিন্তু এক ওরাকল (ভবিষ্যদ্রষ্টা) বলেন, থেটিসের যে পুত্র হবে সে নিজের পিতার চেয়েও বেশি শক্তিশালী হবে। কিছু মত অনুযায়ী থেমিস অথবা প্রমিথিউস এই ভবিষ্যদ্বাণী করেন। জিউস চাননি তার পুত্র তার চেয়েও বেশি শক্তিমান হয়ে তাকে সিংহাসনচ্যুত করুক। জিউস নিজেই তার পিতা ক্রোনাসকে উৎখাত করে স্বর্গের রাজত্ব দখল করেছিলেন। একই পরিণাম যেন নিজেকেও ভোগ করতে না হয় সেই ভয়ে জিউস থেটিসকে পেলেউস নামক এক মানবের সাথে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
জিউসের নির্দেশে থেটিস ও পেলেউসের বিয়ে ঠিক করা হয়। ট্রোজান যুদ্ধের বীর অ্যাকিলিস ছিলেন থেটিস ও পেলেউসের পুত্র। থেটিস ও পেলেউসের বিয়েতেই ট্রোজান যুদ্ধের পটভূমির সূত্রপাত হয়। এই বিয়েতে ‘বিবাদের দেবী’ ইরিসকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তাকে ছাড়া অন্য দেব-দেবীদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়। ফলে ইরিস এই অপমানে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন, এবং তার স্বভাবজাত কান্ড অর্থাৎ বিবাদ সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত হন।
ইরিস একটি সোনার আপেল নিয়ে পেলেউস ও থেটিসের বিয়েতে হাজির হয়, এবং সবচেয়ে সুন্দরী দেবীকে এটি উপহার দেবেন বলে জানান। উপস্থিত সকল নারীই নিজেকে সবচেয়ে সুন্দরী দাবি করে এক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। হেরা, অ্যাথেনা ও আফ্রোদিতি- এই তিন দেবী উক্ত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হন। তারা ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী দেবী। হেরা ছিলেন দেবরাজ জিউসের স্ত্রী, দেবলোকের রানী এবং বিয়ের দেবী। অ্যাথেনা ছিলেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবী, এবং আফ্রোদিতি ছিলেন সৌন্দর্য, ভালোবাসা ও যৌনতার দেবী। দেবরাজ জিউস নিজে এই দেবীদের মধ্যে কাউকে সবচেয়ে সুন্দরী বলে সিদ্ধান্ত দিতে রাজি হননি। কারণ কোনো একজনকে নির্বাচিত করলে অন্য দুই দেবীর সঙ্গে তার সংঘর্ষ তৈরির সম্ভাবনা ছিল। জিউস চালাকি করে এই সম্ভাব্য সংঘাত এড়িয়ে যান।
দেবরাজ জিউসের আদেশে ট্রয়রাজ প্রায়ামের পুত্র অর্থাৎ ট্রোজান রাজপুত্র প্যারিসের উপর এই প্রতিযোগিতার বিচারকের দায়িত্ব বর্তায়। প্যারিস তখন আইডা পর্বতে তার পাল চড়াচ্ছিল, তখন তিন দেবী তার কাছে গিয়ে সবচেয়ে সুন্দরী দেবীকে নির্বাচনের দায়িত্ব দেয়। দেবীদের সবাই নগ্ন হয়ে প্যারিসকে সিদ্ধান্ত নিতে বলে, কিন্তু যুবরাজ অনাবৃত দেবীদের দেখে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। প্রত্যেক দেবীই যুবরাজ প্যারিসকে নিজের পক্ষে আনার চেষ্টা করতে থাকেন। সবাই প্যারিসকে নিজেদের সাধ্যমতো বিভিন্ন উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
দেবালয়ের রানী হেরা প্যারিসকে অসীম রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রচুর ধনসম্পদের প্রস্তাব দেন। জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনা দেন অফুরন্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রস্তাব। সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতি প্যারিসকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারীর সঙ্গে প্রেম করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। প্যারিস আফ্রোদিতির এই প্রস্তাব ফেলতে পারেনি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রমণীকে পাওয়ার আশায় প্যারিস আফ্রোদিতিকে সেরা সুন্দরী হিসেবে নির্বাচিত করেন, এবং সোনার আপেল দেবীকে উপহার দেন। এর মানে হলো অন্য দুই দেবীর উপর আফ্রোদিতির বিজয়। প্যারিসের এই সিদ্ধান্তে স্বাভাবিকভাবেই অ্যাথেনা ও হেরা অনেক ক্ষুব্ধ হন।
আফ্রোদিতিও তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন। মর্ত্যের সবচেয়ে সুন্দরী নারী হেলেনের সঙ্গে প্যারিসের প্রেম করিয়ে দেন। কিন্তু সমস্যা হলো, হেলেন ছিলেন স্পার্টারাজ মেনেলাওসের স্ত্রী। প্যারিস তখন হেলেনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। আফ্রোদিতির বরে হেলেনও প্যারিসের প্রেমে পড়ে। একপর্যায়ে কোনোরকম পরিণামের কথা না ভেবেই প্যারিস হেলেনকে নিয়ে ট্রয়ে পালিয়ে যায়। মেনেলাওস স্বাভাবিকভাবেই এই কর্ম মেনে নিতে পারেনি। তিনি কোনো বিলম্ব না করেই ট্রোজানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
প্রথমদিকে গ্রিকরা কূটনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করলেও ট্রোজানরা ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। সুতরাং গ্রিকদের কাছে যুদ্ধ ছাড়া কোনো পন্থা ছিল না, তারা তা-ই করে। মেনেলাওসের ভাই আগামেমনন ছিলেন মাইসেনিয়ার রাজা। তিনি তার ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসেন, এবং যুদ্ধের জন্য মিত্রবাহিনী গঠন করতে থাকেন। আগামেমনন আচিয়ানদের তাদের পক্ষে যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানান। আচিয়ানরাও তখন আগামেমননের আহ্বানে সাড়া দেয়। এভাবে গ্রিকরা অনেক সৈন্য ও বীরদের জড়ো করে একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠনে সক্ষম হয়। গ্রিক বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মেনেলাওসের ভাই আগামেমনন।
করিন্থ, ম্যাগনেসিয়া, ক্রীট, রুডস, এথেন্স ও স্পার্টাসহ আরো কিছু রাজ্যের সমন্বিত বাহিনী নিয়ে গ্রিকরা ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। গ্রীক যোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন তৎকালীন বীর যোদ্ধাদের মাঝে শীর্ষস্থানীয়। অ্যাকিলিস, ওডিসিয়াস, অ্যাজাক্স, ডিওমেডিস, প্যাট্রোক্লাস, অ্যান্টিলোকাস, মেনেসথিউস এবং ইডোমেনাসের মতো পরাক্রমশালী গ্রিক বীরেরা ছিলেন উপদেবতা বা দেব-দেবীদের বংশধর। এদের কারো পিতা অথবা কারো মাতা ছিলেন দেব-দেবী। ফলে অনেক ক্ষমতাধর দেব-দেবী গ্রিকদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। অ্যাথেনা, পসাইডন, হেরা, হেফাস্টাস, হার্মিস এবং থেটিস গ্রীকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করেন।
ট্রয়রাজ প্রায়ামের নেতৃত্বে ট্রোজানরাও এক শক্তিশালী মিত্র বাহিনী গঠন করে। ট্রোজানদের সাহায্যে এগিয়ে আসে তাদের অনেক মিত্ররাজ্য। ট্রোজানদেরও ছিল হেক্টর, ঈনিয়াস ও গ্লুকাসের মতো অনেক বীর যোদ্ধা। গ্রিকদের মতো ট্রোজানরাও দেব-দেবীদের থেকে সহযোগিতা পায়। আফ্রোদিতি, অ্যাপোলো, অ্যারিস ও লেটো এই যুদ্ধে ট্রোজানদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে।
শেষপর্যন্ত গ্রিকরা তাদের বিশাল বাহিনী নিয়ে ট্রয় নগরীকে আক্রমণ করে। ট্রয় নগরী ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও দুর্ভেদ্য দেয়াল এবং দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীমতে, ট্রয়ের দেয়ালগুলো দেবতা পসাইডন ও অ্যাপোলো নির্মাণ করেছিল ফলে এগুলো ভেদ করা অসম্ভব ছিল। এজন্য শহরের বাইরের সমভূমিতে গ্রিক ও ট্রোজান বাহিনী একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে। বছরের পর বছর ধরে ট্রয়ের বাইরে এই যুদ্ধ চলতে থাকে। গ্রিক সৈন্যরা ট্রয়কে দীর্ঘ দশ বছরব্যাপী অবরুদ্ধ করে রাখে। কিন্তু ট্রয় তাদের এশিয়ান মিত্রদের সাথে বিভিন্নভাবে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছিল, তাই সমস্যায় পড়তে হয়নি ট্রোজানদের। যুদ্ধ যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল, তখন শেষ বছরে এসে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হয় দুই বাহিনী। দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হয় পরাক্রমশালী বীরেরাও।
দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধ অমীমাংসিত থাকায় যোদ্ধারা বেশ বিরক্ত হয়। একপর্যায়ে মেনেলাওস প্যারিসকে একক যুদ্ধে আহ্বান জানান। প্যারিসও এই আহ্বানে সাড়া দেয়। ফলে প্যারিস ও মেনেলাওস দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রথমে প্যারিস মেনেলাওসকে লক্ষ্য করে একটি বর্শা নিক্ষেপ করে, কিন্তু তার বর্শাটি মেনেলাওস তার ঢালের মাধ্যমে আটকে দেন। এরপর মেনেলাওস প্রতিআক্রমণ হিসেবে প্রচন্ড জোরে তার বর্শা নিক্ষেপ করেন। সেটি প্যারিসের ঢাল ভেদ করে ঢুকে পড়ে। বর্শাটি তার শরীরে লাগেনি। এরপর মেনেলাওস তার তরবারি দিয়ে প্যারিসের হেলমেটে সজোরে আঘাত হানে। এই আঘাতে মেনেলাওসের তলোয়ার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মেনেলাওস তখন খালি হাতে প্যারিসের হেলমেট ধরে তাকে মাঠ থেকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কথিত আছে, আফ্রোদিতির হস্তক্ষেপে প্যারিস সে যাত্রায় বেঁচে যান। এরপর আরো দুই বীর হেক্টর ও অ্যাজাক্স যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দীর্ঘক্ষণ তুমুল যুদ্ধের পর অমীমাংসিত থাকে তাদের যুদ্ধ।
মহাপরাক্রমশালী বীর থেটিসপুত্র অ্যাকিলিস ছিলেন মর্ত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। আগামেমনন অ্যাকিলিসের প্রিয় উপপত্নীকে নিয়ে নেন। ফলে অ্যাকিলিস ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং তিনি আর যুদ্ধ করবেন না বলে জানিয়ে দেন। অ্যাকিলিসকে ছাড়া শুরুতে কিছু লড়াইয়ে গ্রিকরা জয়লাভ করলেও একপর্যায়ে বিপর্যয়ে পড়ে গ্রিকরা, এবং হারতে শুরু করে। ট্রোজানদের আক্রমণে পিছু হটতে হটতে গ্রিকরা সাগরতীরে তাদের জাহাজের কাছাকাছি চলে যায়। ট্রোজানরা তখন কিছু গ্রিক জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগামেমনন অনুধাবন করেন, এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে অ্যাকিলিসকে প্রয়োজন।
আগামেমনন অ্যাকিলিসকে প্রচুর ধনসম্পদের প্রস্তাব দিয়ে পুনরায় যুদ্ধে যোগদানের কথা বলেন। অ্যাকিলিস এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। উপায় না দেখে অ্যাকিলিসের প্রিয় বন্ধু প্যাট্রোক্লাস অ্যাকিলিসকে যুদ্ধে যোগদানের অনুরোধ করেন, কিন্তু অ্যাকিলিস তার প্রস্তাবও নাকচ করে দেন। অসহায় প্যাট্রোক্লাস এবার প্রিয় বন্ধু অ্যাকিলিসের কাছে তার ঢাল ও বর্ম পরিধানের অনুমতি চেয়ে বসেন। উপায় না দেখে অ্যাকিলিস এই প্রস্তাবে রাজি হন। প্যাট্রোক্লাস অ্যাকিলিসের সরঞ্জাম পরিধান করে বীরদর্পে যুদ্ধ করতে করতে ট্রোজানদের গ্রিক শিবির থেকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। প্যাট্রোক্লাস এতটাই বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন যে তিনি ট্রোজান বীর সার্পেডনকেও হত্যা করতে সক্ষম হন। প্রবল উত্তেজিত প্যাট্রোক্লাস অগ্রসর হতে হতে ট্রয়ের দেয়ালের কাছাকাছি চলে আসেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কিছুক্ষণ পরেই ট্রয়ের যুবরাজ ও বীর যোদ্ধা প্রায়ামপুত্র হেক্টরের হাতে মারা পড়েন প্যাট্রোক্লাস; যদিও এতে দেবতা অ্যাপোলোর সহায়তা ছিল। প্রিয় বন্ধু প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যুর সংবাদে শোকে কাতর অ্যাকিলিস রাগ ও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এরই মধ্যে তার উপপত্নীকে ফিরিয়ে দেওয়ায় সিদ্ধান্ত নেন আগামেমনন। ক্রোধাক্রান্ত অ্যাকিলিস পুনরায় রণক্ষেত্রে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন, সেই সঙ্গে ট্রোজানদের, এবং বিশেষ করে হেক্টরের উপর ভয়ানক প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করেন। অ্যাকিলিসের নতুন বর্ম প্রয়োজন ছিল। তার নতুন বর্মের যোগান দেন তার মা থেটিস। ক্রোধে ফেটে পড়া অ্যাকিলিস নতুন বর্ম পেয়ে তান্ডব চালাতে থাকেন। অ্যাকিলিসের তুমুল আক্রমণে ট্রোজানরা পিছু হটতে হটতে নগরীর ভেতরে ঢুকে পড়ে।
চরম সাহসী যুবরাজ হেক্টর একাই দেয়ালের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। অবশেষে অ্যাকিলিস ও হেক্টর একে অপরের মুখোমুখি হয়। সময়ের দুই শ্রেষ্ঠ বীর সামনাসামনি লড়তে শুরু করে। মহাপরাক্রমশালী যোদ্ধা অ্যাকিলিসের কাছে হেক্টর বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। প্রায়ামপুত্র ট্রোজান যুবরাজ হেক্টরকে নির্মমভাবে হত্যা করেন অ্যাকিলিস। হেক্টরকে মেরে মৃতদেহ রথের পেছনে বেঁধে ট্রয়ের বিখ্যাত দেয়ালের সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন গ্রিক শিবিরে। সেখানে বীর হেক্টরের স্থান হয় ময়লার স্তুপে।
নিজের প্রিয়বন্ধু প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়ে কিছুটা তৃপ্ত হয় বীর অ্যাকিলিস। এবার তিনি তার নিহত বন্ধুর সম্মানে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করেন। সেদিন রাতে ট্রোজানরাজ প্রায়াম ছদ্মবেশে গ্রীক শিবিরে প্রবেশ করেন এবং অ্যাকিলিসকে তার ছেলে হেক্টরের লাশ ফেরত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন যাতে তাকে যথাযথভাবে সমাধিস্থ করা যায়। প্রথমে অনিচ্ছুক থাকলেও শেষপর্যন্ত বৃদ্ধ পিতার মানসিক আবেদন ফেলতে পারেননি অ্যাকিলিস। তিনি হেক্টরের মৃতদেহ ফিরিয়ে দিতে সম্মত হন। এখানেই হোমারের জগদ্বিখ্যাত ‘ইলিয়াড’ সমাপ্ত হয়। তবে যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি।
অ্যাকিলিস এই ঘটনার পর খুব বেশি দিন তার প্রতাপ চালাতে পারেননি। তিনি একপর্যায়ে ট্রয় নগরীর ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। শহরে ঢোকার পর যুবরাজ প্যারিস অ্যাকিলিসকে লক্ষ্য করে একটি তীর নিক্ষেপ করে। এই তীর দেবতা অ্যাপোলোর সহায়তায় অ্যাকিলিসের গোড়ালিতে আঘাত হানে। মিথোলজি মতে, অ্যাকিলিসের গোটা দেহ অভেদ্য ছিল। তার মা থেটিস শৈশবে তাকে স্টাইক্স নদীর জলে ডুবিয়ে নেন, যার ফলে তিনি অভেদ্য হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার গোড়ালির যে অংশ ধরে তাকে ডুবানো হয়েছিল সেই অংশে জল না লাগায় তা ভেদ্য ছিল, ফলে অ্যাপোলো সেখানেই তীরের আঘাত লাগিয়ে দেন। এই তীরের আঘাতেই মহাপরাক্রমশালী বীর যোদ্ধা, এক মানব কিংবা উপদেবতা, থেটিসপুত্র অ্যাকিলিস মারা যান। এরপর থেকে মানুষের দুর্বল জায়গা বোঝাতে ‘অ্যাকিলিস হিল’ প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
পরবর্তীতে এই যুদ্ধে আরো অনেক বীরের মৃত্যু হয়। অবশেষে, ওডিসিয়াস যুদ্ধ শেষ করার একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। তিনি ভেতরে ফাঁপা এমন একটি কাঠের ঘোড়া নির্মাণের নির্দেশ দেন। রাতের আঁধারে এই ঘোড়ার অভ্যন্তরে গ্রিক সৈন্যরা লুকিয়ে পড়ে। সেদিন রাতে ঘোড়াকে ট্রয়ের গেটের সামনে রেখে সমগ্র গ্রিক নৌবহর ট্রয়ের উপকূল থেকে পশ্চাদপসরণ করে নিকটবর্তী দ্বীপ টেনেডোসে চলে যায়। গ্রিকরা ট্রয়ে সিনন নামক এক ডাবল এজেন্টকে রেখে যায়। পরদিন ট্রোজানরা ট্রয়ের বাইরে গ্রিক সৈন্যদের না দেখে অবাক হয় এবং কাঠের ঘোড়াটি দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
গ্রিক ডাবল এজেন্ট সিনন ট্রোজানদের বোঝান যে গ্রীকরা এই যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে পলায়ন করেছে, এবং ‘ট্রোজান হর্স’ একটি ঐশ্বরিক উপহার যা ট্রয়ের জন্য অনেক সৌভাগ্য নিয়ে আসবে। যদিও অ্যাপোলোর পুরোহিত লাওকুন এবং জ্যোতিষ ক্যাসান্দ্রা ট্রোজানদের সতর্ক করে, কিন্তু তাদেরকে কেউ বিশ্বাস করেনি। সব নিষেধ উপেক্ষা করে কোনোকিছু না ভেবেই আনন্দের সঙ্গে ট্রোজানরা ঘোড়াকে শহরে নিয়ে আসে। এরপর ট্রয়ের বাসিন্দারা বিজয় উদযাপন শুরু করে। ট্রোজানদের এই বিজয়োল্লাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সেদিন রাতে গ্রিক জাহাজগুলো পুনরায় ট্রয়ের উপকূলে ফিরে আসে, এবং ঘোড়ার ভিতরে লুকিয়ে থাকা গ্রিক সৈন্যরা বের হয়ে এসে শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই হাজার হাজার গ্রিক সৈন্য ট্রয় নগরীর অভ্যন্তরে ঢুকতে থাকে।
এক দশকব্যাপী ধরে রাখা ট্রোজানদের প্রতিরক্ষা এত সহজেই অতিক্রম করে গ্রিকরা। শহরে ঢুকেই গ্রিকরা গণহত্যা শুরু করে, এবং নগরীর অধিকাংশ স্থানে আগুন লাগিয়ে দেয়। গ্রিকরা ট্রয়ের বসতবাড়ি থেকে শুরু করে উপাসনালয় পর্যন্ত ধ্বংস করতে শুরু করে। ট্রোজানরাজ প্রায়ামকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ট্রোজানরা আর কোনো প্রতিরোধই করতে পারেনি। অবশেষে, এক দশকব্যাপী যুদ্ধের পর, গ্রিকদের হাতে ট্রোজানদের বিখ্যাত ট্রয় নগরীর পতন ঘটে। এভাবে এক মহাকাব্যিক অধ্যায়ের অবসান হয়। গণহত্যা থেকে বেঁচে থাকা কয়েকজন বীরের একজন ছিলেন ঈনিয়াস, যিনি পরবর্তীকালে ট্রয় থেকে ইতালিতে যান, এবং প্রথম রোমান রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন।
দেব-দেবীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্র থেকে শুরু হয়ে গ্রিস এবং ট্রয়ের মধ্যে দীর্ঘ ১০ বছরব্যাপী সংঘটিত এই যুদ্ধ প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনাগুলোর একটি। ট্রয়ের যুদ্ধ গ্রিক উপকথা ও প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের অন্যতম কথিত কাহিনী। হোমারের ইলিয়াড ও অডেসি থেকে শুরু করে ভার্জিলের ইনিডসহ অনেক সাহিত্যে ট্রোজান যুদ্ধের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ট্রোজান যুদ্ধ প্রাচীন পৃথিবী থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে পশ্চিমা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। শিল্পী-সাহিত্যিকরা এখনও এই পৌরাণিক যুদ্ধ নিয়ে মাতামাতি করেন। এই যুদ্ধগাথা গ্রিক তথা পশ্চিমা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।