হারকিউলিস নিজের পাপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন বারোটি শ্রমের মাধ্যমে। এর মঝে নয় নম্বরটি ছিল আমাজন রানী হিপোলাইটার কোমরবন্ধনী চুরি করে আনা। যুদ্ধের দেবতা অ্যারিসের কন্যা হিপোলাইটা পিতার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন এই কোমরবন্ধনী, যা শুধুই সাজসজ্জার আনুষঙ্গিক ছিল না, এটি হিপোলাইটার শক্তিবৃদ্ধি করতো।
‘একটি মেয়ের গহনা চুরি এমন কি কঠিন কাজ?’ এই ভেবেই হয়তো হারকিউলিস একাই চলে গিয়েছিলেন আমাজনদের রানীর কোমরবন্ধনী চুরি করতে। হিপোলাইটা হয়তো স্বেচ্ছায় দিয়েই দিতেন, বাধ সাধলেন দেবী হেরা, গুজব রটিয়ে দিলেন, ‘হেরাক্লেস (হারকিউলিসের গ্রিক নাম) এর মূল উদ্দেশ্য রানীকে বন্দী করা, গহনা টহনা ওসব বাজে কথা!’ যুদ্ধাংদেহী সেই নারীদের কাছ থেকে গহনা হাতিয়ে নিজের প্রাণখানা বাঁচিয়ে ফেরত আসতে হারকিউলিসকে সেবার বেগ পেতে হয়েছিল বৈকি!
গ্রিক উপাখ্যানে বেশ কয়েকবার উল্লেখিত হলেও আমাজনদের নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি কখনোই। তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় সম্পূর্ণরূপে নারীশাসিত যোদ্ধা জাতির অস্তিত্ব হুমকি বৈকি! খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে হোমারের ইলিয়াড থেকে সর্বপ্রথম জানা যায় ভয়ংকর এক যোদ্ধা জাতির কথা, যাদের সবাই ছিল নারী। হোমারের মতে, তারা ছিল ‘পুরুষের সমান’, অর্থাৎ যেকোনো পুরুষ যোদ্ধা থেকে তাদের দক্ষতা কিছু কম ছিল না। কোনো পুরুষ একেক যুদ্ধে কোনো আমাজনকে হারাতে পারলে তা নির্যাতন বা দুর্বলের উপর অন্যায় নয়, বরং কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচিত হত।
প্রাচীন গ্রিক উপকথায় আমাজনদের সম্পর্কে পাওয়া যায় অদ্ভুত সব তথ্য। ধারণা করা হতো, কৃষ্ণ সাগরের পাশে (যা বর্তমানে উত্তর তুরস্ক) অবস্থিত আমাজনদের শহর। প্রচলিত ধারণা ছিল, আমাজনেরা সমকামী জাতি, যারা পুরুষকে ঘৃণা করে, কিন্তু সন্তান উৎপাদনের জন্য বছরে একবার পুরুষদের সাথে মিলিত হতো। কন্যাসন্তান জন্ম নিলে তাকে নিজেদের সাথে রেখে যুদ্ধবিদ্যা শেখানো হত। কিন্তু পুত্রসন্তানদেরকে তাদের পিতার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হতো। আমাজন দুনিয়ায় ছেলেদের স্থান নেই। কথিত আছে, তারা বর্শা বা তীর চালনার সুবিধার জন্য নিজেদের একবক্ষ কেটে ফেলত। যদিও বিভিন্ন ছবি আর ভাস্কর্য থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, এটি ছিল নিছক গুজব।
কারা এই আমাজন, আর কেনইবা তাদের ভিতর ছিল পুরুষসঙ্গে অনীহা, তার সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা গ্রিক উপকথায় নেই। তবে বিভিন্ন বর্ণনা থেকে ধারণা করা হয়, স্পার্টা নগরীর দেবী আর্টেমিসের মন্দিরের এক সেবাদাসী অট্রেরা আমাজনদের সূচনা করে। আমাজনেরা গ্রিক চিরকুমারী দেবী আর্টেমিস আর যুদ্ধদেবতা অ্যারিসের উপাসনা করত। কথিত আছে, অ্যারিসের সহায়তায় অট্রেরার গর্ভে হিপোলাইটা, অ্যান্টিওপি, মেলানিপ্পি আর পেনথেসিলিয়া নামের চার কন্যার জন্ম হয়, যারা পরবর্তীতে আমাজনদের রানী হয়। অট্রেরাকে পূর্বদিকের বাতাসের দেবতা ইউরসের কন্যা বলেও অনেকে উল্লেখ করে।
এশিয়া মাইনরের উত্তর উপকূলে হ্যালিস নদীর তীরবর্তী ট্র্যাবসন শহর আমাজন অধ্যুষিত বলে প্রচলিত ছিল। বলা হয়ে থাকে, শুরুতে থেমিস্কিরা নগরীতে গারগ্যারিয়ান নামক পুরুষ যোদ্ধা ও আমাজনরা সহাবস্থান করত। পরবর্তীতে আমাজনরা গারগ্যারিয়ানদের থেমিস্কিরা থেকে তাড়িয়ে দিলেও জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আশংকায় তাদের সাথে মিলিত হতে থাকে এই চুক্তিতে যে কন্যাসন্তান আমাজনেরা এবং পুত্রসন্তান গারগ্যারিয়ানরা লালনপালন করবে। আমাজন সৈন্যবাহিনী সাইম, মিরিন, এফিসাস, স্মিরনা প্রভৃতি নগরীর ভিত্তি স্থাপন করে। রানী অট্রেরা এফিসাসে আর্টেমিসের সম্মানে মন্দির স্থাপন করেন।
কথিত আছে, মদের দেবতা ডায়োনিসাস তার ভক্তকূল নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণের একপর্যায়ে থেমিস্কিরাতে আসেন। কিন্তু যোদ্ধা এই জাতি তাদের সম্মানের সাথে বরণ না করায় তারা রেগে গিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। অট্রেরা প্রথমে ডায়োনিসাসের কাছে ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেন এবং খুব দ্রুত নিজের ভুল বুঝতে পারেন, কেননা ডায়োনিসাস ইতোমধ্যে পিতা জিউসের অনুগ্রহে দেবত্ব লাভ করেছিলেন যা তাকে প্রায় অজেয় করে তুলেছিল। নিজের অনুসারীদের রক্ষা করতে অট্রেরা আর্টেমিসের সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং এফিসাসে এসে ডায়োনিসাসের বাহিনীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। এরপর থেকে এফিসাসের আর্টেমিস মন্দিরটি সব মেয়ের জন্য আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রচারিত হয়। কোনো মেয়ে মন্দিরে এসে আর্টেমিসের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে কেউ আর তার কোনো ক্ষতি করতে পারতো না।
অট্রেরা অবসর গ্রহণের পর রানী হন হিপোলাইটা। থিসিউস থেমিস্কিরা ভ্রমণের সময় হিপোলাইটার সাথে তার প্রণয় হয়। সহযোদ্ধাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে হিপোলাইটা থিসিউসের সাথে এথেন্সে গিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। হিপোলাইটাই একমাত্র আমাজন, যিনি বিয়ে করেছিলেন। এই ঘটনায় আমাজনরা রেগে গিয়ে এথেন্স আক্রমণ করে। মতান্তরে, থিসিউস পরবর্তীতে হিপোলাইটাকে ভুলে গিয়ে ফায়েড্রাকে বিয়ে করায় হিপোলাইটা আমাজনদের নিয়ে এথেন্স আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধ অ্যাটিকের যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধক্ষেত্রে বোন পেনথেসিলিয়ার হাতে মৃত্যু হয় হিপোলাইটার। তীব্র অপরাধবোধ গ্রাস করে পেনথেসিলিয়াকে, সব রাগ গিয়ে পড়ে গ্রিকদের উপর। এই রাগ থেকেই পরবর্তিতে ট্রয় যুদ্ধে রাজা প্রিয়ামের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয় আমাজনরা।
হোমার পরবর্তী কবিরা আমাজনদের ট্রয় নগরীর পক্ষে যুদ্ধ করার কথা বলেন। আর্কটিনোস অফ মিলেটাস এর মতে, গ্রিক বীর অ্যাকিলিস আমাজন রানী পেনথেসিলিয়ার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধের একপর্যায়ে অ্যাকিলিসের হাতে মৃত্যু হয় পেনথিসিলিয়ার। নিঃসাড় দেহ মাটিতে আছড়ে পড়ার পর শিরস্ত্রাণ খুলে গেলে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ প্রেমে পড়ে যান অ্যাকিলিস। মৃতদেহ ট্রয় নগরীতে ফিরিয়ে দেন তিনি, বারবার অনুরোধ করেন এই অসামান্য প্রতিভাশীল যোদ্ধা যেন সম্মানের সাথে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া লাভ করেন। অসম্পূর্ণ এই প্রেমের কাহিনী ট্রয়ের যুদ্ধকে আরও মর্মস্পর্শী করে তোলে।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এথেন্স নগরীর পত্তন এবং আমাজনদের পরাজয়ের মাঝে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেন অনেক ইতিহাসবেত্তা। অনেকেই হেরাক্লেস আর থিসিউসের কাহিনীর সময়কাল একীভূত করেন এবং তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় আমাজনদের পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিল বলে বিশ্বাস করেন। এই সময়েই গ্রিসের পুরুষদের ভেতর আমাজন ঘরানার যুদ্ধবিদ্যা ‘অ্যামাজনোম্যাসি’তে পারদর্শী হয়ে ওঠে। কিন্তু ব্ল্যাক সি বা উত্তর তুরস্ক এলাকা থেকে আমাজনরা কীভাবে এথেন্সে আসে তার কোনো সদুত্তর অনেকদিন পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস এই দুটি বর্ণনার ভিতর যোগসূত্র স্থাপন করেন। হেরোডোটাসের বর্ণনা অনুযায়ী গ্রিকরা উত্তর তুরস্ক আক্রমণ করার সময় কতিপয় আমাজনকে বন্দী করে জাহাজে করে গ্রিসে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাজনেরা জাহাজেই পালিয়ে যায় এবং নিজেদের অস্ত্র পুনরুদ্ধার করে বন্দিকারী সবাইকে হত্যা করে। কিন্তু অশ্বারোহী এই নারীরা নৌযান পরিচালনায় অদক্ষ ছিল বলে নিজেদের রাজ্যে আর ফেরত যেতে পারেনি। স্রোত আর বাতাসের করুণায় তারা একসময় স্কিথিয়ায় পৌঁছায় এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকে।
আমাজনদের সাথে গ্রিকরা বার বার যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়েছে। আমাজনদের উৎসর্গ করা অনেক চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। চিত্রকর্ম বা ভাস্কর্যগুলোতে গ্রিকদের অন্য শত্রুদের মতো যুদ্ধের ময়দানে কখনও পিছু হটতে দেখায় যায় না আমাজনদের। এর থেকে ধারণা করা হয়, আদতে গ্রিকরা কখনো আমাজনদের সাথে যুদ্ধের ময়দানে পেরে ওঠেনি।
গ্রিকদের কাছে আমাজন নারীরা ছিল অবিশ্বাস্য অপমানের মতো, খানিকটা ভয়ংকর বিস্ময়ও বটে। আর আমাদের কাছে তারা প্রচলিত প্রথার বাইরে নতুন এক জীবনের অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। দৃঢ়, করিতকর্মা এবং সাহসী, এই যোদ্ধারা হয়ে উঠতে পারেন সাধারণ মেয়েদের ‘মেয়ে’ হতে চাওয়ার আরও একটি কারণ ।
Featured Image: Ancient Origins