মোবাইলখানা হাতে নিয়ে মনের সুখে হেঁসে হেঁসে চ্যাট করছে আকাশ। পাশে বসে ৫০টি টাকার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করছে ছোট ভাই অঙ্কিত। আইসক্রিম না খেলে এখনই মরে যাবে যেন। ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করার আগ পর্যন্ত কিছুই বলল না আকাশ। একেবারে যেন কোনো অস্তিত্বই নেই অঙ্কিতের, তেমনই ভাব করে একমনে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ বায়না করতে করতে ভাইয়ের ঘাড় ধরে ঝুলে পড়ে দারুণ এক তথ্য আবিষ্কার করল ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া অঙ্কিত। ভাই তার চ্যাট করছে রামিসা আপুর সাথে!
এই মেয়ের সাথে কথা বলা নিয়েই তো মা আর ভাইয়া বেশ ঝগড়া করছিল গত সপ্তাহে। সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল ব্ল্যাকমেইলিং। “এক্ষনি টাকা না দিলে মাকে বলে দেব তুমি রামিসা আপুর সাথে চ্যাট কর”– দারুণ কাজ হলো এই কথায়। আকাশ উঠে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যাবে, এমন সময় দরজায় ছায়ার নড়াচড়া দেখে পেছনে তাকিয়েই দেখে রান্নাঘর থেকে খুন্তি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং মা! “আকাশ!” বলে তার দিকে মা তেড়ে আসতেই কোনোমতে অঙ্কিতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল সে, “ঘরের শত্রু যে আসলেই বিভীষণ হয়, তুই আজকে আরেকবার প্রমাণ করলি!”
শুধু আকাশই না, এমনই করে আত্মীয়-স্বজন বা কাছের মানুষদের কাছ থেকে কোনো ঝামেলায় পড়লেই চট করে আমরা স্মরণ করি বিভীষণকে। এখন প্রশ্ন হলো, কে এই বিভীষণ? কেনই বা তিনি সবার ঘরের শত্রু বনে গেলেন? কী-ই বা করেছিলেন তিনি?
রামায়ণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রাবণ। রাবণের ছোট ভাই হলো বিভীষণ। রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ- বিশ্রবা মুনির তিন ছেলে। তাদের এক ছোট বোনও ছিল, নাম তার শূর্পনখা। তাদের মা কৈকসী ছিলেন সুমালী রাক্ষসের মেয়ে। কৈকসীর আরেক নাম নিকষা। সুমালী নিজে তার মেয়ে নিকষাকে বিশ্রবা মুনির কাছে পাঠিয়েছিল। কারণটি অবশ্য তেমন মহৎ কিছু ছিল না। সুমালীরা ছিল তিন ভাই। মাল্যবান, সুমালী ও মালী। তিনজন মিলে একবার সুমেরু পর্বতে কঠোর তপস্যা শুরু করে দেয়। তাদের সে তপস্যায় সন্তুষ্ট হন ব্রক্ষ্মা। খুশি হয়ে তিনি তিন ভাইকে তিনটি বর দেন- তারা হবে অজেয়, শত্রুহন্তা ও চিরজীবী। মানুষ হোক বা রাক্ষস, এক জীবনে আর কী লাগে!
তিন ভাই তিনজনের প্রচণ্ড অনুরক্ত ছিল। বর পাওয়ার খুশিতে তারা সমস্ত জগত জুড়ে মারাত্মক উৎপাত শুরু করে। ধীরে ধীরে তাদের উপর বিরক্ত হয়ে ওঠে জনপদের প্রায় সকলে। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতা আর ঋষিরা মিলে বিষ্ণুর কাছে গিয়ে এর প্রতিকার চান। বিষ্ণু তখন তিন ভাইকে দমন করতে এগিয়ে আসেন। বিষ্ণুর হাতে মৃত্যু হয় মালীর। মাল্যবান আর সুমালী তাদের গোটা দলবল আর আত্মীয়-স্বজন নিয়ে পাড়ি জমায় পাতালপুরীতে। এরই মধ্যে তারা বিশ্বকর্মাকে দিয়ে ত্রিকূট পর্বতে লঙ্কাপুরী নির্মাণ করিয়ে নেয়। তারা চলে গেলে বিশ্রবা মুনির পরামর্শে কুবের সেখানে বসতি স্থাপন করে। কুবেরও ছিলেন বিশ্রবা মুনির আরেক ছেলে। ব্রক্ষ্মার বরে তিনি ধন-সম্পদে ফুলে-ফেঁপে ওঠেন। তার হাতে লঙ্কাপুরী ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এ ঘটনার অনেক দিন পরে, একবার সুমেলী পাতাল থেকে মর্ত্যলোকে আসে ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে সে গেল লঙ্কাপুরীতে। সেখানে গিয়ে কুবেরের ঐশ্বর্য আর লঙ্কাপুরীর জাঁকজমকপূর্ণ খোলতাই চেহারা দেখে রীতিমতো চোখ কপালে উঠে যায় তার। ঈর্ষায় জ্বলে-পুড়ে যেন ছাই হয়ে যাচ্ছিল সুমালী। যে করেই হোক, আবার লঙ্কাপুরীর দখল তাকে পেতেই হবে- সেই ভাবনা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে তার। সাথে প্রতিশোধের ব্যাপারটা তো আছেই। তখনই তার মাথায় আসে আরেক ফন্দি- বিশ্রবা মুনির সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কুবেরের মতো ধনকুবের আর ক্ষমতাধর সন্তানও পাওয়া যাবে, আবার হাতছাড়া হয়ে যাওয়া লঙ্কাপুরীও ফের দখলে আনা যাবে। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। সেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে রাক্ষসী মেয়ে কৈকসী বা নিকষাকে সে পাঠিয়ে দেয় বিশ্রবা মুনির কাছে। বিশ্রবা মুনি তখন তপোবনে তপস্যা করছিলেন। কৈকসী তার কাছে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। মাথা নিচু করে মাটিতে আঙুল দিয়ে এলোমেলো দাগ টানতে লাগল সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল বিশ্রবা মুনির। চোখ খুলতেই তিনি দেখতে পেলেন কৈকসীকে। তপস্যা থামিয়ে তাকে তপোবনে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কৈকসী তার পরিচয় মুনিকে বললেও এখানে আসার কারণ জানাল না। উল্টো তার প্রতি একধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলল, পারলে যেন সে তপোবলে সেই কারণ জেনে নেয়। তৎক্ষণাৎ আবার ধ্যানে বসে যান বিশ্রবা মুনি। দিব্য চোখে দেখতে পেলেন কৈকসী তার সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক স্থাপন করতে পাতালপুরী থেকে মর্ত্যে চলে এসেছে। তবে তার উদ্দেশ্য খুব একটা ভালো কিছু নয়। কিন্তু তারপরও কৈকসীর এত কষ্ট করে এতদূর এসেছে ভেবে কৈকসীর বাসনা তিনি পূরণ করলেন।
কিন্তু তার আগেই জানিয়ে দিলেন, এমনিতে কৈকসী সকাল সকাল এসেছে, তার উপর মুনির ধ্যানও ভাঙিয়েছে। তাছাড়া তার নিয়তেও যথেষ্ট গোলমাল আছে। কাজেই তাদের সন্তানরা হবে রাক্ষস। খুবই খারাপ স্বভাবের রাক্ষস। তখন কৈকসী অনেক অনুনয়-বিনয় করে বিশ্রবা মুনির মন গলানোর চেষ্টা করে। শত হোক মা তো, নিজের সন্তানরা খারাপ স্বভাবের রাক্ষস হবে, এ কথা সে কীভাবে সহ্য করবে? শেষমেশ খানিকটা নরম হয়ে অভিশাপ কিছুটা কমিয়ে দেন বিশ্রবা মুনি। জানান, কৈকসীর ছোট ছেলে রাক্ষস হলেও ভালো স্বভাবের রাক্ষস হবে, ভীষণ ধার্মিক হবে। কৈকসীর এই ধার্মিক রাক্ষস ছোট ছেলেটির নামই বিভীষণ।
এর অনেক দিন পরের কথা। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা তখন বনবাসে ছিলেন। রাবণও বোনজামাই বিদ্যুজ্জিহ্বকে মেরে ফেলার পর তার বোন শূর্পণখাকে সেই বনেই থাকতে দিয়েছিল। সেখানেই রামের দেখা পায় শূর্পণখা। রামের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে সোজা গিয়ে তাকে প্রেম নিবেদন করে বসে বেচারি। খালি রামই না, লক্ষ্মণও তাকে ফিরিয়ে দেয়। রেগে-মেগে শূর্পণখা গিয়ে সীতাকে খেয়ে ফেলতে উদ্যত হয়। তখন রামের আদেশে লক্ষ্মণ গিয়ে শূর্পণখার নাক কেটে ফেলে। সেই নাক কাটার বদলা নিতে রাবণ সীতাকে তুলে নিয়ে গেল। আর এই ঘটনা থেকেই রাম-রাবণের যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। রাবণের এই সীতাকে তুলে নিয়ে আসার ব্যাপারটি মোটেও সমর্থন করেনি তার ছোট ভাই বিভীষণ। সে বারংবার বুঝিয়ে-শুনিয়ে সীতাকে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু রাবণ তার কথা তো শোনেইনি, উল্টো বিভীষণ যতবার এই প্রসঙ্গে কথা বলতে এসেছে ততবার তাকে ভর্ৎসনা করেছে।
সীতাহরণ মেনে নিতে পারেনি রাবণের আরেক ভাই কুম্ভকর্ণও। তবে শেষ পর্যন্ত কুম্ভকর্ণের কাছে তার পরিবারই বড় হয়ে ওঠে। আর তাই সে রাবণের কাজকে সমর্থন না করলেও তার পক্ষ নিয়ে রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। বিভীষণ কিন্তু তা করেনি। সে তার পরিবারকে ত্যাগ করে হলেও রামের পক্ষে যোগ দেয়। রাক্ষস-রাজ্যের নানা গোপন কথা, গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে রামকে যুদ্ধে জয়ী হতে সহায়তা করে। শুধু তা-ই নয়, সে এমনকি নিজে রাক্ষস হয়েও রামের পক্ষ নিয়ে রাক্ষসদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করে। এভাবে রামের পক্ষ নিয়ে বিভীষণ হয়তো ন্যায়ের পক্ষে থেকেছে, ধর্মের পক্ষ নিয়েছে। কিন্তু আপন পরিবারের সাথে শত্রুর মতো আচরণ করে সে পেয়েছে বিশ্বাসঘাতকের পদবী। তারই ফলশ্রুতিতে আপন পরিবারের কেউ শত্রুর মতো আচরণ করলে বা নিজেদের পক্ষের কেউ বিরোধী পক্ষের হয়ে কাজ করলে তাকে বলা হয় ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’।
তথ্যসূত্র: অনুসূর্য নাবীল, ‘পৌরাণিক বাগধারা’, অবসর প্রকাশনী, ২০০৭, পৃষ্ঠা নং- ৪৩-৪৫
ফিচার ইমেজ- lifeberrys.com