সুপারম্যান বা অতিমানব সম্ভবত শুধু কমিক্স বইয়ে, কার্টুনে বা চলচ্চিত্রেই দেখা যায়। কিন্তু প্রাণীজগতে এমন কিছু অদ্ভুত ক্ষমতা বিশিষ্ট প্রাণী আছে, যাদের অতিমানবীয় (অথবা অতিপ্রাণীয়) ক্ষমতার জানতে পারলে কাল্পনিক জগতের অতিমানবরাও ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠবে। চলুন জানা যাক, এমন কিছু প্রাণীর বিস্ময়কর ক্ষমতার কথা।
দীর্ঘপদী ময়ুর চিংড়ি
ম্যান্টিস চিংড়ি বা পিকক ম্যান্টিস চিংড়ি নামে পরিচিত এই মাছগুলো মাত্র ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। কিন্তু এরা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী প্রাণী। এরা সাধারণত মুষ্ঠি দ্বারা আঘাতের মাধ্যমে এদের শত্রুর উপর আক্রমণ করে থাকে। এদের পেশির গঠন এমন জটিলভাবে তৈরি হয়েছে যে, যখন এরা শত্রুর উপর আক্রমণের জন্য বাহুকে প্রসারিত করে, তখন সেটি অনেকটা স্প্রিংয়ের মতো কাজ করে এবং যখন স্প্রিংটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন এটি ০.২২ ক্যালিবার বুলেটের চেয়েও দ্রুত ত্বরণে ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে শত্রুর দিকে ছুটে যায়।
এই প্রচন্ড বেগ শক্ত খোলস বিশিষ্ট যেকোনো শত্রুকে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। এই আঘাত এতো বেশি শক্তিশালী যে, এরা মাঝে মাঝেই অ্যাকুরিয়ামের কাঁচও ভেঙ্গে ফেলতে পারে। সেজন্য এদেরকে সাধারণত কাঁচের তৈরি অ্যাকুরিয়ামে না রেখে পুরু প্লাস্টিকের পাত্রে রাখা হয়। এছাড়াও আঘাতের আগেই এদের গতি এবং পানিতে যে বুদবুদের মতো সৃষ্টি করে, সেটা অনেকটা শক ওয়েভের মতো কাজ করে। সেই তরঙ্গের আঘাতে এদের শত্রু প্রথমে অবশ হয়ে যায় এবং এরপর তাদের উপর মূল আঘাতটি এসে পড়ে।
এতো জোরে আঘাত করা সত্ত্বেও নিজেদের শরীরের কোনো ক্ষতি না হওয়ার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা এদের মুষ্ঠিতে এক ধরনের বিশেষ পদার্থের খোলসকে চিহ্নিত করেছেন। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা এই খোলসটি নিয়ে গবেষণা করছেন ক্ষুদ্র এবং পাতলা, কিন্তু শক্তিশালী আবরণ তৈরি করার জন্য, যা প্রচন্ড আঘাতেও ভেঙ্গে পড়বে না।
উলভারিন ব্যাঙ
এক্সম্যান চলচ্চিত্রের উলভারিন চরিত্রটি আমাদের অনেকেরই পরিচিত। বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন এই মানব চরিত্রটি বিশেষ প্রয়োজনে হাতের আঙ্গুল থেকে ব্লেডের মতো ধারালো নখ বের করতে পারে। উলভারিন চরিত্রটি কাল্পনিক হলেও মধ্য আফ্রিকায় এক প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়া যায়, যাদের সত্যি সত্যিই অনেকটা এ ধরনের ক্ষমতা আছে। হেয়ারি ফ্রগ বা লোমশ ব্যাঙ নামের এই ব্যাঙটির বৈজ্ঞানিক নাম Trichobatrachus Robustus। শরীরের একপাশে চুলের মতো দেখতে চামড়া জাতীয় এক প্রকার পদার্থ আছে বলেই এর নাম হেয়ারি ফ্রগ। তবে এটি হরর ফ্রগ বা উলভারিন ফ্রগ নামেও পরিচিত।
এই প্রজাতির ব্যাঙের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা বিপদে পড়লে পায়ের পাতা ভেদ করে নখের মতো ধারালো হাড় বের করতে পারে। এদের এই থাবা মোটেও অন্যান্য প্রাণীর নখের মতো না। বরং এগুলো মূলত পায়ের হাড়। বিপদে পড়লে এরা পায়ের হাড়ের ধারালো অগ্রভাগ ভেঙ্গে, সেগুলোকে পায়ের পাতা ভেদ করে বাইরে নিয়ে আসতে পারে। তবে একবার বের করার সেই হাড় আবার শরীরের ভেতরে প্রবেশ করাতে পারে কিনা, অথবা নতুন হাড় সৃষ্টি হয় কি না, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত হতে পারেন নি।
সব পরিবেশে বাসযোগ্য জলভালুক
এরা সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী, যারা কোনো স্পেস স্যুট না পরেও মহাকাশ ভ্রমণে যেতে পারবে। এরা মূলত ১.৫ মিলিমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট জীবাণু, যারা শৈবালের উপর বাস করে। এদের নাম ট্রাডিগ্রেড, যার অর্থ যা ধীর পদক্ষেপে চলে। তবে এরা ওয়াটার বেয়ার, স্পেস বেয়ার প্রভৃতি নামেও পরিচিত। আট পা বিশিষ্ট খন্ডায়িত দেহবিশিষ্ট জীবাণু এরা। সারা বিশ্বের এদের অন্তত ১,০০০ ধরনের প্রজাতি আছে।
বিশ্বের সব স্থানে, সব ধরনের পরিবেশে এদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পর্বতের চূড়ায়, সমুদ্রের গভীরে, ফুটন্ত পানিতে, আণবিক বিকিরণস্থলে, মহাশূণ্যে – এমন কোনো পরিবেশ নেই যেখানে এরা বাঁচতে পারে না। এদের কিছু কিছু প্রজাতি পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি ১ কেলভিনেও বাঁচতে পারে। আবার কিছু প্রজাতি ২০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপও সহ্য করতে পারে। এরা সমুদ্রের তলদেশের চাপের চেয়েও ছয় গুণ বেশি চাপ সহ্য করতে পারে। কোনোরকম খাবার বা পানি ছাড়াও এরা ৩০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
এদের বিভিন্ন বিচিত্র পরিবেশে বেঁচে থাকার ক্ষমতা এবং বিরূপ পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থেকে ধারণা করা হয়, বিশ্বের সব প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এরাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে। প্রচন্ড বিরূপ পরিবেশে দীর্ঘদিন থাকলে এদের মৃত্যু হতে পারে।
অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন কাটল ফিশ
নামে ফিশ বা মাছ হলেও কাটল ফিশ মূলত অক্টোপাস গোত্রীয় সামুদ্রিক প্রাণী। এদেরও আটটি পা আছে, তবে সেগুলো অক্টোপাসের মতো দেহের চারদিকে ছড়ানো না। এরা আকারে ১৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
শত্রুর চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য কাটল ফিশের শরীরের রং এবং নকশা পরিবর্তন করার বিস্ময়কর ক্ষমতা আছে। অন্য কিছু প্রাণীও প্রয়োজন অনুযায়ী শরীরের রং পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু কাটলফিশের মতো নিখুঁতভাবে পটভূমির সাথে মিশে গিয়ে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মতো ক্ষমতা খুব প্রাণীরই আছে। এরা ৩২ ধরনের রং, ৬ ধরনের জটিল জ্যামিতিক নকশা, ৮ ধরনের অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে পটভূমির সাথে সম্পূর্ণ মিশে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। এদের কোনো কোনো প্রজাতি ৭৫ ধরনের রং, ৭ ধরনের নকশা এবং ১৪ ধরনের অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করতে পারে।
বিষাক্ত রক্ত বিশিষ্ট ঈল
ঈল হচ্ছে এক ধরনের লম্বা আকৃতির মাছ, যারা ৫ সেন্টিমিটার থেকে শুরু করে ৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এদের সাধারণত কোনো পাখনা থাকে না। এরা শরীরে তরঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে সাঁতার কাটে। এরা সাধারণত নিশাচর এবং পানির গভীরে অন্ধকারে চলতে পছন্দ করে।
বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর শরীরে বিভিন্ন রকম আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা থাকে। কেউ ধারালো অঙ্গ দিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করতে পারে, কেউ বিষাক্ত তরল নিক্ষেপ করে শত্রুকে অন্ধ করে দিতে পারে, কেউ আবার নিজের শরীরের রং পাল্টে ফেলে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, ঈলের এসব কোনো ক্ষমতাই নেই। কিন্তু তাদের শরীরে এমন ব্যবস্থা আছে যে, কোনো প্রাণী যদি তাদেরকে আক্রমণ বা হত্যা করেই ফেলে, এরপর তাকে তার প্রায়শ্চিত্য করতে হবে। কারণ ঈলের রক্ত ভয়াবহ রকমের বিষাক্ত। এদের খুবই সামান্য পরিমাণ পরিমাণ রক্তও শরীরের পেশীতে সংকোচনের সৃষ্টি করতে পারে এবং হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে।
সাউন্ড রেকর্ডার লাইয়ারবার্ড
গান গাইতে বা মানুষের গলার স্বর নকল করতে পারে, এরকম পাখির কথা আমাদের অজানা না। কিন্তু শব্দ নকল করার ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার লাইয়ারবার্ড নামক পাখি বিশ্বের যেকোনো পাখিকে হার মানাতে সক্ষম। এদের অত্যন্ত জটিল স্বরযন্ত্রের গঠনের কারণে এরা শুধু প্রাকৃতিক না, বিভিন্ন অদ্ভুত অদ্ভুত যান্ত্রিক শব্দও নকল করতে পারে। মানুষের গলার স্বর তো বটেই, কুকুরের ডাক, গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ, ক্যামেরার শাটারের শব্দ, করাতের শব্দ সহ শত শত শব্দ এরা অনায়াসে হুবহু নকল করতে পারে।
শূন্যে ভেসে থাকতে সক্ষম হামিংবার্ড
সব পাখিই উড়তে পারে, সম্ভবত উটপাখি আর ইমু বাদে। কিন্তু হামিংবার্ড নামক এই ক্ষুদ্র পাখিগুলো শুধু উড়তেই পারে না, এরা শূন্যের উপর এক জায়গায় ভেসে থাকতে পারে। এরা এই অসাধ্য সাধন করে প্রতি সেকেন্ডে ৭০ বারেরও বেশি ডানা ঝাপটানোর মধ্য দিয়ে। এই অস্বাভাবিক দ্রুতগতির কারণে এরা উল্টোদিকেও উড়তে পারে। বিনা বিশ্রামে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে সক্ষম হামিংবার্ড।
হীট সেন্সর বিশিষ্ট পিট ভাইপার
পিট ভাইপার এক বিশেষ ধরনের সাপ, যাদের বসবাস আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ায়। এদের দুই চোখের নিচে দুটি করে পিট বা গর্তের মতো আছে, যেগুলো মূলত অবলোহিত তরঙ্গ গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ শিকার যে বর্ণেরই হোক, যত ছোটই হোক, দিনে বা রাতে কোনো সময়েই এই সাপের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় নেই। কারণ প্রতিটি জীবিত প্রাণীর শরীর থেকেই তাপ নির্গত হয়। আর সে তাপই এই জাতীয় সাপ অবলোহিত তরঙ্গ হিসেবে দেখতে পারে।
ফিচার ইমেজ- bendigoadvertiser.com.au