মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া সে বসবাসের কথা কল্পনাও করতে পারে না। সমাজে মানুষের সাথে বিভিন্ন পশুপাখিও সহাবস্থান করছে। মানুষের শখের বশে হোক কিংবা নিজস্ব প্রয়োজনে হোক, পশুপাখিকে গৃহে রাখা নতুন কিছু নয়। তাই বলে কি, মানুষ কখনও জঙ্গলে গিয়ে পশুপাখির সাথে থাকার কথা ভাবতে পারে? কী করতেন, যদি মাত্র ৪-৫ বছর বয়সে আপনাকে কোনো গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হতো? টারজান কিংবা মুগলীর গল্প বলছি না। বাস্তবেই জলে-জঙ্গলে কাটানো কয়েকজন মানবশিশু বা বন্যশিশুর কথা বলছি, যারা প্রয়োজনে কিংবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে জঙ্গলে দীর্ঘসময় কাটিয়েছে এবং প্রাণীরাই তাদের বেঁচে থাকতে সহায়তা করেছে!
মেরিনা চ্যাপম্যান
মেরিনা চ্যাপম্যান আনুমানিক ১৯৫০ সালে কলম্বিয়ায় জন্মগ্রহণকারী একজন ব্রিটিশ। এই নারীর শৈশব অন্যান্য মানবশিশুর মত স্বাভাবিকভাবে মায়ের সাথে কাটেনি।
মাত্র ৫ বছর বয়সে কিছু লোক মেরিনাকে অপহরণ করে। এরপর অজ্ঞাত কারণে অপহরণকারীরা তাকে কলম্বিয়ার গভীর বনাঞ্চল বিপজ্জনক রেইনফরেস্টে ফেলে যায়। মেরিনা ভেবেছিল, হয়তো অপহরণকারীরা তাকে নিতে আসবে। কিন্তু সময় যতই গড়ায়, তার বিশ্বাসে ততই ফাটল ধরতে থাকে। সে বুঝতে পারে, কেউই তাকে উদ্ধার করতে আসবে না।
মেরিনা কাঁদতে থাকে। সে কয়েক ঘণ্টা পর একদল কাপুচিন বানর দেখতে পায়। সে বানরদের চলফেরা, আনন্দ-উল্লাস ও বন্ধন দেখে বিস্মিত হয়। সে বানরদের আশপাশে থেকে তাদের সামাজিক কর্মকাণ্ড, খাওয়া, পান করা, ভাষা ইত্যাদি নকল করতে থাকে।
মেরিনা বেরি ফল, গাছের শিকড়, বানরদের ফেলে দেওয়া কলা ইত্যাদি খেত। একদিন সে অতিরিক্ত তেঁতুল খাওয়ার কারণে পেটব্যথায় আক্রান্ত হয়। ব্যথায় ছটফট করতে থাকে। সেদিন একটি বয়স্ক বানর তাকে কর্দমাক্ত পানি পানের উপায় বাতলে দেয়। মেরিনা সেই পানি পান করে। ফলে তার বমি হয় ও পেটব্যথা সেরে যায়!
এই ঘটনার পর থেকে বানররা মেরিনাকে তাদের দলের অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। মেরিনা জঙ্গলে বানরদের সাথে কাটাতে থাকে। সে তখন বানরদের মতো গাছে ওঠা, গাছের গর্তে লুকানো, চারপায়ে চলা, বানরদের মত বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি ও শব্দ করা ইত্যাদি শিখে ফেলে। এভাবেই মেরিনার আনুমানিক ৫ বছর জঙ্গলে কেটে যায়।
ভাগ্যদোষে মেরিনা জঙ্গলে থেকে, জঙ্গল জীবনের সাথে অভিযোজিত হলেও মানব সমাজে মেশার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাই একদিন বানরের মত হেঁটে এসে কয়েকজন শিকারীর হাতে ধরা দেয়। ভাগ্য বোধহয় খুলে যায় এবার! কিন্তু এরপর যা ঘটেছিল তাতে বোধহয় জঙ্গলই ভাল ছিল মেরিনার।
শিকারীরা তাকে একটি পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। তবে মেরিনা সেখানকার গৃহস্থালীয় কাজ করলেও পতিতাবৃত্তিতে জড়ায়নি। একদিন সে পতিতালয় থেকে পালিয়ে একটি এতিমখানায় যায়। এতিমখানা থেকে মারজুয়া নামের এক দয়ালু মহিলা তাকে উদ্ধার করে নিজের সন্তানদের সাথে রাখেন।
ষাটোর্ধ্ব মেরিনা বর্তমানে ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ডে স্বামীর সাথে বসবাস করছেন। তিনি এখন দুই সন্তানের জননী। মূলত ২০১৩ সালে মেরিনা, মেয়ে ভেনেস্সা জেমসের সহায়তা ও উৎসাহে ‘The girl with no name’ বইটিতে তার জীবনের এই ঘটনা প্রকাশ করেন। সেই সময় বইটি ব্যাপক সাড়া ফেললেও তার জঙ্গলে কাটানোর পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন অভিমত ও যুক্তির জন্ম হতে থাকে। মেরিনার কথার সত্যতা যাচাই করতে গাছে ওঠা, বানর সমাজের সাথে মিশতে যাওয়া ও বানরদের ভাষায় ভাবপ্রকাশ সহ নানারকম তাকে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। এছাড়াও পরীক্ষা করা হয়েছিল তার হাড়ের গঠন। সেগুলোতে এই ঘটনার সত্যতা প্রকাশ পায়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল মেরিনার উপর প্রায় তিন মিনিটের একটি ডকুমেন্টারিও প্রকাশ করে।
মার্কোজ রড্রিগেজ প্যান্টোজা
আপনের চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে জঙ্গল ভালো। এই প্রবাদের বাস্তবতা মিলে যায় স্পেনে জন্মগ্রহণকারী বন্যশিশু মার্কোজ রড্রিগেজ প্যান্টোজার জীবনী থেকে। মাত্র ৬-৭ বছর বয়সে মার্কোজকে তার বাবা সিয়েরা মরেনা পর্বতের কাছে এক কৃষকের কাছে বিক্রি করে দেন। কিছুদিন পর সেই কৃষক মারা যায়। মার্কোজ ফিরে আসে সৎ মায়ের কাছে। কিন্তু সৎ মায়ের প্রহারে অতিষ্ঠ হয়ে সে জঙ্গলে বাস করার সিদ্ধান্ত নেয়।
একদিন সে নির্জন পর্বতে চলে যায়। সেখানে খরগোশ ও বিভিন্ন ধরনের পাখি শিকার করা শিখে ফেলে। সে টানা ১২ বছর নির্জন পর্বতে নেকড়ে, ছাগল, সাপ ও বিভিন্ন প্রাণীদের সাথী হিসেবে বাস করেছিল। নেকড়ের গুহায়ও সে থেকেছিল। তার সবচেয়ে ভাল বন্ধুও হয়েছিল সেই নেকড়ে। মার্কোজ প্রাণীদের ভাষা শিখেছিল ও তাদের মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছিল।
একদিন মার্কোজ গার্ডিয়া বেসামরিক বাহিনীর নজরে পড়ে যায়। তারা তাকে উদ্ধার করে পর্বতের পাদদেশে একটি ছোট্ট গ্রামে নিয়ে যায়। সেখানে তার বাবার সাথে আবার দেখা হয় ও তার বাবা তাকে চিনতে পারে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে মার্কোজ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
ট্রাইয়ান কালডারার
ট্রাইয়ান কালডারার রোমানিয়ায় বাস করত। কিন্তু মাত্র ৩-৪ বছর বয়সে পিতামাতার পারিবারিক অশান্তির কারণে সে জঙ্গলে হারিয়ে যায়। শুরু হয় তার জঙ্গলের জীবন।
ট্রাইয়ান ৩ বছর জঙ্গলে কাটানোর পর, ২০০২ সালে ৭ বছর বয়সে এক মেষপালকের কাছে ধরা পড়ে। মেষপালক পুলিশকে খবর দেয়। এরপর পুলিশ ট্রাইয়ানকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
ট্রাইয়ানকে যখন ধরা হয় তখন সে শিম্পাঞ্জীর মতো চলছিল, প্রাণীদের মতো আচরণ করছিল। তাছাড়াও সে খাবার পেলে কুকুরের মতো আচরণ করত ও তার খাবারে অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দিত না। সে সকল প্রকার খাবারই খেত ও ফলমূল চিনতো না। তাছাড়াও সে খাওয়ার পরই ঘুমিয়ে যেত। অর্থাৎ তার মাঝে প্রাণীদের অনেক বৈশিষ্ট্যই প্রকাশ পেয়েছিল।
যা-ই হোক, হাসপাতাল থেকে যখন টেলিভিশনে বাচ্চাটিকে দেখানো হয়েছিল, তখন ট্রাইয়ানের মা লিনা কালডারার তাকে চিনতে পারেন। এরপর হাসপাতালে গিয়ে বাচ্চাটিকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন তিনি।
জন সেবুনিয়া
জন সেবুনিয়াকে উগান্ডার বানর বালক বলা হয়ে থাকে। মাত্র ৩-৪ বছর বয়সে চোখের সামনে, বাবার হাতে মাকে খুন হতে দেখে ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় সেবুনিয়া। সেবুনিয়া জঙ্গলে ভারভেট বানরদের সাথে বাস করত।
একদিন মিলি নামের এক আদিবাসী মহিলা জঙ্গলে শুকনো ডালপালা কুড়াতে গিয়ে গাছের গর্তে লুকিয়ে থাকতে দেখেন সেবুনিয়াকে। মহিলাটি দ্রুত গ্রামে এসে বিষয়টি সবাইকে জানান। গ্রামবাসীরা বানরদের কাছ থেকে সেবুনিয়াকে উদ্ধার করেন।
বানররা কিন্তু স্বেচ্ছায় সেবুনিয়াকে ছেড়ে দেয়নি। তারা গ্রামবাসীর দিকে ডালপালা ছুঁড়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করছিল। তারপরও গ্রামবাসীরা সেবুনিয়াকে উদ্ধার করে মিলিকে দিয়ে দেন। মিলি শিশুটিকে আবার ‘পাল এন্ড মলি ওয়াসওয়া’ নামক এতিম শিশুদের জন্য গঠিত দাতব্য প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করেন।
উদ্ধারের সময় সেবুনিয়া কথা বলতে পারত না। পরবর্তীতে সে কথা বলা শিখে ফেলে। কথা বলা শেখার পর মায়ের হত্যার কথা প্রকাশ করে। সেবুনিয়া এখন ভালো গানও গাইতে পারেন, আবার বানরদের সাথেও মেশা ভোলেননি। বর্তমানে তিনি ‘পার্ল অফ আফ্রিকা’ নামক সঙ্গীতদলের সাথে কাজ করছেন।
নাতাশা মিকাইলোভা
নাতাশা মিকাইলোভা এক ফুটফুটে ছোট্ট শিশুর নাম, যে ২০০৯ সালে সাইবেরিয়ার চিতা শহরের একটি বাসায় কুকুর বিড়ালের সাথে বড় হতে থাকে। পুলিশ যখন নাতাশাকে উদ্ধার করে, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর।
নাতাশাকে আপন পিতামাতাই কুকুর বিড়ালের সাথে একটি ঘরে আটকে রাখে। সেখানেই শিশুটি কুকুর বিড়ালের মতো স্বভাব নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। সে কুকুরের মত ডাকত কিন্তু কোনো কথা বলতে পারত না। উদ্ধারের সময় শিশুটি পুলিশের উপর কুকুরের মত হামলেও পড়েছিল! আবার পালানোরও চেষ্টা করছিল।
শিশু অবহেলার দায়ে পুলিশ পরে নাতাশার বাবা-মাকে আটক করেছিল। আর নাতাশাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেখানে মনোবিজ্ঞানীদের সহায়তায় তার চিকিৎসা করা হয়েছিল।
পশুপাখির মস্তিষ্ক মানুষের মতো উন্নত নয়। তবে মানুষের মতো হিংসা-বিদ্বেষও বোধহয় তারা বোঝে না। তাই তো জঙ্গলে আশ্রয় নেয়া বন্যশিশুদের বাঁচিয়ে রেখেছিল বনের পশুরা।