যে গাছেরা ছোঁয় না একে অপরকে

বিশেষ প্রজাতির এই গাছগুলোর শীর্ষ প্রতিবেশী গাছের শীর্ষকে স্পর্শ করতে চায় না। ফলে এক গাছ থেকে আরেক গাছের মধ্যে ফাঁকা স্থান তৈরি হয়। এভাবে একাধিক গাছের মধ্যকার ফাঁক দেখতে যেন অনেকটা পাজলের মতো দেখায়। এই শূন্যস্থানগুলো যেন ফাঁকা জায়গারই একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। গাছদের মধ্যে এ ধরনের দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘ক্রাউন শাইনেস’।

 

বলে রাখা ভালো, সব গাছের ক্ষেত্রে ক্রাউন শাইনেস ঘটে না। আবার সব বনে ক্রাউন শাইনেসের দেখা নাও পাওয়া যেতে পারে। ব্ল্যাক ম্যানগ্রোভ (Avicennia germinans), পাইন গাছ (Pinus contorta), জাপানিজ লার্চ (Larix kaempferi), ইউক্যালিপ্টাসের কিছু প্রজাতি ছাড়াও আরো কিছু প্রজাতির মধ্যে ক্রাউন শাইনেস দেখা যায়। সাধারণত একই প্রজাতির একাধিক গাছের মধ্যে ক্রাউন শাইনেস দেখা গেলেও কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির গাছের মাঝেও এটি দেখা যায়। আবার একই গাছের একাধিক ডালের মধ্যেও এটি দেখা যেতে পারে।

এক গাছের সাথে আরেক গাছের এ ধরনের দূরত্ব বজায় রাখার দৃশ্য বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতেই দেখা যায়। কোস্টারিকার ম্যানগ্রোভ থেকে শুরু করে মালয়েশিয়ার কর্পূর গাছেও এ ধরনের দূরত্ব চোখে পড়ে।

যেভাবে আলোচনায় এলো

১৯৮২ সালের কথা। জীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিস জ্যাক পাটজ দুপুরের তীব্র গরম থেকে বাঁচতে কোস্টারিকার গুয়ানাকাস্টে ন্যাশনাল পার্কের ব্ল্যাক ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে হাঁটছিলেন। কয়েক ঘণ্টার ফিল্ডওয়ার্ক আর দুপুরের খাবার শেষে ভাতঘুমের কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, গাছের নিচে একটু ঘুমিয়ে নেবেন।

Image Source: sciencehalimah.blogspot.lt

ঘুমানোর সময় তিনি যখন উপরের দিকে তাকালেন, তখন খেয়াল করলেন, বাতাসের কারণে এক গাছের ডাল আরেক গাছের দিকে হেলে পড়লেও গাছগুলোর পাতা আরেক গাছের পাতার সাথে দূরত্ব বজায় রাখছে। যেন এক গাছ আরেক গাছের পাতাকে ছুঁতে আগ্রহী নয়।

চল্লিশ বছর আগে পাটজ যখন এ দৃশ্য দেখেছিলেন, তখন তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, যে গাছেরও ব্যক্তিগত জায়গার প্রয়োজন আছে। বর্তমান সময়ে এসে তার এই পর্যবেক্ষণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খোঁজার জন্য অনেক বিজ্ঞানী কাজ করছেন। তবে ১৯২০ সাল থেকে বৈজ্ঞানিক সাহিত্যে ক্রাউন শাইনেসের কথা উঠে এসেছে অনেকবার।

ক্রাউন শাইনেসের কারণ

গাছদের মধ্যে এ শূন্যস্থান সৃষ্টি হওয়ার আসল কারণ এখনো বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করতে পারেননি। একেক বিজ্ঞানী একেক ধরনের তত্ত্ব দিয়েছেন। তবে তাদের বেশিরভাগই স্বীকার করেছেন, ক্রাউন শাইনেসের পেছনে একক কোনো কারণ না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে।

গাছেদের ক্রাউন শাইনেস; Image Source: 500.px

 

কিছু বিজ্ঞানী প্রথমদিকে অনুমান করেছিলেন যে, সালোকসংশ্লেষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আলোর অভাবের কারণে গাছগুলো তাদের মধ্যকার এই শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে পারে না।

জীববিজ্ঞানী এবং ট্রি ফাউন্ডেশনের পরিচালক মেগ লোম্যানের মতে, এ ধরনের ক্রাউন শাইনেস স্যোশাল ডিসট্যান্সিংয়ের বৃক্ষ-সংক্রান্ত সংস্করণও হতে পারে। তিনি বলেন, যে মুহুর্ত থেকে আপনি গাছগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে পারবেন, তখন থেকে আপনি গাছগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারবেন। আইসোলেশনের (বিচ্ছিন্নতা) এটাই সৌন্দর্য। গাছগুলো আসলে তাদের নিজেদের স্বাস্থ্যরক্ষা করে চলেছে।

১৯৫৫ সালে উত্তর-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় ইউক্যালিপ্টাসের এক জাতের গাছের ওপর এক গবেষণা করা হয়। এতে বলা হয়, এখানে প্রচণ্ড বাতাসের কারণে এক গাছ আরেক গাছের সাথে ধাক্কা খায়। এতে গাছগুলোর শীর্ষের পাতা এবং ডাল ভেঙে যায় এবং এক গাছের সাথে আরেক গাছের মধ্যে জায়গা তৈরি হয়।

Image Source: flickr.com

১৯৮৪ সালে এসে পাটজ এবং তার দল তাদের প্রকাশিত গবেষণায় দেখান যে, কিছুক্ষেত্রে বায়ুর প্রভাবে গাছের মধ্যে যে দোলা লাগে, তার কারণে ক্রাউন শাইনেস তৈরি হতে পারে। তাদের গবেষণামতে, যত বেশি বাতাস ম্যানগ্রোভে প্রবাহিত হচ্ছিল, গাছগুলোর শীর্ষের মধ্যে দূরত্বও তত বাড়ছিলে।

পাটজের দুই দশক পরে এসে মিশিগান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী মার্ক রুদনিকির নেতৃত্বে একটি দল কানাডার আলবার্তায় বাতাসের প্রভাবে পাইন গাছের ধাক্কা দেওয়ার বল পরিমাপ করেন। তারা দেখতে পান, যেসব বনে বাতাস বেশি এবং সমান উচ্চতার লম্বা গাছ বেশি, সেসব বনে ক্রাউন শাইনেস বেশি ঘটে। কিন্তু প্রতিবেশী পাইন গাছের সাথে ধাক্কা এড়াতে রুদনিকি ও তার দল যখন নাইলনের দড়ি ব্যবহার করে দেখলেন, গাছগুলোর পাতা তাদের মধ্যকার শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলছে। তখন আর ক্রাউন শাইনেস থাকছে না।

রুদনিকির মতে, কিছু গাছ শিখে নিয়েছে যে, আগায় গিয়ে আর নিজেদের শরীর (ডালপালা, পাতা) বৃদ্ধি করা যাবে না। এ বিষয়ে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুবিদ্যা-বিশেষজ্ঞ ইনেস ইব্যানেজ বলেন, গাছগুলো তাদের বৃদ্ধি একটা পর্যায়ে গিয়ে থামিয়ে দেয়, যাতে গাছের ডাল ভেঙে না পড়ে। গাছেদের ক্ষেত্রে নতুন টিস্যু উৎপাদন করা বেশ কষ্টসাধ্য। এটা অনেকটা এরকম যে, গাছগুলো নিজেরাই বুঝে নেয়- আর বৃদ্ধি পাওয়ার দরকার নেই, বেশি বৃদ্ধি পেলে নিজেরই ক্ষতি হতে পারে।

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টার এবং উদ্যানতত্ত্ববিদ মারলিইজি ডুগেড বলেন, অনেক গাছই নিজেদের বৃদ্ধির বিষয়ে এ ধরনের বিচক্ষণতা আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতে পারে। এজন্য গাছগুলো আশেপাশের গাছপালা হতে উদ্ভূত রাসায়নিক পদার্থ শনাক্ত করতে একটি বিশেষ সংবেদক সিস্টেম ব্যবহার করে। বৃক্ষের এ ধরনের রাসায়নিক যোগাযোগ বেশ জটিল এবং অল্প মাত্রায় ঘটে। কিন্তু এক গাছ যদি আরেক গাছকে বুঝতে পারে, তবে একে অন্যকে স্পর্শ করার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই তারা নিজেদের শীর্ষের ডাল এবং পাতার বৃদ্ধি বন্ধ করে দিতে পারে।

Image Source: demilked.com

ক্রাউন শাইনেসের পেছনে গাছের নিজস্ব সুবিধার বিষয়টি জড়িত বলে মনে করেন লোম্যান। তিনি বলেন, গাছের অন্যতম একটি অঙ্গ হচ্ছে তার পাতা। গাছ চায়, যেকোনো মূল্যে তার পাতাকে রক্ষা করতে। যদি বাতাসের কারণে এর কোনো একটি ডাল আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তা গাছটির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এজন্যও গাছেরা দূরত্ব বজায় রেখে বসবাসের চেষ্টা করে।

মিগেল ফ্র্যাংকোর একটি তত্ত্বে বলা হয়েছে, প্রতিটি গাছ তার প্রতিবেশীদের এমন একটি প্যাটার্নে বা ছাঁচে যেতে বাধ্য করে, যা সম্পদ সংগ্রহকে সর্বাধিক করে তোলে এবং ক্ষতিকারক প্রতিযোগিতা হ্রাস করে। বাস্তুসংস্থান সংক্রান্ত মিথস্ক্রিয়া বেশ জটিল বিষয়। ফলে ক্রাউন শাইনেসের পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে।

সুবিধা

মেগ লোম্যান মনে করেন, নিজেদের সুবিধার জন্যই এই বিশেষ গাছগুলো নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখে। বেঁচে থাকার উপাদান যেমন- পরিপোষক পদার্থ, পানি, জায়গা এবং আলো সংগ্রহের জন্য গাছকেও অন্যান্য গাছ এবং প্রাণীর সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়। ঘন বনাঞ্চলে আলোর জন্য উদ্ভিদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। ক্রাউন শাইনেসের এই শূন্যস্থানগুলো গাছগুলোকে সঠিক আলো পেতে এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া নিজের অনুকূলে রাখতে সাহায্য করে।

Image Source: wikimedia commons

সৃষ্ট শূন্যস্থানের কারণে সূর্যের আলো বনের মাটিতে পৌঁছাতে পারে। ফলে নিচে অবস্থানকারী ছোট উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবনধারণ সহজ হয়, যা ঘুরেফিরে পরোক্ষভাবে ওই বড় গাছের জীবনধারণেই সাহায্য করে।

পাটজ মনে করেন, এই শূন্যস্থানগুলো গাছগুলোকে লায়ানাস নামক আক্রমণাত্মক লতা এড়িয়ে চলতে সাহায্য করে। এ ধরনের লতা সারা পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চলেই দেখা যায়। তাছাড়া এই ফাঁকা জায়গাগুলো রোগবাহী জীবাণু এবং পোকামাকড় এড়াতেও সাহায্য করে। নিজেদেরকে বাহ্যিক রোগজীবাণু থেকে সুরক্ষিত রাখতে গাছেদের মধ্যেও দূরত্ব রাখার প্রয়োজন পড়ে। এ বিশেষ প্রজাতির গাছগুলো সেটিই মেনে চলে।

Related Articles

Exit mobile version