নদীবিধৌত এই ব-দ্বীপ, আমরা যাকে বাংলাদেশ বলে চিনি, আয়তনে এটি খুবই ছোট। কিন্তু তা হলে কী হবে, সাইনো-হিমালয়ান আর ইন্দো-মালয়ান উপাঞ্চলের মাঝে অবস্থিত হওয়ায় জীববৈচিত্র্যের বিচারে আমরা কিন্তু ভরপুর ঐশ্বর্য্যের অধিকারী ছিলাম এক কালে। বর্তমানে জন বিস্ফোরণ আর ক্রমাগত বন বিনাশের ফলে আমাদের টিকে থাকা বাকি বনাঞ্চলও সম্পদের দিক দিয়ে অনেকাংশেই নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে পড়ছে। তবে এতকিছুর পরেও আমাদের গর্ব করার একটি জায়গা কিন্তু টিকে আছে এখনও। সেটি হলো সুন্দরবন।
সুন্দরবনের সবথেকে বড় পরিচয় কী? বললেই সবার চোখে ভেসে ওঠে পেশীবহুল কমলা রঙের চামড়ার ওপরে কালো ডোরা বিশিষ্ঠ একটি প্রাণী। বাংলার গর্ব এই ডোরাকাটা বাঘগুলো বিখ্যাত তাদের সাহস আর বুদ্ধিমত্তার জন্য। যদিও অগম্য এক বাদা জঙ্গলে বসবাস করার কারণে সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে খুব কমই গবেষণা হয়েছে। শুধু তা-ই বা বলি কেন, ২০০১ সালে ‘সোয়াম্প টাইগার‘ তথ্যচিত্রটির আগে এই বাঘের কোনো ভিডিও ফুটেজও ছিল না। আমাদের এই জাতীয় পশুটি নিয়েই আলাপ হবে।
বাংলার বাঘের ইতিহাস
বাংলার বাঘ বললে সবাই সুন্দরবনের বাঘের কথাই মনে করেন। যদিও ভারত, নেপাল, ভুটানের বাঘও কিন্তু আসলে একই প্রজাতির। পৃথিবীতে বাঘের মোট ৬টি প্রজাতি আজ টিকে আছে। এগুলো হলো বাংলার বাঘ, সাইবেরীয় বাঘ, মালয় বাঘ, ইন্দোচীনা বাঘ, সুমাত্রার বাঘ আর দক্ষিণ চীনের বাঘ। মোটমাট বন্য বাঘের সংখ্যা হলো হাজার চারেকের মত। এর মধ্যে বাংলার বাঘের সংখ্যাই প্রায় ষাট শতাংশের বেশি।
কীভাবে সুন্দরবনে এসে জুটলো এই বাঘ? এবারে একটু ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ কয়েকটি হিমযুগ হানা দিয়েছে এযাবৎ কালে। সে আমলে এশিয়ার উত্তরাংশের আবহাওয়া ছিল ঊষ্ণ ও আর্দ্র। ফলে বাঘ ও বাঘের শিকারেরা সেখানেই থাকতো। হিমযুগের আক্রমণে গোটা উত্তর এশিয়া বরফে ঢাকা পড়ে। ফলে তৃণভোজী প্রাণীরা দক্ষিণে যাত্রা শুরু করলে তাদের পিছু পিছু বাঘও এসে জোটে। বাঘেদের একটি দল মধ্য এশিয়া, পূর্ব তুরস্ক, ইরানে ছড়িয়ে পড়ে। অপর অংশটি চীন, ভিয়েতনাম হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে শাখা গাড়ে।
তো ভারতীয় উপমহাদেশ, বিশেষ করে বাংলা তখন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। স্বাধীন সুলতানী আমলে এ অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও পরবর্তী মোঘল আমলে বাংলা আবার অবহেলিত হয়ে পড়ে। মোঘল সুবাদার মুর্শিদকুলি খান বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যান। ফলে অরক্ষিত বাংলায় হানা দিতে থাকে ফিরিঙ্গী জলদস্যুরা। এদের দাপটে, আর সেই সাথে নানান রোগ-শোকে বাংলার জনসংখ্যা উজাড় হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঢাকা পড়ে বনে। সে আমলে হিমালয়ের তরাই থেকে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা হয়ে কুমিল্লা পর্যন্ত অঞ্চল শালের বনে ঢাকা ছিল। আর বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনার উপকূলে গড়ে ওঠে বিশাল ম্যানগ্রোভ বন। ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমলে পুনরায় কুড়ালের কোপ পড়তে থাকে এইসব বনে। ফলে বাঘেরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে দক্ষিণের সুন্দরবনে। লবণাক্ত ভূমির কারণে চাষাবাদের অনুপযুক্ত বলেই মনে করা হতো এই অঞ্চলকে। এভাবেই বাংলাদেশের দক্ষিণে এক টুকরো অঞ্চলে বাঘেদের এক স্থায়ী আবাস গড়ে ওঠে।
বাঘের আবাস সুন্দরবন
সুন্দরবনকে চিরে চলে গিয়েছে শিবসা, পশুর, রায়মঙ্গল, মাথাভাঙ্গা সহ অসংখ্য নদী। বর্ষাকালে হিমালয় থেকে বৃষ্টির পানি এসব নদী বয়ে নিয়ে আসে বিপুল পলিমাটি। এই পলিমাটি মিশ্রিত পানির ঘনত্ব আবার সমুদ্রের পানির ঘনত্বের তুলনায় কম। ফলে মোহনা অঞ্চলে এই পলি থিতিয়ে পড়ে, গড়ে ওঠে চর। বর্ষার পানি সাথে নিয়ে আসে নানা গাছের বীজ। চরে এসব গাছ গজিয়ে সৃষ্টি হয়েছে আজকের সুন্দরবন।
সুন্দরবনের পানি লবণাক্ত, অক্সিজেনের পরিমাণ খুবই কম। ফলে গাছ বাধ্য হয়েছে অভিযোজন করতে। কেউ কেউ মাটি ফুঁড়ে শ্বাসমূল বের করে আনে (কেওড়া, সুন্দরী, পশুর, আমুর), কারো জন্মায় বায়বীয় শেকড় (গর্জন, বাইন), কারো বা জন্মে গুচ্ছমূল (গরান)। ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের গাছগাছালির বৈচিত্র্য তুলনামূলকভাবে কম হলেও কষ্টসহিষ্ণু এই গাছগুলোই কেবল সুন্দরবনে টিকে থাকার উপযুক্ত।
বাংলাদেশের সুন্দরবনের আয়তন হচ্ছে ৬,০২৪ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে পানির অংশ ১,৭০০ বর্গ কিলোমিটার। বাকি অংশের জমি ভেজা, জোয়ার ভাটায় হরদম আর্দ্র আর কাদায় ভরপুর থাকে। ব্রিটিশরা ১৮৯১ সালে বাংলাদেশের সুন্দরবনকে ৪টি রেঞ্জে ভাগ করেছিলো। খুলনার চাঁদপাই ও নলিয়ান রেঞ্জ, সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনি রেঞ্জ আর বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জ। এর মধ্যে বাগেরহাট আর খুলনার অংশে সুন্দরী গাছ এবং হরিণের সংখ্যা বেশি। সাতক্ষীরা অঞ্চলের সুন্দরবন তুলনায় অনেক রিক্ত। সুন্দরী গাছ সংখ্যায় কম, হরিণও বেশি থাকে না। এই রেঞ্জ চারটি আবার ৫৫টি কম্পার্টমেন্টে বিভক্ত। বিরাট এই জঙ্গল আমাদের দেশকে বুক আগলে রক্ষা করে নানা মৌসুমী দুর্যোগ থেকে।
সুন্দরবনের বাঘের স্বভাব
সুন্দরবনের প্রাণীবৈচিত্র্য কম। একটা সময়ে এখানে গণ্ডার, বুনো মহিষ দেখা গেলেও বর্তমানে তারা বিলুপ্ত। তাই বাঘের মেন্যুতে প্রধান খাবার হিসেবে আছে চিতল হরিণ এবং শূকর। এরাই বাঘের ৭০-৯০ ভাগের মতো খাদ্যচাহিদা পূরণ করে। বাকিটা বাঘ পুষিয়ে নেয় মায়া হরিণ, গুইসাপ, বানর, কাঁকড়া, বনমোরগ আর অন্যান্য ছোটখাট প্রাণী শিকার করে। বাঘ প্রধানত জঙ্গলের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে শিকার ধরে। খুব বেশি দূর দৌড়ে শিকার ধরবার মতো সামর্থ্য তার নেই।
একটি প্রচলিত ধারণা আছে, সুন্দরবনের বাঘ আকারে সব থেকে বড়। আসলে ঘটনা কিন্তু তা নয়। আকৃতির দিক থেকে সাইবেরীয় বাঘ বা হিমালয়ে বসবাসকারী ডোরাদার বাঘ সুন্দরবনের বাঘের থেকে অনেক বড় হয়। একটা প্রাপ্তবয়স্ক সুন্দরবনের বাঘের দৈর্ঘ্য সাড়ে সাত থেকে আট ফুটের মত আর ওজন হয় প্রায় ৩০০ পাউন্ড। সেখানে শীত প্রধান অঞ্চলে বসবাসকারী বাঘ দৈর্ঘ্যে প্রায় ১০ ফুট ও ওজনে ৪০০ পাউন্ডের মতো হয়।
তাই বলে সুন্দরবনের বাঘ শক্তি বা হিংস্রতায় কোনো অংশে কম নয়। সাঁতারে পটু এই প্রাণীগুলো প্রধানত শিকার করে রাতে। দিনের বেলাটা ঘুমিয়ে বা বিশ্রাম নিয়ে কাটায়। পুরুষ বাঘের নিজস্ব সীমানা আছে, সে সেখানেই শিকার করে আর টহল দেয়। দৈবাৎ অন্য কোনো বাঘ এলাকায় ঢুকে পড়লে প্রথম নজরেই এরা শক্তি সামর্থ্যের একটা পরিমাপ করে ফেলে।
বাঘ নিঃসঙ্গ প্রাণী। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এদের প্রজননকালেই কেবল বাঘ আর বাঘিনী জোড়া বাধে। বাঘের বাচ্চারা আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের সাথেই থাকে। মা বাঘিণী অত্যন্ত বিপদজনক প্রাণী, বাচ্চাকে রক্ষার জন্য এরা করতে পারে না এমন কিছু নেই।
বাদার মানুষখেকো
মানুষখেকো হিসেবে সুন্দরবনের বাঘের বদনাম আছে। সেই মোঘল আমলে ফরাসী চিকিৎসক বার্নিয়ের (সম্রাট আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক) পর্যন্ত সুন্দরবনের বাঘের হিংস্র স্বভাব এবং নৌকা থেকে মানুষ তুলে নেওয়ার কাহিনী বর্ণনা করেছেন।
জার্মান বিজ্ঞানী হিউবার্ট হেনরিশ মনে করেন, সুন্দরবনের লোনা পানি বাঘের যকৃত নষ্ট করে দেয়। এর ফলে ক্ষিপ্ত বাঘ মানুষখেকো হয়ে পড়ে। অবশ্য এ মতবাদ অনেকেই মানেন না, কারণ অপেক্ষাকৃত মিঠা পানি বিশিষ্ট অঞ্চলেও বাঘ মানুষখেকো হয়। বিখ্যাত শিকারী জিম করবেট বাঘের মানুষখেকো হওয়ার কারণ হিসেবে বুড়ো, অসুস্থ বা আহত হওয়ার ফলে শিকার ধরতে অক্ষম হওয়াকে দায়ী করেছেন। মা যদি মানুষখেকো হয়, তাহলে অনেক সময় বাচ্চা বাঘও মানুষখেকো হয়ে বেড়ে উঠতে পারে।
সুন্দরবনে প্রতি বছর মধু, কাঠ আর মাছের জন্য অনেক মানুষ প্রবেশ করে। বাঘ জঙ্গলের প্রাণী, সে লুকিয়ে থেকে মানুষকে দেখলেও বেশিরভাগ সময়েই মানুষ বুঝতে পারে না। বাঘের কৌতুহলও অত্যন্ত বেশি। সে মানুষকে পর্যবেক্ষণ করে, মানুষের শক্তি সামর্থ্যের পরিমাপ করে এবং পরিশেষে প্রাথমিক জড়তা কেটে গেলে মানুষকে নিজের খাদ্যতালিকায় যোগ করে নেয়। তবে সচরাচর বাঘ যেচে মানুষকে আক্রমণ করতে চায় না।
সুন্দরবনের দুর্গম পরিবেশ, ঘন ঝোপঝাড় বাঘকে দিয়েছে আদর্শ আড়াল। দুর্ধর্ষ সব মানুষখেকো এই জঙ্গলে জন্ম নিয়েছে। এর মধ্যে আছে মরা পশরের মানুষখেকো, চান্দেশ্বরের মানুষখেকো, করমজলের জটাওয়ালা মানুষখেকো, আর সুপতির মানুষখেকো। মানুষও তাই বলে বসে নেই। অনেক বাঘই প্রাণ হারিয়েছে সুলায়মান, মেহের গাজী, হাশেম গাজী বা পচাব্দী গাজীদের মতো বিখ্যাত শিকারীদের হাতে।
মানুষ বাঘকে ভয় পায়, সমীহ করে। সুন্দরবনের বাওয়ালিরা জঙ্গলে ঢোকার আগে মন্ত্র-তন্ত্র জানা গুণীনদের সাথে নিয়ে যায়। পূজা দেয় বনবিবি আর দক্ষিণ রায়কে। বনের ভেতরে বাঘের নাম নেওয়া মানা। লোকজ বিশ্বাস, ‘বাঘ’ কথাটি উচ্চারণ করলেই এই বিশাল প্রাণীটি ধেয়ে এসে ঘাড়ে পড়বে।
তবে যত যা-ই হোক, সমাজে যে বাঘ মানেই ভয়ংকর জাতীয় ধারণা প্রচলিত আছে, তা অমূলক। এ বিষয়ে জিম করবেটের ভাষ্য হলো, বাঘ জঙ্গলের রাজা। মানুষ এই রাজ্যে অনুপ্রবেশ করে, কাঠ কাটে, শিকার করে, পোষা গরু ছাগল চরায়। বাঘ এগুলি ভালোভাবে নেবে না তা বলাই বাহুল্য। এছাড়া যথেচ্ছ শিকারের ফলে বনের প্রাণীদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। খাবারের অভাবে বাঘ অনেক সময় গরু-ছাগল তুলে নেয়, বনের ধারের গ্রামে হামলা চালায়। এ সময়ে মানুষ আর বাঘের সংঘর্ষ ঘটে। আহত অবস্থায় পালাতে পারলে অনেক সময় এসব বাঘ মানুষখেকো হয়ে পড়ে।
বর্তমান অবস্থা
সুন্দরবনের বাঘেরা ভালো নেই। সুন্দরী গাছেরা মরছে আগামরা রোগে, বনের পানি ক্রমাগত নৌযান চলাচলে হয়ে পড়ছে দূষিত, বনের ধারে গড়ে উঠছে কলকারখানা, চিংড়ি ঘের ইত্যাদি। এতে বনে মানুষের প্রবেশ বাড়ছে, পানির লবণাক্ততা বাড়ছে, বাড়ছে অবৈধ শিকার। ফলে বনের বাঘেরা হারাচ্ছে তাদের খাবার আর আবাস। সম্প্রতি বনের প্রান্তের গ্রামগুলোতে মানুষ আর বাঘের সংঘর্ষের পরিমাণ বাড়ছে, মরছে বাঘেরা।
একটা সময় ধারণা করা হতো, বাংলাদেশের সুন্দরবনে প্রায় ৪০০ এর বেশি বাঘ আছে। সে সময়ে বাঘের থাবার ছাপ থেকে সংখ্যা নির্ণয় করা হতো। তবে সম্প্রতি ক্যামেরা ট্র্যাপের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেখা গেছে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা মাত্র ১০৩ থেকে ১০৬টি! এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে জলার এই দুর্গম বনভূমির ডোরাকাটা বেড়ালগুলি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুন্দরবনের মালিকানা বাঘের। মানুষ যদি এই মালিকানাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন না করে, তবে তা দেশের প্রচলিত বন্য আইনের তো বটেই, প্রকৃতির অলিখিত আইনেরই এক চরম লঙ্ঘন হবে। সুন্দরবন এ দেশের মানুষকে বহুবার বিশাল সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের নির্মমতা থেকে রক্ষা করেছে। আজ যদি নানা কায়দায় মানুষ এই বনকে হত্যা করে ফেলে, তাহলে এর ফলাফল হবে আত্মঘাতী। বাঘ বাঁচলে বাচঁবে সুন্দরবন। বন বাঁচলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচবে মানুষ।
তথ্যসূত্র:
সুন্দরবনের ইতিহাস- এ এফ এম আব্দুল জলীল
সুন্দরবনের বাঘ- খসরু চৌধুরী
ফিচার ইমেজ: YouTube