পান্ডা নামটি শুনলে মনের অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কুংফু পান্ডা মুভির ‘পো’ এর ছবি। কুংফু পান্ডার নাদুস নুদুস মিষ্টি পান্ডাটিকে কার না ভালো লাগে! কালো-সাদার মিশেলে সুন্দর পুতুলের মতো দেখতে প্রাণীটির দিকে চোখ পড়লেই যেন আর চোখ ফেরানো যায় না। প্রাণীটি সম্পর্কে আমাদের কৌতূহলেরও শেষ নেই। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো, দিন দিন কমে আসছে পান্ডার সংখ্যা। এখনও হাতে গোনা যা পাওয়া যায় তার অধিকাংশের বাস এশিয়ার চীন দেশে। একটা সময় হয়তো চলে আসবে, যখন পান্ডাকে খুঁজে পাওয়া যাবে শুধুমাত্র ত্রিমাত্রিক ছবির দৃশ্যে।
পান্ডা যেমন দেখতে মজার, এর কর্মকাণ্ডগুলোও তেমনই মজার। পান্ডার বাহ্যিক গড়ন অনেকটা ভালুকের মতোই। তবে ভালুকের মতো দেখতে হলেও চারিত্রিক গুণাবলী কিন্তু ভালুকের সম্পূর্ণ বিপরীত। পান্ডা মূলত নিরামিষভোজি। এরা বনে অবস্থান করলেও এদের প্রধান খাবারের তালিকায় রয়েছে বাঁশ। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এদের কিন্তু মাংস হজম করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পান্ডারা শুধুমাত্র বাঁশ খেয়েই জীবনধারণ করে, যা হজম করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং এর পুষ্টিগুণও খুব কম। মূলত পান্ডার কোষের কর্মকান্ডগুলো খুব ধীরগতিতে কাজ করে এবং এর শরীরে থাইরয়েড হরমোনেরও স্বল্পতা রয়েছে। আর এ কারণেই পান্ডাদের খেতে অনেক সময় লাগে এবং এদের খেতেও হয় পরিমাণে অনেক বেশি।
পান্ডার পা, কান, ঘাড় ও চোখের চারপাশে কালো ঘন লোম থাকে, বাকি অংশে থাকে সাদা লোম। দেখতে নরম মনে হলেও পান্ডাদের গায়ের লোম কিন্তু বেশ রুক্ষ। একটি পূর্ণবয়স্ক পান্ডার গায়ের লোম ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। শরীরে ঘন লোম থাকার কারণে চীনের প্রবল শীতকেও এরা খুব সহজে অগ্রাহ্য করতে পারে। শারীরিক দিক থেকে বিশালাকৃতির হলেও পান্ডা অসম্ভব নিরীহ একটি প্রাণী। তাই চীনে একে শান্তির প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে শান্ত প্রকৃতির হলেও এদের রাগানো মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পান্ডারা রেগে গেলে অনেক সময় ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
লিঙ্গভেদে পান্ডাদের আয়তন এবং ওজনের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। একটি পুরুষ পান্ডার ওজন ২৫০ পাউন্ডের মতো হতে পারে যা একটি স্ত্রী পান্ডার চাইতে অন্তত ২০-৩০ পাউন্ড বেশি। ৪-৬ বছরের মধ্যে একটি পান্ডা বাচ্চা প্রসব করার জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে সাধারণত পান্ডাদের বাচ্চা প্রসব হয়ে থাকে। একটি পান্ডা একত্রে ১-২টি বাচ্চা জন্ম দিতে পারে। বাচ্চা জন্মগ্রহণের সময় বাচ্চার ওজন সাধারণত ৯০-১৩০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
একটি নবজাতক পান্ডা অনেকটাই অসহায় হয়ে জন্মগ্রহণ করে। কেননা জন্মের পর পান্ডারা চোখে দেখতে পারে না বা মুখে দাঁতও থাকে না। এদের গায়ের রঙও হয় হালকা গোলাপী রঙের। জন্মের পর এরা শুধু বুকের দুধ খেয়েই বড় হতে থাকে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পান্ডার শরীরের রঙ ধূসর বর্ণে রূপ নেয়। শিশু জন্মানোর পর মা পান্ডা প্রথম ১০ দিন শিশুকে ফেলে কোথাও যায় না। এমনকি পানি পান করতেও নিজের বাচ্চাকে ছেড়ে যেতে রাজি নয় তারা। জন্মের মাসখানেকের মধ্যে শিশু পান্ডার শরীরের রঙ পরিবর্তিত হয়ে একটি বড় পান্ডার রঙ ধারণ করে। ২-৩ মাসের মধ্যে শিশু পান্ডা হামাগুড়ি দিতে শেখে আর ছয় মাসের মধ্যেই বাঁশ খাওয়া শুরু করে। এক বছরের মধ্যেই পান্ডার ওজন ৪৫ কেজির মতো হয়ে থাকে।
তবে বন-জঙ্গলে শিশু পান্ডারা মোটেও সুরক্ষিত নয়। বাচ্চা একটু বড় হলেই মা পান্ডা খাবারের সন্ধানে বের হয়। তখন বিভিন্ন হিংস্র পশুপাখির সহজ শিকারে পরিণত হয় শিশু পান্ডারা। তবে যখন আয়তনে বড় হয়ে ওঠে, তখন অন্য প্রাণীরা এদের সমীহ করেই চলে। বনে একটি পান্ডা ২০-২৫ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। তবে বিশেষ যত্ন ও চিকিৎসার সাহায্যে এদের ৩০-৩৫ বছর পর্যন্ত বাঁচানো যায়। তাই অনেক সময় চিড়িয়াখানার পান্ডাদের সাধারণ বনের পান্ডার চাইতে বেশি বাঁচতে দেখা যায়।
আগেই বলা হয়েছে, মাংস খাওয়ার যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও পান্ডাদের পছন্দের খাবার বাঁশ। এদের খাবারের প্রায় ৯৯ শতাংশই বাঁশ। ২৫-৩০ পাউন্ড বাঁশ একটি পান্ডা অনায়াসে খেয়ে ফেলতে পারে। এদের মানুষের মতো পরিপাটি দাঁত রয়েছে যার সাহায্যে খুব সহজেই পান্ডারা বাঁশ চিবিয়ে খেতে পারে। দিনের প্রায় অধিকাংশ সময় পান্ডা শুধুমাত্র খাওয়ার কাজে ব্যয় করে থাকে। তাদের বাঁশ খাওয়ার কৌশলও খুব মজার। দাঁতের সাহায্যে বাঁশের উপরের শক্ত আবরণ ছাড়িয়ে পান্ডা শুধুমাত্র ভেতরের নরম অংশই খেয়ে থাকে। ততবে এরা অনেক সময় বাঁশ ছাড়াও ঘাস, লতাপাতা ও বিভিন্ন রকম ফলমূলও খেয়ে থাকে।
পান্ডার অনেকগুলো গুণের মধ্যে অন্যতম হলো এর প্রখর ঘ্রাণশক্তি। গায়ের গন্ধ শুঁকেই একটি পান্ডা অন্য আরেকটি পান্ডাকে চিনে ফেলে। দিনে বা রাতে যেকোনো সময় পান্ডা ঘ্রাণের মাধ্যমেই বাঁশের খোঁজ পেয়ে যায় খুব সহজে। এছাড়াও এদের নিজস্ব অনেকগুলো ডাকও রয়েছে। পান্ডা মানুষের মতো দুই পায়ে দাঁড়াতে পারলেও সেটা খুব বেশিক্ষণ নয়, কেননা এদের পেছনের পায়ে খুব বেশি জোর থাকে না। তবে মজার ব্যাপার হলো, এরা সাঁতার কাটতে এবং গাছে চড়তে বেশ পারদর্শী। খুব সহজেই পান্ডারা এক গাছ হতে অন্য গাছে ঝুলে ঝুলে সঙ্গীদের সাথে খেলা করে।
পান্ডারা মূলত স্তন্যপায়ী প্রাণী। চীনের মধ্যাঞ্চলের কিছু পাহাড়ি বনে এদের অধিক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। একটা সময় চীনের বিভিন্ন স্থানে পান্ডা চোখে পড়লেও বর্তমানে সিচুয়ান, সাংশি আর গানসু প্রদেশেই এদের বেশি দেখা যায়। বিশ্বায়নের যুগে চীনও কৃষি ও শিল্প-কারখানা স্থাপনের দিকে অনেক বেশি মনোযোগ দেয়ার কারণে বন-জঙ্গলের পরিমাণ কমে আসছে ব্যাপক পরিমাণে। ফলে উপযুক্ত বাসস্থানের অভাবে ধীরে ধীরে পান্ডার সংখ্যা কমে আসছে। পর্যাপ্ত বাঁশের অভাবেও এদের খাওয়ার সংকট দেখা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ধারণা করা হয়, পান্ডারা প্রায় ২০-৩০ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে রয়েছে। তবে দিন দিন তাদের বেঁচে থাকা সংকটাপন্ন হয়ে যাচ্ছে। গবেষকদের মতে, ধীরে ধীরে কমে আসছে পান্ডার সংখ্যা। ২০০৮ সালে এক জরিপে দেখা যায় যে, বিশ্বব্যাপী মাত্র ৩ হাজারের মতো পান্ডা জীবিত রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে একসময় পান্ডার দেখা পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। তাদের জন্যে অভয়ারণ্য তৈরি করতে চীন সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
পান্ডার নাদুস নুদুস চেহারা আর আলসে চালচলন দেখে খুব ভালোবেসে যদি একধরনের বাসনা পোষণ করেন যে, আপনারও যদি একটি পান্ডা থাকতো, তাহলে ভাবনাটি খুব একটা অযৌক্তিক বলা যাবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, অনেক বড় বড় চিড়িয়াখানা পর্যন্ত পান্ডা পুষতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেয়ে ওঠে। কেননা একটি পূর্ণবয়স্ক পান্ডার নিত্যদিনের খাবার যোগান দেয়া মোটেও সহজ কথা নয়!
ফিচার ইমেজ- wallpaperstudio10.com