প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এখনো পর্যন্ত হারিয়ে গেছে অসংখ্য প্রাণী। তেমনি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া অতিকায় এক প্রাণী ম্যামথ। ম্যামুথুস গণের সব প্রজাতিকেই ম্যামথ ডাকা হয়। তবে ম্যামথদের সবশেষ টিকে থাকা প্রজাতি ছিল লোমশ ম্যামথ। বর্তমান হাতিদের পূর্বপুরুষ ধরা হয় এই ম্যামথ প্রজাতিকে। আকারে তারা অবশ্য ছিল এই হাতিদের চেয়ে একটু বড়। এদের ছিল বিশাল দাঁত, লোমে ভরা দেহ আর বড় শুঁড়। অ্যানিমেটেড সিনেমা ‘আইস এজ’ যারা দেখেছেন, তারা হয়তো ইতোমধ্যে চিনে ফেলেছেন সিনেমায় ‘ম্যানি’ নামের বিশাল দাঁতের অধিকারী লোমশ এই প্রাণীকে।
বরফ যুগের এই প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে চার হাজার বছর আগে। মনে করা হয়, এরা আরো পঞ্চাশ লক্ষ বছর আগে থেকেই ছিল পৃথিবীতে। আদিম মানুষদের আঁকা গুহাচিত্রেও দেখা গেছে এই ম্যামথদের। কিন্তু কেন সদলবলে হারিয়ে গেল এরা? অত্যধিক শিকার? জলবায়ুর পরিবর্তন? নাকি, অন্যকিছু?
সর্বশেষ আবাসস্থল
গবেষকদের ধারণা, উত্তর আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে ম্যামথের বিলুপ্তি ঘটে প্রায় ১০ থেকে ১৪ হাজার বছর আগে। তবে তারপরও অন্তত পাঁচ হাজার বছরের বেশি সময় এরা টিকে ছিল আলাস্কার সেন্ট পল দ্বীপে। এখানে থাকা ম্যামথের দলটি পানির অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় বলে ধারণা গবেষকদের। এখনকার হাতিদের যেমন প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়, ম্যামথদেরও তেমনি দৈনিক কমপক্ষে প্রায় ৭০-২০০ লিটার পানির প্রয়োজন হতো। কিন্তু তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে সুপেয় জলাধারগুলো নোনা পানিতে পরিণত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সুপেয় পানির অভাবে ধীরে ধীরে তারা এগিয়ে যায় বিলুপ্তির দিকে।
তবে গবেষকদের দাবি, ম্যামথের সর্বশেষ দলটি বেঁচে ছিল রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব প্রান্তসীমার দ্বীপ র্যাঙ্গেলে। বর্তমানে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং প্রায় ৭,৬০০ কিলোমিটার আয়তন এই দ্বীপের। ধারণা করা হয়, দ্বীপটি একসময় তুষারসেতুর মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল পৃথিবীর মূল ভূখণ্ডের সাথে। কিন্তু, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সেই পৃথিবীর মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত করে রাখা বরফসেতুটি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেলে এখানেই আটকা পড়ে ম্যামথের সর্বশেষ দলটি।
তারপর নানাবিধ কারণে এখানেও টিকতে না পেরে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়, সেটিও ঘটে মানুষ প্রথম এই দ্বীপে পদার্পণ করার এক শতাব্দী আগে।
ম্যামথের খোঁজে
যদিও ম্যামথদের আদি নিবাস ছিল আফ্রিকা, তবে এরা পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে সাইবেরিয়ার ইয়ামাল পেনিনসুলা থেকে উদ্ধার করা হয় ৪০,০০০ বছর পুরনো প্রায় অক্ষত একটি ম্যামথ শিশুর মৃতদেহ। কঠিন বরফে জমে থাকায় একেবারেই অক্ষত ছিল উদ্ধারকৃত মৃতদেহটি। মাঝেমধ্যেই আলাস্কা কিংবা সাইবেরিয়ায় দেখা যায় ম্যামথদের এমন দেহাবশেষ।
ধারণা করা হয়, বিলুপ্ত এই প্রজাতির অন্তত কোটি মৃতদেহ ঢাকা পড়ে আছে সাইবেরিয়ার বিশাল বরফ ঢাকা অঞ্চলে। এখনও আলাস্কা ও সাইবেরিয়ায় বিপুল পরিমাণে পাওয়া যায় ম্যামথের দাঁত কিংবা হাড়-কঙ্কাল। এসব অঞ্চলের অধিবাসীরা ম্যামথের দাঁত দিয়ে নানা অলঙ্কার বানায়। এসব অঞ্চলের মাটির নিচ থেকে বছরে প্রায় অর্ধশত টনের কাছাকাছি ম্যামথের দাঁত উদ্ধার করা হয় বলে জানা যায়। এ থেকে ধারণা করা যায়, এ অঞ্চলে বিশাল সংখ্যক বসবাস ছিল এ প্রাণীর।
কীভাবে বিলুপ্ত হলো ম্যামথ?
তবে ঠিক কী কারণে ম্যামথ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল, তা নিয়ে রয়েছে প্রচুর বিতর্ক। কেউ কেউ মনে করেন, মানুষের অত্যধিক শিকারের কারণেই হারিয়ে গেছে তারা। একেকটি ম্যামথ শিকারের মাধ্যমে প্রচুর মাংস পাওয়া যেত। মানুষ তখন মাংসের পাশাপাশি ম্যামথদের হাড় অস্ত্র তৈরিতে এবং দাঁত বিভিন্ন অলঙ্কার তৈরির কাজে ব্যবহার করত। তবে তাদের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে শিকার একটি কারণ হলেও তা কখনোই একমাত্র বা প্রধান কারণ ছিল না। কেননা, বহু জায়গায় মানুষের পদচারণা পড়ার আগেই ম্যামথ বিলুপ্ত হয়েছিল।
গবেষকদের একটি দল মনে করেন, বরফযুগের শেষে বিশাল তৃণভূমি ক্রমশ বনে ঢেকে যেতে থাকলে এরা খাদ্যাভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এমন বিচ্ছিন্নতা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, পৃথিবীর তাপমাত্রা তখন ক্রমশ বাড়ছিল। সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে ও বিশাল বিশাল তৃণভূমি বনে পরিণত হয়ে যাওয়ায় তাদের খাবারের অভাব ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছিল। ম্যামথরা যেহেতু ছিল বরফযুগের প্রাণী, তাই সে সময়ের হিমশীতল পরিবেশে গায়ে লোম ও চর্বির আধিক্য থাকায় তারা খুব সহজেই মানিয়ে নিয়েছিল নিজেদের। কিন্তু বরফযুগের অবসান হওয়ায় ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে তাদের অবসানও নিশ্চিত হয়ে যায়। তারা পরিবর্তিত তাপমাত্রায় টিকে থাকতে পারেনি। পর্যাপ্ত খাবার কিংবা সুপেয় পানির অভাব, সেই সাথে ক্রমাগত শিকার হয়তো তাদের বিলুপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
এই বিশালাকার প্রাণীর বিলুপ্তির পেছনে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে আরো কিছু সম্ভাবনার কথা বলা যেতে পারে। যেমন, হঠাৎই নতুন কোনো রোগজীবাণুর আক্রমণ, মহামারি বা বড় কোনো দুর্যোগে তারা প্রাণ হারিয়েছে। এমনও হতে পারে, ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা অনেক কমে যাওয়ায় জিনবৈচিত্র্য হ্রাস পেয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে তারা। কিন্তু, এসবই শুধু অনুমান। বাস্তবে কোনোটারই পক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ নেই।
কাজেই আসলেই ঠিক কী কারণে হারিয়ে গেছে ম্যামথরা, তা মোটামুটি অন্ধকারাচ্ছন্নই রয়ে গেছে এখনও।
ম্যামথরা কি ফিরে আসছে?
সাম্প্রতিকালে কিছু বিজ্ঞানী উঠেপড়ে লেগেছেন ম্যামথকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টায়! এ প্রকল্প আশার আলো দেখছে, কারণ তাদের নিকটবর্তী প্রজাতি এশীয় হাতি এখনও পৃথিবীতে বর্তমান আছে। প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, খুব শীঘ্রই এ প্রকল্প সফলতার মুখ দেখতে পারে। সাইবেরিয়া অঞ্চলের বরফের মধ্য থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে ম্যামথের ফ্রোজেন’ ডিএনএ-র নমুনা। সেখান থেকেই নানা প্রক্রিয়ায় এই অতিকায় প্রাণীর ক্লোন করার চেষ্টা চলছে। যদিও সম্ভাবনা খুবই কম, তবুও কে জানে, হয়তো আগামীতে দেখা মিলতেও পারে কয়েক হাজার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এই প্রাণীর!
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ একমত নন এই ফিরিয়ে আনার চেষ্টার বিষয়ে। যদি জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে ম্যামথদের ক্লোন করা সম্ভব হয়ও, তবু নতুনভাবে সৃষ্টি করা ম্যামথ যারা টিকে থাকতে পারেনি পৃথিবীর পরিবর্তিত পরিবেশে, তারা এখনও কি টিকতে পারবে? কেননা, তাদের বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ, খাদ্য কিংবা কোনোকিছুই তো আর আগের মতো নেই!